একাত্তরে গণহত্যায় আনুষ্ঠানিক ক্ষমা প্রার্থনাসহ ঐতিহাসিক সমস্যার সমাধানে ভবিষ্যতে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার ‘সদিচ্ছা’ পাকিস্তান ব্যক্ত করেছে, বলেন পররাষ্ট্র সচিব জসীম উদ্দিন।
Published : 17 Apr 2025, 08:39 PM
দুদেশের সম্পর্ক মজবুত করতে পাকিস্তানকে অমীমাংসিত ঐতিহাসিক সমস্যাগুলোর সমাধান করতে বলেছে বাংলাদেশ। এক্ষেত্রে একাত্তরে গণহত্যার জন্য আনুষ্ঠানিক ক্ষমা প্রার্থনা এবং প্রায় সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার পাওনা চেয়েছে সরকার।
বৃহস্পতিবার ঢাকায় পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব আমনা বালুচের সঙ্গে বৈঠকে এমন আলোচনা হওয়ার কথা বলেছেন পররাষ্ট্র সচিব জসীম উদ্দিন।
বৈঠকের পর বিকালে এক ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, “আমি পাকিস্তানের সাথে বিদ্যমান ঐতিহাসিকভাবে অমীমাংসিত বিষয়গুলো উত্থাপন করেছি। যেমন- আটকেপড়া পাকিস্তানিদের প্রত্যাবাসন, অবিভাজিত সম্পদে বাংলাদেশের ন্যায্য হিস্যা প্রদান, ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য প্রেরিত বিদেশি সাহায্যের অর্থ হস্তান্তর এবং ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের তৎকালীন সশস্ত্রবাহিনী কর্তৃক সংঘটিত গণহত্যার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাওয়া।
“আমরা বলেছি, দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী দেশ হিসেবে আমরা পাকিস্তানের সাথে বিদ্যমান ঐতিহাসিকভাবে অমীমাংসিত বিষয়সমূহের দ্রুততম সময়ের মধ্যে নিষ্পত্তির মাধ্যমে একটি মজবুত, কল্যাণমুখী ও ভবিষ্যৎমুখী সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য পাকিস্তানের সহযোগিতা কামনা করি এবং এই লক্ষ্যে আমরা একযোগে কাজ করার বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছি।”
এক্ষেত্রে পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া কী ছিল, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এসব বিষয়ে ভবিষ্যতে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার ‘সদিচ্ছা তারা ব্যক্ত করেছেন’।
পররাষ্ট্র সচিব বলেন, “তারা যেটা বলেছেন যে, বিষয়টা নিয়ে তারা এনগেইজড থাকবেন, এই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনায় থাকবেন তারা, সামনের বৈঠকগুলোতে।”
দীর্ঘদিন পর এই বৈঠক হওয়ার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “একটা জিনিস আপনাদেরকে মনে রাখতে হবে, পাকিস্তানের সাথে আজকে যে বৈঠকটা অনুষ্ঠিত হয়েছে, সেটি নিয়মিত বৈঠকই হওয়ার কথা। কিন্তু এই বৈঠক সর্বশেষ অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০১০ সালে।
“কাজেই ২০১০ সালের দেড় দশক পরে প্রথম যে বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়েছে, সেই বৈঠকে আমরা আশা করি না যে, সমস্যাটা সমাধান হয়ে যাবে। কিন্তু তাদের দিক থেকে এ বিষয় নিয়ে ভবিষ্যতে আলোচনা করার একটা সদিচ্ছা তারা ব্যক্ত করেছেন।”
পাওনা অর্থের পরিমাণের বিষয়ে এক প্রশ্নে জসীম উদ্দিন বলেন, “আমাদের কাছে যে হিসাবটা আছে, সেখানে দেখানো আছে যে, বাংলাদেশের পরিকল্পনা কমিশনের সাবেক ডেপুটি চেয়ারম্যানের একটা হিসাব অনুযায়ী, (এটা) ৪ বিলিয়ন ডলার। আরেকটা হিসাবে বলা আছে, ৪ দশমিক ৩২ বিলিয়ন। আমরা আজকের আলোচনায় এই ফিগারটাই বলেছি। এটা একটা।
“আরেকটা হচ্ছে, ১৯৭০ সালের নভেম্বরে যে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় হয়, সেখানে বিভিন্ন বিদেশি রাষ্ট্র এবং সংস্থা ২০০ মিলিয়ন ইউএস ডলার সমপরিমাণ অর্থ দান করেছিল, সেটাও আমরা এই বৈঠকে হিস্যা চেয়েছি।”
দীর্ঘ ১৫ বছর বিরতির পর পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের ফরেন অফিস কনসালটেশনে (এফওসি) যোগ দিয়ে বুধবার ঢাকা সফরে এসেছেন পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব আমনা বালুচ।
বৃহস্পতিবার সকালে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন পররাষ্ট্র সচিব জসীম উদ্দিন এবং আমনা বালুচ ছিলেন পাকিস্তান দলের নেতৃত্বে।
ওই বৈঠকের পর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এসে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব। এরপর প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন তিনি।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক শেষে ফেরার পথে সাংবাদিকরা কথা বলার চেষ্টা করলেও এড়িয়ে যান আমনা বালুচ। পরে বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে ব্রিফিংয়ে আলোচনার নানা দিক তুলে ধরেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব জসীম উদ্দিন।
৫৩ বছর আগের ক্ষতিপূরণের হিসাবে মূল্যস্ফীতির হার যুক্ত করা হয়েছে কি না এবং না করলে কেন- এমন প্রশ্নে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, “যে প্রশ্নটা করলেন, মূল্যস্ফীতি হার যুক্ত করা এবং কেন করছি না, এটা হচ্ছে আরও বিস্তারিত আলোচনার বিষয়। আজকে আমরা যে জিনিসটা তাদের কাছ থেকে শুনতে চেয়েছি, সেটি হচ্ছে যে, আমরা এ বিষয়ে আলোচনায় সম্পৃক্ত থাকব।
“এ বিষয়ে গত দেড় দশক ধরে কোনো আলোচনা হয় নাই। কাজেই আমাদের লক্ষ্যই ছিল বিষয়টা ফ্ল্যাগ করা, তাদের নজরে আনা। এবং আমাদের প্রত্যাশা, সামনে যে সমস্ত এনগেইজমেন্ট হবে, যে সমস্ত বৈঠক হবে, সেগুলোতে এ বিষয়টা সুনির্দিষ্টভাবে আলোচনা করার আমরা একটা সুযোগ পাব।”
অমীমাংসিত সমস্যার সমাধান বাকি রেখে সম্পর্ক কীভাবে এগোবে, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, “আমরা দুটো পয়েন্ট মাথায় রেখে, এই বিষয় উত্থাপন করেছি। একটা হচ্ছে যে, দেড় দশক পরে আমরা এ পর্যায়ে বসলাম, কাজেই এই প্রসঙ্গটা তোলা উচিত এবং তুলেছি এটা ন্যায্যতা ও ঔচিত্যের দিক থেকে।
“দুই নম্বর হচ্ছে, এটা আমরা পাকিস্তানি প্রতিনিধিদলকে বলেছি যে, বাংলাদেশের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্ক এখন যে জায়গায় দাঁড়িয়েছে, সাম্প্রতিককালে উচ্চ পর্যায়ে যোগাযোগ এবং বিভিন্নক্ষেত্রে আমাদের সহযোগিতার কারণে, সেটাকে একটা শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড় করাতে গেলে, আমাদেরকে এই অমীমাংসিত বিষয়গুলোর মীমাংসা আশু প্রয়োজন।”
পররাষ্ট্র সচিব বলেন, “আমরা একটা শব্দ ব্যবহার করেছিলাম, ‘অন এ সলিড ফাউন্ডেশন’। আমরা বলেছি, একটা মজবুত ভিত্তির উপর দাঁড় করানোর জন্য এই বিষয়গুলোর মীমাংসা হওয়া উচিত।
“এবং আমরা মনে করি, পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের এখন যে সম্পর্ক, এই সময়টাতে এই বিষয়গুলো সমাধান করার জন্য একটা উপযুক্ত সময়।”
অমীমাংসিত সমস্যা সমাধানের বিষয়ে পাকিস্তানের প্রতিউত্তরের বিষয়ে আরেক প্রশ্নে জসীম উদ্দিন বলেন, “আমরা আমাদের অবস্থানটা তুলে ধরেছি। কূটনীতির কাজটাই হচ্ছে, আমাদের অবস্থানটাকে তুলে ধরে সেটা নিয়ে এগিয়ে যাওয়া। এখানে বিষয়টা এই রকম না যে, আমি তোলার পরে তারা সেটাকে আলোচনার মধ্যে রাখতে চান নাই।
“তারা বলেছে যে, তারা এ নিয়ে ভবিষ্যতে আলোচনা অব্যাহত রাখতে চান। কাজেই এই আলোচনার প্রেক্ষিতে ভবিষ্যত আলোচনার জন্য প্রস্তুতি নেব। এই হচ্ছে আমার অবস্থান।”
বাংলাদেশ কি পাকিস্তানের দিকে ঝুঁকছে?
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ভারতের দিকে ‘ঝুঁকে’ থাকার পর এবার সরকার পাকিস্তানের দিকে ‘ঝুঁকছে’ কি না, এমন প্রশ্ন করা হয় পররাষ্ট্র সচিব জসীমকে।
উত্তরে তিনি বলেন, ‘স্থবির’ সম্পর্ককে ‘স্বাভাবিক’ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। সেজন্য দুদেশের মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক আলোচনার প্ল্যাটফর্মগুলোকে সচল করা হচ্ছে।
এক্ষেত্রে ‘জাতীয় স্বার্থকে’ মাথায় রাখার কথা বলছেন তিনি।
এ প্রশ্নে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, “পাকিস্তানের সাথে আমাদের যে সমস্ত প্রাতিষ্ঠানিক ম্যাকানিজম আছে, তার মধ্যে পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠক একটি যার সর্বশেষটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০১০ সালে। আরেকটি প্রাতিষ্ঠানিক ম্যাকানিজম হচ্ছে, জয়েন্ট ইকোনমিক কমিশন, সেটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০০৪ সালে। অর্থাৎ ২১ বছর আগে। অর্থাৎ দুই দশকেরও বেশি সময় আগে।
“আমরা এখন স্থবির যে সম্পর্ক, সেই সম্পর্কটাকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছি এবং সেটা আমরা সম্পূর্ণরূপে আমাদের যে জাতীয় স্বার্থ, সেই জাতীয় স্বার্থের কথা মাথায় রেখেই আমরা করছি।”
তিনি বলেন, “এক্ষেত্রে ঝোঁকার প্রশ্ন যদি বলেন, আমি একটা-দুটা উদাহরণ দিতে পারি। যেটা আমাদের জন্য লাভজনক। যেমন, যোগাযোগ। আমরা উড়োজাহাজ যোগাযোগ চালু করছি। এক দেশ থেকে আরেক দেশে মানুষ গেলে, আমরা মনে হয় না সেটাকে ঝোঁকা বলা হয়। কিংবা ব্যবসা-বাণিজ্য যদি বৃদ্ধি পায়, সেটাকেও ঝোঁকা বলা হয় না।
জসীম বলেন, “আমি মনে করি যে, আমরা পাকিস্তানের সাথে যেভাবে আলোচনায় সম্পৃক্ত হচ্ছি, সেটার ফাউন্ডেশন হচ্ছে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা এবং পারস্পরিক লাভ। আমরা আমাদের যে লাভ, সেটা আমরা দেখছি। কাজেই এটা কোনোভাবেই একটা বিশেষ দেশের দিকে ঝোঁকার বিষয় নয়।”
পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিবের সফরের সুদূরপ্রসারী প্রভাবের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “আমি মনে করি, এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব হচ্ছে, দুদেশের মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগকে রক্ষা করা। যে বৈঠকটি প্রতি বছর হওয়ার কথা, সেই বৈঠকটি যাতে দেড় দশক পরে না হয়। সেটা যাতে পরবর্তী বছর অনুষ্ঠিত হয়।
“এবং এটা যদি নিয়মিত যোগাযোগটা থাকে, তাহলে আমরা এই সম্পর্ক থেকে পরস্পরে লাভবান হতে পারব। কাজেই আমাদের এই মুহূর্তে লক্ষ্য হচ্ছে যে, এই যোগাযোগগুলোকে নিয়মিত করা এবং এই যোগাযোগের মাধ্যমে পারস্পরিকভাবে লাভজনক সে সমস্ত ক্ষেত্র, জনগণ পর্যায়ে যোগাযোগ, বাণিজ্য, বিনিয়োগ, সমুদ্রপথে যোগাযোগ বা বিমানপথে যোগাযোগ- এই জিনিসগুলোকে এগিয়ে নেওয়া।”
উচ্চ আদালতের রায়ে পাকিস্তানি নাগরিকদের সন্তানদেরকে জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব দিয়ে আসছে বাংলাদেশ। সে প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে আটকেপড়া পাকিস্তানির সংখ্যা কত- এমন প্রশ্ন করা হয় পররাষ্ট্র সচিবরকে।
উত্তরে তিনি বলেন, “আটকেপড়া যে সমস্ত পাকিস্তানি নাগরিক ছিল, তাদেরকে যখন অপশন দেওয়া হয়, কেউ কেউ বাংলাদেশ থেকে যেতে চেয়েছিলেন, তাদেরকে সেই নাগরিকত্ব দেওয়া হয়েছে। আর কেউ কেউ পাকিস্তানে ফেরত যেতে চেয়েছেন।
“এবং দেড় দশকের আগে, আমরা বিভিন্ন সময় এ বিষয় নিয়ে কথাবার্তা বলেছি, এবং সেখানে দেখা যায়, এ পর্যন্ত ১ লাখ ২৬ হাজার ৯৪১ জন আটকেপড়া পাকিস্তানি নাগরিক সেখানে ফিরে গেছেন। এখন তিন লাখ ২৪ হাজার ১৪৭ জন আছেন, যারা ১৪টা জেলাতে ৭৯টা ক্যাম্পে বসবাস করছেন।”
পাক পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফর, সরাসরি ফ্লাইট প্রসঙ্গে
পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠকে পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহান দারের আসন্ন ঢাকা সফরের তারিখ চূড়ান্ত করার কথা জানান পররাষ্ট্র সচিব জসীম উদ্দিন।
এ বিষয়ক প্রশ্নে তিনি বলেন, পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফর হবে ২৭-২৮ এপ্রিল।
ওই বৈঠককে সামনে রেখে প্রস্তাবিত নতুন এবং পুরাতন বিভিন্ন সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) পর্যালোচনার জন্য বৃহস্পতিবার একটি যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনের কথাও বলেন তিনি।
“যাতে করে আমাদের যে সমস্ত লাইন মিনিস্ট্রি আছে, তাদের সাথে বসে এমওইউগুলো পর্যালোচনা এবং চূড়ান্ত করতে পারি।”
বাণিজ্য ঘাটতি মেটানো, ব্যবসায় প্রসার এবং যোগাযোগ বাড়ানোর বিষয়ে বৈঠকে আলোচনা হওয়ার কথা বলেন তিনি।
পাকিস্তানি উড়োজাহাজ সংস্থা ‘ফ্লাই জিন্নাহকে’ সরাসরি ফ্লাইট পরিচালনার অনুমতি এরইমধ্যে দেওয়ার তথ্য জানিয়ে তিনি বলেন, আরেকটি সংস্থা ‘ফ্লাই সিয়াল’ এর করা আবেদন অনুমোদনের প্রক্রিয়ায় আছে।