নোয়াখালীতে হাজারের বেশি ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ বা আংশিক বিধ্বস্ত; পটুয়াখালী ও পিরোজপুরে আমনের ক্ষতি তুলনামূলক বেশি।
Published : 18 Nov 2023, 12:00 AM
ঘূর্ণিঝড় ‘মিধিলি’র প্রভাবে প্রবল বৃষ্টিতে দেয়াল ধসে, গাছের ডাল ভেঙে অন্তত সাতজনের মৃত্যু হয়েছে। উপকূলীয় বিভিন্ন জেলায় হাজারের বেশি কাঁচা ঘরবাড়ির ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পাশাপাশি টানা বৃষ্টির কারণে উঠতি আমন ফসলও ক্ষতির মুখে পড়েছে বলে জানিয়েছে কৃষি অধিদপ্তর।
শুক্রবার যেসব স্থানের ওপর দিয়ে ঝড় বয়ে গেছে তার মধ্যে বেশ কিছু এলাকায় বড় বড় গাছ ভেঙে ও উপড়ে পড়ে যান চলাচল ব্যাহত হয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় রেললাইনে গাছ উপড়ে ঢাকার সঙ্গে চট্টগ্রাম-নোয়াখালী-সিলেট তথা পূর্বাঞ্চলের ট্রেন চলাচল বন্ধ ছিল প্রায় দুই ঘণ্টা।
প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে উপকূলীয় অনেক জায়গা দুপুরের পর থেকে বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন ছিল। ফলে বিকালে দেশের মোট চাহিদা অন্য দিনের তুলনায় অর্ধেকে নেমে আসে।
উপকূলের চরাঞ্চলসহ নিম্নাঞ্চলে জলাবদ্ধতা তৈরি হওয়ায় মানুষকে দুর্ভোগে পড়তে হয়েছে। টানা বৃষ্টির মধ্যে সরকারি ছুটির দিনে রাস্তায় যানবাহন ও মানুষজনের আনাগোনা ছিল একেবারেই কম।
পশ্চিম-মধ্য বঙ্গোপসাগরে গত ১৪ নভেম্বর একটি লঘুচাপ সৃষ্টি হওয়ার পর সেটি উত্তর-পশ্চিম দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ধীরে ধীরে শক্তি সঞ্চয় করে সেই ঘূর্ণিবায়ুর চক্র ১৫ নভেম্বর নিম্নচাপে পরিণত হয়। তারপর বাঁক নিয়ে উত্তর-পূর্ব দিকে অগ্রসর হওয়ার পথে বৃহস্পতিবার পরিণত হয় গভীর নিম্নচাপে। পরে সেটি ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেয়।
ওই অবস্থায় মোংলা ও পায়রা বন্দরকে সাত নম্বর এবং চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার বন্দরের ছয় নম্বর বিপৎসংকেত দেখাতে বলা হয়। শুক্রবার বেলা ১টার দিকে ঘণ্টায় ৮৮ কিলোমিটার গতির বাতাসের শক্তি নিয়ে পটুয়াখালীর খেপুপাড়ার কাছ দিয়ে মোংলা-পায়রা উপকূলে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় ‘মিধিলি’।
পরের দুই ঘণ্টায় বৃষ্টি ঝরাতে ঝরাতে বেলা ৩টার দিকে তা পুরোপুরি স্থলভাগে উঠে আসলেও তেমন কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি এবারের ঘূর্ণিঝড় মিধিলি-তে।
আবহাওয়াবিদরা গত দু’দিন ধরেই বলে আসছিলেন, বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট এই ঘূর্ণিঝড়টি অপেক্ষাকৃত দুর্বল এবং খুব বেশি ক্ষয়ক্ষতির শঙ্কা নেই।
ঘূর্ণিঝড়টি বৃষ্টি ঝরিয়ে দুর্বল হওয়ার পর বিপৎসংকেত নামিয়ে তিন নম্বর হুঁশিয়ারি সংকেত দেখাতে বলে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
এর মধ্যেই বৃহস্পতিবার রাত ৩টার দিকে প্রবল বর্ষণে কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার হ্নীলা ইউনিয়নের মৌলভীবাজারের মরিচ্যাঘোনার পানিরছড়া এলাকায় বসতঘরের মাটির দেয়াল চাপায় এক পরিবারের চারজন নিহত হন।
তারা হলেন- ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের পানিরছড়ার ফকির মোহাম্মদের স্ত্রী আনোয়ারা বেগম (৫০), ছেলে শাহিদুল মোস্তফা (২০), মেয়ে নিলুফা ইয়াছমিন (১৫) ও সাদিয়া বেগম (১১)।
দমকা হাওয়ায় গাছের ঢাল ভেঙে বিকালে চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ উপজেলার মগধারা ইউনিয়নের আব্দুল ওহাব (৭২) এবং মীরসরাই উপজেলার জোরারগঞ্জ ইউনিয়নের দক্ষিণ সোনাপাহাড় এলাকার আনোয়ার হোসেনের শিশু সিদরাতুল মুনতাহা আরিয়া (৪) মারা গেছেন।
এ ছাড়া টাঙ্গাইলের বাসাইল উপজেলা পরিষদের গেইটের সামনে গাছের ডাল ভেঙে ব্যবসায়ী আব্দুর রাজ্জাক (৪০) মারা গেছেন। তিনি উপজেলার মিরিকপুর গ্রামের কুসুম মিয়ার ছেলে।
ঝড় এগিয়ে আসায় উপকূলীয় জেলায় জেলায় মাইকিং করা হচ্ছিল সকাল থেকে। আবহাওয়া অফিস বিপদ সংকেত ঘোষণা করার পর ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলো থেকে ২৫ হাজারের বেশি মানুষকে আশ্রয় কেন্দ্রে সরিয়ে নেওয়া হয়।
সাগরে থাকা মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারগুলোতে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে বলা হয়েছিল আগেই। কিন্তু বরগুনার অন্তত ২০টি ট্রলার ঝড় শুরুর আগে ঘাটে ফেরেনি। সেসব নৌযানে ছিলেন তিন শতাধিক জেলে।
নোয়াখালী: ঘূর্ণিঝড় মিধিলির প্রভাবে নোয়াখালীর বিভিন্ন স্থানে গাছপালা উপড়ে ঘরবাড়ির ক্ষতি হয়েছে; যানচলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। এ ছাড়া ঝড়ে বৈদ্যুতিক তার ছিড়ে বিচ্ছিন্ন রয়েছে সংযোগ।
নোয়াখালীর জেলা ত্রাণ ও পুনর্বসান কর্মকর্তা মো. জাহিদ হাসান খান রাতে সাংবাদিকদের বলেন, জেলার ৩৪টি ইউনিয়নে ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে ২২১টি বাড়িঘর আর অংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আরও ৯১৩টি। মোট ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ছয় হাজার ৭৬০ জন।
দ্বীপ উপজেলা হাতিয়া, সুবর্ণচর, কোম্পানীগঞ্জ, কবিরহাটের বিভিন্ন এলাকায় শতাধিক গাছ উপড়ে পড়ার খবর পাওয়া গেছে। অনেক স্থানে ঘরবাড়িও ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এ ছাড়া হেলে পড়েছে পাকা ধান।
হাতিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আব্দুল বাসেদ সবুজ বলেন, “প্রায় ২০ শতাংশ আমন ধান হেলে পড়েছে। শীতকালীন সবজিরও ক্ষতি হতে পারে। তবে ক্ষয়ক্ষতির বিস্তারিত তথ্য জানতে সময় লাগবে।”
নোয়াখালী পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির জেনারেল ম্যানেজার মো. জাকির হোসেন বলেন, “প্রচুর বাতাস হচ্ছে। কর্মীরা ঘটনাস্থলে যেতে পারছেন না। বাতাস কমলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
বরিশাল: ঘূর্ণিঝড় মিধিলির প্রভাবে দমকা বাতাসে বৈদ্যুতিক তারে গাছের ডাল পড়ে বরিশাল নগরীর অর্ধেক এলাকা বিদ্যুতবিহীন হয়ে পড়ে।
বিদ্যুৎ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ওজোপাডিকোর বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগ-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. ফারুক হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, তার অধীনে ১৬ ফিডারের মাধ্যমে ৬৫ হাজার গ্রাহককে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। শুক্রবার সন্ধ্যা সোয়া ৭টা পর্যন্ত ৪০ ভাগ বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়েছে। বাকি গ্রহকদের বিদ্যুৎ সরবরাহে কাজ চলছে।
বিভাগ-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মঞ্জুরুল ইসলাম জানান, তার ফিডারে ৬৪ হাজার গ্রাহক আছেন। এর মধ্যে সন্ধ্যা সোয়া ৭টা নাগাদ ৭০ ভাগ গ্রাহকের বিদ্যুৎ চালু করা হয়েছে।
বরিশাল আবহাওয়া অফিসের জ্যেষ্ঠ পর্যবেক্ষক বশির আহমেদ জানান, বিকাল ৩টা পর্যন্ত বরিশালে ২১৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।
এ ছাড়া নগরীর সদর রোড, ফজলুল হক এভিনিউ, কেডিসি রোড, অক্সফোর্ড মিশন রোড, কালুশাহ সড়ক, বগুড়া রোড, ফকিরবাড়ি রোড, মল্লিক রোড, বাংলাদেশ ব্যাংক গলি, শ্রীনাথ চ্যাটার্জি লেনের বাসিন্দা পানিবন্দি অবস্থায় আছে।
পটুয়াখালী: ঘূর্ণিঝড় মিধিলির প্রভাবে পটুয়াখালীতে আমন ধানে ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। ঝড়ে বিভিন্ন এলাকায় গাছপালা পড়ে যাওয়ার পাশাপাশি বেশকিছু কাঁচা ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা সুমন দেবনাথ বলেন, ঝড়ে জেলায় মোট ১৩৩টি ঘরবাড়ির ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দশমিনা উপজেলায় ৭৫টি, রাঙ্গাবালী ২৬টি, মির্জাগঞ্জে ১৯টি, দুমকিতে ৯টি, কলাপাড়ায় দুটি, বাউফল ও সদর উপজেলা একটি করে ঘর রয়েছে।
পটুয়াখালী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর খামার বাড়ির উপ-পরিচালক মো. নজরুল ইসলাম বলেন, বৃষ্টি আর দমকা হাওয়ায় ধানসহ কৃষির বেশ ক্ষতি হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতির তালিকা প্রস্তুত করা হচ্ছে।
এবার পটুয়াখালীতে এক লাখ ৯১ হাজার ১১৯ হেক্টর জমিতে আমন ধান চাষ হয়েছে; এর মধ্যে ৫ ভাগ পাকা ও ২০ ভাগ আধাপাকা অবস্থায় আছে। এ ছাড়া ৭৫ ভাগ ধানে ফুল আসছে। ঝড় হাওয়ায় ধানে চিটা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
পিরোজপুর: তীব্র হাওয়ার দাপটে ও অতি বৃষ্টির কারণে জেলার বিভিন্ন স্থানে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে আমন ধানের। প্রবল ঝড়ো বাতাসে পানিতে শুয়ে পড়েছে ধানসহ এবং সদ্য শিষ বেরোনো আমন ধানের গাছ। এতে ধানের ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা করেছেন চাষী ও কৃষকরা।
অবিরাম বৃষ্টি ও বাতাস হলে পানি জমে রবিশস্যেরও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা তাদের।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. নজরুল ইসলাম সিকদার জানান, মিধিলি ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে যে বৃষ্টি হয়েছে তাতে আমন ধানের তেমন ক্ষতি হবার কথা নয়। তবে বাতাসের কারণে যদি ধান গাছ নুয়ে যায় এবং পানি আটকে থাকে তাহলে আমন ধানের ব্যাপক ক্ষতি হতে পারে।
ঝালকাঠি: ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে শুক্রবার সকাল থেকে লাগাতর বৃষ্টিতে মানুষের চলাচল কমে যাওয়ায় শহরের রাস্তা-ঘাটগুলিও অনেকটা ফাঁকা হয়ে পড়ে। বিভিন্ন স্থানে গাছ-পালা উপড়ে পড়ে। সে জন্য সকাল থেকেই জেলা শহর বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
ঝালকাঠি বিদ্যুৎ বিভাগের লাইনম্যান খোকন হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বেশ কিছু স্থানে বিদ্যুতের লাইনে গাছের ডাল ভেঙে পড়েছে। বিভিন্ন জায়গায় তারও ছিড়ে গেছে। ডালপালা অপসারণ করে সংযোগ যত দ্রুত সম্ভব বিদ্যুৎ সরবরাহ সচল করতে কাজ চলছে।
বাগেরহাট: ঘূর্ণিঝড় মিধিলির প্রভাবে প্রবল বৃষ্টি ও ঝড়ো হাওয়ায় বাগেরহাটে পল্লী বিদ্যুতের ২৫ হাজার গ্রাহক বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়েছে। এসব গ্রাহকদের সংযোগ দিতে মাঠে কাজ করছে কর্তৃপক্ষ।
বাগেরহাট পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির মহাব্যবস্থাপক (জিএম) সুশান্ত রায় রাতে বলেন সকালে জেলার প্রায় সাড়ে তিন লাখ গ্রাহকের বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়। ঝড়ো হাওয়ায় জেলার বিভিন্ন স্থানে বিদ্যুতের তারের উপরে গাছ ও গাছের ডালপালা পড়ে তার ছিড়ে যায়। ঝড় থেমে যাওয়ার পর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি মাঠে নেমে তারের উপর পড়ে থাকা গাছ ও ডালপালা অপসারণ করে এবং ছিড়ে যাওয়া তার মেরামত কাজ শুরু করে।
শুক্রবার রাত ৯টা পর্যন্ত সোয়া তিন লাখ গ্রাহকের বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া সম্ভব হয়েছে। এখনো ২৫ হাজার গ্রাহক বিদ্যুৎহীন হয়ে আছে। শনিবার দুপুর নাগাদ এসব গ্রাহকদের বিদ্যুৎ সংযোগ পুনঃস্থাপন করা সম্ভব হবে বলে আশা করছেন এই কর্মকর্তা।
আরও পড়ুন:
টেকনাফে মাটির ঘরের দেয়াল ধসে একই পরিবারের ৪ জন নিহত
ঘূর্ণিঝড় মিধিলি: বরিশাল নগরীর অর্ধেক বিদ্যুতবিহীন
ঘূর্ণিঝড় ‘মিধিলি’ টাঙ্গাইলে কেড়ে নিল ব্যবসায়ীর প্রাণ
ঘূর্ণিঝড় ‘মিধিলি’: পটুয়াখালীতে ঘরবাড়ি ও আমনের ক্ষতি
ঘূর্ণিঝড় মিধিলি: নোয়াখালীতে গাছ উপড়ে যানচলাচল বন্ধ, বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন
মিধিলি: বিদ্যুৎহীন ঝালকাঠি, বৃষ্টিতে ফাঁকা রাস্তা-ঘাট
ঘূর্ণিঝড় ‘মিধিলি': ডাল ভেঙে পড়ে প্রাণ কাড়ল দুজনের
ঘূর্ণিঝড় ‘মিধিলি’: বৃষ্টিতে প্রায় ফাঁকা খুলনা নগর
ঘূর্ণিঝড় ‘মিধিলি’: ৭ নম্বর বিপদ সংকেত নামিয়ে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত
ঘূর্ণিঝড় ‘মিধিলি’ পরিণত স্থল নিম্নচাপে, সংকেতও কমেছে