ডেমরার এক আওয়ামী লীগ কর্মী বলেন, “নির্বাচন উৎসবমুখর করার জন্য সবাইকে প্রার্থী হতে বলেছেন। কিন্তু আমরা কাকে ভোট দেব? কাকে দিলে ভালো হয় এখনও সিদ্ধান্ত নেইনি।”
Published : 01 Jan 2024, 10:01 AM
বিএনপির বর্জনের দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী উন্মুক্ত করে দেওয়ার কৌশল যাত্রাবাড়ী, ডেমরা ও কদমতলী থানার একাংশ নিয়ে গঠিত ঢাকা-৫ আসনে ভোট জমিয়ে তুলেছে।
আওয়ামী লীগের নৌকার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে এখানে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে আছেন দলের দুই নেতা। এই তিনজনই স্থানীয় বাসিন্দা। তাদের বাড়ি নির্বাচনি এলাকার তিনটি থানায়। তারা স্থানীয়ভাবে পরিচিত; এলাকায় প্রভাব ও জনপ্রিয়তাও আছে। ফলে এখানে পরাজয়ের নির্ণায়ক হয়ে উঠতে পারে আঞ্চলিকতা।
আসনটিতে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরাও তিন জনের পক্ষে ভাগ হয়ে আছেন। আবার একজনের পক্ষে গেলে অন্যরা নাখোশ হন কি না, সেজন্য কেউ কেউ প্রকাশ্যে অবস্থানও নিচ্ছেন না।
রাজধানীর ১৫টি আসনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১৩ জন প্রার্থী আছেন ঢাকা-১৪ তে। এর পরেই ডেমরার আসনটি, যেখানে প্রচারে আছেন ১২ জন।
তবে নির্বাচনি এলাকার গুরুত্বপূর্ণ মোড় আর অলিগলি ছেয়ে আছে তিন প্রার্থীর পোস্টারে। এরা হলেন আওয়ামী লীগের নৌকার হারুনর রশীদ মুন্না এবং দলের মনোনয়ন না পেয়ে ট্রাক নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী মশিউর রহমান মোল্লা সজল এবং ঈগল নিয়ে কামরুল হাসান রিপন।
এদের মধ্যে মুন্না যাত্রাবাড়ী আওয়ামী লীগের সভাপতি, তার বাড়িও এই থানায়। তার পাশে এই থানায় আওয়ামী লীগের কমিটির সিংহভাগ আছেন।
কামরুল স্বেচ্ছাসেবক লীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি হওয়ায় তিন থানায় এই সংগঠনের নেতাকর্মীদের মাঠে নামাতে পেরেছেন। তার বাড়ি শনির আখড়া, কদমতলী এবং দনিয়ার মাঝামাঝি।
সজল ডেমরা থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। দলের এই থানা কমিটির সিংহভাগ তার পাশে। তার বাবা হাবিবুর রহমান মোল্লা এই আসনটিতে ১৯৯৬ সাল থেকে চারটি নির্বাচনে জিতেছিলেন, হারেন কেবল ২০০১ সালে।
স্থানীয়ভাবে মোল্লা পরিবারের ব্যাপক পরিচিতি এবং নিজস্ব ভোটব্যাংক রয়েছে।
ঢাকা-৪: সানজিদা, আওলাদ, বাবলার আসল পরীক্ষা এবার
নৌকা ‘ডোবানোর’ লড়াইয়ে আওয়ামী লীগের ১৮ এমপি
আসনে আসনে আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগ
সংসদে প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টির প্রার্থী নেই আসনটিতে। নতুন নিবন্ধিত তৃণমূল বিএনপি ছাড়াও বিএনএফ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, বাংলাদেশ সুপ্রীম পার্টি, সাংস্কৃতিক মুক্তিজোট, বাংলাদেশ কংগ্রেস, ইসলামী ঐক্যজোট, ইসলামিক ফ্রন্ট ও বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা আলোচনায় নেই, ভোটারদের কাছে পরিচিতও নন।
২০২০ সালের মাঝামাঝি সময়ে সংসদ সদস্য হাবিবুর রহমান মোল্লার মৃত্যুর পর অক্টোবরের উপনির্বাচনে নৌকা নিয়ে জয় পাওয়া কাজী মনিরুল ইসলাম মনু মনোনয়ন না পেয়ে এবার ভোটের লড়াইয়ে নেই। স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে মনোনয়নপত্র জমা দিলেও তিনি তা প্রত্যাহার করে নেন। কারো পক্ষে তার অবস্থান আছে, এমন আভাসও মিলছে না।
‘কাকে ফেলে কার কাছে যাব’
বিএনপি ও সমমনাদের বর্জনের এই নির্বাচনে দলের কৌশলের কারণে নৌকার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী আছে দেশের বহু আসনেই। প্রতিটিতেই আওয়ামী লীগের এক পক্ষ নৌকার পক্ষে, অপর পক্ষ স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে। তবে ঢাকার এই আসনটিতে সমীকরণটি আরও জটিল।
তিন প্রার্থীই স্থানীয়, ছোটবেলা থেকেই এলাকাবাসীর সঙ্গে উঠাবসা, ব্যাপক পরিচিত আর দলেও তাদের প্রভাব আছে। নেতাকর্মীরা কাকে ছেড়ে কার পক্ষে থাকবেন, এই সিদ্ধান্ত নিতে গিয়েই দ্বিধাদ্বন্দ্বে।
ডেমরা এলাকার বাসিন্দা ও আওয়ামী লীগের কর্মী মো. সাইফুল ইসলাম পাটওয়ারী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “তিন জনই তো শেখ হাসিনার প্রার্থী। এখন আমরা কাকে ভোট দেব?
“নির্বাচনকে উৎসবমুখর করার জন্য নেত্রী সবাইকে প্রার্থী হতে বলেছেন। কিন্তু আমরা কাকে ভোট দেব? কাকে দিলে ভালো হয় এখনও সিদ্ধান্ত নেইনি।”
৫০ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “আমরা পড়েছি মহা বিপাকে। নেতাকর্মীরা চরম দ্বিধাদ্বন্দ্বে আছেন। তারা কাকে বাদ দিয়ে কার পক্ষে নামবেন তা নিয়ে অস্বস্তিতে ভুগছেন।
“এক নেতার পক্ষে প্রচারে অংশ নিলে যদি অন্যরা মনে কষ্ট পান, এজন্য অনেকে ভোটের মাঠ থেকে দূরেও রয়েছেন।”
সকাল থেকে রাত অবধি বিরামহীন প্রচার
দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে রাজধানীর প্রবেশমুখের আসনটি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১৩টি ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত। ভোটার সংখ্যা প্রায় ৫ লাখ। এদের মধ্যে যত সম্ভব মানুষের কাছে পৌঁছতে প্রার্থী ও তার সমর্থকদের চেষ্টা চোখে পড়ছে।
এ এলাকায় রয়েছে সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল। ভোটারদের মধ্যে স্থানীয় বাসিন্দা ছাড়াও আছে শ্রমজীবী ও ব্যবসায়ীরা।
শনিবার যাত্রাবাড়ী, ডেমরা, রায়েরবাগ ও শনির আখড়া ঘুরে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে জড়িত তিন প্রার্থীর ব্যাপক প্রচার চোখে পড়েছে।
এদিন সজল মোল্লা সকালে দনিয়া এলাকায় নির্বাচনি সভা শেষে কোনাপাড়ার বাড়িতে নির্বাচনি প্রধান ক্যাম্পে যান। এরপর ডেমরার বিভিন্ন ওয়ার্ডে প্রচার প্রচার চালান। রাত নয়টার সময়ও তাকে শুন্যা টেংরা এলাকায় মতবিনিময় শেষে বাড়ি বাড়ি যেতে দেখা গেছে।
তিনি প্রচারে তার বাবার কথা টানছেন আনছেন, অনুরোধ করছেন তাকেও সমর্থন করতে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “এ আসনে মোল্লা পরিবার আস্থা ও বিশ্বাসের পরিবার। আমার বিশ্বাস জনগণ আমাকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করবে এং আমি বাবার প্রতি মানুষের আস্থা আমি ধরে রাখতে পারব।”
ভোট বর্জন ২০১৪ সালে ভুল ছিল, এবারও ভুল: খুশী কবির
পাবনা-১: টুকু-সাইয়িদের পাল্টাপাল্টি মামলায় ভোটে উত্তাপ
সুনামগঞ্জ-১: আওয়ামী লীগ নেতার ‘হিন্দু কোটার’ বক্তব্যে তোলপাড়
আওয়ামী লীগসহ সব সহযোগী সংগঠনের বেশিরভাগ নেতাকর্মী তার সঙ্গে আছেন দাবি করে তিনি বলেন, “আপনি নিজেও আজকে আমার সঙ্গে বিভিন্ন স্থানে ঘুরে দেখেছেন, আমার সঙ্গে কারা। সবাই তো আওয়ামী লীগেরই, এলাকার মুরব্বিরা আমার সঙ্গে আছে।”
দল স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়া উন্মুক্ত করে দেওয়ার পর জনগণের সিদ্ধান্তের প্রতি ‘সম্মান জানাতে’ প্রার্থী হয়েছেন দাবি করে সজল বলেন, “এই এলাকায় আমি দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতি করে আসছি। এখানকার সর্বস্তরের মানুষের সঙ্গে আমার উঠাবসা, নেতাকর্মীরা আমার সঙ্গে আছে।”
আরেক স্বতন্ত্র প্রার্থী কামরুল হাসানও এদিন সকালে দনিয়ার নিজ বাড়িতে প্রধান নির্বাচনি ক্যাম্পে নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে মুসলিমনগরের মদিনা চত্বর এলাকায় আরেকটি ক্যাম্প উদ্বোধন করেন। এরপর তিনি ডেমরার আল আমিন রোডসহ আরও বেশ কিছু এলাকায় প্রচারে যান।
আলআমিন রোড এলাকায় ভোট চাওয়ার সময় কথা হয় এই প্রার্থীর সঙ্গে। তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ছোটবেলা থেকে আমি এই এ এলাকায় বড় হয়েছি। দীর্ঘদিন ছাত্র রাজনীতিতে যুক্ত ছিলাম। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি থাকাকালেই বিভিন্ন ওয়ার্ড ও পাড়া মহল্লায় মানুষের বিপদ আপদে পাশে দাঁড়িয়েছি। আওয়ামী লীগের বড় অংশ আমার সঙ্গে আছে, আমি উনাদের পরামর্শে কাজ করে যাচ্ছি।
“এলাকাবাসী জানেন, আমি এমপি হতে পারলে তাদের জন্য, আওয়ামী লীগের জন্যই ভালো হবে। আমি আমার সবটুকু দিয়ে এই এলাকার জনগণের জন্য কাজ করব, পাশাপাশি নেত্রীর আস্থা ধরে রাখতে পারব।”
আওয়ামী লীগের প্রার্থী হারুনর রশীদ মুন্না এদিন প্রচার শুরু করেন যাত্রাবাড়ীতে নিজ বাড়ির সামনে নির্বাচনি ক্যাম্প থেকে। এরপর তিনি যান কদমতলীর অলিগলিতে। বিকালে ডেমরার কোনাপাড়ায় মতবিনিময় সভা করে রাত অবধি ভোটারের দুয়ারে দুয়ারে গিয়ে ভোট প্রার্থনা করেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “এখানে নৌকার বাইরে কারও কিছু বলার সুযোগ নেই। অনেকেই নির্বাচন করতে পারে, তবে আমি মনে করি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিকেরা আমার জন্য কাজ করছে এবং ভোটের মাধ্যমে তার প্রমাণ মিলবে।”
শরীয়তপুর-১: স্বামী লাঙ্গলের প্রার্থী, স্ত্রী নৌকায় ভোট চাচ্ছেন
টাঙ্গাইল-৪: লতিফ সিদ্দিকীর প্রত্যাবর্তন, নাকি নৌকার ধারাবাহিকতা?
নৌকার প্রার্থী বলেন, “এই এলাকায় আমি দীর্ঘ দিন ধরে রাজনীতি করে আসছি। এখানের আওয়ামী লীগ থেকে শুরু করে সর্বস্তরের মানুষের সঙ্গে আমার উঠাবসা, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা আমার সঙ্গে আছে।
“এ আসনে বঙ্গবন্ধু নির্বাচন করেছেন। এখানে নৌকার বাইরে কারও কিছু বলার সুযোগ নেই। অনেকেই নির্বাচন করতে পারে, তবে আমি মনে করি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিকেরা আমার জন্য কাজ করছে এবং ভোটের মাধ্যমে তার প্রমাণ মিলবে।”
কার পক্ষে কে
দোলাইরপাড় এলাকার বাসিন্দা সৈয়দ শাকিল আহমেদ বলেন, “মুন্না (নৌকার প্রার্থী) ছোটবেলা থেকেই রাজনীতি করে। তার দ্বারা কারো কোনো ক্ষতি হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে সে কোনো সময় নির্বাচন করেনি। তাই তাকে নৌকা প্রতীকে ভোট দিতেই হবে। আমরা যারা আওয়ামী লীগ করি, এর বাইরেও বিভিন্ন পেশার মানুষ তার পক্ষে নেমেছে।”
চট্টগ্রামে নৌকা-স্বতন্ত্রের লড়াইয়ে জমজমাট ৯টি আসন
নতুন ইতিহাসের অপেক্ষায় মুরাদের জামালপুর-৪
দনিয়া এলাকায় বেসরকারি একটি স্কুলের শিক্ষক মো. সাইফুদ্দিন ঈগল প্রতীকের পক্ষে। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আমরা যে কোনো সমস্যায় পড়লে সবার আগে ছুটে আসনে কামরুল হাসান রিপন ভাই। আমি নিজেও আওয়ামী লীগের রাজনীতি করি, এক সময় ছাত্রলীগের নেতা ছিলাম। এখানে রিপন ভাই শেখ হাসিনার পরীক্ষিত নেতা। তিনি বিরোধীদলে থাকার সময়ও নেতাকর্মীদের পাশে ছিলেন।
“আমরা বলছি, শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করতে, আওয়ামী লীগের হাতকে শক্তিশালী করতে রিপন ভাইয়ের বিকল্প নাই। তিনি এমপি হলে চাঁদাবাজ মুক্ত ঢাকা-৫ উপহার পাবেন। আমরা ভোটারদের ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি।”
৫০ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ নেতা ও যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মো. খোরশেদ আলম নির্বাচন করছেন সজল মোল্লার পক্ষে ট্রাক প্রতীকে।
তিনি বলেন, “আমরা আগে থেকেই মোল্লা পরিবারের সঙ্গে আছি।
“নৌকা না পেলেও আমরা তো নৌকার লোকই। জননেত্রী শেখ হাসিনা নির্বাচন উন্মুক্ত করে দেওয়ায় একজন নৌকা পেয়েছেন, তবে সজল মোল্লাও শেখ হাসিনার প্রার্থী। ট্রাক প্রতীকে ভোট দিলেও সেটা আওয়ামী লীগের পক্ষেই, শেখ হাসিনার প্রার্থীকেই দেওয়া হবে।”