দুইবার আওয়ামী লীগের ‘ছাড়ে‘ জিতেছে জাতীয় পার্টি। এবার নৌকার প্রার্থীর সঙ্গে আছেন দলের এক স্বতন্ত্র প্রার্থী। ফলে ভোটের হিসাব সহজ নয় এখানে।
Published : 30 Dec 2023, 09:39 PM
আওয়ামী লীগের ছাড়ে দুটি নির্বাচনে পাস করে আসা জাতীয় পার্টির কো চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা এবার আছেন বেকায়দায়।
ঢাকা-৪ আসনে এবার তাকে ছাড় না দিয়ে আওয়ামী লীগ প্রার্থী করেছে ২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী সানজিদা খানমকে। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পাওয়া আওলাদ হোসেনও আছেন দৌড়ে।
এ দুইজনের তুলনায় লাঙ্গলের প্রার্থীকে প্রচারে অনেকটা কাঠখড় পোড়াতে হচ্ছে, দিতে হচ্ছে বাড়তি মনোযোগ। তবে তিনি ভাবছেন, আওয়ামী লীগ যেহেতু দুই ভাগ, এই সুযোগ নেওয়া যাবে এবার।
যাত্রাবাড়ী ও শ্যামপুরের আংশিক এলাকা নিয়ে এই আসনে মোট প্রার্থী ৯ জন। এদের মধ্যে নৌকার সানজিদা, লাঙ্গলের বাবলা ও ট্রাক নিয়ে আওলাদ ছাড়া বাকিরা নেই আলোচনায়।
জোটবদ্ধ হওয়ার পর ২০০৮ সালে জাতীয় পার্টি এই আসনে আওয়ামী লীগের সানজিদার পক্ষে ছিল। যে কারণে এটা জানার সুযোগ নেই নৌকার পক্ষে রায় দেওয়া ভোটারদের কতজন আসলে জাতীয় পার্টির সমর্থক।
এরপর ২০১৪ ও ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগ প্রার্থী না দিয়ে বাবলাকে সমর্থন দেয়। জিতেও যান তিনি।
জাতীয় পার্টির নেতা এবারও ছাড়ের আশায় ছিলেন। তবে ক্ষমতাসীন দল যে ২৬টি আসনে ছাড় দেয়, তাতে আসনটি না দেখে হতাশ হন। তবে ভোটের ময়দান না ছেড়ে পরীক্ষায় নামার সিদ্ধান্ত নেন লাঙ্গলের প্রার্থী।
ভোটাররা বলছেন, শ্রমজীবীদের বসতিও আছে আসনটিতে। আছে আঞ্চলিকতার নানা বিষয়ও। বিএনপি-জামায়াতের দিকে পক্ষপাত আছে, এমন ভোটাররা কেন্দ্রে এলে ভোটের হাওয়া কার দিকে যাবে, সেসব নানা সমীকরণে নির্ধারণ হবে জয় পরাজয়।
আওয়ামী লীগ বিভক্ত
নবস সংসদ নির্বাচনে সরাসরি ভোটে জয় পাওয়া আওয়ামী লীগের সানজিদা খানমকে দশম সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন না দিয়ে সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য করা হয়।
পরের নির্বাচনে জাতীয় পার্টির সঙ্গে আওয়ামী লীগ আবার মহাজোট করলে হতাশ হতে হয় তাকে।
গত ২৬ নভেম্বর সানজিদাকে প্রার্থী ঘোষণা করলেও তিনি নিশ্চিত ছিলেন না শেষ পর্যন্ত ভোটের মাঠে থাকবেন কি না। কারণ, আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির মধ্যে আসন সমঝোতা নিয়ে আলোচনা চলছিল।
এর মধ্যে আওয়ামী লীগ সিদ্ধান্ত জানায়, এবার স্বতন্ত্র হয়ে কেউ ভোটের মাঠে থাকলে দলের আপত্তি নেই। এই বার্তা পেয়ে প্রধানমন্ত্রীর সাবেক সহকারী একান্ত সচিব আওলাদ হোসেন বিপুল উৎসাহ নিয়ে ভোটে নেমে যান, যিনি ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচনেও দল নিরপেক্ষ প্রার্থী হয়ে অল্পের জন্য হেরে যান।
এমনকি সানজিদাকে বসিয়ে দেওয়া হলেও ভোটের মাঠে থাকার সিদ্ধান্ত জানান তিনি।
গত ১৭ ডিসেম্বর মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন সানজিদা নিশ্চিত হন, তিনি ভোটের লড়াইয়ে থাকছেন। তবে আওলাদের প্রার্থিতা প্রত্যাহার না করা এবং বাবলারও ভোটের মাঠে থাকায় তৈরি হয় নতুন সমীকরণ।
সানজিদা ও আওলাদ দুই পক্ষেই আছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। স্বভাবতই বিভক্ত সমর্থকরাও। দুই পক্ষের প্রচারে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক জনসম্পৃক্ততাও দেখা যাচ্ছে।
নৌকার পক্ষে আছেন শ্যামপুর থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান হাবু, শ্যামপুর থানা আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পাদক গাফফার দেওয়ান রাজিব, শ্যামপুর থানা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি শেখ ইসলাম শাকিল, ৪৭ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মইনউদ্দিন চিশতি।
অন্যদিকে আওলাদের পাশে আছেন ৫৭ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর সাইফুল ইসলাম, বাস ট্রাক মালিক সমিতির নেতা তাজুল ইসলাম, ৫৮ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি শহিদ উল্লাহ, সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম, ঢাকা জেলা পরিষদের সদস্য ও শ্যামপুর আওয়ামী লীগ নেতা আলমগীর হোসেন।
ঢাকা মহানগর দক্ষিণ মহিলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ফেরদৌসি ইয়াসমিন পপি বলেন, "নৌকাকে আমরা ভালোবাসি, আওয়ামী লীগকে ভালোবাসি। নৌকার মাঝি পছন্দ হয় নাই।”
আমাকে হারানো সহজ না: সানজিদা
২০০৮ সালে সানজিদা প্রথমবার যখন ভোটের লড়াইয়ে নামেন, তিনি তার প্রতিদ্বন্দ্বীকে বলতে গেলে উড়িয়ে দেন। নৌকা নিয়ে সেবার তিনি পান ৯২ হাজার ৯৫৫ ভোট।
তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন বিএনপির আবদুল হাই, যিনি একাধিক নির্বাচনে জিতেছিলেন মুন্সিগঞ্জ সদর আসন থেকে। নতুন আসনে এসে তার পক্ষে ভোট পড়ে ৫০ হাজার ৭৯৯টি।
সানজিদা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "এখানে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ঐক্যবদ্ধ। সবাই নৌকার নির্বাচন করছে। জয়ের ব্যাপারে শতভাগ আশাবাদী।
“আমার সঙ্গে ৭ জন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী আছে। এদের মধ্যে ২০১৪ ও ১৮ সালের নির্বাচনে লাঙ্গলের আবু হোসেন বাবলাকে আমরাই পাস করিয়েছি, উনার তো কোনো ভোটই নাই।
“আওলাদ হোসেন তো ২০১৪ সালেও স্বতন্ত্রী প্রার্থী হয়েছিলেন। তখন তাকে আওয়ামী লীগ বহিষ্কার করেছিল। তিনি তো ১৪ হাজার ভোট পেয়েছিলেন। আর আমি তো ২০০৮ সালে বিএনপিকে ৪২ হাজার ভোটে হারিয়েছিলাম। এই এলাকা আমার গোছানো। এখানে আমাকে হারানো সহজ ব্যাপার না।”
ভোটের সম্ভাব্য ফলাফল কী হতে যাচ্ছে?- এই প্রশ্নে তিনি বলেন, "লাঙ্গলের অস্তিত্ব নেই, কিছু ভোট পাবেন প্রার্থী আওলাদ হোসেন। আর নৌকার প্রার্থী অপ্রতিরুদ্ধ।"
আমার সম্পর্ক আত্মার: আওলাদ
নৌকার মনোনয়ন না পেয়ে আওলাদের এটি দ্বিতীয় নির্বাচন। ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার পর তিনি আওয়ামী লীগের সমর্থন পাওয়া জাতীয় পার্টির বাবলাকে বলতে গেলে কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন।
ভোটার খরার সেই নির্বাচনে হাতি প্রতীক নিয়ে তিনি হেরেছিলেন হাজার তিনেক ভোটে। তার পক্ষে রায় দিয়েছিলেন ১৪ হাজার ৭৮৭ জন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে আওলাদ বলেন, “ছাত্রজীবন থেকে আমি এই এলাকায় রাজনীতি করি, এলাকার মানুষের পাশে থাকি। এলাকার মানুষের সঙ্গে আমার একটা আত্মীক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। আমাকে তারা ভালোবাসে, আমিও এই এলাকার মানুষকে ভালোবাসি। আমি শতভাগ আশাবাদী এই এলাকার মানুষ নেতৃত্বের পরিবর্তন করবে, উন্নয়ন দেখবে।”
আওয়ামী লীগ করেও নৌকার বিপক্ষে কী বলে ভোট চাইছেন, এই প্রশ্নে তিনি বলেন, “এখানে ভোট হবে ব্যক্তিকেন্দ্রিক। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সারাদেশে নৌকা দিয়েছেন, আবার স্বতন্ত্র প্রার্থীকেও সমর্থন দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচনে যিনি বিজয়ী হবেন, তাকে নিয়েই স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলবেন। সুতরাং কাকে ভোট দিলে বঞ্চিত-অবহেলিত মানুষের উপকার হবে, সেটিই ভাবছে ভোটাররা।
“এখন মার্কা নয়, ব্যক্তিই মূল বিষয়। যিনি মার্কাটা নিয়ে এসেছেন, তাকে তো মানুষ একবার দেখেছে, লাঙ্গল মার্কার প্রার্থীকে দুইবার দেখেছে। তারা এই এলাকার মানুষের জন্য কিছু করতে পারেননি।"
সুযোগ দেখছেন বাবলা
আওয়ামী লীগে বিভক্তি আর টানা দুই মেয়াদে সংসদ সদস্য থাকাকালে এলাকায় জনসম্পৃক্ততাকে কাজে লাগিয়ে বাজিমাত করার স্বপ্নে বিভোরা বাবলা।
তিনি বলেন, “আমি দীর্ঘদিন ধরে এই এলাকার মানুষের সেবা দিয়ে যাচ্ছি, দল মত নির্বিশেষে আমি সবার পছন্দের লোক। শ্যামপুর-কদমতলীর যে এলাকায়ই গণসংযোগ করতে গিয়েছি সবাই আমাকে বলেছে, সুষ্ঠু ভোটের নিশ্চয়তা দেন। আমি বলতে চাই, কোনো কূটকৌশল করে ঢাকা-৪ আসনে লাঙ্গলের জয় ঠেকানো যাবে না।"
এরশাদ সরকারের পতনের পর বাবলা এই আসনে ২০০১ সালে লাঙ্গল নিয়ে লড়াই করে পান ১৫ হাজার ৪১৩ ভোট। তবে সে সময় আসনটি ছিল বড়। এরপর সেই নির্বাচনি এলাকাটি ভেঙে আসলে দুটি হয়।
২০১৪ সালে আওয়ামী লীগ প্রার্থী না দেওয়ার পর স্বতন্ত্র হিসেবে লড়া আওলাদকে হারিয়ে তিনি জেতেন; ভোট পান ১৭ হাজার ৭৭২।
এরশাদ শাসনামলে ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালের নির্বাচনে বাবলা সংসদ সদস্য হন ঢাকা-১ (নবাবগঞ্জ-দোহার) আসন থেকে।
ভোটাররা কী বলছেন
পোস্তগোলা রোডের আলম মার্কের ব্যবসায়ী আব্দুল বাতেন মিয়া কদমতলী এলাকার বাসিন্দা। তিনি সরাসরি কোনো দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত না থাকলেও রাজনীতি নিয়ে খোঁজখবর রাখেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "গত ১৫ বছরে দুজন এমপি দেখছি। তাদেরকে ব্যবসায়ীদের কোনো কাজে আসতে দেখিনি। এলাকায় খোঁজ খবরও নেন না। তবে আওলাদ হোসেনের নাম ডাক ভালোই শুনি। আমি কাকে ভোট দিব, তা এখনও সিদ্ধান্ত নেইনি। তবে শুনেছি আওলাদ সাহেব হলে ভালো হবে।"
একই এলাকার আরেক বাসিন্দা বাদল মিয়া আওয়ামী লীগের সমর্থক। তিনি বলেন, “প্রার্থী বলতে সানজিদাকেই মনে করি। এখানে আওলাদ সাহেবের ব্যক্তিগত কোনো ভোট ব্যাংক নাই। তিনি চেষ্টা করছেন। বিএনপি বা অন্য দলের ভোটারদের কেন্দ্রে টানতে পারলে হয়ত কিছু ভোট পাবেন।
“আগেও তিনি লাঙ্গলের বিরুদ্ধে নির্বাচন করেছেন, তখন নৌকা ছিল না। তারপরেও তেমন ভোট পাননি। এবার নৌকার বিরুদ্ধে নির্বাচন করে বেশি সুবিধা করতে পারবেন না।”
ধোলাইপাড়ের চায়ের দোকানদার রজব আলী বলেন, “এই এলাকায় বেশি লোকজন দেখি নৌকার, বিএনপির লোকজন তো আর মাঠে নাই। ট্রাকের কিছু লোক আছে। লাঙ্গলের কোনো লোকজন দেখি না। তাদের ভোটার একেবারেই নাই।”
জাতীয় পার্টিকে নিয়ে কী ভাবছেন এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, “গত দুই নির্বাচনে বাবলা সাহেবকে আওয়ামী লীগই পাস করিয়েছি। এবার তো উনার সঙ্গে কেউ যাবে না, জাতীয় পার্টির ভোট এই এলাকায় কোনো সময়ই ছিল না।”