কালিহাতীতে প্রার্থী মোট নয়জন। তবে ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে এ আসনে ত্রিমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতার আভাস পাওয়া গেছে।
Published : 29 Dec 2023, 10:40 PM
কালিহাতি উপজেলা নিয়ে গঠিত টাঙ্গাইল-৪ আসনে আওয়ামী লীগের জন্য তিনি অপরিহার্যই ছিলেন। সাতবার নির্বাচন করে পাঁচবার সংসদের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। যখন জিততে পারেননি, খুব অল্প ভোটের ব্যবধানে হেরেছেন।
কিন্তু বিতর্কিত মন্তব্যের কারণে ২০১৪ সালের পর পরিস্থিতি পাল্টে যায়। আওয়ামী লীগ তাকে দল থেকে বহিষ্কার করে, মন্ত্রিত্ব হারান, জেল খাটেন- রাজনীতিতেও এক প্রকার নিষ্ক্রিয় ও সঙ্গহীন হয়ে পড়েন। ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাজনীতিতে ফেরার চেষ্টায় স্বতন্ত্র প্রার্থী হলেও ব্যর্থ হন।
দল তাকে বাদ দিলেও ‘মনে-প্রাণে আওয়ামী লীগার’ ৮৬ বছরের আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী এবারও নৌকার বিরুদ্ধে প্রার্থী হয়ে রাজনীতিতে ‘প্রত্যাবর্তনের’ চেষ্টা করছেন। ট্রাক প্রতীককে পাস করিয়ে সংসদে ফিরতে হলে তাকে লড়তে হবে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নৌকা মার্কার প্রার্থী মোজাহারুল ইসলাম তালুকদারের সঙ্গে।
স্থানীয় ভোটারদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পুরনো আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে কেউ কেউ অনুসারী-ভক্ত হিসেবে আব্দুল লতিফ সিদ্দিকীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। তারা যদি লতিফ সিদ্দিকীকে ভোট এনে দিতে পারেন সেটা নৌকার মার্কার ভোট হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
অন্য্যদিকে দলের নেতৃত্বের বড় অংশটি এখনও মোজাহারুলের সঙ্গে আছেন। তারা নৌকার ভোটকে অটুট রাখতে দিনরাত ভোটারদের দ্বারে দ্বারে ছুটছেন। তারপরও আওয়ামী লীগের প্রার্থীর ভোটের প্রচারে যেরকম জমায়েত বিগত সময়ে দেখা গেছে- এবার সেই জমায়েত ‘তুলনামূলক কম’ বলে মনে করছেন অনেকে।
তারা এটাও বলছেন, লতিফ সিদ্দিকী আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে নেই প্রায় এক দশক। এই সময়ের মধ্যে দলের তৃণমূলে একটি নতুন প্রজন্মও এসেছে; যাদের সঙ্গে ট্রাক মার্কার প্রার্থীর সম্পর্ক ক্ষীণ।
এ আসন থেকে দুইবার সংসদ সদস্য হয়েছেন শাহজাহান সিরাজ। ১৯৯১ সালে তিনি জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি থেকে নির্বাচিত হলেও পরে বিএনপিতে যোগ দেন। ২০০১ সালে তিনি বিএনপি থেকেই আবার নির্বাচিত হন। বিএনপিবিহীন এই নির্বাচনে তার মেয়ে সারওয়াত সিরাজ শুক্লা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ঈগল প্রতীক নিয়ে লড়াইয়ে নেমেছেন।
কালিহাতীতে প্রার্থী মোট নয়জন। তবে শীত উপেক্ষা করে ভোটের উত্তাপ ছড়াতে থাকা ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে আসনটিতে ত্রিমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতার আভাস পাওয়া গেছে। ভোটারদের মধ্যে ঘুরেফিরে এ তিনজনকে নিয়েই জল্পনার ডানা মেলছে।
অন্য ছয় প্রার্থী হলেন- জাতীয় পার্টি মনোনীত লিয়াকত আলী (লাঙ্গল), জাতীয় পার্টি-জেপি মনোনীত সাদেক সিদ্দিকী (বাই সাইকেল), জাকের পার্টির মোন্তাজ আলী (গোলাপ ফুল), তৃণমূল বিএনপি মনোনীত শহিদুল ইসলাম (সোনালি আঁশ), বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টির শুকুর মামুদ (একতারা), জাসদের এস এ এম আবু মুস্তফা (মশাল)।
লাঙ্গলের প্রার্থী লিয়াকত আলী ২০১৮ সালের নির্বাচনে আব্দুল লতিফ সিদ্দিকীর ছোট ভাই কাদের সিদ্দিকীর পার্টি বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক জনতা দলের হয়ে লড়াই করেছিলেন। সেবার তিনি ৩৪ হাজারের কিছু বেশি ভোট পেয়ে দ্বিতীয় হন। এবার আর কাদের সিদ্দিকী তাকে প্রার্থী করেননি; এমনকি বড় ভাইয়ের আসনে তিনি দলের কোনো প্রার্থীও দেননি।
দীর্ঘদিন পর চলতি বছরের সেপ্টেম্বরের শেষে আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী যখন কালিহাতিতে আবার গণসংযোগে আসেন, তখন কাদের সিদ্দিকী ও পরিবার তার পাশে ছিলেন। দুই ভাই তখন এক মঞ্চে বসেছেন। মনোনয়নপত্র দাখিলের সময় লতিফ সিদ্দিকীর সঙ্গে ছোটভাই কাদের সিদ্দিকীও ছিলেন।
এসব কারণে ভোটারদের একটি অংশের ধারণা হয়েছে, হয়ত বড় ভাইকে সুযোগ করে দিতেই কৃষক শ্রমিক জনতা দল এখানে কোনো প্রার্থী দেয়নি। তবে গামছা মার্কার সব ভোটার লতিফ সিদ্দিকীকে বেছে নেবেন- এমনটা নাও হতে পারে।
কাদের সিদ্দিকী ভোট করছেন পাশের বাসাইল-সখীপুর উপজেলা নিয়ে গঠিত টাঙ্গাইল-৮ আসনে। আর টাঙ্গাইল-৫ সদর আসন থেকে লড়ছেন তাদের আরেক ভাই মুরাদ সিদ্দিকী।
দুটি পৌরসভা ও ১৩টি ইউনিয়ন নিয়ে টাঙ্গাইল-৪ আসন।
ভোটার আছেন ৩ লাখ ৫৪ হাজার ৫৫৬ জন; তাদের মধ্যে পুরুষ ১ লাখ ৭৮ হাজার ৮৯২ জন, ১ লাখ ৭৫ হাজার ৬৬২ জন নারী।
মোট ভোট কেন্দ্র ১১০টি।
আবদুল লতিফ সিদ্দিকী টাঙ্গাইল-৪ আসনে প্রার্থী হয়েছেন সাতবার; ১৯৭০ সালে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য, ১৯৭৩, ১৯৯৬ এবং ২০০৮, ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রিত্ব পান।
শাহজাহান সিরাজ ১৯৯১ (জেএসডি) ও ২০০১ (বিএনপি) সালে জয়ী হন।
হাসান ইমাম খান সোহেল হাজারী ২০১৭ সালের উপ-নির্বাচন এবং ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক নিয়ে জয়ী হন।
লতিফ সিদ্দিকী সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ভোটের প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন। বিভিন্ন সভা-সমাবেশ ও গণসংযোগে তিনি বলছেন, “দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গত দুই মাস ধরে আমি কালিহাতীর মানুষের ভালোবাসার আওয়াজটা জানার চেষ্টা করেছি। মানুষের ভালোবাসা পুঁজি করে আমি নির্বাচনে এসেছি। ট্রাক প্রতীক নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছি। আগামী ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে মানুষের ভালোবাসাই আমাকে বিজয়ী করবে।”
তার ভাষ্য, “নির্বাচনে আমি কোনোদিন দাঙ্গাহাঙ্গামা বরদাস্ত করিনি, এখনও করব না। কোনো প্রকার জালভোট, পেশীশক্তির ব্যবহার করে কেন্দ্র দখলের মাধ্যমে ভোট আদায়, অর্থ দিয়ে ভোটার প্রলুব্ধ করে ভোট আদায় ইত্যাদি অপকৌশলকে আমি ঘৃণা করি।”
তিনি উপজেলার প্রতিটি গ্রাম, ওয়ার্ডে নির্বাচন পরিচালনা কমিটি গঠন করার নির্দেশ দেন। একইসঙ্গে কেন্দ্র কমিটিও করার কথা বলেন।
তবে লতিফ মনে করেন, এবারের নির্বাচনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কেন্দ্রে ভোটার আনা; ভোটারদের কেন্দ্রে নির্বিঘ্নে যাতায়াত ও নিরাপত্তার বিষয়ে আশ্বস্ত করা। কোনো প্রকার জাল-জালিয়াতি নয়, অর্থের প্রলোভন নয়, পেশীশক্তির বাহাদুরি নয়। ভোটাররা নির্বিঘ্নে ও স্বাধীনভাবে ভোট দিয়ে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করবে- এটাই প্রত্যাশা করেন তিনি।
অন্যদিকে নৌকার প্রার্থী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মোজহারুল ইসলাম তালুকদার বলেন, “সারাজীবন রাজনীতি করেছি মানুষের কল্যাণে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও শেখ হাসিনার নেতৃত্বের সঙ্গে কোনোদিন বেঈমানি করি নাই। আওয়ামী লীগ করতে গিয়ে অনেক জেল-জুলুম-নির্যাতন-অত্যাচার সহ্য করেছি।”
এমপি পদে নৌকার প্রার্থী করে শেখ হাসিনা ‘ধন্য করেছেন’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, “মুক্তিযুদ্ধের সূতিকাগার কালিহাতীতে নৌকার কোনো বিকল্প নেই। শান্তি ও উন্নয়নের স্বার্থে জনগণ নৌকাকেই ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করবেন।”
বিএনপি সরকারের সাবেক মন্ত্রী প্রয়াত শাজাহান সিরাজের মেয়ে সারওয়াত সিরাজ শুক্লা সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী। শাজাহান সিরাজ জীবদ্দশায় আওয়ামী লীগ, জাসদ, গণফোরাম ও সবশেষে বিএনপির রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন।
বাবার অনুসারীদের সঙ্গে নিয়েই শুক্লা নির্বাচনি বৈতরণি পার হওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন। নিজ এলাকায় চালিয়ে যাচ্ছেন গণসংযোগ।
তিনি বলেন, “আমার বাবা শাজাহান সিরাজের পাশে যেভাবে কালিহাতীবাসী দাঁড়িয়েছিলেন, আমার পাশেও সেভাবেই থাকবেন তারা। আমি অবশ্যই কালিহাতীকে মাদক, সন্ত্রাস, বৈষম্যমুক্ত, সুন্দর অনন্য উচ্চতার একটি উপজেলা গড়ার জন্য কাজ করব।
“বিজয়ী হলে সবার আগে শিশু ও নারীদের জন্য কটি হাসপাতাল গড়ে তুলব। আমি শতভাগ আশাবাদী ভোট দিয়ে কালিহাতীর জনগণ আমাকে বিপুল ভোটে বিজয়ী করবে।”
বাংড়া ইউনিয়নের ধুনাইল গ্রামের ভোটার শহিদুল ইসলাম মনে করেন, এবারের নির্বাচনে মোজহারুল, লতিফ সিদ্দিকী ও শুক্লার মধ্যেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে।
আর কালিহাতী পৌর এলাকার সাতুটিয়া গ্রামের আমিনুল ইসলাম বলেন, “লতিফ সিদ্দিকী কালিহাতী আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে চারবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। কালিহাতীতে তার বিকল্প নাই।”
আসনটি ঘিরে ত্রিমুখি লড়াইয়ের আভাস পাওয়া গেলেও ভোটাররা ভোট দিয়ে শেষ পর্যন্ত কাকে নির্বাচিত করবেন তা জানতে ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
তবে সবার প্রত্যাশা, ভোটাররা নির্বিঘ্নে কেন্দ্রে গিয়ে পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়ে বাড়ি ফেরার পরিবেশ সৃষ্টি করবে নির্বাচন কমিশন ও স্থানীয় প্রশাসন।