Published : 07 Apr 2025, 07:59 PM
লাঙ্গলবন্দের পবিত্র স্নানোৎসবে গিয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছিলেন— “বাংলাদেশের মতো এত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি আর কোথাও নেই।”
কথাটা বলার সময় তিনি হয়তো আশপাশে থাকা ক্যামেরার ফ্ল্যাশ দেখে মুগ্ধ ছিলেন, অথবা পদোচিত ‘সুরক্ষিত বলয়ের’ ভেতর থেকে একটা সুন্দর গল্প বলার দায়বদ্ধতায় ছিলেন।
কিন্তু বাস্তবতা? বাস্তবতা বলছে— এই ‘সম্প্রীতি’ আছে কেবল শব্দে।
বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা, নিপীড়ন, হুমকি বা সামাজিক বয়কট— সবই এখন এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে, যেখানে এসব ঘটনার সংবাদ সংবাদমাধ্যমে আসার জন্য আগে তা ‘ভাইরাল’ হওয়া জরুরি। যেন সংখ্যালঘু নির্যাতন এখন ‘সোশ্যাল-মিডিয়া সেন্সিটিভ’ বিষয়— সংবাদ না, ট্রেন্ড।
সম্প্রতি দিনাজপুর সদর উপজেলার বনতারা গ্রামে যা ঘটেছে, সেটি এমনই এক ভয়াবহ ট্র্যাজেডি। অভিযোগ উঠেছে, ঢাকায় থাকা একজন হিন্দু গার্মেন্টস কর্মী ‘ধর্ম অবমাননা’ করেছেন। তার কারণে গোটা গ্রামের হিন্দু সম্প্রদায় অবরুদ্ধ জীবনযাপন করছেন— দোকান বন্ধ, রাস্তায় বের হওয়া নিষেধ, মাইকিং করে আতঙ্ক ছড়ানো হয়েছে। অথচ রাষ্ট্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা, প্রশাসন, পুলিশ— সবাই যেন ঘুমিয়ে। সংবাদমাধ্যমও মুখে কুলুপ এঁটে আছে। যদি কেউ গলা তোলে, তাহলে তাকে ‘সহযোগী’ বানিয়ে পুলিশে ধরিয়ে দেওয়া হয়। এটাই কি সেই ‘বিশ্বসেরা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি’?
এমন পরিস্থিতিতে যখন কেউ বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের কথা তোলে— পরিসংখ্যান, চাক্ষুষ উদাহরণ কিংবা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা দিয়ে তুলে ধরার চেষ্টা করে যে এখানে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সম্প্রদায় কী ধরনের নিপীড়নের শিকার হচ্ছে— তখনই অনেকের মুখে এক প্রকার স্বস্তিদায়ক, অথচ ভয়ঙ্কর আত্মপ্রবঞ্চনায় ভরা জবাব ভেসে আসে: “ভারতে তো মুসলমানদের ওপর এর চেয়েও বেশি নির্যাতন হয়!” যেন প্রতিবেশী দেশটিতে একটি অন্যায় সংঘটিত হলেই আমাদের দেশে আরেকটি অন্যায় স্বাভাবিক হয়ে যায়, কিংবা সেজন্য আমাদের আর বিবেকের দায় থাকে না।
এই মনোভাব আসলে একটা জাতিগত আত্মরক্ষামূলক প্রবণতা, যেখানে অন্যের পাপকে নিজের অপরাধের পর্দা হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এই অদ্ভুত যুক্তিবিদ্যা সমাজে এমনভাবে ছড়িয়ে গেছে যে, রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের খবর এলেও মানুষ তা স্বাভাবিক বলে মেনে নেয়, কেননা ‘ওদের দেশেও এমন হয়’। অথচ এই তুলনার সময় কেউ ভাবেন না যে ভারতের মুসলিমরা যদি নিপীড়িত হন, তাহলে সেটা ভারতের ব্যর্থতা— বাংলাদেশের নয়। ভারতের অন্যায়ের সমালোচনা করে বাংলাদেশের অন্যায়কে জায়েজ করা যায় না। বরং এতে উল্টো বাংলাদেশের নৈতিক অবস্থান প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
আর এই তুলনার মধ্য দিয়ে যে জিনিসটা সবচেয়ে বেশি লজ্জাজনকভাবে প্রকাশ পায়, তা হলো— আমাদের দেশের বড় একটি অংশ সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার প্রশ্নে সত্যিকার অর্থে আগ্রহী নয়। তারা তাদের বিবেকের বোঝা লাঘব করতে চায় অন্যের অবিচার দেখিয়ে। তারা চায়, সংখ্যালঘুরা মুখ বন্ধ রাখুক, নিপীড়নকে ‘ভাগ্যের লিখন’ ভেবে মেনে নিক, এবং যে কোনো প্রতিবাদ যেন চাপা পড়ে 'ভারতীয় প্রসঙ্গ' নামক চিরচেনা ঢাল দিয়ে।
এই প্রবণতা আমাদের সামাজিক বিবেকের ভয়াবহ রকম অবক্ষয়ের প্রতিচ্ছবি। আমরা যদি অন্য দেশের ন্যায়-অন্যায়ের তুলনায় নিজেদের মানবাধিকার নির্ধারণ করতে শুরু করি, তাহলে সেটা মানবিকতার নয়, নিছক রাজনৈতিক সুবিধাবাদের দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়ায়। বাস্তবতা হলো— সংখ্যালঘুদের ওপর যে কোনো নিপীড়ন, তা যেখানে-যার দ্বারাই সংঘটিত হোক না কেন, সেটি অন্যায়ের চেয়েও বড় মানবাধিকার লঙ্ঘন। এবং সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ার দায় আমাদের সবার। ভারতের সাম্প্রদায়িক সহিংসতার সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনার খেলায় নয়, বিবেকের দৃষ্টিতে বিচার করলেই কেবল সত্য প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।
‘ধর্ম অবমাননা’ এখন এ দেশের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর রাজনৈতিক হাতিয়ার। দিনাজপুরের ঘটনায় যেমন দেখা গেল— একজন শিক্ষক, উপেন্দ্র রায়, পরিস্থিতি শান্ত করার জন্য যুক্তির কথা বললেন। কিন্তু সেই যুক্তি 'জনতা'র কানে সহ্য হয়নি, তাকেই পেটানো হলো, গ্রেপ্তার করা হলো।
এই সংস্কৃতি শুধু ভয়ঙ্কর নয়, এটি আমাদের রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা ও সামাজিক অবক্ষয়ের সবচেয়ে নগ্ন প্রতিচ্ছবি।
সবচেয়ে হতাশাজনক হচ্ছে সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যমগুলো সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনাগুলো উপক্ষো করে। তাদের কৌশল যেন সরকারকে সহায়তা করার নীতি: ‘খবর নাই' মানেই 'ঘটনাও নাই’! মূলধারার মিডিয়া আজকাল সংখ্যালঘুদের বিষয়ে কেবল তখনই রিপোর্ট করে যখন সেটি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তোলপাড় হয়। দিনাজপুরের ঘটনাটি তিনদিন ধরে চলেছে, অথচ কোনো আলোচনাই নেই টিভি বা পত্রিকার পর্দায়। এটা কি অসচেতনতা? না, ইচ্ছাকৃত এড়িয়ে যাওয়া?
একইভাবে, টাঙ্গাইলের অখিল কর্মকারের ওপর গণপিটুনির ভিডিও ভাইরাল হয়েছে, কিন্তু মূলধারার কোনো সংবাদমাধ্যমের চোখে পড়েনি। যেন তারা বুঝে নিয়েছে— এই নির্যাতিত মানুষেরা রাষ্ট্রের ‘মূল ধারার’ নাগরিক নন।
অথচ আমরা প্রতিনিয়ত শুনি, ‘বাংলাদেশ অসাম্প্রদায়িক চেতনার দেশ’। এ যেন এক জাতীয় স্লোগান, প্রতিটি মঞ্চে, প্রতিটি মাইকে, সরকারি-বেসরকারি প্রতিটি বিবৃতিতে গর্বের সঙ্গে উচ্চারিত হয়। কিন্তু বাস্তবে সেই ‘চেতনা’ যেন সংখ্যালঘুদের কষ্টে কানে তুলো দেয়, নিপীড়নের সময় হয়ে পড়ে অদৃশ্য, আর কেউ প্রতিবাদ করলে— তুলে ধরে পাশের দেশের কোনো বীভৎস উদাহরণ। যেন প্রতিবেশীর অন্যায় আমাদের অন্যায়কে বৈধ করে তোলে।
কিন্তু মানুষ ভোলে না। যারা সংখ্যালঘু, তারা ১৯৭১ দেখেছে, দেখেছে ১৯৯০-৯২, ২০০১, ২০১৩-১৫, এবং সাম্প্রতিক ২০২১ কিংবা অতি সাম্প্রতিক, প্রতিটি দুঃসময় তাদের স্মৃতির ভারে জমা হয়েছে। মুখে কিছু বলেনি মানে ভুলে গেছে এমন নয়। তারা চুপ থেকেছে, সহ্য করেছে—কিন্তু ভোলেনি।
‘সম্প্রীতির বিজ্ঞাপন’ আর ‘বাস্তবের নিপীড়ন’ একসঙ্গে চলতে পারে না— এই মৌলিক সত্য ভুলে যাওয়া জাতির ভবিষ্যৎও হয় অন্ধকার। আর বাংলাদেশে এখন চলছে এই দ্বিচারিতা— বক্তৃতায় সম্প্রীতি, বাস্তবে বিভেদ। একদিন ইতিহাস নিশ্চয় লিখবে—“বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা যতটা বলা হতো, বাস্তবে তা ছিল ততটাই দুর্লভ।”