এই ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো যেত, স্বচ্ছতা ও দক্ষতার সঙ্গে প্রান্তিক মানুষের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করা যেত। কিন্তু এক ঝটকায় বাতিল করে দেওয়া মানে তাদের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করা।
Published : 10 Apr 2025, 08:34 AM
প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা বাতিল করা হয়েছিল ২০১৮ সালে। আন্দোলনের মুখে তা করতে বাধ্য হয়েছিল সরকার। তবে, ২০২৪ সালের জুন মাসে হাই কোর্টের রায়ে কোটা ব্যবস্থা পুনর্বহাল করা হয়। ওই সিদ্ধান্ত পুনরায় ছাত্রদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করে এবং বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে এবং পরে তা সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনে রূপ নেয়। অনিবার্য পরিণতিতে সরকারেরই পতন ঘটে।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন, যা শুরুতে সরকারি চাকরিতে কোটাপ্রথা বাতিলের আন্দোলন ছিল, তাতে নারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ লক্ষ্য করা গেছে। তার মানে এ নয় যে, কোটা বিলুপ্তির আন্দোলনটি যখন সরকার পতনের আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়, তখন ওই আন্দোলনে নারীরা ছিলেন। তখনও নারীরা ছিলেন এবং বিগত যে কোনো আন্দোলন-সংগ্রামের তুলনায় অনেক বেশিই ছিলেন।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের শুরুতে নারী আন্দোলনকারীদের অনেকেই সমতার ভিত্তিতে প্রতিযোগিতার পক্ষে অবস্থান নিয়ে নারীদের জন্য বরাদ্দ কোটার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। অনেকেই তখন বলছিলেন, “নারীরা তাদের সক্ষমতায় আত্মবিশ্বাসী এবং সহানুভূতির মাধ্যমে নয়, বরং সমতার ভিত্তিতে এগিয়ে যেতে চান।”
২০২৪ সালের জুলাই মাসে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে সরকারি চাকরিতে নতুন কোটা ব্যবস্থা প্রণয়ন করা হয়। ওই ব্যবস্থায় ৯৩ শতাংশ পদ মেধার ভিত্তিতে এবং বাকি ৭ শতাংশ বিভিন্ন সংরক্ষিত শ্রেণির জন্য বরাদ্দ করা হয়। স্বাধীনতা সংগ্রামী ও তাদের সন্তানদের জন্য ৫ শতাংশ, জাতিগত সংখ্যালঘুদের জন্য ১ শতাংশ এবং তৃতীয় লিঙ্গ ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য ১ শতাংশ সংরক্ষণ করা হয়। নারীদের কোটা পুরোই বাতিল করা হয় আদালতে।
ফলে সম্প্রতি ‘সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগ বিধিমালা, ২০২৫’-এর যে খসড়া তৈরি করা হয়েছে, এই খসড়া অনুযায়ী, সহকারী শিক্ষক পদে নিয়োগে নারী, পোষ্য ও পুরুষ কোটা আর থাকছে না। পূর্বে, এই নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ৬০ শতাংশ নারী কোটা, ২০ শতাংশ পোষ্য কোটা এবং ২০ শতাংশ পুরুষ কোটার ভিত্তিতে সম্পন্ন হতো। প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক নিয়োগে নারী ও পোষ্য কোটা বাতিলের সিদ্ধান্ত দেশের শিক্ষানীতি ও সমতাভিত্তিক রাষ্ট্রচিন্তার ওপর একটি বড় ধাক্কা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এ সিদ্ধান্ত শুধু নিয়োগ প্রক্রিয়ার একটি ছোটখাটো পরিবর্তন নয়, বরং এটি একটি রাষ্ট্রীয় অবস্থান— যেখানে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতি দায়বদ্ধতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে।
নারী, জেলা ও আদিবাসী— এই শ্রেণিগুলোর জন্য কোটা বরাদ্দ করা হয়েছিল একটি বিশেষ বাস্তবতা থেকে। সমাজে তাদের কাঠামোগত বঞ্চনা, আর্থ-সামাজিক বৈষম্য ও সাংস্কৃতিক প্রতিবন্ধকতা অস্বীকার করার মতো নয়। তাই এই কোটাগুলো ছিল এক ধরনের ‘ইতিবাচক বৈষম্য’, যাতে করে সুযোগসুবিধা বঞ্চিত জনগোষ্ঠী রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।
বাংলাদেশের সংবিধানের ১৯(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “সমাজের অনগ্রসর অংশের উন্নয়নের জন্য রাষ্ট্র বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।” একইভাবে ২৮(৪) অনুচ্ছেদ বলছে, “নারী বা শিশু বা অনগ্রসর যে কোন শ্রেণীর জন্য বিশেষ বিধান করা বৈষম্য নয়।” অর্থাৎ সংবিধান নিজেই কোটা ব্যবস্থার নৈতিক ও আইনি ভিত্তি প্রদান করেছে। এর মূল দর্শনই হচ্ছে সমতা আনতে হলে সবার জন্য সমান নিয়ম নয়, বরং অসম ব্যবস্থায় পিছিয়ে পড়াদের জন্য বাড়তি সুযোগ তৈরি করতে হবে।
নারীদের ক্ষেত্রে দেখা যায়, অনেক পরিবার এখনো মেয়েদের শিক্ষকতার জন্য দূরের জেলায় পাঠাতে দ্বিধাবোধ করে। নিরাপত্তা, যাতায়াত, আবাসন ইত্যাদি বিষয় এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। নারী কোটার মাধ্যমে স্থানীয় বা নিকটবর্তী এলাকার নারীরা চাকরি করার সুযোগ পেতেন, যা বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল।
অন্যদিকে আদিবাসীদের তো বাংলা ভাষা প্রথম ভাষা নয়। স্কুলের পাঠক্রম, ভাষা ও সামাজিক কাঠামো তাদের জন্য একটি দ্বৈত প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। তাই কোটা ব্যবস্থা তাদের জন্য সম্ভাবনার দরজা খুলে দিচ্ছিল। তারা দেশের মূল জনস্রোতের সঙ্গে মিলিত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছিল। কিন্তু বর্তমান ব্যবস্থাপনায় তাদের কোটার হার আশঙ্কাজনকভাবেই কমে গিয়েছে।
নারীরা মেধাভিত্তিক প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে আগ্রহী এবং সফলও হচ্ছেন। তবে, এখনও এমন কিছু শ্রেণির নারী রয়েছেন, যাদের পেছনের সামাজিক, ভৌগোলিক বা আর্থসামাজিক বাস্তবতা বিবেচনায় বিশেষ সহায়তা প্রয়োজন। তাই, যদি নারী কোটার সংস্কার ও পুনর্বিন্যাস হয়, তাহলে নিচের শ্রেণিভুক্ত নারীরা এর অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন বা হওয়া উচিত:
· প্রান্তিক ও দুর্গম অঞ্চলের নারী: যেমন হাওর, চর, পাহাড়ি এলাকা বা সীমান্তবর্তী অঞ্চলের নারীরা, যাদের শিক্ষার সুযোগ সীমিত। এইসব এলাকায় স্কুলে যেতে অসুবিধা হয়, শিক্ষকের অভাব থাকে, এমনকি ইন্টারনেট সংযোগও দুর্বল। এই নারীরা যদি চাকরির সুযোগ পান, তাহলে ওই এলাকার উন্নয়নেও ভূমিকা রাখবেন।
· আদিবাসী নারীরা: ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক বৈষম্যের কারণে তারা মূলধারার প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়েন। তাদের জন্য মাতৃভাষাভিত্তিক প্রস্তুতি, বিশেষ বৃত্তি ও কোটা পুনর্বহাল সহায়ক হবে।
· অর্থনৈতিকভাবে অস্বচ্ছল পরিবার থেকে আসা নারী: যারা পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম হতে চান কিন্তু কোচিং, অনলাইন প্রস্তুতি বা রিসোর্স কেনার সামর্থ্য নেই। সরকারি বৃত্তি বা বিশেষ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের প্রস্তুত করে কোটার আওতায় আনা যেতে পারে।
· শারীরিক বা মানসিক প্রতিবন্ধী নারী: যারা দ্বিগুণ বৈষম্যের শিকার— একদিকে নারী, অন্যদিকে প্রতিবন্ধী। বর্তমান নতুন কোটায় তৃতীয় লিঙ্গ ও প্রতিবন্ধীদের জন্য ১ শতাংশ কোটা সংরক্ষণ করা হলেও নারীদের আলাদা গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।
· উত্তরাধিকার আইনে বঞ্চিত নারী: মুসলিম আইনে নারী পৈতৃক সম্পত্তিতে কিছু অধিকার সংরক্ষণ করলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের বঞ্চিত করা হয়। হিন্দু নারীর পৈতৃক সম্পত্তিতে কোনো আইনগত অধিকার নেই। আদিবাসীদের মধ্যেও গারোদের মতো দুয়েকটি জাতিগোষ্ঠীর নারীরা সম্পত্তির অধিকার পেলেও বাকিদের অবস্থা হিন্দুদের মতোই।
· পরিবারে নির্যাতনের শিকার বা সিঙ্গেল মাদার নারীরা: যারা সংসারের দায়িত্ব একা কাঁধে নিয়ে এগিয়ে চলেছেন। সমাজ ও পরিবারের কাছ থেকে অনেক ক্ষেত্রেই সমর্থন পান না। তাঁদের জন্য স্থানীয় নিয়োগ, প্রশিক্ষণ বা কোটা সুবিধা বিশেষভাবে প্রয়োজন।
বাংলাদেশে প্রান্তিক অঞ্চলগুলোতে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ এবং অন্যান্য মৌলিক সেবা এখনও পর্যাপ্তভাবে পৌঁছায় না। বিশেষ করে হাওর, চর, পাহাড়ি এলাকা, এবং সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলো যেখানে জীবনযাত্রার মান তুলনামূলকভাবে অনেক খারাপ। এই অঞ্চলের নারীরা শিক্ষা ও অন্যান্য সুযোগের অভাবে পিছিয়ে পড়েন। অঞ্চলভিত্তিক কোটা প্রবর্তন করা হলে, এসব অঞ্চলের নারীদের জন্য বিশেষ সুযোগ সৃষ্টি হবে, যা তাদের একদিকে সামাজিকভাবে সম্মানজনক কাজের সুযোগ দেবে, অন্যদিকে ওই অঞ্চলের উন্নয়নেও ভূমিকা রাখবে। এর মাধ্যমে, যেমন ভৌগোলিক বৈষম্য কমবে, তেমনি সামাজিকভাবে অবহেলিত জনগণের উন্নয়নও সম্ভব হবে। সেখানকার মেয়েরা যারা কঠিন পরিস্থিতি সামলানোর জন্য কাজ করছেন, তাদের জন্য সহায়তা প্রদান। কর্মক্ষেত্রে স্থানীয় নারীদের উপস্থিতি বৃদ্ধি পাবে, যা স্থানীয় সমাজের উন্নয়ন এবং নারীদের ক্ষমতায়নকে ত্বরান্বিত করবে। প্রান্তিক এলাকায় কোটা ব্যবস্থা প্রয়োগ করা হলে সেখানে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ও উদ্যোক্তা তৈরির সুযোগ তৈরি হবে।
নারীদের জন্য লক্ষ্যভিত্তিক অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতি হলো এমন একটি নীতি যা নারীদের প্রাতিষ্ঠানিক বাধা পেরিয়ে সমাজের সব স্তরে সম্পৃক্ত করার উদ্দেশ্যে কাজ করবে। বর্তমান সমাজে অনেক নারী সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক বাধার সম্মুখীন হন। লক্ষ্যভিত্তিক নীতি নারীদের সেই বাধা দূর করে তাদের সমান সুযোগ দেওয়ার মাধ্যমে প্রকৃত সমতার সৃষ্টি করবে। এই নীতি অনুযায়ী, কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে যেমন শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, উদ্যোক্তা সৃষ্টি এবং সরকারি চাকরিতে নারীদের জন্য নির্দিষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ করা যেতে পারে।
এমন কিছু পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে: নারীদের জন্য বিশেষ বৃত্তি ও প্রশিক্ষণ প্রদান, যা তাদের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করবে; নারীদের জন্য বিশেষ নিয়োগ প্রক্রিয়া, যাতে তাদের কর্মজীবনে প্রবেশ সহজ হয়; এবং এমন প্রণোদনা কর্মসূচি, যেখানে নারীরা যদি কোনো পুরুষের সমান পদে দায়িত্ব পালন করেন তবে তাঁদের পদোন্নতি বা আরও সুযোগ সৃষ্টি করা হয়।
কোটা পূরণ না হলে মেধা তালিকায় স্থানান্তর
এটি একটি সম্ভাব্য উপায় যা কোটা ব্যবস্থার বিকল্প সংস্কার হতে পারে। এই ধারণার মূল বক্তব্য হলো, যদি নির্দিষ্ট কোটা পূর্ণ না হয় (যেমন নারী, আদিবাসী অথবা প্রতিবন্ধী কোটা), তবে ওই পদগুলো মেধা তালিকার ভিত্তিতে পূর্ণ করা যাবে। এই ব্যবস্থা নারী কোটা বা অন্য কোটার উদ্দেশ্যকে অক্ষুণ্ণ রাখবে, তবে অন্যভাবে মেধারও মূল্যায়ন করবে।
এভাবে, পদ পূর্ণ না হলে মেধাবী প্রার্থীদের জন্য সুনির্দিষ্ট সুযোগ থাকবে, যা তাদের জন্য প্রতিযোগিতার মাধ্যমে অর্জনযোগ্য হতে পারে। এতে একদিকে কোটা ব্যবস্থা সংরক্ষিত হবে, অন্যদিকে মেধা এবং যোগ্যতার ভিত্তিতে নির্বাচন নিশ্চিত হবে। এই ব্যবস্থায় কোনো ধরনের অবিচার হবে না, কারণ মেধাবী প্রার্থীরা সহজেই সঠিক পদে স্থান পাবেন। ডাটা-বেইজড অনুযায়ী কোটার পর্যালোচনা হতে পারে, প্রতি পাঁচ বছর পর পর জনগণের আর্থসামাজিক অবস্থা অনুযায়ী কোটার ধরন, হার ও প্রয়োগ পর্যালোচনা করা।
কোটা মানেই মেধাহীনদের জন্য সুবিধা নয়। বরং এটি ওই মানুষদের জন্য একটি সুযোগ, যারা সুযোগ না পেলে প্রতিযোগিতায় অংশ নিতেই পারতেন না। এই ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো যেত, স্বচ্ছতা ও দক্ষতার সঙ্গে প্রান্তিক মানুষের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করা যেত। কিন্তু এক ঝটকায় বাতিল করে দেওয়া মানে তাদের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করা। এটা শুধু রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ভুল নয়— এটা এক প্রকার নৈতিক ও সাংবিধানিক ব্যর্থতা।
কোটা নয়, দরকার সময়োপযোগী, ন্যায্য ও অন্তর্ভুক্তিমূলক কোটা সংস্কার। যাতে সমাজের প্রতিটি প্রান্তিক মানুষ—নারী, আদিবাসী, জেলাভিত্তিক বঞ্চিত জনগোষ্ঠী শিক্ষকতা ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্তরে নিজেদের জায়গা তৈরি করতে পারে, সম্মানের সঙ্গে।