আ হ ম মুস্তফা কামালের বাজেটে স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্ন আছে, কিন্তু বাস্তব অবস্থার প্রতিফলন কতটা হয়েছে?
Published : 02 Jun 2023, 02:34 AM
মূল্যস্ফীতি থেকে সাধারণের মুক্তি আর আবারও উচ্চ প্রবৃদ্ধির যাত্রায় দেশকে নিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে ‘স্মার্ট’ এক বাংলাদেশের স্বপ্নের কথা বলেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল; যাতে আইএমএফের দেখানো পথে আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে একগুচ্ছ সংস্কারের ঘোষণা এসেছে।
তবে সরকারের বড় অঙ্কের আয়-ব্যয়ের এ হিসাবে সাধারণের হাঁপ ছাড়ার খুব বেশি সুযোগের দেখা যেমন মেলেনি, তেমনি কোভিড ও যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে খারাপ সময় পার করা অর্থনৈতিক সংকটের উপর আলোকপাত কিংবা তা কাটিয়ে ওঠার সুস্পষ্ট দিক-নির্দেশনাও চোখে পড়েনি।
অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুরের ভাষায়, “এখন স্মার্ট বাংলাদেশে চলে গেছি, কিন্তু বর্তমান বাংলাদেশের আলোচনাই নেই (বাজেটে)।” একই প্রতিক্রিয়া এসেছে গবেষণা সংস্থা সিপিডির কাছ থেকেও।
আওয়ামী লীগের জোট শরিক দল ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননের কাছেও বাজেটটি হয়েছে এমন, যেখানে ‘উন্নয়নের কথামালা বাস্তবতাকে করে তুলেছে কিছুটা অস্পষ্ট’।
ডিজিটাল থেকে স্মার্ট বাংলাদেশ হওয়ার পথে অর্থমন্ত্রী একগুচ্ছ সংস্কারের কথা তুলে ধরেছেন আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায়; স্বপ্নের এক দেশ গড়ে তোলার অঙ্গীকার করেছেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত স্বাধীন সার্বভৌম সোনার বাংলাদেশ’ বিনির্মাণের অসমাপ্ত কাজ বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে শেষ করার কথা বলেছেন।
তবে ঊর্ধ্বমুখী পণ্যমূল্যের কারণে ধুকতে থাকা সাধারণকে স্বস্তি দিতে মূল্য নিয়ন্ত্রণের তেমন পদক্ষেপের ঘোষণা দেননি। উল্টো কিছু ক্ষেত্রে কর ও শুল্ক বাড়িয়ে তাদের খরচের বোঝা বাড়িয়েছেন। অতি দরিদ্রদের সহায়তায় সরকারের এগিয়ে আসার পদক্ষেপ দৃশ্যমান হয়নি, যদিও কিছু ভাতা ও উপকারভোগীর সংখ্যা সামান্য বাড়ানো হয়েছে।
এসব বিবেচনায় নিয়ে অর্থনীতিবিদ সেলিম রায়হান মনে করছেন, প্রস্তাবিত বাজেটের ‘ফোকাস’ই ঠিক নেই। এটা ‘সময়োপযোগী বাজেট হয়নি’ বলে মন্তব্য এসেছে আরেক অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেনের কাছ থেকে।
বৃহস্পতিবার অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল জাতীয় সংসদে দেশের ৫২তম বাজেট উপস্থাপন করেন। টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন সরকারের শেষ বাজেট এবং অর্থমন্ত্রী হিসেবে তার পঞ্চম বাজেট।
সরকারের স্মার্ট বাংলাদেশ রূপরেখার বাস্তবায়নের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে এবার তিনি আগামী অর্থবছরের বাজেটে ‘উন্নয়নের অভিযাত্রায় দেড় দশক পেরিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা’ এর কথা তুলে ধরেন।
দীর্ঘ বাজেট উপস্থাপনকালে তিনি বাংলাদেশ আজ বিশ্বের উন্নয়ন-প্রত্যাশী দেশসমূহের জন্য এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচিত হওয়ার দাবি তুলে ধরেন।
দেশের আর্থসামাজিক খাতে অগ্রগতির কথা তুলে ধরেন তিনি লম্বা বাজেট বক্তৃতার বিভিন্ন পর্যায়ে। দেশের সার্বিক চিত্র তুলে ধরে বর্তমান সরকারের কয়েক বছরের উন্নয়ন কার্যক্রম, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মৃত্যু হার হ্রাস, দারিদ্র হ্রাস, সুশাসন প্রতিষ্ঠার কথা বলেন।
একই সঙ্গে বিভিন্ন দেশের সরকারপ্রধানসহ সংবাদ মাধ্যমে বাংলাদেশের সাফল্যের প্রশংসা করে দেওয়া বক্তব্য তুলে ধরেন বক্তৃতায়। বিশেষ করে গত দেড় দশকে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ অর্জনগুলো প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্নের ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ এর ভিত রচনা করেছে।
২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ হওয়ার মাধ্যমে উন্নত দেশে পরিণত হবে। তার আশা, ওই বাংলাদেশ মাথাপিছু আয় হবে সাড়ে ১২ হাজার ডলার, দারিদ্রসীমার নিচে থাকবে ৩ শতাংশের কম মানুষ আর চরম দারিদ্র নেমে আসবে শূন্যের কোঠায়। বাজেট ঘাটতি থাকবে ৫ শতাংশের নিচে এবং রাজস্ব-জিডিপ অনুপাত হবে ২০ শতাংশের ওপরে।
পেপারলেস ও ক্যাশলেস সোসাইটির সেই বাংলাদেশে স্বয়ংক্রিয় যোগাযোগ ব্যবস্থা, সকলের কাছে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে যাবে।
তবে এ স্বপ্নযাত্রার পথে বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটের কথা সেভাবে উঠে আসেনি। চলমান এ সংকট সমাধান কীভাবে তাও নেই বলে মনে করছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডি। মূল্যস্ফীতির উচ্চ হার ৬ শতাংশে নামিয়ে আনাকেও উচ্চাভিলাষী বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
আইএমএফের ছাপ
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরামর্শ মেনে অর্থমন্ত্রী বাজেটে আর্থিক খাতসহ বিভিন্ন ধরনের সংস্কারের ঘোষণা দিয়েছেন।
অর্থনীতির চাপ কাটাতে সংস্থাটির কাছ থেকে নেওয়া ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণের পরবর্তী কিস্তি পেতে বাজেট প্রণয়নের পরিকল্পনায় আন্তর্জাতিক অর্থায়নকারী সংস্থাটির দেওয়া পরামর্শের ছাপ দেখা গেছে।
অর্থমন্ত্রী বলেছেন, “আর্থিক খাতে সুশাসন ও দক্ষ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকার কাজ করছে।’’
কর ব্যবস্থাপনায় সংস্কার, কর অব্যাহতি না দেওয়া, ভর্তুকি কমানো, কর-জিডিপি অনুপাত বাড়ানো, জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয়ে বাজারভিত্তিক কৌশল, বাজারভিত্তিক সুদহার নির্ধারণে সরকার সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে বলে ঘোষণা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী।
বাজেট ঘাটতি কমিয়ে আনতে ছাড় সুবিধা বাতিল করে রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধি করে কর জিডিপি অনুপাত শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ বৃদ্ধি ও আর্থিক খাত সংস্কারের যে পরামর্শ দিয়েছিল আইএমএফ; তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ভুর্তকি পর্যায়ক্রমে কমিয়ে আনার ঘোষণা এসেছে তার কাছ থেকে।
এছাড়াও একাধিক বিনিময় হারের ব্যবধান কমিয়ে আনা, রিজার্ভ বাড়াতে সাশ্রয়ী অর্থায়ন সংগ্রহ, বিদেশ ভ্রমণে কর বৃদ্ধি ও খেলাপি ঋণ পরিস্থিতি উন্নয়নে ব্যাসেল-৩ বাস্তবায়নের ঘোষণাও দিয়েছেন তিনি।
বাজেট বক্তৃতায় কামাল বলেন, “অপরিহার্য কোনো কারণ ব্যতীত আমরা কর অব্যাহতির এসআরও জারি করা পরিহার করব।”
আইএমএফের পরামর্শে বাংলাদেশ ব্যাংক ছয় মাস অন্তর অন্তর মুদ্রানীতি ঘোষণা করার রীতিও ফিরিয়ে আনে। মুদ্রানীতির প্রক্ষপণ বাজারভিত্তিক ও স্বচ্ছ করতেও পরামর্শ রয়েছে সংস্থাটির।
সেই আলোকে বাজেটেও মুদ্রানীতিতে পরিবর্তনের ঘোষণা দিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, সামষ্টিক অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা ও উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনে মুদ্রানীতিতে সময়োপযোগী পরিবর্তন আনা হচ্ছে।
প্রস্তাবিত বাজেটে আইএমএফের পরামর্শের ছাপ যেমন সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী বিএনপি নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী দেখছেন, তেমনি দেখেছে গবেষণা সংস্থা সিপিডিও।
আমীর খসরুর মতে, সরকার আইএমএফের ‘শর্তের কারণেই’ নানা সংস্কারের কথা এখন বলেছে।
মূল্যস্ফীতি কমানো, জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে উচ্চাভিলাষ
অর্থনীতির বর্তমান সংকটের পেছনে মূল ভূমিকা রাখা মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপট তুলে ধরে অর্থমন্ত্রী বলেন, মূল্যস্ফীতি ছাড়াও বর্ধিত আমদানি ব্যয় বাংলাদেশের আমদানি-নির্ভর অর্থনীতির ওপর নানাভাবে চাপ সৃষ্টি করছে।
মূল্যস্ফীতির উচ্চ হারে ভুগছে মানুষ। তবে তা মোকাবেলায় বাজেটে জোরালো পদক্ষেপ নেই। এর বিপরীতে জ্বালানি তেল, বিদ্যুতে ভুর্তকি তুলে দেওয়ার ইঙ্গিত দিয়ে দাম সমন্বয়ে ফর্মুলার কথা বলেছেন।
পণ্যমূল্যের দামে সাধারণের দিশেহারা অবস্থার মধ্যে এ থেকে মুক্তি পেতে দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষের সহায়তায় তেমন পদক্ষেপ দেখা যায়নি। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী খাতে ব্যয় বেড়ে ১ লাখ ২৬ হাজার ১৭২ কোটি টাকার প্রস্তাবের মধ্যে বিধবাদের জন্য ৫০ এবং বয়স্কদের জন্য ১০০ টাকা ভাতা বাড়ানোর প্রস্তাব করেছেন। একে খুবই অপ্রতুল বলেছেন অর্থনীতিবিদরা। সংখ্যা বাড়লেও গরিবদের সহায়তায় আওতায় বাড়ানো হয়নি।
তবে ২০২২ সাল থেকে মূল্যস্ফীতি বাড়তে থাকলে সাধারণ ব্যক্তি করদাতাদের করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানোর দাবি এবার তিনি কিছুটা মেনে তিন লাখ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে তিন লাখ টাকা করেছেন। তবে মূল্যস্ফীতির উচ্চ হারের মধ্যে তা কতটুকু স্বস্তি দেবে সীমিত আয়ের মানুষকে তা নিয়ে সন্দিহান অনেকেই; যেখানে মুদ্রাস্ফীতির কারণে করদাতাগণের প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছে বলে খোদ অর্থমন্ত্রীর স্বীকারোক্তিই এসেছে।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ভর্তুকি ছাড়া আর কোনো কৌশলের ঘোষণা আসেনি। আবার আইএমএফের শর্তের কারণে চাইলে ভর্তুকি খুব বেশি বাড়ানোর পথে যেতে পারেননি তিনি।
অপরদিকে ধনীদের সম্পদে সারচার্জ আরোপের নিম্নসীমা এক কোটি টাকা বাড়িয়ে সম্পদশালীদের খুশি করার চেষ্টা দেখা গেছে। তিনি কর বাড়ানোর কথা বললেও করপোরেট করে হাত দেননি। ব্যবসায়ীদের বিভিন্নভাবে কর ছাড় দেওয়া হয়েছে। স্থানীয় শিল্পকে সংরক্ষণে আমদানিতে সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। প্রণোদনাও থাকছে অনেক খাতে। এবারও ব্যবসায়ীবান্ধব বাজেট প্রণয়ন করেছেন তিনি।
ভর্তুকি বাড়িয়ে যেমন স্বস্তি দেওয়ার চেষ্টা দেখা যায়নি, তেমনি মোবাইল ফোন, প্লাস্টিক পণ্য, টিস্যু, কলম, অ্যালুমিনিয়াম পণ্য, বাইসাইকেল লিফটে করারোপের পাশাপাশি ভ্রমণ কর বাড়িয়ে সাধারণের খরচ বাড়ানোর পথ তৈরি করেছেন। এতে বাজেট কতটা জনবান্ধব হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
তবে ম্যালেরিয়া, যক্ষ্মা ও ক্যান্সারসহ বিভিন্ন রোগের ওষুধে করছাড়ের প্রস্তাব দিয়ে স্বাস্থ্যসেবায় খরচ কমানোর কথা বলেছেন। অন্যদিকে একাধিক গাড়ির ক্ষেত্রে পরিবেশ সারচার্জ আরোপের নতুন বিষয় যুক্ত করার প্রস্তাব করে আয় বাড়ানোর চেষ্টা দেখা গেছে নতুন বাজেটে।
কোভিড পরবর্তী সময় থেকে শুরু হওয়া সংকটের কথা তুলে ধরেন অর্থমন্ত্রী। মহামারীর রেশ না কাটতেই আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়া, রপ্তানি ও রেমিটেন্সে ধীরগতিতে বাণিজ্য ঘাটতি ও চলতি লেনদেন ভারসাম্যের ঘাটতি বাড়িয়েছে। এর কারণে তীব্র ডলার সংকট তৈরি হয়েছে। অর্থনীতিতে তৈরি হওয়া এ সংকট কাটানোর উপায়গুলো তুলে ধরেননি তিনি। এগুলো মোকাবেলার ক্ষেত্রে সমন্বিত পদক্ষেপ তেমন চোখে পড়েনি।
প্রস্তাবিত বাজেটে অর্থনীতির প্রয়োজনীয় সংস্কারে তেমন পদক্ষেপ নেই বলেও মন্তব্য করেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন। তিনি বলেন, “এই বাজেট এমন এক সময়ে এসেছে যখন আইএমএফের কিছু শর্ত বহাল রয়েছে, যেহেতু তারা ঋণ দেবে। বাজেট ডকুমেন্টে তিন বার আইএমএফের কথা বলা হলেও তাদের শর্তগুলোর ব্যাপারে পরিষ্কারভাবে কিছু বলা হয়নি। কিন্তু আমরা দেখেছি, বিভিন্ন লক্ষ্যমাত্রা যেগুলো আছে সেখানে কিন্তু এসব শর্ত পালনের ইঙ্গিত রয়েছে।”
বাজেটে আইএমএফের শর্তগুলোও ‘অতিরঞ্জিত’ করে প্রয়োগ করা হয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্ব ব্যাংকের সাবেক অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন। তার ভাষ্যে, “আইএমএফ বলছে ভর্তুকি যৌক্তিকীকরণ করতে হবে, কিন্তু বাজেটে যৌক্তিকীকরণের কিছু তো দেখছি না।”
মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার কথা বলা হলেও তা কীভাবে হবে, তা খুঁজে না পাওয়ার কথা বললেন সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান।
“গত এক বছর ধরে যে পদক্ষেপগুলো নেওয়া হয়েছে, সেগুলো কার্যকর হয়নি। যেগুলো নেওয়ার প্রয়োজন ছিল, সেগুলো নেয়নি। তাহলে আমরা কীভাবে বুঝব যে পরবর্তী অর্থবছরে কিছু উদ্যোগ নেওয়া হবে, যাতে ইনফ্লাশন কমে আসবে। এগুলো বাজেটে একদমই আলোচনায় নেই।”
‘স্মার্ট’ হওয়ার অভিযাত্রায় বাজেটে ব্যয় বাড়ল ১৫%
বাজেট ২০২৩-২৪: যেসবের দাম বাড়ছে, যেসবের কমছে
সাড়ে ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত আয় করমুক্ত, প্রস্তাব বাজেটে
আইএমএফের শর্তে সংস্কারের উদ্যোগ, কমছে ভর্তুকি
তবে অর্থমন্ত্রী আশা করছেন বিশ্ব অর্থনীতির অনুকূল পরিবর্তন বাংলাদেশের পক্ষে যাবে। তিনি বলেন, কোভিড পরিস্থিতির সার্বিক উন্নয়নে দেশের অভ্যন্তরে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে পূর্ণ গতি সঞ্চার হয়েছে। এছাড়াও অর্থবছরের শেষাংশে কৃষিখাতে ভাল ফলন আসছে।
পাশাপাশি উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ ও উৎপাদশীলতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এবং সুসংহত অভ্যন্তরীণ চাহিদার কল্যাণে পূর্বের ধারাবাহিকতায় আগামী অর্থবছরে উচ্চ প্রবৃদ্ধির ধারায় ফেরার আশা প্রকাশ করে মুস্তফা কামাল সাড়ে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের আশা প্রকাশ করেন।
এর ব্যাখ্যায় তিনি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ক্রমান্বয়ে কৃচ্ছসাধন নীতি থেকে বের হয়ে আসার কথা বলেছেন।
তিনি বলেন, মেগাপ্রকল্পসহ প্রবৃদ্ধি সঞ্চারক চলমান ও নতুন প্রকল্পে বিনিয়োগ করব। এ উদ্দেশ্যে আগামী জিডিপির ৬.৩ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
স্বাস্থ্যের বরাদ্দে বিশেষজ্ঞরা অখুশি
রিটার্ন দাখিলে দিতে হবে অন্তত ২০০০ টাকা, প্রস্তাব অর্থমন্ত্রীর
দেশে সংযোজিত মোবাইল ফোনের দাম বাড়ছে
একইসঙ্গে, বিনিয়োগ অনুকূল পরিবেশ তৈরি, যেমন- নিষ্কন্টক জমি, উন্নত অবকাঠামো, নিরবচ্ছিন্ন ইউটিলিটি, আর্থিক প্রণোদনা ও সহজ ব্যবসায়িক প্রক্রিয়া ইত্যাদি সুযোগ সুবিধাসহ অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগ সুবিধা প্রদানের কথা বলেন।
আয়ের চেয়ে বাড়তি ব্যয়ের হিসাব
দেশের অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট অর্থমন্ত্রীকে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ছয় মাস আগে বর্তমান সরকারের এ মেয়াদের শেষ বাজেটে খুব বেশি বড় বাজেট করার বিলাসিতা দেখাতে দেয়নি। তবে আয় কম হওয়ায় বরাবরের মতো ব্যয়ের বিশাল চাপ সামলানোর চিন্তা করতে হয়েছে। সংকটকাল বলে অন্য সময়ের নির্বাচনকালীন বাজেটের মতো জনতুষ্ঠির পথে যেতে পারেননি তিনি।
ব্যয় অর্থাৎ বাজেটের আকার: ৭,৬১,৭৮৫ কোটি টাকা, জিডিপির ১৫.২%
পরিচালন/অনুন্নয়ন ব্যয়: ৪,৩৬,২৪৭ কোটি টাকা
উন্নয়ন ব্যয়: ২,৬৩,০০০ কোটি টাকা
ভর্তুকি: ১,১০,৯৮৭ কোটি টাকা, জিডিপির ২.২%
আয়- মোট রাজস্ব: ৫ লাখ কোটি টাকা
বাজেট ঘাটতি: ২,৬১,৭৮৫ কোটি টাকা, জিডিপির ৫.২%
অভ্যন্তরীণ আয়: ১,৫৫,৩৯৫ কোটি টাকা
ব্যাংক ঋণ: ১,৩২,৩৯৫ কোটি টাকা
বৈদেশিক উৎস: ১ লাখ ২ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা
বরাবরের মত রাজস্ব আয়ে উচ্চাশা
আগামী অর্থবছরেও বিশাল রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছেন অর্থমন্ত্রী। এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে আবারও পরোক্ষ কর বাড়ানোর পথে যাচ্ছে সরকার। এতে কর-শুল্ক বাড়ায় সাধারণের ওপর চাপ বাড়বে।
এবারও রিটার্ন বাড়ানোর মাধ্যমে আয়কর থেকে কর বাড়ানোর ওপর জোর দিয়েছেন। ৮৮ লাখ টিআইএনধারীর মধ্যে এবার ২৫ শতাংশ বেড়ে রিটার্ন দাখিল হয়েছে ৩২ লাখ। তবে সব টিআইএনধারীকে করের আওতায় আনতে তিনি দুই হাজার টাকা ন্যূনতম কর চাপানোর প্রস্তাব করেছেন। এতে সরকারের রাজস্ব বাড়লেও সাধারণের ওপর চাপ তৈরি করবে।
আয়- মোট রাজস্ব: ৫ লাখ কোটি টাকা
এনবিআরের রাজস্ব: ৪,৩০,০০০ কোটি টাকা
প্রত্যক্ষ কর: ১,৭৮,০০০ কোটি টাকা
পরোক্ষ কর: ২,৫২,০০০ কোটি টাকা
আয়কর-মুনাফা: ১,৫৩,২৬০ কোটি টাকা
আমদানি শুল্ক-কর: ১,১২,৯০৩ কোটি টাকা
টিআইএন: ৮৮ লাখ (হালনাগাদ)
রিটার্ন দাখিল: ৩২ লাখ (হালনাগাদ)
এত অর্থ কীভাবে আদায় হবে সে প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “স্বল্পোন্নত দেশ হতে উত্তরণ পরবর্তী সময়ের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণ, ব্যয় দক্ষতা বৃদ্ধি ও সাশ্রয়ী অর্থায়নের দেশি-বিদেশি উৎস অনুসন্ধান হবে রাজস্ব খাতের নীতি-কৌশল। রাজস্ব আহরণে সকল সম্ভাবনাকে আমরা কাজে লাগাতে চাই।
“রিটার্ন দাখিল পদ্ধতি সহজীকরণসহ অন্যান্য সংস্কারের মাধ্যমে কর নেট সম্প্রসারণ, কর অব্যাহতি যৌক্তিকীকরণ, স্বয়ংক্রিয় ও স্বচ্ছ পদ্ধতিতে মূল্য সংযোজন কর আদায় সহায়ক ইলেক্ট্রনিক ফিসকাল ডিভাইস স্থাপন ও সম্প্রসারণ, অনলাইনে ভ্যাট নিবন্ধন, কর প্রশাসনের অটোমেশন ইত্যাদি কার্যক্রমের মাধ্যমে কর রাজস্ব আদায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি করা হবে।”
রাজস্ব আহরণের ক্ষেত্রে আইএমএফের পরামর্শ মেনে তিনি রাজস্ব খাতে সংস্কারের মাধ্যমে কর-জিডিপি অনুপাত বাড়ানোর কথা বলেছেন।
করের লক্ষ্য পূরণ কঠিন হবে: এফবিসিসিআই
আয়কর আদায় বাড়াতে নিয়োগ হচ্ছে এজেন্ট
সংকটের প্রতিফলন বাজেটে নেই: সিপিডি
বাজারভিত্তিক সুদহার ও মুদ্রানীতির কাঠামো বদলের ঘোষণা বাজেটে
বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতির (এফবিসিসিআই) সভাপতি জসিম উদ্দিন বলেছেন, “আমার কাছে মনে হয়েছে, ২০৪১ সাল এবং এলডিসি (স্বল্পোন্নত দেশের থেকে উত্তরণ) গ্র্যাজুয়েশনকে মাথায় রেখে বাজেট ঘোষণা করেছেন। সেখানে চ্যালেঞ্জ অবশ্যই আছে, কালেকশনটা চ্যালেঞ্জ হতে পারে।”
রিটার্ন দাখিলে দুই হাজার টাকা কর বসানো প্রসঙ্গে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক সদস্য আলী আহম্মেদ একটি টেলিভিশনে প্রতিক্রিয়ায় বলেন, “এ রকম এক্সপেরিমেন্ট করার চেয়ে, আমাদের যেখানে টাকা আছে, যেখান থেকে কর আসতে পারে। খুব সাহস করে সেইসব জায়গা কি আমরা ধরতে পারব? সরকারের সেই রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকা কি থাকা সম্ভব হবে? বিশেষ করে, নির্বাচনের বাজেটে। নির্বাচন এই বাজেটের মধ্যেই হচ্ছে।”
কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগ
ঘাটতি মেটাতে সরকারের বিপুল ব্যাংক ঋণের কারণে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ চাহিদা বাড়লে তাতে উদ্যোক্তাদের ঋণ কমলে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাধাগ্রস্ত হবে। বিনিয়োগ আকর্ষণে করপোরেট করে আরও ছাড়ের দাবি থাকলেও তাতে সায় দেননি অর্থমন্ত্রী।
বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে রপ্তানি কমলেও তা বাড়াতেও বিশেষ পদক্ষেপ তুলে ধরা হয়নি। আর কর্মসংস্থান বাড়ানোর কথা বললেও এ বিষয়ে বিশেষ ঘোষণা বা নীতি সহায়তা নেই।
একাধিক গাড়ি থাকলে গুনতে হবে পরিবেশ সারচার্জ
করারোপ ‘বাড়াবে’ বাড়ি-ফ্ল্যাটের খরচ
সর্বজনীন পেনশন নতুন অর্থবছরেই, আশা অর্থমন্ত্রীর
মানবসম্পদ উন্নয়নের মাধ্যমে দেশের জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগাতে দীর্ঘদিন থেকে বিনিয়োগ করার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের। তবে বাজেট বরাদ্দের অংশ হিসেবে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে বরাদ্দ বাড়লেও এতে সন্তুষ্ট নন সংশ্লিষ্টরা। আয়-ব্যয়ের বিশাল হিসাবের ফর্দ মেলাতে গিয়ে অর্থমন্ত্রীর ইচ্ছা থাকলেও এদিকটায় খুব বেশি জোর দিতে পারেন না। তেমনি স্মার্ট বাংলাদেশের যে স্বপ্নযাত্রার কথা বাজেট বক্তৃতাজুড়ে তিনি তুলে ধরেছেন তার কতটুকু বাস্তবায়নের পথে নিয়ে যেতে পারবেন এখন সেই চ্যালেঞ্জ নিতে হবে তাকে।
[প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন ফয়সাল আতিক, শেখ আবু তালেব, জাফর আহমেদ, গোলাম মতুর্জা অন্তু, মাসুম বিল্লাহ, শহীদুল ইসলাম, শাহরিয়ার নোবেল, কাজী নাফিয়া রহমান, মরিয়ম সুলতানা]