স্বাস্থ্যের বরাদ্দে বিশেষজ্ঞরা অখুশি

“স্বাস্থ্য খাতের কিছু জায়গায় উন্নয়ন খুব জরুরি,” বলেন লেনিন চৌধুরী।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 June 2023, 06:32 PM
Updated : 1 June 2023, 06:32 PM

নতুন অর্থবছরের জন্য স্বাস্থ্য খাতে যে বাজেট প্রস্তাব করা হয়েছে তা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

তাদের ভাষ্য, দেশের দুর্বল স্বাস্থ্যখাতকে পথ দেখাতে বাজেটে বরাদ্দ বাড়ানোর পাশাপাশি সংস্কার আনা জরুরি ছিল। সেই বাস্তবতায় এবার যে বরাদ্দ এসেছে তাতে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ হবে না।

২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য স্বাস্থ্যখাতে ৩৮ হাজার ৫২ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, যা মোট বাজেটের ৫ শতাংশ।

বিদায়ী অর্থবছরের মূল বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ ছিল ৩৬ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা বা মোট বাজেটের ৫.৪ শতাংশ। পরে সংশোধনে তা ২৯ হাজার ৭৪৯ কোটি টাকা বা ৪.৫ শতাংশে নেমে আসে।  

টাকার অংকে বরাদ্দ সামান্য বাড়লেও তাতে সন্তুষ্ট নয় জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তাদের একজন লেলিন চৌধুরী বলেন, “কোভিড দুর্যোগের সময় স্বাস্থ্য খাতের নাজুক অবস্থা সামনে আসে এবং কোন কোন জায়গায় সংস্কার প্রয়োজন তাও ধরা পড়ে।

“সেই জায়গা থেকে আমাদের প্রত্যাশা ছিল, এবারের স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দটা এমন হবে যেটি স্বাস্থ্যসেবায় জনগণের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে পারে, যেটা আমরা ভারত বা অন্যান্য দেশে দেখতে পারি। স্বাস্থ্য খাতের কিছু জায়গায় উন্নয়ন খুব জরুরি।”

স্বাস্থ্য খাতে প্রস্তাবিত বরাদ্দের মধ্যে ৮ হাজার ৬২১ কোটি টাকা রাখা হয়েছে স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের জন্য। আর স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের জন্য রাখা হয়েছে ২৯ হাজার ৪৩১ কোটি টাকা।

আর বরাদ্দের ২২ হাজার ৫৮৮ কোটি টাকা খরচ হবে খাতটির পরিচালন বাবদে, বাকি ১৫ হাজার ৪৬৪ কোটি টাকা ব্যয় হবে উন্নয়নে।

বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল জানিয়েছেন, সাধারণ জনগণের জন্য উন্নত চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সকে ৫০ শয্যা থেকে ১০০ শয্যায়, ৬টি জেলা সদর হাসপাতালকে ১০০ শয্যা থেকে ২৫০ শয্যায় উন্নীত করা হবে।

আর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শয্যা ১ হাজার ৩১৩ থেকে ২ হাজার ২০০ শয্যায়, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে শয্যা সংখ্যা ৪১৪ থেকে ১ হাজার ২৫০-তে উন্নীত করা হবে।

তাছাড়া ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজির ২০০ শয্যাকে ৫০০ শয্যায়, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ২০০ শয্যাকে ৪০০ শয্যায় উন্নীত করা হবে।

আগামী অর্থবছরের বাজেটে স্বাস্থ্য খাত পেয়েছে জিডিপির দশমিক ৭৬ শতাংশ, যেখানে চলতি অর্থবছরের সংশোধিত জিডিপিতে এই হার দশমিক ৬৭ শতাংশ।

লেনিন চৌধুরী বলেন, “বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আমাদের মত দেশগুলোতে জিডিপির ৫ শতাংশ বরাদ্দের সুপারিশ করে, গত ১২/১৩ বছর যাবত জিডিপির ১ শতাংশের কম দেওয়া হচ্ছিল। এবার সেটা আরও কমেছে।”

গত জানুয়ারিতে সরকারের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের ‘বাংলাদেশ ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্টস ১৯৯৭-২০২০’ প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে প্রতিবছরই চিকিৎসায় সরকারি ব্যয় কমছে, বিপরীতে ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় বাড়ছে। ২০২০ সালে স্বাস্থ্য ব্যয়ে সরকারি খরচ ছিল ২৩ শতাংশ, যেখানে সেবা নিতে ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় ছিল ৬৯ শতাংশ।

আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশে চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে প্রতিবছর ৫০ লাখের বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাচ্ছে।

লেলিন চৌধুরী বলেন, বাজেটে বরাদ্দ এমন হওয়া উচিত যেন চিকিৎসা সেবা নিতে সাধারণ মানুষের পকেটের খরচটা কমে আসে।

“প্রতিবছর প্রায় ৬০ লাখ মানুষ ক্যান্সারসহ জটিল রোগের চিকিৎসা নিতে দরিদ্রসীমার নিচে চলে যায়। এই মানুষগুলোকে যেন দরিদ্রসীমার নিচে যেতে না হয়, সে ব্যবস্থা নিতে হবে। কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো যথার্থভাবে কার্যকর করার জন্য একদিকে জনবল দরকার, অন্যদিকে  লজিস্টিক সাপোর্ট দরকার। এ দেশের মানুষকে পরিপূর্ণ চিকিৎসা দেওয়ার জন্য যতজন চিকিৎসক থাকা দরকার, তার অর্ধেক রয়েছে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ লেনিন বলেন, “একজন চিকিৎসকের বিপরীতে তিনজন নার্স থাকা দরকার। দুইজন চিকিৎসকের জন্য একজন নার্স রয়েছে। একজন চিকিৎসকের বিপরীতে পাঁচজন টেকনিশিয়ান থাকা দরকার, সেটিও নাই। সেই পরিকল্পিত জনবল গড়ে তোলার একটি রূপরেখা আমরা এই বাজেটে পাব বলে ভেবেছিলাম- কোনোটিই পাইনি।”

এই চিকিৎসক বলেন, “যে বাজেট দেওয়া হচ্ছে তাতে- স্বাস্থ্য সেবায় নিজস্ব খরচ একদিকে বেড়ে যাবে এবং স্বাস্থ্যখাতে অপ্রতুলতা তৈরি হবে। এবারের বাজেটের মধ্য দিয়ে আমরা স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অবনমনই লক্ষ্য করছি। জিডিপির ২ শতাংশ বা বাজেটের ১০ শতাংশ বরাদ্দ থাকা দরকার ছিল।”

বাজেটে কম বরাদ্দের পাশাপাশি তা খরচে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দক্ষতা ও সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। প্রতি বছরই স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ ফেরত যাচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে লেলিন চৌধুরী বলেন, “এই বাজেটটি কাজে লাগানোর জন্য একটি সামর্থ্যবান স্বাস্থ্য বিভাগ পরিধিতে ও বিস্তৃতিতে গড়ে তোলা দরকার ছিল। সেটাও আমরা এই বাজেটে দেখিনি।”