করের লক্ষ্য পূরণ কঠিন হবে: এফবিসিসিআই

করমুক্ত আয়সীমা বাড়ায় সন্তোষ প্রকাশ করলেও আয়কর বিবরণী দাখিলে দুই হাজার টাকা ন্যূনতম কর আদায়ের প্রস্তাব নিয়ে আপত্তি জানিয়েছেন ব্যবসায়ী নেতারা। 

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 June 2023, 05:20 PM
Updated : 1 June 2023, 05:20 PM

মোট খরচের ৫৬.৪৪ শতাংশ এনবিআরের মাধ্যমে কর হিসেবে সংগ্রহ করার লক্ষ্য ধরে নতুন অর্থবছরের যে বাজেট প্রস্তাব অর্থমন্ত্রী দিয়েছেন, সেই লক্ষ্য পূরণ কঠিন হবে এবং কম আয়ের মানুষের ওপর করের বোঝা বাড়বে বলে মনে করছেন দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতারা।  

বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতির (এফবিসিসিআই) সভাপতি জসিম উদ্দিন বলেছেন, “আমার কাছে মনে হয়েছে, ২০৪১ সাল এবং এলডিসি (স্বল্পোন্নত দেশের থেকে উত্তরণ) গ্র্যাজুয়েশনকে মাথায় রেখে বাজেট ঘোষণা করেছেন। সেখানে চ্যালেঞ্জ অবশ্যই আছে, কালেকশনটা চ্যালেঞ্জ হতে পারে।” 

বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার এই বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।

এর মধ্যে ৫ লাখ ৩ হাজার ৯০০ কোটি টাকা তিনি রাজস্ব খাত থেকে যোগান দেওয়ার পরিকল্পনা সাজিয়েছেন।

এর ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মাধ্যমে কর হিসেবে আদায় করার আশা করছেন তিনি। ফলে এনবিআরের কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ছে ১৬ শতাংশের বেশি। টাকার ওই অংক মোট বাজেটের ৫৬.৪৪ শতাংশের মত।

এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, “আমাদের ফরেন কারেন্সি যেহেতু এক্সপোর্ট ও রেমিটেন্সের ওপর নির্ভরশীল, সেখানে আমাদের ফরেন কারেন্সির প্রাইসটা কোথায় পর্যন্ত যাবে আমরা জানি না। এগুলোকে যদি আমরা ঠিক রাখতে পারি... বাজেটে কালেকশন যদি না হয় তাহলে এক্সপেনডেচার তো ডিফিকাল্ট।” 

তিনি বলেন, “টার্গেট অ্যাচিভ করতে হলে এক্সপেনডেচারে যেতেই হবে। সেক্ষেত্রে আমাদের কালেকশন বাড়াতেই হবে। বাড়ানোর জন্য আমরা সব সময় যেটি বলি, এক জায়গায় সীমাবদ্ধ না থেকে জাল বিস্তৃত করা। সহজে যেসব জায়গা থেকে ট্যাক্স কালেকশন করা যায়—ভ্যাট সোর্স, অগ্রিম আয়কর (এআইটি), অ্যাডভান্স ভ্যাট; এগুলো কম করে বরং নতুনদের কারের আওতায় নিয়ে আসা…।” 

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি সামির সাত্তারের মতে, কামাল এবার যে বাজেট দিয়েছেন, তা ‘হাইব্রিড বাজেট’। 

“এখানে ব্যবসার দিকেও খেয়াল করা হচ্ছে, অর্থনীতির দিকেও খেয়াল করা হচ্ছে। আমরা একটি চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, যেটি সরকারের একা সামাল দেওয়া সম্ভব না। কম আয়ের মানুষের ওপর করের বোঝা তৈরি হয়ে যাবে।”  

বাজেট প্রস্তাব অনুযায়ী ২৩৪ আমদানি পণ্যের সম্পূরক শুল্ক (এসডি) ও ১৯১ আমদানি পণ্যের নিয়ন্ত্রক শুল্ক (আরডি) প্রত্যাহারের প্রস্তাবে স্থানীয় শিল্প প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে মনে করছে এফবিসিসিআই। 

করমুক্ত আয়সীমা সাড়ে তিন লাখ টাকা করায় ব্যবসায়ী নেতারা সন্তোষ প্রকাশ করলেও আয়কর বিবরণী দাখিলে দুই হাজার টাকা করে ন্যূনতম কর আদায়ের প্রস্তাব নিয়ে তারা আপত্তি জানিয়েছেন।   

এসডি ও আরডি প্রত্যাহার নিয়ে উদ্বেগ এফবিসিসিআই এর 

২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে ২৩৪ আমদানি পণ্যের সম্পূরক শুল্ক (এসডি) এবং ১৯১ আমদানি পণ্যের নিয়ন্ত্রক শুল্ক (আরডি) প্রত্যাহারের প্রস্তাবে স্থানীয় শিল্প প্রতিষ্ঠান ভোগান্তিতে পড়বে মনে করছে এফবিসিসিআই। 

বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে এসে এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বলেন, “এই জায়গাটা দেখা দরকার। কারণ এটা হলে তো লোকাল ইন্ডাস্ট্রি সাফার করতে পারে। এগুলো করা হয়েছে হয়ত এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের রোডম্যাপের কারণে। এই মুহূর্তে আমাদের ডলারের যে সংকট, এই সংকটের সময় আমরা বিদেশি পণ্য আনতে চাই কি চাই না, সেটা লোকাল ইন্ড্রাস্ট্রিকে প্রাধান্য দিয়েই কিন্তু আমাদের এগোতো হবে।” 

ডলার সংকটের কারণে ব্যবসায়ীরা যে অনেক পণ্য আনতে পারছেন না, সে কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “আমরা বলেছিলাম, ইম্পোর্ট সাবস্টিটিউট আইটেমকে প্রাধান্য দেওয়ার জন্য। ইম্পোর্ট সাবস্টিটিউট আইটেম বাংলাদেশে আমরা যত বেশি উৎপাদন করতে পারি, ততবেশি আমাদের ইম্পোর্টের উপর চাপ কমবে।” 

কাঁচামাল ও মূলধনী যান্ত্রপাতির ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদী নীতি সহায়তার প্রত্যাশা জানিয়ে এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, “আমরা বলছি আমাদের লোকাল ইন্ডাস্ট্রিকে প্রাধান্য দিতে। সেটা যদি করি তাহলে আগামী দুই বছর পর দেখা যাবে আমাদের অনেক আইটেম আছে, যেগুলো ইম্পোর্ট করতে হবে না। তখন কিন্তু আমাদের ডলারের সংকট ঘোচাতে পারি।” 

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, পুরো বাজেটের তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে শনিবারের মধ্যে বিস্তারিত প্রতিক্রিয়া জানাবে এফবিসিসিআই। 

সভাপতি বলেন, “আমরা তো পুরো বাজেট এখনো পড়তে পারি নাই। তাৎক্ষণিকভাবে আমাদের যা মনে হয়েছে, বাজেটটাতে লং টার্ম ভিশন রয়েছে। কিন্তু আমরা প্রতিনিয়ত ব্যবসা বাণিজ্য নিয়ে যে ট্যাক্স-ভ্যাট আরোপ করা হয়, সেগুলো আমরা পর্যালোচনা করতে পারিনি। আগামী দিন আমাদের এক্সপার্ট কমিটির মিটিং আছে। আশা করি, শনিবারে আমরা ডিটেইল বলতে পারব।” 

রিটার্ন দিলেই আয়করের প্রস্তাব প্রত্যাহার চায় ডিসিসিআই 

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল যে প্রস্তাব করেছেন, তাতে করমুক্ত সীমার নিচে থাকলেও আয়কর বিবরণি দাখিলে টিআইএনধারীকে ২ হাজার টাকা গুনতে হবে আগামী অর্থবছর থেকে। বাজেটের এ প্রস্তাব প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছে ডিসিসিআই। 

বৃহস্পতিবার রাতে এক সংবাদ সম্মেলনে ডিসিসিআইয়ের সভাপতি সামির সাত্তার বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যক্তি শ্রেণির করমুক্ত আয়সীমা সাড়ে তিন লাখ টাকা করা হয়েছে। তবে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় নিয়ে সেটাকে পাঁচ লাখ টাকা করা প্রয়োজন বলে মনে করেন তারা। 

সামির সাত্তার বলেন, ভ্যাট টার্নওভারের সীমা বৃদ্ধিসহ ভ্যাট রিটার্ন ও অডিট প্রক্রিয়া অটোমেশনের করা প্রয়োজন। এছাড়া রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এবং ব্যবসায়ীদের মধ্যে অংশীদারিত্ব বাড়াতে হবে। 

“মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, রাজস্ব বৃদ্ধি, আমদানি নির্ভরতা কমানো, প্রাইভেট সেক্টরের রিকভারি টার্গেটকে সামনে রেখে বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে। আশা করছি এবারের বাজেটটি গ্লোবাল ক্রাইসিস মোকাবিলায় এবং প্রাইভেট সেক্টর রিকভারির ক্ষেত্রে একটি কার্যকর ভূমিকা পালন করবে।” 

ডিসিসিআই সভাপতি বলেন, “দীর্ঘদিনের প্রত্যাশিত ইনকাম ট্যাক্স আইন বাস্তবায়ন করা একটি উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ। এটি বাস্তবায়নের মাধ্যমে ব্যবসায়ীরা সহজভাবে ট্যাক্স দিতে পারবে।” 

বাজেট পুনর্বিবেচনার দাবি রিহ্যাবের  

জমি রেজিস্ট্রেশনে উৎসে আয়কর বাড়ানোর প্রস্তাব এবং নির্মাণশিল্পের বিভিন্ন পণ্যের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করায় ফ্ল্যাটের দাম বাড়বে বলে জানিয়েছে রিয়েল এস্টেট এ্যান্ড হাউজিং এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-রিহ্যাব। 

সংগঠনটির সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামিন কাজল তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় ওই প্রস্তাব পুনর্বিবেচনার দাবি জানিয়েছেন। 

সংগঠনটির এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, বাজেটে জমি রেজিস্ট্রেশনে উৎসে আয়কর বাড়ছে, সিমেন্ট, পাথর, টাইলস, লিফট, সিরামিক, গ্লাস, সুইচ-সকেট, ক্যাবল, কিচেনওয়্যারসহ কমপক্ষে ১০-১২টি পণ্যের উপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এই বাজেট পুনর্বিবেচনা না করলে আগামীতে জমি এবং ফ্ল্যাটের দাম বৃদ্ধি পাবে ও এর প্রভাব ফ্ল্যাট ক্রেতাদের ওপর পড়বে। 

এবার ২০১৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে অর্থমন্ত্রী জমি রেজিস্ট্রেশনে উৎসে কর বাড়ানোর প্রস্তাব করেন।  

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) আওতাধীন এবং এর বহির্ভূত এলাকায় জমি রেজিস্ট্রেশনকালে যৌক্তিকভাবে উৎসে কর হার বাড়ানোর প্রস্তাব রাখেন অর্থমন্ত্রী। 

এর প্রতিক্রিয়ায় রিহ্যাব সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামিন বলেন, “যে সকল পণ্যের দাম বাড়বে তার ক্রেতা হচ্ছি আমরা, যারা ফ্ল্যাট তৈরি করি। আর সব শেষ এই পণ্যের দাম গিয়ে পড়বে ফ্ল্যাট ক্রেতার উপর। এই সব পণ্যের দাম সহনশীল না রাখলে আবাসন শিল্পে সংকট তৈরি হবে।” 

উৎসে কর কমানোর দাবি বিএফএফইএ এর 

বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএফএফইএ) হিমায়িত চিংড়ি ও অন্যান্য মাছ রপ্তানির ওপর উৎসে কর ০.২৫ শতাংশ নির্ধারণ করার আহ্বান জানিয়েছে। 

সংগঠনের সভাপতি কাজী বেলায়েত হোসেন এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেন, হিমায়িত চিংড়ি ও অন্যান্য মাছ রপ্তানি খাতটি দীর্ঘ দিন যাবৎ বিভিন্ন আওতা বহির্ভূত কারণে লোকসান দিয়ে রপ্তানি কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে বিধায় এ খাতের রপ্তানির উপর আরোপিত উৎসে কর ১ শতাংশ যুক্তিসঙ্গত নয়। 

সংগঠনটি বলছে, বর্তমানে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ইউরোপসহ বিশ্বের অর্থনীতিতে মন্দা অবস্থা সৃষ্টি হওয়ায় বিশ্ব বাজারে চিংড়ির দাম প্রতি কেজিতে প্রায় ২ ডলার হ্রাস পেয়েছে। এছাড়াও কম মূল্যের ভেনামির সাথে আন্তর্জাতিক বাজারে চিংড়ি রপ্তানি কার্যক্রম ভালোভাবে চালিয়ে যাওয়া কষ্টকর হয়ে গেছে। 

অন্যান্য কৃষি পণ্যের মত চিংড়িতে ১০ শতাংশ নগদ সহায়তা এবং মাছে ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২০ শতাংশে উন্নীত করার জন্য দাবি জানিয়েছ বিএফএফইএ।