“পিপি দায়িত্বে আছেন, কিন্তু আদালতে আসবেন না কেন? রিজাইনওতো করেননি। বেতনভাতা যখন নিচ্ছেন, তখন না আসার কোনো সুযোগই নেই।”
Published : 21 Aug 2024, 05:52 PM
দুদকের আইনজীবীর অনুপস্থিতির কারণে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদক তৌফিক ইমরোজ খালিদীর বিরুদ্ধে দুদকের করা মামলায় অভিযোগপত্র আমলে নেওয়ার বিষয়ে শুনানি হয়নি।
সরকারি দায়িত্বে থেকেও সংশ্লিষ্ট আইনজীবীর বিনা নোটিসে আদালতে গরহাজির থাকা নিয়ে সমালোচনা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বিবাদীপক্ষের আইনজীবীরা।
তৌফিক খালিদীর আইনজীবী মিয়া মোহাম্মদ কাওসার আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পিপি দায়িত্বে আছেন, কিন্তু আদালতে আসবেন না কেন? রিজাইনওতো করেননি। বেতনভাতা যখন নিচ্ছেন, তখন না আসার কোনো সুযোগই নেই।”
বুধবার ঢাকার মহানগর জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ আসসামছ জগলুল হোসেনের আদালতে তৌফিক খালিদীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলার অভিযোগপত্র আমলে নেওয়ার বিষয়ে শুনানি হওয়ার কথা ছিল।
শুনানির শুরুতে অভিযোগপত্র আমলে না নিয়ে অব্যাহতির আবেদন আদালতে জমা দেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদকের আইনজীবী মিয়া মোহাম্মদ কাওসার আলম।
তখন প্রসিকিউশনকে এই আবেদনের কপি দেওয়া হয়েছে কি না জানতে চান বিচারক। তাদেরকে কপি দেওয়ার কথা জানানো হলে, পরের আলোচনায় দুদকের আইনজীবীর শুনানির বিষয় আসে।
তখন প্রসিকিউশনের একজন কনিষ্ঠ আইনজীবী আদালতকে বলেন, দুদকের প্রধান আইনজীবী এদিন শুনানি করবেন না, এই আদালতে দুদকের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মাহমুদ হোসেন জাহাঙ্গীরই শুনানি করবেন।
পরে মামলায় পক্ষভুক্ত এলআর গ্লোবালের আইনজীবী শাহীনূর ইসলাম অনি শুনানিতে বলেন, এই মামলার পক্ষভুক্ত হয়েছে তার মক্কেল। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে বিনিয়োগের অর্থ ফেরত পাওয়ার জন্য আবেদন করার কথা বলেন তিনি।
এরপর আদালতকে জানানো হয়, তৌফিক ইমরোজ খালিদী এবং এলআর গ্লোবাল একই মামলার দুই পক্ষ হলেও শুনানির তারিখ আলাদা আলাদা দিনে নির্ধারিত।
তখন বিচারক জানতে চান, এলআর গ্লোবালের আবেদনের উপর শুনানি কবে?
২৯ সেপ্টেম্বর তারিখ থাকার কথা জানানো হলে বিচারক অভিযোগপত্র আমলে নেওয়ার আবেদন, অব্যাহতির আবেদন এবং এলআর গ্লোবালের আবেদনের বিষয়ে ওইদিন একসঙ্গে শুনানি তারিখ ঠিক করে দেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের পক্ষে শুনানিতে আরও ছিলেন আইনজীবী নোমান হোসাইন তালুকদার, লাতিফুর রহমান, রাহুল দ্রাবিড় শর্মা।
অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট ফার্ম এলআর গ্লোবাল বাংলাদেশ ২০১৯ সালের শেষ ভাগে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে ৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করার পর এ মামলার সূত্রপাত হয়।
বিনিয়োগের ওই টাকাই ‘অবৈধ প্রক্রিয়ায়’ অর্জন করা হয়েছে অভিযোগ করে সাড়ে আট মাস পর মামলা দায়ের করে দুদক।
আর চার বছর ধরে তদন্ত করে এ বছর এপ্রিলে দুদকের দেওয়া অভিযোগপত্রে বলা হয়, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম এবং এর প্রধান সম্পাদকের কয়েকটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে প্রায় ৪৩ কোটি টাকা রয়েছে, যা ‘অসাধু উপায়ে’ অর্জন করা হয়েছে এবং ওই অর্থ স্থানান্তরে ‘মানি লন্ডারিং’ হয়েছে।
এলআর গ্লোবাল বাংলাদেশের বিনিয়োগ করা ওই অর্থ আদালতের আদেশে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের হোল্ডিং কোম্পানি বাংলাদেশ নিউজ টোয়েন্টিফোর আওয়ার্স লিমিটেড এবং তৌফিক ইমরোজ খালিদীর বিভিন্ন ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ‘অবরুদ্ধ’ অবস্থায় রয়েছে গত পাঁচ বছর ধরে।
পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের চাপে এলআর গ্লোবাল বাংলাদেশ এখন ওই অর্থ মুক্ত করে দেওয়ার জন্য আদালতে এসেছে, যাতে তারা ছয়টি মিউচুয়াল ফান্ডের অর্থ সমন্বয় করতে পারে, যেখান থেকে তারা ওই অর্থ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে বিনিয়োগ করেছিল।
তৌফিক ইমরোজ খালিদী বরাবরই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছেন। তিনি বলেছেন, “এ অভিযোগ এতটাই হাস্যকর, যুক্তিহীন ও ভিত্তিহীন যে দুর্নীতি দমন কমিশন এবং সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতাকে এটা গভীরভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করবে।”
দুদকের মামলায় চার্জশিট: অভিযোগ ‘হাস্যকর, যুক্তিহীন, ভিত্তিহীন’, বলছেন তৌফিক ইমরোজ খালিদী
কী অভিযোগ দুদকের?
২০১৯ সালের ১৩ অক্টোবর এক প্রতিবেদনে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম জানায়, তাদের কোম্পানিতে ৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করছে এলআর গ্লোবাল বাংলাদেশ। ওই বিনিয়োগের একটি বড় অংশ তারা ব্যয় করবে ডিজিটাল সংবাদ সেবার সম্প্রসারণ ও উদ্ভাবনে।
কিন্তু পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) তাৎক্ষণিকভাবে ওই ‘বিনিয়োগ ও বিনিয়োগ সংক্রান্ত কার্যক্রম থেকে বিরত’ থাকার নির্দেশ দেয়।
তার দুই সপ্তাহের মাথায় দুর্নীতি দমন কমিশন ‘জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও অবস্থান গোপনের’ অভিযোগ পাওয়ার কথা জানিয়ে তৌফিক ইমরোজ খালিদী ও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের বিরুদ্ধে ‘অনুসন্ধান’ শুরু করে।
দুদকের চিঠি পেয়ে ওই বছর ২৬ নভেম্বর কমিশনের কার্যালয়ে গিয়ে নিজের বক্তব্য জানিয়ে আসেন তৌফিক ইমরোজ খালিদী। এরপর দুদকের আবেদনে ২০১৯ সালের নভেম্বরে খালিদী এবং বাংলাদেশ নিউজ টোয়েন্টিফোর আওয়ার্স লিমিটেডের ওই ব্যাংক অ্যাকাউন্টগুলো ‘অবরুদ্ধ’ করা হয়, এখনও তা সেই অবস্থাতেই আছে।
এরপর ২০২০ সালের ৩০ জুলাই মামলা দায়ের করেন দুদকের উপ-পরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধান। অভিযোগে বলা হয়, তৌফিক ইমরোজ খালিদী চারটি ব্যাংকের বিভিন্ন হিসাবে ৪২ কোটি টাকা জমা রেখেছেন, যার ‘বৈধ কোনো উৎস’ দুদক পায়নি।
সেই এজাহারে বলা হয়, তৌফিক ইমরোজ খালিদী তার নামে থাকা কোম্পানির ২০ হাজার শেয়ার ২৫ কোটি টাকায় এবং কোম্পানির আরও ২০ হাজার নতুন শেয়ার ইস্যু করে ২৫ কোটি টাকায় এলআর গ্লোবাল বাংলাদেশের কাছে বিক্রি করেছেন। ওই ৪০ হাজার শেয়ারের ‘প্রকৃত মূল্য ৪০ লাখ টাকা’। কিন্তু ১২ হাজার ৪০০ টাকা প্রিমিয়ামসহ প্রতিটি শেয়ার বিক্রি করা হয়েছে ১২ হাজার ৫০০ টাকায়।
“তৌফিক ইমরোজ খালিদীর ভাষ্য অনুযায়ী, তিনি ব্র্যাক-ইপিএলকে দিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের অ্যাসেট ভ্যালুয়েশন করিয়েছেন। ব্র্যাক-ইপিএলের প্রতিবেদন অনুসারে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের ভ্যালুয়েশন ধরা হয়েছে ৩৭১ কোটি টাকা।”
কিন্তু ওই প্রতিবেদন ‘ভুয়া’ ছিল অভিযোগ করে এজাহারে বলা হয়, ওই ৫০ কোটি টাকার মধ্যে ৪২ কোটি টাকা এইচএসবিসি, ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেড, সাউথ ইস্ট ব্যাংক লিমিটেড এবং মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক লিমিটেডের বিভিন্ন হিসাবে জমা করা হয়েছে।
“তৌফিক ইমরোজ খালিদী উক্ত অস্থাবর সম্পদ অসাধু উপায়ে অর্জন করেছেন, যা তার জ্ঞাত আয়ের উৎসের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ।”
এরপর কেটে যায় তিন বছর নয় মাস। তৌফিক ইমরোজ খালিদীর জামিন আটকাতে বার বার চেষ্টা করেছে দুদক, লাভ হয়নি। বরং তৌফিক ইমরোজ খালিদীর আবেদনে রুল জারি করে হাই কোর্ট। মামলাটি কেন বাতিল করা হবে না– তা জানতে চাওয়া হয়েছে সেখানে।
সেই রুল নিষ্পত্তি হওয়ার আগেই গত মার্চে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের উপ-পরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধানকে তার বর্তমান কর্মস্থল ময়মনসিংহ থেকে ডেকে এনে প্রতিবেদন দিতে বলে কমিশন। তিনি গত রোজার ঈদের আগে অভিযোগপত্র জমা দিলে ১৮ এপ্রিল কমিশন সভায় তা অনুমোদন করা হয়।
দুদক এখন বলছে, এইচএসবিসি, ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেড, সাউথ ইস্ট ব্যাংক লিমিটেড এবং মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক লিমিটেডে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের মূল কোম্পানি এবং প্রধান সম্পাদকের বিভিন্ন হিসাবে ৪৩ কোটি ৫৭ লাখ ৭৬ হাজার ৪৬৭ টাকা ‘ফ্রিজ’ বা অবরুদ্ধ করে রাখা আছে, তার ‘বৈধ কোনো উৎস নেই’।
কোম্পানির শেয়ার বিক্রির টাকাই যে ওইসব অ্যাকাউন্টে জমা হয়েছে, সে কথা দুদকের এজাহারেও ছিল। অথচ অভিযোগপত্রে দুদক বলছে, তৌফিক ইমরোজ খালিদী ওই সম্পদ ‘অসাধু উপায়ে’ অর্জন করেছেন, যা তার জ্ঞাত আয়ের সঙ্গে ‘সংগতিপূর্ণ নয়’।
এই কারণ দেখিয়ে ২০০৪ সালের দুর্নীতি দমন কমিশন আইনের ২৭ (১) ধারা এবং ২০১২ সালের মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের ৪(২) ও ৪(৩) ধারায় চার্জশিট দিয়েছে দুদক।
অভিযোগপত্র অনুমোদনের খবরে তৌফিক ইমরোজ খালিদী গত ২৩ এপ্রিল তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, “তদন্তের যে দীর্ঘসূত্রতা হল, আর তার যে ফল এ পর্যন্ত এল, তাতে কার্যত ন্যায়বিচার থেকেই বঞ্চিত রাখা হল। এ ধরনের প্রক্রিয়া সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর বিষয়ে সাধারণ মানুষের মনে আস্থার সংকট তৈরি করতে পারে। তারপরও আমরা এর নিষ্পত্তিতে বিচার ব্যবস্থা এবং বিজ্ঞ বিচারকদের ওপর পূর্ণ আস্থা রাখতে চাই। আমি আত্মবিশ্বাসী, ন্যায়বিচার আমি পাব।”
তৌফিক ইমরোজ খালিদী কী বলছেন?
কোন পরিস্থিতিতে কী পরিকল্পনা নিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম বিনিয়োগ চুক্তি করেছিল, সেই অর্থ কোথায় কীভাবে আছে বা ব্যয় হয়েছে, কেন তৌফিক ইমরোজ খালিদী নিজের হাতে থাকা কিছু শেয়ার বিক্রি করেছেন এবং ওই চুক্তির পর কী কী ঘটেছে তার একটি বিবরণ ২০২০ সালের ২৫ জানুয়ারি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের মতামত কলামে প্রকাশিত এক নিবন্ধে তুলে ধরেন তৌফিক ইমরোজ খালিদী।
‘অল ফর জার্নালিজম! শিরোনামে ওই নিবন্ধে তিনি বলেন, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের বিকাশ, উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ নিশ্চিত করতে বিনিয়োগ প্রয়োজন ছিল। তাছাড়া দীর্ঘদিনের ‘স্বল্প বিনিয়োগ কিংবা বিনিয়োগ খরার’ কারণে কর্মীদের অনেকের বেতন বকেয়া পড়ছিল, বেড়ে যাচ্ছিল দায়; সে কারণে কোম্পানির ৩৭ হাজার ১০০ টাকা মূল্যমানের প্রতিটি শেয়ার মাত্র ১২ হাজার ৫০০ টাকায় ছেড়ে দিতে হয়েছে তাকে।
তারিখ ধরে পুরো ঘটনাক্রম তুলে ধরে তৌফিক ইমরোজ খালিদীর সেই নিবন্ধে বলা হয়, ২০১৭ সালের ৩ এপ্রিল ইনফরমেশন মেমোরেন্ডাম (আইএম) তৈরির জন্য ব্র্যাক-ইপিএলের সঙ্গে এনডিএ স্বাক্ষরিত হয়। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপকদের সঙ্গে কয়েক মাস কাজ করে একটি ইনফরমেশন মেমোরেন্ডাম তৈরি করে ব্র্যাক-ইপিএল। তাতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের ভ্যালুয়েশন হল ৪৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি ২০১৮), তখনকার বিনিময় হার অনুযায়ী বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ দাঁড়ায় ৩৭১ কোটি টাকা।
পরে এলআর গ্লোবালের সঙ্গে বিনিয়োগের বিষয়ে আলোচনা শুরু হলে ব্র্যাক-ইপিএলের কাছ থেকে ইনফরমেশন মেমোরেন্ডামের হালনাগাদ সংস্করণ আনা হয়। ২০১৯ সালের ৩ অক্টোবর চুক্তি হয় এলআর গ্লোবালের সঙ্গে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের ২০ হাজার শেয়ার এবং তৌফিক ইমরোজ খালিদীর নামে থাকা কোম্পানির শেয়ারের মধ্যে ২০ হাজার শেয়ার এলআর গ্লোবাল বাংলাদেশের কাছে বিক্রি করা হয় মোট ৫০ কোটি টাকায়। এর মধ্যে ২৫ কোটি টাকা তার অ্যাকাউন্টে এবং ২৫ কোটি টাকা কোম্পানির অ্যাকাউন্টে জমা হয়।
৬ অক্টোবর বিনিয়োগের টাকা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের মূল প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ নিউজ টোয়েন্টিফোর আওয়ার্স লিমিটেড এবং তৌফিক ইমরোজ খালিদীর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে পৌঁছায়। তৌফিক ইমরোজ খালিদী তার হাতে থাকা কোম্পানির শেয়ারের একটি অংশ বিক্রি করে দেওয়ায় ওই টাকা ‘পুরোপুরি বৈধভাবেই’ তার অ্যাকাউন্টে যায়।
ওই নিবন্ধে তৌফিক ইমরোজ খালিদী লিখেছেন, ওই বিনিয়োগ থেকে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের হাতে পাওয়া অর্থের ২৫ শতাংশের বেশি ব্যয় হয়েছে কোম্পানির পুঞ্জীভূত দায়ের একটি বড় অংশ মেটাতে। আর তার শেয়ার বিক্রির টাকা কোথায় আছে তা এফডিআর অ্যাকাউন্টগুলো দেখলেই ‘বোঝা যায়’।
বিনিয়োগের ওই টাকা বাংলাদেশের ব্যাংক থেকে ‘ক্লিয়ার’ হয়েই কোম্পানি ও ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে ঢুকেছে, সেক্ষেত্রে মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগ কীভাবে আসছে, সেই প্রশ্নও তিনি রেখেছেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমই যে স্বউদ্যোগে বিনিয়োগ পওয়ার খবর নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল, সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে খালিদী বলেছেন, পুরো ঘটনাপ্রবাহে কোথাও কোনো কিছু লুকানো হয়নি।
একজন সাবেক সহকর্মী সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে এক পোস্টে দুদকের তদন্তসহ পুরো বিষয়টিকে ‘হয়রানি’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন জানিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদক ওই নিবন্ধে প্রশ্ন রাখেন- ‘নৈতিক সাংবাদিকতার’ চর্চা করাই তার এবং বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের ‘ভুল’ ছিল কি না। ‘অনেক প্রথমের জন্ম দেওয়া’ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের ‘ক্ষতি করে কার স্বার্থ হাসিল’ করা হচ্ছে? বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম এবং যিনি এর নেতৃত্বে, তার ‘ভাবমূর্তি নষ্ট করে কার কী লাভ?’
“সব মিলিয়ে এ এক হতাশাজনক পরিস্থিতি। কিছু বিতর্কিত লোক, যাদের কাজ সব সময়ই প্রশ্নবিদ্ধ, তাদের স্বার্থে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে এতটা নগ্নভাবে ব্যবহার- এটা আমরা কখনও দেখতে চাই না, যখন আমরা সেরকম একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার চেষ্টা করছি, যেটাকে মানুষ অনুকরণ-অনুসরণ করবে, যেটা হবে মানুষের ভরসার জায়গা।… বাস্তবিক অর্থেই আমাদের অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে।”
আইনি লড়াই
অনুসন্ধান, তলব এবং মামলার এজাহার- সবগুলো পর্যায়ে কমিশনের লিখিত ভাষা যেভাবে বার বার বদলে গেছে, তাকে এর আগে ‘দুদকের গোল পোস্ট বদলের নমুনা’ হিসেবে দেখিয়েছিলেন তৌফিক ইমরোজ খালিদীর একজন আইনজীবী।
তার জামিন বাতিলের জন্য ২০২০ সালে সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত গিয়েছিল দুদক, তা খারিজ করে দিয়ে আপিল বিভাগ কমিশনের আইনজীবীকে প্রশ্ন করেছিল, এসব আবেদন নিয়ে এসে কেন তিনি আপিল বিভাগের ‘সময় নষ্ট’ করছেন।
মামলাটিকে ‘অসার ও নিবর্তনমূলক’ হিসেবে বর্ণনা করে ন্যায়বিচারের স্বার্থে তা বাতিলের জন্য ২০২২ সালের এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে হাই কোর্টে একটি আবেদন করেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদক।
তার আবেদনে বলা হয়, দুদকের দায়ের করা ওই এজাহারে আইন অনুসারে ‘প্রাইমা-ফেসি’ বা প্রাথমিক সারবত্তা নেই। মামলাটি ‘অসার, গোলমেলে, নিপীড়নমূলক’। এটি চালিয়ে যাওয়া হবে আদালত ও আইনগত প্রক্রিয়ার অপব্যবহার। তাই ‘চূড়ান্ত ন্যায় বিচারের স্বার্থে’ এটির কার্যক্রম বাতিল চাওয়া হয়।
আর্জিতে যুক্তি দেওয়া হয়, এফআইআরে বলা অভিযোগ যদি সত্য বলে ধরেও নেওয়া হয়, তাহলেও তা দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনে বিচার্য নয়।
এজাহারে অর্থের উৎস নিয়ে যে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, তা খণ্ডন করে তৌফিক ইমরোজ খালিদীর আবেদনে বলা হয়েছে, স্বীকৃতভাবে শেয়ার হস্তান্তরের মাধ্যমে ওই টাকা অর্জন করা হয়েছে। তাই বিক্রি করা শেয়ারের অর্থের উৎস নিয়ে কোনো প্রশ্ন থাকলে তা শেয়ার ক্রয়কারীকে করা উচিত।
তাছাড়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম যৌথমূলধনী কোম্পানি ও ফার্মগুলোর নিবন্ধকের দপ্তর থেকে যথাযথভাবে নিবন্ধিত একটি বেসরকারি কোম্পানি, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত নয়। সুতরাং শেয়ার বিক্রির জন্য সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনকে জানানোর বাধ্যবাধকতা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জন্য প্রযোজ্য নয়।
এরপর পৌনে দুই বছরে বেশ কয়েকবার এ মামলার তারিখ পড়ে। দুদকের পক্ষ থেকে বার বার সময় চেয়ে শুনানি পেছানো হয়। কয়েকটি তারিখে দুদকের আইনজীবী হাজির না থাকায় শুনানি করা যায়নি।
শেষ পর্যন্ত খালিদীর করা রিট আবেদনের শুনানি নিয়ে বিচারপতি এ এস এম আব্দুল মোবিন ও বিচারপতি মো. মাহমুদ হাসান তালুকদারের হাই কোর্ট বেঞ্চ চলতি বছরের ২ জানুয়ারি রুলসহ আদেশ দেয়।
দুদকের করা এ মামলা কেন বাতিল করা হবে না, তার ব্যাখ্যা চাওয়া হয় রুলে। দুদক চেয়ারম্যান এবং ঢাকার জেলা প্রশাসককে রুলের জবাব দিতে বলা হয়।