পর্ব ৩: যে সম্পদ টাকার অংকে মাপা যায় না

মিডিয়ার ব্যবসা কীভাবে চলে সে বিষয়ে কোনো ধারণা ছিল না আজকের বিশ্বের শীর্ষ ধনী জেফ বেজোসের। এমনকি এরকম একটি খাতে টাকা ঢালার কোনো আগ্রহও তার ছিল না। তাহলে কোন চিন্তা থেকে ২০১৩ সালে তিনি ওয়াশিংটন পোস্ট কিনে নিয়েছিলেন?

ফারহান ফেরদৌসবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 August 2020, 06:39 PM
Updated : 29 August 2020, 02:17 PM

যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদপত্রের ইতিহাসে এক বিশেষ জায়গা নিয়ে থাকা প্রায় দেড়শ বছরের পুরনো এই পত্রিকাটির অবস্থা তখন বিশেষ ভালো না। কাটতি কমে যাওয়ায় আয় কমছিল ধারাবাহিকভাবে।

রয়টার্স সে সময় এক প্রতিবেদনে হিসাব করে দেখিয়েছিল, তখনকার বাজার দরে আমেরিকার বনেদী এ পত্রিকার দাম হত বড় জোর ৬ কোটি ডলার। সেই কোম্পানিই অ্যামাজনের প্রতিষ্ঠাতা বেজোস কিনলেন ২৫ কোটি ডলার দিয়ে।

ওয়াশিংটন পোস্ট কেনার আগে বেজোস কী কী হিসাব কষেছিলেন, তার একটি ধারণা পাওয়া যায় তার সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে ২০১৮ সালে প্রকাশিত ফোর্বসের এক প্রতিবেদনে।

বেজোস প্রথমত দেখেছিলেন, যে প্রতিষ্ঠানটি তিনি কিনছেন, সেটি কতটা গুরুত্বপূর্ণ। দ্বিতীয়ত এর ভবিষ্যৎ কী। অর্থাৎ, ছাপা পত্রিকার বাজার যখন ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে, ইন্টারনেট ব্যবহার করে ব্যবসা করার অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে তিনি ওয়াশিংটন পোস্টকে কতটা টেনে তুলতে পারবেন।

বেজোসের ব্যবসা পরিকল্পনা সফল হয়েছিল, অনলাইন সংস্করণকে কেন্দ্র করে নতুন বিজনেস মডেল চালু করার পর ওয়াশিংটন পোস্ট দ্রুত লাভের মুখ দেখেছিল। 

ওয়াশিংটন পোস্ট বিক্রি হওয়ার পর ২০১৩ সালের অগাস্টে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে রয়টার্স লিখেছিল, বেজোস ওই পত্রিকার মালিকানা পাওয়ার জন্য তখনকার ভ্যালুয়েশনের অনেকগুণ বেশি প্রিমিয়াম দিয়েছিলেন এর ‘ইনট্যানজিবল অ্যাসেট’ (যে সম্পদ টাকার অংকে পরিমাপযোগ্য নয়) বিবেচনায় নিয়ে।

বিশ্লেষক ও ব্যাংকারদের বরাত দিয়ে রয়টার্স ওই প্রতিবেদনে লিখেছিল, ওয়াশিংটন পোস্টের মত ব্র্যান্ড ভ্যালু যে পত্রিকার থাকে, আর সেই পত্রিকা যখন বিক্রি হয়, তখন ব্যবসায়িক লেনদেনের প্রথাগত সূচকগুলো দিয়ে তার বিচার হয় না। বিষয়টি অনেকখানি নির্ভর করে ক্রেতা কত দাম দিতে চান তার ওপর।

‘অস্বাভাবিক ও কাল্পনিক’ দাম?

বেজোসের ওয়াশিংটন পোস্ট কেনার এই পুরনো গল্প এই প্রতিবেদনের আলোচনায় আসছে দেশের সবচেয়ে পুরনো অনলাইন সংবাদধ্যম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি এলআর গ্লোবাল বাংলাদেশের বিনিয়োগ নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের একটি মামলার অভিযোগের সূত্র ধরে।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম এবং এর প্রধান সম্পাদক তৌফিক ইমরোজ খালিদীর হাতে থাকা ৪০ হাজার শেয়ার গতবছর এলআর গ্লোবাল বাংলাদেশের কাছে বিক্রি করা হয় ৫০ কোটি টাকায়।

এক্ষেত্রে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের ১০০ টাকা ফেইস ভ্যালুর প্রতিটি শেয়ার ১২ হাজার ৫০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে, যাকে দুদকের মামলায় ‘এ যাবৎকালে বাংলাদেশে সর্বোচ্চ মূল্য’ এবং ‘অস্বাভাবিক ও কাল্পনিক’ দাম বলা হয়েছে।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের মত যেসব প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত নয়, যাদের শেয়ার নিয়মিত বাজারে হাতবদল হয় না, বহু বছর ব্যবসা করে যারা সুনাম ও ব্র্যান্ড ভ্যালু তৈরি করেছে, সেরকম কোম্পানির শেয়ার হস্তান্তরের সময় কত টাকা প্রিমিয়াম ধরলে তাকে যৌক্তিক, আর কখন ‘অস্বাভাবিক বা কাল্পনিক’ বলা যাবে?

বিষয়টি বোঝার চেষ্টায় এর আগে এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের আকিজ গ্রুপের তামাকের ব্যবসা জাপান টোবাকোর কাছে বিক্রি এবং ঢাকার অ্যাপোলো হাসপাতালের শেয়ারের বড় অংশ যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এভারকেয়ারের কাছে বিক্রির বিষয়টি আলোচনা করা হয়েছিল।

ওই দুটি কোম্পানির শেয়ার বিক্রি বা হস্তান্তরে পরিমাপযোগ্য সম্পদের হিসাব নিশ্চয় একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক হয়ে থাকতে পারে। কিন্তু যেসব কোম্পানি আজকের ডিজিটাল দুনিয়ায় সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে ব্যবসা শুরু করে দ্রুত বিকশিত হয়েছে, যাদের স্থাবর অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ কম, তাদের মালিকানা বা শেয়ার বিক্রির ক্ষেত্রে কী ঘটবে?

মোবাইল ব্যাংকিংয়ের ব্যবসায় বিশ্বে চমক জাগানো কোম্পানি বিকাশের যাত্রা শুরু হয়েছিল ২০১০ সালে। সে সময় এটি ছিল বাংলাদেশের ব্র্যাক ব্যাংক লিমিটেড এবং যুক্তরাষ্ট্রের মানি ইন মোশনের একটি যৌথ উদ্যোগ।

ওয়ার্ল্ড ব্যাংক গ্রুপের ইন্টারন্যাশনাল ফাইনান্স কর্পোরেশন (আইএফসি) ২০১৩ সালের এপ্রিলে বিকাশের অংশীদার হয়। ২০১৭ সালে বিকাশের মালিকানায় যুক্ত হয় চীনের আলীবাবা গ্রুপ।

আইএফসি যখন বিনিয়োগ করল, তখনও বিকাশ ছিল লোকসানি কোম্পানি। ১০ লাখ ডলার বা ৮৫ কোটি টাকায় বিকাশ লিমিটেডের সাড়ে ১২ শতাংশ শেয়ার কিনে নেয় আন্তর্জাতিক ওই আর্থিক প্রতিষ্ঠান।

বিকাশের ১০০ টাকা ফেইস ভ্যালুর ৪৭ হাজার ৭৪৪টি শেয়ার আইএফসি কিনে নেয় ৮৫ কোটি টাকায়। সে হিসেবে প্রতি শেয়ারের দাম হয় ১৭ হাজার ৮০৩ টাকা। অর্থাৎ, ফেইস ভ্যালুর বিচারে বিকাশের ওই শেয়ার আইএফসি কিনেছিল ১৭৭ গুণ দাম দিয়ে।

দ্রুত ব্যবসার বিস্তার ঘটিয়ে বিকাশ ২০১৭ সালে ৪৮ কোটি ৭৮ লাখ টাকা মুনাফা করে। পরের বছর বিকাশের জন্য বড় বিনিয়োগ নিয়ে আসে চীনের আলীবাবা।

এই গ্রুপের প্রতিষ্ঠান অ্যান্ট ফাইনানশিয়াল ২০১৮ সালে ৭৫০ কোটি টাকায় বিকাশ লিমিটেডের ১০ দশমিক ১০ শতাংশ সাধারণ শেয়ার এবং ৫৫ হাজার ৭৩৩টি প্রেফারড শেয়ার কিনে নেয়।

অ্যান্ট ফাইনানশিয়ালের কাছে ১০০ টাকা ফেইস ভ্যালুর ৩৮ হাজার ৫৫৩টি সাধারণ শেয়ার এবং একই অভিহিত মূল্যের ৫৫ হাজার ৭৩৩টি প্রেফারড শেয়ার বিক্রি করে বিকাশ ওই ৭৫০ কোটি টাকা পায়।

সে হিসেবে প্রতিটি শেয়ারের দাম হয় ৭৯ হাজার ৭৫০ টাকা। অর্থাৎ, ফেইস ভ্যালুর বিচারে বিকাশের ওই শেয়ার অ্যান্ট ফাইনানশিয়াল কিনেছিল ৭৯৬ গুণ দাম দিয়ে।

বাংলাদেশের চাকরি খোঁজার অনলাইন সেবা বিডিজবস ডটকম ১৫ লাখ টাকা পুঁজি নিয়ে ২০০০ সালে যাত্রা শুরু করে। তখন তাদের পরিশোধিত মূলধন ১ কোটি ৭ লাখ ৪৯ হাজার ৮৩০ টাকা।

১৪ বছর পর অস্ট্রেলিয়ার জব সাইট সিক (seek) প্রায় ৩৮ কোটি ৫০ লাখ টাকায় বিডিজবসের ২৫ শতাংশ শেয়ার কিনে নেয়। ২০১৪ সালে ওই শেয়ার হস্তান্তরের সময় বিডিজবসের ভ্যালুয়েশন হয় ১৫০ কোটি টাকা।

চার বছর পরে বিডিজবস ডটকমের আরো ১০ শতাংশ শেয়ার কেনার আগ্রহ দেখায় সিক। তখনকার মূল্যায়নে বিডিজবস ডটকমের পুরো কোম্পানির দাম ওঠে ৩০০ কোটি টাকা। ওই মূল্যায়নের ভিত্তিতে বিডিজবসের আরো ১০ শতাংশ শেয়ার কিনতে সিককে পরিশোধ করতে হয় ৩০ কোটি টাকা।   

হিসাব করলে দেখা যায়, ১০ টাকা ফেইস ভ্যালুর প্রতিটি শেয়ার বিডিজবস বিক্রি করেছে ১ হাজার ৬০৮ টাকা প্রিমিয়াম ধরে। অর্থাৎ শেয়ারের ফেইস ভ্যালু ১০০ টাকা হলে প্রিমিয়াম দাঁড়াত ১৫ হাজার ৯৮০ টাকা।

লেনদেনের এই হিসাবগুলো কোথাও অস্বাভাবিক বা কাল্পনিক মনে হচ্ছে?

‘ইনট্যানজিবল অ্যাসেট’

একটি পাবলিক বা প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানির সব শেয়ারের দাম কত হবে বা ওই কোম্পানির মূল্য কত হবে সে বিষয়টি নির্ধারণের তিন ধরনের পদ্ধতি আছে। এর একটি হচ্ছে সম্পদভিত্তিক পদ্ধতি, একটি বাজারভিত্তিক পদ্ধতি এবং আয়ভিত্তিক পদ্ধতি।

বিশ্বজুড়ে সেবাখাতের প্রসারের এই সময়ে কোম্পানির মালিকানা বদল বা শেয়ার হস্তান্তরের ক্ষেত্রে আয়ভিত্তিক পদ্ধতিটিই বেশি প্রচলিত। একটি চালু ব্যবসাকে বাস্তবসম্মত একটি বাণিজ্যিক পরিকল্পনা অনুযায়ী চালালে কত বছরে কত নগদ টাকা আসতে পারে, সেজন্য মূলধন ব্যয় কত হতে পারে, এসব হিসাব করেই ভ্যালুয়েশনের কাজটি করা হয়।

আর তখনই একটি কোম্পানির ব্র্যান্ড ভ্যালুর মত ‘ইনট্যানজিবল অ্যাসেটগুলোর’ হিসাব চলে আসে।

ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক মো. মুসা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “একটি কোম্পানির মোট মূল্য (ভ্যালুয়েশন) নির্ধারণে ‍যদি ক্যাশ ফ্লোর গ্রোথ বেশি ধরা হয় তাহলে বুঝতে হবে সেখানে ব্র্যান্ড ভ্যালু আছে।

“কারণ ব্র্যান্ড ভ্যালু বেশি থাকলে কোম্পানিটি তার সেবা বা পণ্যের দাম বেশি রাখতে পারে। আর দাম বেশি রাখলে তার নগদ প্রবাহ বেড়ে যায়। এভাবে একটি কোম্পানির ব্র্যান্ড ভ্যালু পরোক্ষভাবে একটি কোম্পানির মোট মূল্য (ভ্যালুয়েশন) নির্ধারণে চলে আসে।”

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের একজন মুখপাত্র বলেন, একটি কোম্পানি অন্য কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে যখন তারা ভবিষ্যতে সেখানে ভালো লাভের সম্ভাবনা দেখে। এলআর গ্লোবালও তাই করেছে।

“আমাদের মত কোম্পানির দাম বিবেচনা করতে গেলে স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ মূল্যের চেয়ে ব্র্রান্ড ভ্যালু এবং সামনের ডিজিটাল মিডিয়ার দুনিয়ায় আমাদের সম্ভাবনার দিকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। এলআর গ্লোবাল সেই হিসাব করতে ভুল করেনি।”

এলআর গ্লোবালের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রিয়াজ ইসলাম

এলআর গ্লোবাল বাংলাদেশ নিউ ইয়র্ক ভিত্তিক একটি কোম্পানির সহযোগী প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশের বাজারে তহবিল ব্যবস্থাপনায় তারা দেশের দ্বিতীয় শীর্ষ কোম্পানি। একটি সংবাদমাধ্যমে বিনিয়োগ করার সিদ্ধান্ত তারা কেন নিল? আর সেটা কেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম?

এলআর গ্লোবাল বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রিয়াজ ইসলাম বিনিয়োগ ও আর্থিক সেবা খাতে কাজ করছেন ৩০ বছর ধরে। এর মধ্যে ২০ বছর তিনি কাজ করেছেন নিউ ইয়র্কভিত্তিক সিটিগ্রুপের হয়ে, দশ বছর ধরে আছেন এলআর গ্লোবালে।

গতবছর বিনিয়োগের খবর প্রকাশ হওয়ার সময় তিনি বলেছিলেন, “আমাদের এই বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রাথমিক কারণ তৌফিক ইমরোজ খালিদী এবং তার গড়ে তোলা ব্র্যান্ড, যার পেছনে রয়েছে আদর্শ, সততা ও কনটেন্টের মান বজায় রাখার ক্ষেত্রে দৃঢ় সংকল্প এবং অত্যন্ত সীমিত পুঁজি নিয়ে পাঠকের আস্থা ধরে রেখে আরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা।

“সেই সঙ্গে অবশ্যই আমরা এই ব্র্যান্ডের দৃঢ় ভিত্তি, দেশ ও দেশের বাইরে এর কোটি পাঠকের বিশাল ব্যাপ্তি এবং ভবিষ্যতের সম্ভাবনার জায়গাগুলো বিবেচনা করেছি।”