দুর্নীতির অভিযোগ কেন উঠল, সাংবাদিকদের খুঁজতে বললেন তৌফিক ইমরোজ খালিদী

হঠাৎ কেন ‘অবৈধ সম্পদ অর্জনের’ অভিযোগ তোলা হল, তা সাংবাদিকদেরই ‘তদন্ত’ করে দেখতে বললেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদক তৌফিক ইমরোজ খালিদী।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 Nov 2019, 10:36 AM
Updated : 26 Nov 2019, 12:53 PM

তিনি বলেছেন, যে অভিযোগ তার বিরুদ্ধে করা হচ্ছে তা ‘একেবারেই ভিত্তিহীন’। তিনি সব সময় নিয়ম মেনে চলার চেষ্টা করেছেন এবং কোনো ‘অবৈধ সম্পদ’ তার নেই।

“সাংবাদিক হিসেবে আপনারা ইনভেস্টিগেশন করেন যে কেন হয়েছে। কোন খবর নিয়ে হয়েছে। কোনো খবরে যদি আমাদের ভুল থাকত, একটি শব্দ, একটি বাক্য, একটি তথ্য, তাহলে আমার বিরুদ্ধে মামলা করতে পারত। মামলা করেনি কেন? এই পথ কেন নিয়েছে?”

‘জ্ঞাত আয়ের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ সম্পদ অর্জনের’ অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের চিঠি পাওয়ার পর সোমবার ঢাকার দুদক কার্যালয়ে এসেছিলেন তৌফিক ইমরোজ খালিদী। সেখানেই তিনি এ বিষয়ে প্রথমবারের মত সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন। 

গত ৫ নভেম্বর দুদকের পক্ষ থেকে একটি চিঠি পাঠিয়ে তৌফিক ইমরোজ খালিদীকে ১১ নভেম্বর দুদক কার্যালয়ে উপস্থিত থাকতে অনুরোধ করা হয়। চিঠিতে বলা হয়, খালিদীর নিজের এবং বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের হিসাবে ‘বিপুল পরিমাণ টাকা স্থানান্তরের মাধ্যমে অবস্থান গোপন’ এবং বিভিন্ন ‘অবৈধ কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে জ্ঞাত আয়ের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ সম্পদ’ অর্জনের অভিযোগে তার বক্তব্য জানা প্রয়োজন।

তা’ক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় এক বিবৃতিতে তিনি সে সময় বলেছিলেন, “আমাদের প্রকাশিত কয়েকটি সংবাদ প্রতিবেদন খুবই শক্তিশালী একটি মহলকে নাখোশ করেছে। আর আমার সহকর্মীদের বস্তুনিষ্ঠ ও উদাহরণযোগ্য সাংবাদিকতার মূল্য এখন আমাদের এভাবে দিতে হচ্ছে।”

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদক সাক্ষাতের জন্য সময় চেয়ে আবেদন করলেও দুদকের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু না জানানোয় সোমবার তিনি কমিশনের দপ্তরে যান। পরে দুদকের পক্ষ থেকে বলা হয়, আগে করা তার আবেদনের প্রেক্ষিতে তাকে সময় দেওয়া হবে। তিনি ফিরে যেতে পারেন।

দুদক থেকে তিনি বেরিয়ে আসার সময় চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম সবুজ জানতে চান, সময় চেয়ে আবেদন করার পরও কেন তিনি কমিশনে এসেছেন।

উত্তরে তৌফিক ইমরোজ খালিদী বলেন, “আমি আইন কানুন মেনে চলার চেষ্টা করি। যদি সময়সীমা না বাড়ানো হয়, তাহলে কী হবে? কাজেই আমি এসেছি। আমাকে আনুষ্ঠানিকভাবে যেহেতু জানানো হয়নি। কাজেই আমাকে আসতে হয়েছে।”

 

যে অভিযোগে দুদকে ডাকা হয়েছে, সে বিষয়ে তৌফিক ইমরোজ খালিদীর বক্তব্য জানতে চেয়েছিলেন সাংবাদিক সবুজ।

উত্তরে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদক বলেন, “অভিযোগটা কী সেটা আমি বুঝতে পারছি না। আমাকে বলা হয়েছে যে, অবৈধ সম্পদ অর্জনের …

“যেটা হয়েছে, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে একটি খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ করেছে। সেই বিনিয়োগের একটি অংশ হচ্ছে, আমরা নতুন শেয়ার ইস্যু করে তাদের কাছে দিয়েছি। (অন্য অংশ হল) আমার অল্প মালিকানায় যেটা আছে, সেটার একটা অংশ বিক্রি করেছি। তাতে আমার একেবারে সম্পদহীন অবস্থা থেকে যে সম্পদ তৈরি হয়েছে, এতে অবৈধ সম্পদ অর্জন কী করে হলো?”

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম গত ১৩ অক্টোবর এক প্রতিবেদনে জানায়, তাদের কোম্পানিতে ৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করছে নিউ ইয়র্ক ভিত্তিক একটি কোম্পানির সহযোগী প্রতিষ্ঠান এলআর গ্লোবাল বাংলাদেশ। ওই বিনিয়োগের একটি বড় অংশ তারা ব্যয় করবে ডিজিটাল সংবাদ সেবার সম্প্রসারণ ও উদ্ভাবনে।

তৌফিক ইমরোজ খালিদী বলেন, “বাংলাদেশে নিবন্ধিত একটি কোম্পানি আমার শেয়ার কিনে নিয়েছে। তারা মিউচুয়াল ফান্ড ম্যানেজ করে, ট্রাস্টি। আমাদের দিক থেকে সমস্ত আইন কানুন মেনে আমরা এই বিনিয়োগ গ্রহণ করেছি। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম কোনো গণমাধ্যম কোম্পানিতে, সংবাদমাধ্যম বিষয়ক কোম্পানিতে এই ধরনের একটি বিনিয়োগ এসেছে। আমার ধারণা কেউ কেউ সেটা পছন্দ করেনি।”

তিনি বলেন, ব্যক্তি হিসেবে তার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে, তার জন্য তা অত্যন্ত বেদনাদায়ক।

“যারা আমাকে চেনে, আমার সঙ্গে যারা কাজ করে, আমার বন্ধু, আমার সহকর্মী, আমার আত্মীয়-স্বজন, আমার পরিবার- আমার ধারণা, তাদের সবার জন্য বেদনাদায়ক।”

ওই অভিযোগকে ‘একেবারেই ভিত্তিহীন’ হিসেবে বর্ণনা করে তৌফিক ইমরোজ খালিদী সাংবাদিক সবুজের আরেক প্রশ্নের উত্তরে বলেন, “আমার যেহেতু কিছু মালিকানা (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে) ছিল। সেটার একটি অংশ আমি বিক্রি করেছি। সেটা থেকে কিছু টাকা আমার ইয়েতে (অ্যাকাউন্টে) এসেছে। তেশরা অক্টোবরে কাগজপত্র সিগনেচার করা হয়েছে,  ছয়ই অক্টোবর আমার অ্যাকাউন্টে টাকা এসেছে।

“সেই টাকার যে আয়কর দিতে হয়, সেই টাকা আয়কর আমি দেব। সেটা ২০১৯-২০ করবর্ষে সেটা হবে। আমি সে আয়কর দেব। আমাকে কেউ কোনোদিন বলতে পারবে না যে, আমি ঠিকমত আয়কর দিই না।”

পদ্মা ব্যাংকের কাছে অর্থ দাবি করার একটি ‘গুঞ্জন’ নিয়েও প্রশ্ন করেন সাংবাদিক সবুজ। উত্তরে তৌফিক ইমরোজ খালিদী বলেন, ‘গুঞ্জন’ নিয়ে কোনো কথা তিনি বলবেন না।

“পদ্মা ব্যাংকের যে ইয়ে হয়েছে, আমি শুনেছি, কোনো একজন ফেইসবুকে একটা পোস্ট দিয়েছে। পদ্মা ব্যাংকের এমডি কে- আমি চিনি না। তার নামও জানি না। এখন পর্যন্ত জানি না। জানার চেষ্টাও করিনি। আপনি খেয়াল করলে দেখবেন, ফেইসবুকে যে পোস্ট দেওয়া হয়েছে, আমি সেই পোস্টের জবাবও দেইনি। আমার কাছে জবাব দিতেও রুচিতে বেঁধেছে। কার সঙ্গে আমি ঝগড়া করব? কার সঙ্গে?”

প্রথম আলোর সাংবাদিক মোর্শেদ নোমান প্রশ্ন করতে গিয়ে বলেন, “তৌফিক ভাই ইয়েটা যেটা বলা হয়েছে যে, এআর গ্লোবাল…।”

তার কথা শুধরে দিয়ে তৌফিক ইমরোজ খালিদী বলেন, এলআর গ্লোবাল।

মোর্শেদ নোমান তখন বলেন, “এলআর গ্লোবাল আপনার প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করেছে। একটা কথা হচ্ছে যে, এটা এসইসি কর্তৃক ৫ বছরের জন্য নিষিদ্ধ। এরা বিনিয়োগ করতে পারে না।

তৌফিক ইমরোজ খালিদী বলেন, এলআর গ্লোবাল নিষিদ্ধ কি-না, সেই প্রশ্নটা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনকে করতে হবে।

“নিষিদ্ধ থাকলে তাদের ব্যবস্থাপনায় থাকা যে ছয়টি মিউচুয়াল ফান্ড আছে, সেই মিউচুয়াল ফান্ডের অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তিনি ট্রান্সফার করতে পারতেন না। সেই কোম্পানি পারত না। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের অ্যাকাউন্টে এবং আমার ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে… এটা সম্ভব হত না। কাজেই এই যে প্রচারণা আছে… শোনেন আমিও সাংবাদিক। আপনারাও সাংবাদিকতা করেন। আপনাদেরকে আমার অধিকার আছে কিছু কথা বলার।

“আরেকটু হোমওয়ার্ক করে আসবেন। এই যে জিজ্ঞেস করলেন, ৫ বছরের জন্য নিষিদ্ধ হয়েছে, আপনি হোমওয়ার্কটা করেননি। হোমওয়ার্ক করে আসবেন, জেনে আসবেন। যে কোম্পানিকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, সেই কোম্পানি কখনো তাদের ম্যানেজ করা ফান্ড থেকে চেক ইস্যু করতে পারে না এবং সেই চেক কোনো ব্যাংক অনার করবে না।

মোর্শেদ নোমান তখন বলেন, “আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম- ‘শোনা যাচ্ছে’।”

তৌফিক ইমরোজ খালিদী বলেন, “শোনা কথা নিয়ে কখনো প্রশ্ন করবেন না। হোমওয়ার্ক করে আসবেন, জেনে আসবেন। শোনা কথা নিয়ে আমরা লিখি না। যেমন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে আপনি কখনো দেখবেন না যে, শোনা কথা লেখা হয়েছে।… কখনো দেখবেন না যে প্রচারণা চালানো হয়েছে।”

হঠাৎ করে কেন অভিযোগ তোলা হল, এ বিষয়ে তৌফিক ইমরোজ খালিদী কী মনে করছেন, তা জানতে চেয়েছিলেন সাংবাদিক মোর্শেদ নোমান।

উত্তরে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদক বলেন, “আমিও অত্যন্ত বিস্মিত। আমি একেবারেই বিস্মিত হয়েছি। আমি চমকে গেছি।… এই প্রথম আমি বিষয়টি নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলছি।

“আমার সহকর্মীরা যখন এসেছিলেন, যেদিন চিঠি এসেছে, আমি তাদেরকে বলেছি, এটি নিষ্পত্তি হওয়া পর্যন্ত আমি প্রয়োজন হলে, প্রয়োজন হলে না, আমি তাদেরকে একদম প্রস্তাবই দিয়েছি যে আমি আমার পদ থেকে পদত্যাগ করতে চাই।… আমার সহকর্মীদেরকে বলেছি যে, তারা আমাকে প্রশ্ন করতে পারে। জিজ্ঞেস করতে পারে। যেহেতু আমি নিজেই এখন খবরের মধ্যে আছি, আমি নিউজ মেকার, সো আমাকে জিজ্ঞেস করতে পারে, প্রশ্ন করতে পারে।

“ওরা আমাকে প্রশ্ন করেছে, সেই সব প্রশ্নের জবাব দিয়েছি। সেই সব জিনিস ছাপাও হয়েছে, আপনারা দেখেছেন। আমিও বিস্মিত, আমি জানতে চাই, কেন (অভিযোগ তোলা) হয়েছে।”

কারা কেন ওই অভিযোগ তুলছে, সে বিষয়টি সাংবাদিকদের খতিয়ে দেখার আহ্বান জানিয়ে তৌফিক ইমরোজ খালিদী বলেন, “আমাকে বলেছে (দুদকে) আসার জন্য, আমি বলেছি- আমি যাব। আমাকে প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছে যে, এটা ‘ঠিকঠাক’ করে দেওয়া যায়। আমাকে এটা বলা হয়েছে, ওটা বলা হয়েছে…। বিভিন্ন জন বিভিন্ন রকমের প্রস্তাব দিয়েছে।

“অভিযোগ যেহেতু এসেছে, আমি ডিফেন্ড করতে এসেছি। যতদূর পর্যন্ত যেতে হয়, আমি ডিফেন্ড করব। কিন্তু এই রাষ্ট্র ব্যবস্থায় আরেকটু স্বচ্ছতা আনা উচিত। আরেকটু সততা থাকা উচিত। আরেকটু ন্যায়নিষ্ঠতা থাকা উচিত।”

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদককে কেন ডাকা হয়েছিল সে বিষয়ে সাংবাদিকরা জানতে চাইলে দুদক সচিব মুহাম্মদ দিলোয়ার বখত বলেন, “জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ ছিল, সেই ব্যাপারে কমিশনে একটা অনুসন্ধান চলমান আছে। অনুসন্ধানের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের জন্য অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা তাকে আজকে নোটিস করেছিলেন।

“কিন্তু তিনি গত ৭ নভেম্বর আসতে পারবেন না বলে অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা বরাবর একটি আবেদন করেন। সেই আবেদনটি বিবেচনায় নিয়ে কমিশনের অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা পরবর্তী তারিখ নির্ধারণের জন্য কাজ করছেন।”

তৌফিক ইমরোজ খালিদী অভিযোগগুলো ভিত্তিহীন বলে দাবি করেছেন, তারপরও কেন দুদক এ অনুসন্ধান করছে- এমন প্রশ্নে দুদক সচিব বলেন, “কোনো অভিযোগ এলে কমিশন যাচাই-বাছাই কমিটির মাধ্যমে তা যাচাই-বাচাই করে অনুসন্ধান করে থাকে। আশা করি অনুসন্ধান করে প্রকৃত বিষয় বেরিয়ে আসবে।”