পর্ব ১: ‘অস্বাভাবিক, কাল্পনিক’ দাম?

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদক তৌফিক ইমরোজ খালিদীর বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলায় ‘অস্বাভাবিক ও কাল্পনিক’ দামে শেয়ার বিক্রির অভিযোগ এনেছে দুর্নীতি দমন কমিশন, যার ভেতরে আগ্রহী যে কেউ ভাবনার খোরাক পাবেন।

ফারহান ফেরদৌসবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 August 2020, 06:28 PM
Updated : 25 August 2020, 06:47 PM

মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, তৌফিক ইমরোজ খালিদী তার এবং কোম্পানির ৪০ হাজার শেয়ার ৫০ কোটি টাকায় বিক্রি করেছেন অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি এলআর গ্লোবাল বাংলাদেশের কাছে।

এখানে ১০০ টাকা ফেইস ভ্যালুর (অভিহিত মূল্য) প্রতিটি শেয়ার ১২ হাজার ৪০০ টাকা প্রিমিয়ামসহ ১২ হাজার ৫০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে, যাকে দুদক ‘এ যাবৎকালে বাংলাদেশে সর্বোচ্চ মূল্য’ এবং ‘অস্বাভাবিক ও কাল্পনিক’ দাম বলছে।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম পুঁজিবাজারে নিবন্ধিত নয়, নিয়ম অনুযায়ী যৌথ মূলধনী কোম্পানি ও ফার্মগুলোর নিবন্ধকের দপ্তর থেকে অনুমোদন নিয়ে তারা প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি হিসেবে ব্যবসা করছে।

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত একটি কোম্পানির শেয়ারের দাম প্রতিদিন বাড়ে-কমে। কোনো কোম্পানির শেয়ারের দাম অস্বাভাবিক মাত্রায় বেড়ে গেলে স্বাভাবিকভাবেই সন্দেহ তৈরি হয়।

কিন্তু যে কোম্পানি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত নয়, যাদের শেয়ার নিয়মিত বাজারে হাতবদল হয় না, বহু বছর ব্যবসা করে যারা সুনাম ও ব্র্যান্ড ভ্যালু তৈরি করেছে, সেরকম একটি কোম্পানির শেয়ার হস্তান্তরের সময় কত টাকা প্রিমিয়াম ধরলে তাকে ‘অস্বাভাবিক বা কাল্পনিক’ বলা যাবে?

সাম্প্রতিক কয়েকটি কোম্পানির মালিকানা হস্তান্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করা যায়।

২০১৮ সালের শেষ দিকে পৃথিবীর অন্যতম বড় তামাক কোম্পানি জাপান টোবাকো বাংলাদেশের আকিজ গ্রুপের তামাকের ব্যবসা ১২ হাজার ৪৩০ কোটি টাকায় কিনে নেয় (এখানে প্রতি ডলার ৮৪ টাকা ৫৬ পয়সা ধরা হয়েছে)।

আকিজ গ্রুপের ওই কোম্পানি ইউনাইটেড ঢাকা টোবাকো লিমিটেডও পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত নয়।

কেনার সময় যে আর্থিক তথ্য জাপান টোবাকো প্রকাশ করেছিল, তাতে দেখা যায়, ২০১৮ সালের ৬ অগাস্ট ইউনাইটেড ঢাকা টোবাকো কোম্পানির পেইড-আপ ক্যাপিটাল (পরিশোধিত মূলধন) ছিল ২ কোটি টাকা।

এখন ইউনাইটেড ঢাকা টোবাকোর প্রতিটি শেয়ারের ফেইস ভ্যালু যদি ১০০ টাকা ধরা হয়, তাহলে সেই ১০০ টাকার প্রতিটি শেয়ার জাপান টোবাকো কিনেছে ৬ লাখ ২১ হাজার ৮১০ টাকায়।

এই দাম কি অস্বাভাবিক বা কাল্পনিক?

জাপান টোবাকো হিসাব করে দেখেছে, ২ কোটি টাকা পেইড-আপ ক্যাপিটালের কোম্পানি ইউনাইটেড ঢাকা টোবাকোর মোট সম্পদের পরিমাণ ১ হাজার ২৯০ কোটি টাকা, প্রতি শেয়ারে নিট সম্পদের পরিমাণ ৬৪ হাজার টাকা, বছরে নিট বিক্রির পরিমাণ ১ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা আর মুনাফার পরিমাণ (অপারেটিং প্রফিট) ৪৭০ কোটি টাকা।

লাভজনক মনে হয়েছে বলেই জাপান টোবাকো এত বেশি প্রিমিয়াম দিয়ে ইউনাইটেড ঢাকা টোবাকোর সব শেয়ার কিনে নিয়েছে।

ইউনাইটেড ঢাকা টোবাকো

(আকিজ গ্রুপের টোবাকো ইউনিট)

বাংলাদেশ নিউজ ২৪ আওয়ার্স লিমিটেড

(বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম)

বিক্রি হওয়ার সময় ছিল লাভজনক কোম্পানি

লোকসানে থাকা অবস্থায় ২০১৭ সালে ব্র্যাক ইপিএলের ভ্যালুয়েশনে দাম আসে ৩৭১ কোটি টাকা বা ৪ কোটি ৬০ লাখ ডলার; ২০১৯ সালের অক্টোবরে ৩৩% শেয়ার হস্তান্তরের সময় কোম্পানি ছিল ব্রেক-ইভেনে

পেইড-আপ ক্যাপিটাল ২ কোটি টাকা

পেইড-আপ ক্যাপিটাল ১ কোটি টাকা

বিক্রির সময় দাম ওঠে ১.৫ বিলিয়ন ডলার

(সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকা)

শেয়ার হস্তান্তরের সময় দাম ওঠে ১ কোটি ৮০ লাখ ডলার

(দেড় বিলিয়ন টাকা বা ১৫০ কোটি টাকা)

১০০ টাকার প্রতি শেয়ারের দাম হয় ৬,২১,৮১০ টাকা

১০০ টাকার প্রতি শেয়ারের দাম হয় ১২,৫০০ টাকা

আবার ঢাকার অ্যাপোলো হাসপাতালের মালিক কোম্পানি এসটিএস হোল্ডিংস যখন ২০২০ সালের শুরুর দিকে তাদের হাতে থাকা ৫৫ শতাংশের মত শেয়ার যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এভারকেয়ার হেলথ ফান্ড ও যুক্তরাজ্যের সিডিসি গ্রুপের কাছে বিক্রি করে দিল, তখন তারা পেয়েছে ১ হাজার কোটি টাকার মত।

এই লেনদেন হওয়ার আগে অ্যাপোলো হাসপাতালের পেইড-আপ ক্যাপিটাল ছিল ১৫০ কোটি টাকা। প্রতি শেয়ারের ফেইস ভ্যালু ১০০ টাকা ধরলে আর ৫৫ শতাংশ শেয়ার ১ হাজার কোটি টাকায় বিক্রি হয়ে থাকলে প্রতিটি শেয়ার বিক্রি হয়েছে ১ হাজার ২১২ টাকায়।

এটা কি যৌক্তিক মূল্য ছিল?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক এম সাদিকুল ইসলাম বলছেন, একটি পাবলিক বা প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানির সব শেয়ারের দাম কত হবে বা ওই কোম্পানির মূল্য কত হবে সে বিষয়টি নির্ধারণের তিন ধরনের পদ্ধতি আছে।

একটি হচ্ছে সম্পদভিত্তিক পদ্ধতি, একটি বাজারভিত্তিক পদ্ধতি এবং আয়ভিত্তিক পদ্ধতি।

“এসব পদ্ধতিতে একটি শেয়ারের দাম কত হতে পারে তার কোনো সীমা ঠিক করা নেই। তবে সেটা যৌক্তিক হতে হবে। আর প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানির ক্ষেত্রে শেয়ারের দাম নির্ভর করে নেগোসিয়েশনের উপরে।”

নিবন্ধিত পাবলিক লিমিটেড কোম্পানির ‘ভ্যালুয়েশনের’ ক্ষেত্রে সুবিধা হল, ক্রেতা-বিক্রেতার হাতবদলের মধ্য দিয়ে চাহিদা আর সরবরাহে বিবেচনায় ওই শেয়ারের একটি দাম সব সময় নির্ধারিত হয়েই থাকে। আর এই দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে ওই তিন পদ্ধতিরই মিশেল থাকে।

বিশ্বজুড়ে সেবাখাতের প্রসারের এই সময়ে কোম্পানির মালিকানা বদল বা শেয়ার হস্তান্তরের ক্ষেত্রে আয়ভিত্তিক পদ্ধতিটিই বেশি প্রচলিত, সেটা প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি হোক, কিংবা পাবলিক।

সম্পদভিত্তিক পদ্ধতি সেই ধরনের কোম্পানির ‘ভ্যালুয়েশনের’ ক্ষেত্রে উপযুক্ত, অ্যাকাউন্টিংয়ের ভাষায় যে কোম্পানিকে আর ‘চালু কারবার’ হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে না এবং দায় শোধের জন্য যাদের সম্পদ বিক্রি করে দেওয়ার মত পরিস্থিতি হয়েছে।

একটি কোম্পানির ব্যবসার মৌলিক বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে ‘গোল্ডেন স্ট্যান্ডার্ড’ হল ওই কোম্পানি ভবিষ্যতে কত টাকা আয় করতে পারে তার বর্তমান মূল্যটি বের করা; আর এটা সব খাতে, পাবলিক ও প্রাইভেট সব কোম্পানির জন্যই প্রযোজ্য।

একটি চালু ব্যবসাকে বাস্তবসম্মত একটি বাণিজ্যিক পরিকল্পনা অনুযায়ী চালালে কত বছরে কত নগদ টাকা আসতে পারে, সেজন্য মূলধন ব্যয় কত হতে পারে, এসব হিসাব করেই ভ্যালুয়েশনের কাজটি করা হয়।

অর্থাৎ, এই প্রক্রিয়ায় একটি কোম্পানির দাম নির্ধারণ করা হয় মূলত ভবিষ্যতে এর আয়ের সম্ভাবনার ওপর ভিত্তি করে।

ফলে প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানির শেয়ারের দাম বৃদ্ধির হিসাব কেউ যদি কেবল পেইড-আপ ক্যাপিটাল আর ফেইস ভ্যালুর সঙ্গে তুলনা করে বুঝতে চান, কিংবা এই হাতবদলকে পুঁজিবাজারে নিবন্ধিত কোম্পানির শেয়ার লেনদেনের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলেন, তার দিকভ্রান্ত হওয়া স্বাভাবিক।

বাংলাদেশের ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারের পেইড-আপ ক্যাপিটাল কয়েক বছর আগেও এক কোটি টাকা ছিল, যা পরে বাড়ানো হয়েছে। এখন কেউ এই পত্রিকাটির মালিকানা এক কোটি টাকায় কিনতে চাইলে তা পাবেন?

কিংবা ফাইনানশিয়াল এক্সপ্রেসের কথাই যদি ধরি, ১৯৯৩ সালে প্রতিষ্ঠার সময় যাদের পেইড-আপ ক্যাপিটাল ছিল ১০ লাখ টাকা, বহু বছর পরে যেটা বাড়িয়ে ১ কোটি টাকা করা হয়, সেই কোম্পানি নিশ্চয় ওই দামে কেউ কেনার কথা ভাবতে পারবেন না।

ফোর্বস থেকে

আবার একটি কোম্পানির কী পরিমাণ স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ আছে, সেই হিসাব দিয়ে সেই কোম্পানির ব্র্যান্ড ভ্যালু হিসাব করা যায় না।

অর্থ-বাণিজ্যের সাময়িকী ফোর্বস ২০২০ সালের সেরা ব্র্যান্ডগুলোর যে তালিকা করেছে, তার শীর্ষ পাঁচটিই প্রযুক্তি খাতের কোম্পানি। এসব কোম্পানির নিট সম্পদের পরিমাণ অন্য অনেক কোম্পানির চেয়ে কম হলেও ব্র্যান্ড ভ্যালুতে তারা এগিয়ে।

তালিকার শীর্ষে থাকা অ্যাপলের মোট সম্পদের পরিমাণ ১০৫ বিলিয়ন ডলার, কিন্তু ফোর্বসের বিচারে তাদের ব্র্যান্ড ভ্যালু ২৪১.২ বিলিয়ন ডলারের সমতুল্য।

অথচ ৫২ ট্রিলিয়ন ডলারের সম্পদ নিয়ে টয়োটা আছে এই তালিকার ১১ নম্বরে, এই জাপানি কোম্পানির ব্র্যান্ড ভ্যালু ৪১.৫ বিলিয়ন ডলার।

আবার উবার নামের যে কোম্পানির অ্যাপ ব্যবহার করে বিশ্বের পৌনে আটশ শহরে রাইড শেয়ারিং সেবা চলছে, তাদের নিজেদের কোনো ট্যাক্সি নেই বলে কি উবারকে সস্তায় কিনে ফেলা যাবে?