সব কাজ গুছিয়ে সুপারিশ জমা দেওয়ার জন্য ৯০ দিন যথেষ্ট নয় বলে মনে করছেন কমিশনপ্রধানদের কেউ কেউ।
Published : 12 Dec 2024, 01:39 AM
গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর রাষ্ট্র ও রাজনীতির পুরনো ছক বদলাতে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত সংস্কার কমিশনগুলো এখন কাজ গুছিয়ে আনতে ব্যস্ত।
বিএনপির মত বড় দলের দিক থেকে দ্রুত সংস্কার শেষ করে নির্বাচন দেওয়ার চাপ রয়েছে। সাধারণ মানুষের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে কৌতুহল আছে। সরকারের একজন উপদেষ্টা কয়েকদিন আগে বলেছেন, তিনি ব্যক্তিগতভাবে মনে করেন আগামী বছর নির্বাচত সরকার দেখা যাবে।
এমন পরিস্থিতিতে সংস্কার কমিশনের কাজের অগ্রগতি কতদূর- সেই আলোচনা সামনে আসছে।
নির্ধারিত সময় ডিসেম্বর-জানুয়ারির মধ্যে সুপারিশ জমা দিতে হলে সংস্কার কমিশনগুলোর হাতে আর বেশি সময় নেই। সব কাজ গুছিয়ে সুপারিশ জমা দেওয়ার জন্য ৯০ দিন ‘স্বল্প সময়’ বলে মনে করছেন কমিশনপ্রধানদের কেউ কেউ। তবে তারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রতিবেদন তুলে দিতে আশাবাদী।
ক্ষমতাগ্রহণের দুই মাসের মাথায় অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে রাষ্ট্রের ছয় খাত সংস্কারের লক্ষ্যে ছয়টি কমিশন গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার। এরপর নভেম্বরে আরো আরও পাঁচ খাত সংস্কারের জন্য পাঁচটি কমিশন করা হয়। প্রত্যেক কমিশনকে সুপারিশ জমা দিতে ৯০ দিন সময় দেওয়া হয়েছে।
প্রথম ধাপে গঠিত ছয় সংস্কার কমিশন ওয়েবসাইট খুলে মতামত সংগ্রহ, অংশীজনদের সঙ্গে মতবিনিময়, জরিপ ও লিখিতভাবে মতামত নেওয়ার কাজ এগিয়ে নিচ্ছে।
সুপারিশমালা প্রস্তুতে এসব প্রস্তাব ও মতামত পর্যালোচনার কাজ আগামী তিন সপ্তাহের মধ্যে শেষ করার প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে তারা।
নভেম্বরের দ্বিতীয়ার্ধে দ্বিতীয় ধাপে গঠন করা পাঁচ সংস্কার কমিশনের কাজও শুরু হয়েছে।
• নির্বাচন ব্যবস্থা, পুলিশ, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন ও জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন গঠন হয় ৩ অক্টোবর। সে হিসাবে ২ জানুয়ারি শেষ হতে যাচ্ছে ৯০ দিন।
• ৬ অক্টোবর গঠন করা হয় সংবিধান সংস্কার কমিশন। ৫ জানুয়ারি এ কমিশনের জন্য প্রতিবেদন জমা দেওয়ার শেষ সময় ধরা হচ্ছে।
• ১৮ নভেম্বর গণমাধ্যম, স্বাস্থ্য, শ্রম, নারী বিষয়ক ও স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়। প্রতিবেদন দিতে ১৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময় পাচ্ছে তারা।
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার
আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে হওয়া তিনটি জাতীয় নির্বাচন নিয়েই বিতর্ক রয়েছে। বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হওয়া, ভোটকেন্দ্রে বিরোধী প্রার্থীদের বাধা, কারচুপি, দিনের ভোট রাতে করার অভিযোগ উঠলেও নির্বাচন কমিশন কোনো ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়।
এসব কারণে গত জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংস্দ নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি-জামায়াতসহ সরকারবিরোধী দলগুলো।
২০১১ সালে সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করার পর থেকে বিএনপি ও সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবি জানিয়ে আসছিল।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কারের উদ্যোগের পাশাপাশি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার আইনি প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
ইতোমধ্যে নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, ২ জানুয়ারি খসড়া হালনাগাদ ভোটার তালিকা প্রকাশের পর তথ্য সংগ্রহে বাড়ি বাড়ি যাবে। এরপর ২ মার্চ চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করবে।
সোমবার কমিশনের এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে বিএনপির পক্ষ থেকে তিন থেকে চার মাসের মধ্যে সংস্কার শেষ করে নির্বাচনের দাবি জানানো হয়।
‘বড় ধরনের সংস্কার করে নির্বাচন’– আইএমএফের এক উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকের পর প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস এমন বার্তা দেওয়ার পর দিন বিএনপির পক্ষ থেকে ওই দাবি আসে।
নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কতদূর এগিয়েছে জানতে চাইলে কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা আশা করছি, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সুপারিশ জমা দিতে পারব। সময় নিয়ে একটা প্রতিবন্ধকতা আছে। অনেক কাজ এবং অনেকের সঙ্গে কথা বলতে হয়েছে। যত সময় পাওয়া যাবে তত বেশি কাজ করা যাবে, মানুষের মতামত নেওয়া যায়।”
তিনি বলেন, “সময় একটু কম হয়ে গেছে, কিন্তু এর মধ্যেই করতে হবে আর কি। আমরা আশা করি, সন্তোষজনক একটা সুপারিশ হবে।”
প্রস্তাব পাওয়ার ক্ষেত্রে সবমহলের সাড়া মেলার বিষয়টি তুলে ধরে বদিউল আলম বলেন, “সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সমাজের গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ের সবাই মতামত দিয়েছেন। ফেইসবুক, ওয়েবসাইট- এগুলোর মাধ্যমে শত শত প্রস্তাব পেয়েছি।
“আমরা একটা মেসেজ পাঠিয়েছি, আশা করি আরও সাড়া পাব। রাজনৈতিক দলগুলোর সাড়াও সন্তোষজনক। তারা আগ্রহী এসব পরিবর্তন করতে। অধিকাংশ দল তাদের প্রস্তাব পাঠিয়েছে।”
নিবন্ধিত ৪৮ দলের মধ্যে বিএনপি-জামায়াতসহ ২২টির কাছ থেকে লিখিত মতামত চেয়েছিল নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন। আওয়ামী লীগ ও বিলুপ্ত দ্বাদশ সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টিসহ বাকি দলগুলোর কাছে মতামত চাওয়া হয়নি।
বদিউল আলম মজুমদার বলেন, “কী সুপারিশ থাকবে এটা বলা দুরূহ, কিন্তু একটা জিনিস বলা যায়, ইভিএম থাকবে না। কারণ ইভিএম যেগুলো আছে সেগুলো কার্যকর নয়, নষ্ট হয়ে গেছে।
“ইভিএমের বিষয়ে ঐকমত্য তৈরি হয়নি, রাজনৈতিক ঐকমত্য ছাড়া ইভিএম ব্যবহার করা যায় না,” বলেন তিনি।
কমিশনপ্রধান বলেন, “এখনও চূড়ান্ত হয়নি আমাদের সুপারিশ। কতগুলো বিষয়ে ব্যাপক জনমত আছে যেমন- ‘না’ ভোট, সংসদের উচ্চকক্ষ, সর্বোচ্চ দুই মেয়াদ প্রধানমন্ত্রী থাকার সীমা নির্ধারণ- রাজনৈতিক দলগুলো আগ্রহী এ ব্যপারে। আমরা এখনো নিশ্চিত না, তবে অনেক কিছু নিয়েই ভাবছি।”
এ নির্বাচন বিশেষজ্ঞের ভাষ্য, “এগুলোর জন্য অবশ্যই সংবিধানে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনতে হবে। তার জন্য সংসদ লাগবে, সেজন্য নির্বাচিত সরকারের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।”
বিচার বিভাগ সংস্কার
বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের প্রধান আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মোমিনুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিচার বিভাগীয় সংস্কার কমিশনের কার্যক্রম একটা চলমান প্রক্রিয়া। সংস্কারের কাজ খণ্ডকালীন নয়, স্থায়ী কমিশন থাকা উচিত।”
পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন নির্ধারিত সময়ে শেষ করা কঠিন হতে পারে বলে মনে করেন তিনিও।
আপিল বিভাগের সাবেক এ বিচারপতি বলেন, “ডিসেম্বরের মধ্যে সরকারের কাছে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা। আমরা এ পর্যন্ত ৭০০-৮০০ এর মত প্রস্তাব পেয়েছি। এসব সুপারিশ লিপিবদ্ধ করে প্রতিবেদনের জন্য তৈরি করতেই ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহ লেগে যাবে। সেক্ষেত্রে স্বল্প সময়ে আপাতত কিছু একটা দিতে পারব।”
ইতোমধ্যে গণমাধ্যমে তিনি বলেছেন, বিচারপ্রার্থী মানুষের হয়রানি ও খরচ কমানোর উপায় খুঁজে বের করতে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠনের সুপারিশ পাঠাবে কমিশন। পাশাপাশি সারাদেশে আদালতে বিচারাধীন থাকা মামলাজট কমানো ও উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগের নীতিমালার খসড়া প্রণয়ন করা হয়েছে।
দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার
দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক সংস্কারে গঠিত কমিশনের প্রধান ইফতেখারুজ্জামান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের তো ৬ জানুয়ারি পর্যন্ত সময়। আশা করছি এ মাসের শেষের দিকে সুপারিশ জমা দিতে পারব, বড়জোর জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহ লাগতে পারে।”
তিনি বলেছেন, বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে কমিশনের কথা হয়েছে। দুদকে যারা কর্মরত আছেন, আগে যারা কাজ করেছেন, বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাসহ সরাসরি কমিশনের সঙ্গে জড়িত, সংস্থাটির মাধ্যমে হয়রানির শিকার হয়েছেন, অভিযোগ আছে- এমন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ, শিক্ষার্থী, সংশ্লিষ্ট গবেষক, বিশেষজ্ঞ, বেসরকারি সংগঠন-এনজিও, দুদকের পক্ষে-বিপক্ষে আইনি লড়াই যারা করেছেন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট-বিএফআইইউ- এমন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলেছে কমিশন।
“ঢাকা বা ঢাকার বাইরে যাদের সঙ্গেই কথা বলতে চেয়েছি, ইতিবাচক সাড়া পেয়েছি।”
কমিশনপ্রধান বলেন, “দুদকে কমিশনার নিয়োগের ক্ষেত্রে দলীয় প্রভাব সবসময় থাকে; সেটার সংস্কার কীভাবে করা যায়; পরবর্তী পর্যায়ে যারা আছে, এখানে আমলাতন্ত্রের প্রভাব আছে খুব, এগুলো বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।
“দুদকে দুটো শ্রেণি (প্রেষণে আসে, দুদক সরাসরি নিয়োগ করে) আছে, তাদের মধ্যে বৈষম্য আছে, অরাজকতা, অনিয়ম আছে; এই বিষয়গুলো বিভিন্ন গবেষণা এবং গণমাধ্যমের প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে– সেগুলোর যথার্থতা যাচাই করতে পেরেছে দুদক সংস্কার কমিশন।”
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “যারা ক্ষমতার সঙ্গে জড়িত ছিলেন বা আছেন তাদের বিরুদ্ধে দুদক কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে না। যারা ক্ষমতার বাইরে, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ তাদের হয়রানির শিকার হতে হয়- এ ধরনের বিষয়গুলো আলোচনায় এসেছে এবং অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা আরও কীভাবে জোরদার করা যায়, জবাবদিহি কীভাবে নিশ্চিত করা যায় সে বিষয়ে মতামত এসেছে।”
তিনি বলেন, “দুদক স্বাধীন হোক, সেটা আমরা সবাই চাই। এগুলো নিয়েই আমাদের সুপারিশ থাকবে। এখনো তো সুপারিশের সিদ্ধান্ত হয়নি। বিষয়গুলো আলোচনা হচ্ছে।
“কিছু আইন আছে যেগুলো দুদকের কাজের ওপর প্রভাব ফেলে। যেমন- সিভিল সার্ভিস অ্যাক্ট, কর আইন। যে আইনগুলো কোনো কোনো ক্ষেত্রে দুদককে দুর্বল করে দিয়েছে, সেগুলো সরিয়ে দিয়ে দুদককে শক্তিশালী করার সুপারিশও থাকবে।”
সংবিধান, পুলিশ ও জনপ্রশাসন সংস্কার
সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান আলী রীয়াজ ইতোমধ্যে বলেছেন, “আমাদের কাজের অগ্রগতি হচ্ছে। রাজনৈতিক দল, অংশীজনসহ সবার সহযোগিতা পাচ্ছি। নির্ধারিত সময়ে সুপারিশ দিতে পারব আশা করি।
“কমিশনকে যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সে অনুযায়ী সুপারিশ করব। ৬ অক্টোবর কাজ শুরুর পর থেকে ৯০ দিন তথা ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত (প্রতিবেদন জমার) সময় পাবো আশা করি।”
তিনি বলেন, কমিশনের দায়িত্ব হচ্ছে বিভিন্ন অংশীজনের কাছ থেকে পাওয়া প্রস্তাবগুলো নিয়ে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে একটা সুপারিশ করা।
“আমরা ওয়েবসাইটের মাধ্যমে মন্তব্য সংগ্রহ করেছি, নির্ধারিত সময়ে ৫০ হাজারের বেশি সুপারিশ পেয়েছি। …যে সমস্ত প্রস্তাব ও মতামত আসবে, বিবেচনায় নেব। যেখানে যে ধরনের সুপারিশ করা দরকার আমরা সে সুপারিশ করব।”
৪ ডিসেম্বর সংবিধান সংস্কার কমিশনের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ৫ থেকে ১০ ডিসেম্বর বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো দেশের ৬৪ জেলায় নাগরিকদের মতামত জরিপ করবে। ইতোমধ্যে অংশীজন, বিভিন্ন সংগঠন, ব্যক্তি, সংবিধান বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে মতবিনিময় অব্যাহত রেখেছে কমিশন। ওয়েবসাইটের মাধ্যমে ৫০ হাজার ৫৭৩ জনের মতামত পাওয়া গেছে। দলগুলোর কাছ থেকেও লিখিত মতামত নেওয়া হয়েছে।
সবশেষ ৪ নভেম্বর অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র সংস্কার কার্যক্রম এগিয়ে নিতে যে ছয় কমিশন করেছে সেই সব কমিশনের প্রধানদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস।
এ বৈঠকে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী বলেছেন, তার কমিশনের কাজ পুরোদমে শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে ওয়েবসাইটের মাধ্যমে সবার মতামত সংগ্রহ করছেন তারা। কমিশনের সদস্যরা জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে জনসাধারণের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন।
আরেক বৈঠকে পুলিশ সংস্কার কমিশনের কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে প্রধান উপদেষ্টাকে অবহিত করেন কমিশন প্রধান সফর রাজ হোসেন।
বৈঠকে সফর রাজ বলেন, কিছু আইন ও বিধি সংশোধনের প্রস্তাব এসেছে, যেগুলো যাচাই-বাছাই করে দেখা হচ্ছে। এছাড়া কয়েকটি প্রক্রিয়া সহজ করে তোলার জন্য সুপারিশ করা হবে। ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮ এর কয়েকটি ধারা পরীক্ষা করা হচ্ছে এবং সেসব ধারা পরিবর্তন করা হবে কি না তা যাচাই করে দেখা হচ্ছে।
‘মব’ নিয়ন্ত্রণে বলপ্রয়োগ পদ্ধতি পরিবর্তনের প্রস্তাব নিয়েও কাজ চলছে বলে জানান তিনি।
ইতোমধ্যে পুলিশ সংস্কার কমিশনের সমীক্ষায় অংশ নেওয়া ৮৮ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীটিকে ‘রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত’ করার পক্ষে মত দিয়েছে।
আরো ৫ কমিশনের কাজ শুরু, কী ভাবছেন প্রধানরা?
১৮ নভেম্বর গণমাধ্যম, স্বাস্থ্য, শ্রম, নারী বিষয়ক ও স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে তাদেরও প্রতিবেদন হস্তান্তরের কথা রয়েছে।
স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা মাত্র শুরু করলাম। সময়ের মধ্যেই দেওয়া উচিত। লোকজনের সঙ্গে বসতে হবে, শুরু করেছি আমরা। দলগুলোর সঙ্গে এখনও বসা হয়নি, তাদের থেকে সুপারিশ নেওয়া হবে।
“লোকজন পরামর্শ দিচ্ছে, কেমন সাড়া আসছে এবং কী ধরনের পরামর্শ আসছে তা এখন বলা সম্ভব না।”
নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রধান শিরিন পারভীন হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের মাত্র একটা মিটিং হয়েছে। কাজ শুরু করেছি দুই তারিখে। ১১ তারিখে বসব সারা দিনের জন্য।
“নারীর প্রতি যত রকমের বৈষম্য আছে আইনে, বিধিতে, কর্মসূচিতে সেগুলির বিলুপ্তি চাই। সমতার পক্ষে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যায় সেগুলি চিহ্নিত করা হবে।”
নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করার পরিকল্পনা তুলে ধরে তিনি বলেন, “আমরা অনেকের সঙ্গে বসব। কিন্তু আমাদের হাতে সময় তো কম, ৯০ দিন মাত্র সময়। এর মধ্যে চলে গেছে ১০ দিন। শেষ করতে হবে, এর মধ্যে যা হবে তাই জমা দিতে হবে।”
শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রধান সৈয়দ সুলতান আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শুরু করছি, আগাচ্ছি; মতবিনিময়গুলো করছি আমরা। এর মধ্যে স্যানিটারি ওয়ার্কারদের সঙ্গে কথা বলেছি, সরকারের একটা দপ্তরের সঙ্গে কথা বলব টঙ্গীতে আর রিপোর্ট লেখার কাজ চলছে।
“চেষ্টা করব সময়ের মধ্যে প্রাথমিক রিপোর্ট দেওয়ার হলেও দেব।”
কাজের পরিকল্পনার বিষয়ে ধারণা দিয়ে তিনি বলেন, প্রাথমিকভাবে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন, প্রান্তিক শ্রমজীবী গোষ্ঠীর সঙ্গে বসে মতামত নেওয়া হবে। তারপর আস্তে আস্তে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলবে কমিশন।
“সব শ্রমিকের আইনি সুরক্ষা, মজুরীর জাতীয় মানদণ্ড, সবাইকে শ্রম আইনের আওতায় নিয়ে আসা- এসব সুপারিশ রাখার চিন্তা করছি। তারাও এ ধরনের সুপারিশ করছে, বৈষম্য দূর করার প্রস্তাবও আসছে। গৃহ শ্রমিকরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন- সেটাও উঠে আসছে।”
গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রধান সাংবাদিক কামাল আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা ১৮ দিন মাত্র গঠিত হয়েছি, ১৫ দিনও অফিস করার সুযোগ পাইনি। আমরা সবার সঙ্গে আলোচনা করছি। তবে এখনই সংস্কার পরিকল্পনা নিয়ে কোনো মন্তব্য করার সুযোগ আসেনি।”
স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশনের প্রধান এ কে আজাদ খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সাংবাদিকদের সঙ্গে বসব; তাদের মতামত নেব- এই সিদ্ধান্ত হয়েছে। অন্যদের থেকেও সুপারিশ নেওয়া হচ্ছে। আমরা আশা করছি সময়ের মধ্যে জমা দেওয়ার।
“কিন্তু কাজটা বড়, সে তুলনায় ৯০ দিন কম। তারপরও এই সময়ের মধ্যে করতে হবে। সারাদেশে সস্তায় যেন সবাই চিকিৎসা সেবা পায় এ প্রস্তাব এসেছে। চিকিৎসক ও সাধারণ মানুষ- সবার সঙ্গেই আমাদের আলাপ হচ্ছে বা হবে।”
রাজনৈতিক দল, জাতীয় নাগরিক কমিটি, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কী চায়?
সংবিধানে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করা, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ, প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতায় ভারসাম্য আনা, উপরাষ্ট্রপতি ও উপপ্রধানমন্ত্রী পদ সৃজনসহ ৬২টি সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছে বিএনপি।
রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের লক্ষ্যে ২০২২ সালে বিএনপি যে ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাব ঘোষণা করেছিল, তার আলোকেই লিখিত প্রস্তাব দেয় দলটি।
তবে দলটির অবস্থান হল, সংস্কারের কাজটি নির্বাচিত সরকারকেই করতে হবে; অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে সুপারিশগুলো চূড়ান্ত করে রেখে যেতে পারে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের বলেছেন, “সংবিধান সংস্কার কমিশন তাদের সুপারিশগুলো সরকারের কাছে দেবে। প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, তার পরে তিনি সবার সঙ্গে আলোচনা করবেন। রাজনৈতিক দল, অংশীজন, বিশেষজ্ঞ, সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের সঙ্গে আলোচনা করে সংস্কারের সুপারিশগুলো তারা চূড়ান্ত করবেন।
“চূড়ান্ত করার পর দেখা যাবে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে সবাই ঐকমত্য পোষণ করবে। কিছু-কিছু ক্ষেত্রে হয়ত দ্বিমত থাকতে পারে। যেসমস্ত বিষয়ে সবাই একমত হবে, সেগুলো আমরা যদি অঙ্গীকার করি এবং নির্বাচনী ইশতেহারে যদি সেটা প্রতিফলন করি, তাহলে পরে সবার একটা অঙ্গীকার থাকবে যে পরবর্তীতে পার্লামেন্টে যারাই আসুক, তারা সেই সংবিধান সেভাবেই পরিবর্তন করবে।”
নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও অর্থবহ করার জন্য নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠানের ‘ব্যাপক সংস্কারের’ পক্ষে মত দিয়ে জামায়াতে ইসলামী বলেছে, সংস্কার ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব বলে তারা মনে করে না।
নির্বাচন ব্যবস্থাসহ রাষ্ট্র পরিচালনার বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের জন্য ৪১টি প্রস্তাব অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে তুলে ধরেছে জামায়াত।
সংবিধান সংস্কার করে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ‘ভারসাম্য’ আনার পাশাপাশি একই ব্যক্তির পরপর দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী থাকার সুযোগ বন্ধ করার বিষয়টি রয়েছে জামায়াতের প্রস্তাবে। এছাড়া জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক ব্যবস্থা চালু করা, সংবিধানে ‘কেয়ারটেকার সরকার’ ব্যবস্থা স্থায়ীভাবে সন্নিবেশ করা এবং রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের নিয়ম বাতিল করার প্রস্তাব দিয়েছে দলটি।
জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে মতবিনিময় করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন। ‘গণপরিষদ’ নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সংবিধান প্রণয়ন, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ, সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে ভোটসহ ৬৯ দফা লিখিত প্রস্তাব দিয়েছে নাগরিক কমিটি।
কমিশনে প্রস্তাব দেওয়ার পর কমিটির সদস্য সচিব আখতার হোসেন সাংবাদিকদের বলেছেন, “ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে আগের সংবিধান বাতিল হয়ে গেছে বলে আমরা মনে করি। …রাজনৈতিক দলগুলো যে সংবিধান সংস্কারের কথা বলছেন, তাদের সঙ্গে আমরা একমত নই।”
নতুন সংবিধান প্রণয়নের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকেও।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সদস্য তরিকুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেছেন, “সংবিধান এমনভাবে সংস্কার করা হোক, যাতে রাষ্ট্রের তিনটি অর্গানের মধ্যে ভারসাম্য বজায় থাকে। সংবিধানে ছাত্রদের মতামতের প্রতিফলন সংবিধানে রাখার পরামর্শ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দিয়েছে।”
প্রধান উপদেষ্টা যা বলেছেন
ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনে গত ৫ অগাস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। ৮ অগাস্ট মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের যাত্রা শুরু হয়।
দায়িত্ব নেওয়ার একমাস পূর্তিতে ১১ সেপ্টেম্বর প্রধান উপদেষ্টা জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে রাষ্ট্র সংস্কার কার্যক্রম এগিয়ে নিতে ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করার ঘোষণা দেন।
তিনি বলেন, “কমিশনের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে সরকার সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে পরামর্শ সভা করে সংস্কার ভাবনার রূপরেখা চূড়ান্ত করা হবে। এতে এই রূপরেখা কীভাবে বাস্তবায়ন হবে তার একটি ধারণাও দেওয়া হবে।”
সরকারের ১০০ দিন পূর্তিতে ১৭ নভেম্বর সরকারের কর্মকাণ্ড ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা তুলে ধরে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস।
সেদিন তিনি বলেন, “আমরা আশা করছি নির্ধারিত সময়ে, ডিসেম্বর-জানুয়ারির মধ্যেই সংস্কার কমিশনগুলো তাদের সুপারিশমালা সরকারের কাছে পেশ করতে পারবে। তাদের সুপারিশ নিয়ে আমরা রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে ক্রমাগতভাবে আলোচনায় বসব। সকলের ঐকমত্যের ভিত্তিতেই আমরা সংস্কার প্রস্তাব চূড়ান্ত করব।”
সংস্কারের এসব প্রস্তাব বাস্তবায়নে অন্তর্বর্তী সরকার কতটুকু সময় পাবে তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে তিনি বলেন, “তবে আমি আপনাদের কথা দিচ্ছি, আপনারা সুযোগ দিলে প্রয়োজনীয় কিছু অত্যাবশ্যকীয় সংস্কার কাজ শেষ করেই আমরা আপনাদের কাঙ্ক্ষিত নির্বাচন আয়োজন করব। ততদিন পর্যন্ত আমি আপনাদের ধৈর্য্য ধারণ করার অনুরোধ করব।”
পুরনো খবর
নির্বাচনি সংস্কার হয়ে গেলে রোডম্যাপও পেয়ে যাবেন: ইউনূস
শিক্ষার্থী প্রতিনিধি রেখে সংস্কারের ৫ পূর্ণাঙ্গ কমিশন
শিক্ষার্থী প্রতিনিধি মাহফুজ আলমসহ ৯ সদস্যের সংবিধান সংস্কার কমিশন
ইউনূসের কাছে অগ্রগতি তুলে ধরল ৬ সংস্কার কমিশন
রাষ্ট্র সংস্কারে গণমাধ্যম-স্বাস্থ্যসহ আরো ৫ কমিশন পূর্ণাঙ্গ হল
সংস্কার কমিশনগুলোর কাজ এগোল কতদূর?