বিএনপি সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থার বিরোধিতা করলেও সিপিবি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় পার্টি, এবি পার্টি, গণসংহতি আন্দোলন ও গণ অধিকার পরিষদ এর পক্ষে মত দিয়েছে।
Published : 13 Nov 2024, 01:18 AM
অন্তর্বর্তী সরকারের তিন মাসের মাথায় নির্বাচনি ব্যবস্থা সংস্কারের বিষয়টি যতই এগোচ্ছে, সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক (প্রোপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন বা পিআর) পদ্ধতির কথা ঘুরে ফিরে আসছে আলোচনায়।
নিবন্ধিত-অনিবন্ধিত অনেক দলই নানা ফোরামে এই পদ্ধতির পক্ষে-বিপক্ষে মত দিচ্ছে। তাতে যুক্ত হচ্ছেন নির্বাচন বিশেষজ্ঞরাও।
মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন খাত সংস্কারে কমিশন গঠন করেছে, যাদের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রধান উপদেষ্টার কাছে সুপারিশসহ প্রতিবেদন দেওয়া কথা রয়েছে।
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, তাদের কাজ হল কতগুলো সুপারিশ করা, যাতে নির্বাচনি ব্যবস্থা অবাধ, গ্রহণযোগ্য, অংশগ্রহণমূলক হতে পারে। ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যেই সেসব সুপারিশ সরকারের কাছে হস্তান্তরের লক্ষে কাজ করছেন তারা।
শেষ পর্যন্ত কী কী সংস্কার হবে, কবে নাগাদ নির্বাচন হবে সে বিষয়ে কোনো ধারণা এখনও পাওয়া যায়নি। তবে আগে সংস্কার, পরে নির্বাচনের দাবি যেমন রয়েছে; তেমনি বিএনপি নেতারা দাবি করছেন, সংবিধান সংশোধন করতে হলে নির্বাচিতদের হাত দিয়েই তা করতে হবে।
রাষ্ট্র সংস্কারের অংশ হিসেবে অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়ার পর বিভিন্ন দল এ বিষয়ে তাদের মত প্রকাশ করছে।
সিপিবি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় পার্টি, এবি পার্টি, গণসংহতি আন্দোলন ও গণ অধিকার পরিষদের প্রতিনিধিরা সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচনের পক্ষে মত দিয়েছেন।
তবে বিএনপি সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থার বিরোধিতা করে বিদ্যমান ব্যবস্থার অব্যাহত রাখার পক্ষে।
সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব কী
বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে জনপ্রতিনিধি নির্বাচন প্রধানত দুই ধরনের ব্যবস্থা রয়েছে। একটি হচ্ছে, নির্বাচনি এলাকায় প্রার্থীদের মধ্যে যিনি সর্বোচ্চ ভোট পাবেন, তিনি নির্বাচিত হবেন। এ পদ্ধতিকে বলা হয় ‘ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট’। বাংলাদেশে সংসদসহ অধিকাংশ নির্বাচনে দীর্ঘদিন ধরে চর্চিত এই পদ্ধতিটি।
অন্য পদ্ধতি হল সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা বা ‘প্রোপোরশনাল রিপ্রেজেনটেশন’ পদ্ধতি, যেখানে আসনভিত্তিক কোনো প্রার্থী থাকে না। ভোটাররা ভোট দেবেন দলীয় প্রতীকে। একটি দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সে অনুপাতে সংসদে তাদের আসন সংখ্যা নির্ধারণ হবে।
অনেক দেশে এ দুটি পদ্ধতির মিশ্র ব্যবস্থাও চালু রয়েছে।
সদ্য বিদায়ী প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল গত ১৮ অগাস্ট ‘সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির সরকার ও নির্বাচন কল্পনা নয়, বাস্তবতার নিরিখে প্রস্তাবনা’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধে বিশদভাবে ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।
তার ভাষ্যে, পিআর কার্যত নির্বাচন পদ্ধতি নয়। এটি পার্লামেন্ট বা সংসদে আসন বণ্টনের মাধ্যমে জনগণের প্রতিনিধিত্বকে সর্বজনীন করার লক্ষ্যে উদ্ভাবিত একটি উন্নততর পদ্ধতি।
“বলা প্রয়োজন, জনঘন বাংলাদেশের জনগণের সমজাতীয়তা বা সমরূপতা (homogeneity) দেশের রাজনীতি ও নির্বাচনে PR পদ্ধতি প্রবর্তনের জন্য অত্যন্ত অনুকূল,” লিখেছেন তিনি।
বিভিন্ন দুর্বলতার কারণে নির্বাচনের ‘ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট’ পদ্ধতি পরিবর্তিত হয়েছে বলেও তার লেখায় মত দেন সাবেক সিইসি।
সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব বা পিআর পদ্ধতি কেমন তার ব্যাখ্যায় তিনি লেখেন, এই পদ্ধতিতে নির্বাচন ব্যক্তি-প্রার্থীদের মধ্যে হয় না। নির্বাচন হয় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে।
“বিদ্যমান পদ্ধতিতে বাংলাদেশে ৩০০টি আসনে ১৫০০-১৭০০ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। পিআর পদ্ধতিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে নিবন্ধিত কয়েকটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে। ৩০০টি নির্বাচনি কেন্দ্র (আসন) থাকবে না। বাংলাদেশ হবে একটি একক নির্বাচনি কেন্দ্র। নির্বাচনে যে দল মোট প্রদত্ত ভোটের মধ্যে যত শতাংশ ভোট পাবেন সেই অনুপাতে সংসদে আসন লাভ করবেন।
“যেমন ‘ক’ দল মোট প্রদত্ত ভোটের ৫০% ভোট পেলে আসন পাবে ৫০×৩ =১৫০টি, ‘খ’ দল ৪০% ভোট পেলে আসন পাবে ৪০×৩ =১২০টি, ‘গ’ দল ৫% ভোট পেলে আসন পাবে ৫×৩ =১৫টি এবং ‘ঘ’ দল ৫% ভোট পেলে আসন পাবে ৫×৩ =১৫টি। এভাবে সংসদের ৩০০টি আসন পূরণ হবে। এটিই হচ্ছে পিআর পদ্ধতির সাধারণ ফর্মুলা। কোনো একটি দল যদি দশমিক ৩৪% ভোট পেয়ে থাকে, তা হলে তার আসন হবে মাত্র ১টি। ১৮৯৯ সালে বেলজিয়াম এই পদ্ধতি প্রথম প্রবর্তন করে। অধুনা বিশ্বের প্রায় ১০০টির অধিক দেশ কোনো না কোনো ধরনের PR পদ্ধতি অনুসরণ করছে।”
ইতিহাসের পাঠ ১৯৭৩-২০২৪: ভোটের পরিসংখ্যানে কার সমর্থন কত ছিল?
|
আওয়ামী লীগ |
|
বিএনপি |
|
জাতীয় পার্টি |
|
জামায়াতে ইসলামী |
আসন |
সাল |
ভোট প্রাপ্তির হার |
আসন |
ভোট প্রাপ্তির হার |
আসন |
ভোট প্রাপ্তির হার |
আসন |
ভোট প্রাপ্তির হার |
|
১৯৭৩ |
৭৩.২০% |
২৯৩ |
- |
- |
- |
- |
|
|
১৯৭৯ |
২৬.৮৩% |
৩৯ |
৪১.১৬% |
২০৭ |
- |
|
|
|
১৯৮৬ |
২৬.৮৩% |
৭৬ |
- |
- |
৪২.৪৩% |
১৫৩ |
৪.৬১% |
১০ |
১৯৯১ |
৩০.০৮% |
৮৮ |
৩০.৮১% |
১৪০ |
১১.৯২% |
৩৫ |
১২.১৩% |
১৮ |
১৯৯৬ |
৩৭.৪৪% |
১৪৬ |
৩৩.৬০% |
১১৬ |
১৬.৪০% |
৩২ |
৮.৬১% |
৩ |
২০০১ |
৪০.১৩% |
৬২ |
৪০.৯৭% |
১৯৩ |
৭.২৫% |
১৪ |
৪.২৮% |
১৭ |
২০০৮ |
৪৮.০৪% |
২৩০ |
৩২.৫০% |
৩০ |
৭.০৪% |
২৭ |
৪.৭০% |
২ |
২০১৪ |
৭২.১৪% |
২৩৪ |
- |
- |
৭% |
৩৪ |
- |
- |
২০১৮ |
৭৬.৮০% |
২৫৭ |
১৩.৫১% |
৬ |
৫.৩৭% |
২২ |
- |
- |
২০২৪ |
৬৬% |
২২২ |
- |
- |
৩.৪১% |
১১ |
- |
- |
পিআর পদ্ধতির সুবিধা-অসুবিধা
সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচনের পক্ষে মত দিয়েছেন অধিকার ও উন্নয়নকর্মী খুশী কবির।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “এ পদ্ধতিতে সুবিধা হল, ছোট দলগুলোও সংসদে আসন পাওয়ার সুযোগ পায়; কোনো দল একতরফাভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। এখানে কালো টাকা, পেশি শক্তি, কেন্দ্র দখলের বিষয়গুলো আসবে না।
“অসুবিধা হল একটা দল মেজরিটি পায় না, তাকে কারো সাথে কোয়ালিশনে যেতে হয়। কোয়ালিশন কোন কারণে ভেঙে গেলে আবার নতুন করে কোয়ালিশন করতে হয়। তবে ঠিকমতো বোঝাপড়াটা হলে ঝামেলা হয় না। দলকে খুব শক্তিশালী হতে হবে।”
হুট করে কোনো দেশের নির্বাচন পদ্ধতি বদলানো ঠিক নয় বলে মনে করেন নির্বাচন কমিশনের সাবেক অতিরিক্ত সচিব জেসমিন টুলী, যিনি এখন নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনেরও সদস্য।
পিআর পদ্ধতির ভালো-মন্দ দুটো দিকই আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আমাদের দেশে মন্দটা কতটা প্রভাব ফেলবে সেটা বিবেচনা করতে হবে। এ পদ্ধতি চালু করতে হলে অনেক জায়গায় সংশোধন আনতে হবে।
“প্রথমে সব রাজনৈতিক দলের একমত হতে হবে যে, আমরা এই নির্বাচন পদ্ধতিটা চাচ্ছি। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২ সহ এ সংক্রান্ত যত আইন আছে সব জায়গায় পরিবর্তন আনতে হবে, সংবিধানেও পরিবর্তন আনতে হবে” বলেন এ নির্বাচন বিশেষজ্ঞ।
পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে ঝুলন্ত পার্লামেন্ট হওয়ার সম্ভাবনা বাড়বে বলে মনে করেন জেসমিন টুলী।
তিনি বলেন, “ঝুলন্ত পার্লামেন্ট হলে আমাদের দেশে ওই পরিমাণ অর্থ ব্যয় করার সামর্থ আছে কি না যে, একটা সংসদ ভেঙে যেতে পারে কয়েকদিন পরে, আবার নির্বাচনে যাওয়া।
“ছোট ছোট দলকে পয়সার বিনিময়ে কেনার সুযোগ তৈরি হতে পারে। সরকার গঠনের জন্য যে পরিমাণ আসন দরকার সে ভোট পাওয়া গেল না; তাহলে তো ওইদিকে ঝুঁকতে হবে। এখন যে দলাদলি বলছি, এটাও তখন আরও বেড়ে যেতে পারে; একেকটা গোষ্ঠী তৈরি হয়ে যাবে।”
এ পদ্ধতিতে ছোট দলগুলোর ভোট না পাওয়ার আশঙ্কা দেখছেন না তিনি।
জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষক পরিষদ-জানিপপের চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহর মত হল, পিআর পদ্ধতি নিশ্চিত করতে হলে ন্যূনতম কত ভাগ ভোট পেতে হবে জাতীয়ভাবে সেটা সর্বস্বীকৃত হতে হবে।
“নির্বাচন আইনে অবশ্যই পরিবর্তন আনতে হবে। সংবিধানেও পরিবর্তন আনতে হবে। সংবিধানে লিখতে হবে যে, পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন হবে। থ্রেশল্ড (ভোটের ন্যূনতম অংশ) কত শতাংশ হবে সেটা নির্বাচনি আইনে লিখতে হবে, ৩ শতাংশ না ৫ শতাংশ। একটা দল ৩ শতাংশ ভোট পেলে ৩০০ আসনে তার আসন হবে ৯টি, ৫ শতাংশ পেলে হবে ১৫টা আসন এরকম- এই বিষয়টা নির্বাচন আইনে লিখতে হবে।”
পিআর পদ্ধতি চাইলে যে কোনো সময় চালু করা যেতে পারে এবং এ নির্বাচন পদ্ধতি ভোটারদের বোঝাতে সময় লাগবে না বলে মত দেন এ পর্যবেক্ষক।
এ পদ্ধতির কোনো জটিলতা রয়েছে কিনা জানতে চাইলে নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ বলেন, “যে কোনো পদ্ধতিরই জটিলতা রয়েছে।”
সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ আবু হেনা অবশ্য নির্বাচনি পদ্ধতি বদলের আলোচনাকেই ‘অপ্রয়োজনীয়’ বলছেন।
সোমবার নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সঙ্গে মতবিনিময়ের পর সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে তিনি বলেন, “এখানে আমাদের ‘ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট’ সিস্টেম রয়েছে। এ সিস্টেমই কার্যকর হতে পারে, মানুষের এ সিস্টেমের সাথে পরিচয় রয়েছে। আমরা মনে করি না, নতুন কোনো সিস্টেমের (প্রয়োজন রয়েছে)।”
নেপাল ও ইসরাইলের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, যেসব দেশে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা আছে, সেসব দেশে তা ভালো কাজ করছে না।
“আমাদের যে সিস্টেম রয়েছে, যেটার সঙ্গে মানুষ পরিচিত সে পদ্ধতিই কার্যকর করে গড়ে তোলা দরকার। সেটাই সবচেয়ে বড় কথা।”
আসন শূন্য হলে?
নির্বাচন বিশ্লেষক ও নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য আব্দুল আলীম মনে করেন, পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে ‘ব্যালেন্সড’ পার্লামেন্ট তৈরি হবে, অর্থাৎ ছোট-বড় সব দলের অংশগ্রহণ সংসদে থাকবে।
তিনি বলেন, “এখনকার সিস্টেমে একজন প্রার্থী প্রচুর টাকা ঢালে, কিন্তু পিআর সিস্টেমে এটা থাকবে না। যেহেতু দল ভোট করছে, ভোটাররা ভোট দেবে দলকে। প্রচলিত পদ্ধতিতে সংসদ সদস্যরা আইন তৈরিতে উন্নয়নমূলক কাজে (রাস্তা-ঘাট এসব নির্মাণ) বেশি জড়িত হয়ে যাচ্ছে। পিআর সিস্টেমে গেলে এই জিনিসটা থাকবে না। এ কাজটা যারা দায়িত্ব পাবে তারাই করবে, সংসদ সদস্যদের এ ভূমিকাটা কমে যাবে।
“বর্তমানে কোনো একটা দলের এমপি পদত্যাগ করল, আবার নতুন করে নির্বাচন (শূন্য আসনে উপ নির্বাচন) হচ্ছে। কিন্তু পিআর সিস্টেমে এ জিনিসটা করা খুব কঠিন ব্যাপার, অর্থাৎ এভাবে পুরো নির্বাচন করতে হয়। ফলে পুরো পার্লামেন্ট ভেঙে দিতে হয়।
তবে এই পদ্ধতি চালু করতে সংবিধানে পরিবর্তন আনতে হবে বলে তিনি মত দিয়েছেন।
এর জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে যেমন ঐকমত্যে আসতে হবে, পাশাপাশি ভোটারদেরও এই পদ্ধতির ভালো-মন্দ, এর সঙ্গে বর্তমান পদ্ধতির তফাৎ বোঝাতে হবে বলে জানান তিনি।
ভোটারের ভাবনা
দলের চেয়ে প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার পদ্ধতিকে বেশি ‘ন্যায্য’ মনে হয় সিটি ইউনিভার্সিটির প্রভাষক রিদোয়ান আহমেদ রিয়নের।
তিনি বলেন, “আমি একটা দল করতেই পারি; তার মানে ওই দলের সবাই ভালো বা যোগ্য তা নয়। প্রার্থীকে ভোট দেওয়া হলে তিনি যোগ্য কিনা সেটা বিচার করার সুযোগ ভোটারদের থাকে। ভোট যেভাবেই নেওয়া হোক, প্রক্রিয়াটা যদি স্বচ্ছ এবং ফেয়ার হয়, তাহলে সবাই ভোট দিতে পারবে।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আরাফাত হুসাইন বলেন, “আমাদের দেশের ভোটাররা তো আগে থেকে এই বিষয়ে অভ্যস্ত না। জনগণের বুঝতে বা মেনে নিতে হয়ত সময় লাগবে কিন্তু অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হবে আশা করি।
“দলকে ভোট দিলে আমার এলাকায় কে নির্বাচিত হবে সেটা নিয়ে একটা সংশয় থাকবে, কিন্তু দেশের যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি তাতে এটা (পিআর) ভালো পরিবর্তন নিয়ে আসবে আশা করি। ভালো কিছু হলে ওয়েলকাম।”
বিএনপি ও জামায়াতের দুই মত
জামায়াতে ইসলামী সম্প্রতি সংবাদ সম্মেলন করে যে সংস্কার প্রস্তাবে তুলে ধরেছে, সেখানেও জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি চালুর কথা বলা হয়েছে। তবে বিষয়টি নিয়ে আপত্তি জানিয়ে আসছে বিএনপি।
অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়ার পর সংসদ নির্বাচনে সরাসরি ভোটের বদলে ‘সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির’ পক্ষে যে আলোচনা শুরু হয়েছে, তাতে বিপদ দেখছে বিএনপি।
গত ১৮ অক্টোবর দলটির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী সরকারের উদ্দেশে বলেছেন, “হঠাৎ আপনারা আনুপাতিক ভোটের নির্বাচনের কথা সামনে এনে জটিলতা তৈরি করবেন না। আনুপাতিক হারে নির্বাচনের নামে জটিলতা তৈরি মানে স্বাধীনতাবিরোধীদের মদদ দেওয়া। আপনারা সুপরিকল্পিতভাবে কোনো জটিলতা তৈরি করবেন না।”
রিজভী বলেন, “পৃথিবীর অনেক দেশ এই (আনুপাতিক ভোট) পদ্ধতি চালু করে ফিরে এসেছে। নেপাল চালু করেছিল, এলোমেলো হয়ে গেছে। একটা নতুন পদ্ধতি তৈরি করতে হলে সমাজ এবং জনগণের আকাঙ্ক্ষার মিল থাকতে হবে। সুশীল সমাজ এটার ওপর বক্তব্য রাখছেন, আর এটার ওপর ভিত্তি করে আপনারা যদি মনে করেন এটা সঠিক, তাহলে নির্বাচন ব্যবস্থা আরো ভেঙে যাবে।”
এই বিএনপি নেতার যুক্তি, “আনুপাতিক পদ্ধতিটা বুঝতেই চলে যাবে ৫-১০ বছর। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে প্রত্যেকটা দল সমর্থন করেছে। এটা গণতন্ত্রকামী মানুষের সমর্থিত সরকার, আপনাদেরকে জনগণের অন্তরের ভাষাটা আগে বুঝতে হবে।”
নির্বাচন ব্যবস্থাসহ রাষ্ট্র পরিচালনার বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের জন্য ৪১টি প্রস্তাব অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সামনে তুলে ধরেছে জামায়াতে ইসলামী। নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার প্রস্তাবে দলটি বলেছে- জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক ব্যবস্থা চালু করতে হবে।
গত ৯ অক্টোবর রাজধানীর একটি হোটেলে জামায়াতের আমীর শফিকুর রহমানের পক্ষে দলটির নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের এসব প্রস্তাব তুলে ধরেন।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক ব্যবস্থা চালু করা, সংবিধানে কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা স্থায়ীভাবে সন্নিবেশ করা এবং রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের নিয়ম বাতিল করার প্রস্তাবও দিয়েছে জামায়াত।
অংকের খেলা
বাংলাদেশের ভোটের ইতিহাসে দেখা যাচ্ছে, আওয়ামী লীগ কখনো ২৬ শতাংশের কম ভোট পায়নি। তাদের সর্বোচ্চ ভোটের হার ছিল ৭৬ শতাংশ।
পিআর পদ্ধতিতের ভোট হলে ওই সর্বনিম্ন ২৬ শতাংশ ভোটও যদি দলটি পায়, তাদের আসন হয় ৭৮টি। বর্তমান পদ্ধতিতে ১৯৭৯ ও ১৯৮৬ সালে ২৬ শতাংশের মত ভোট পেয়ে তাদের আসন জুটেছিল যথাক্রমে ৩৯টি ও ৭৬টি।
আর আওয়ামী লীগের ইতিহাসের সর্বোচ্চ ৭৬ শতাংশ ভোট আবার পেলে পিআর পদ্ধতিতে দলটির আসন হয় ২২৮টি। ২০১৮ সালের নির্বাচনে ওই হারে ভোট পেয়ে তারা সংসদের ২৫৭টি আসন দখল করেছিল।
বিএনপি ২০১৮ সালে তাদের ইতিহাসের সর্বনিম্ন ১৩ শতাংশ ভোট পেয়ে জিতেছিল ছয়টি আসন। পিআর পদ্ধতির নির্বাচনে ওই হারে ভোট পেলে তাদের আসন হবে ৩৯টি।
আবার ১৯৭৯ সালে ৪১ শতাংশ ভোট পাওয়া বিএনপির আসন ছিল ২০৭টি। ২০০১ সালে ৪১ শতাংশ ভোট পেয়ে দলটি ১৯৩টি আসন জিতেছিল। আনুপাতিক পদ্ধতির নির্বাচনে ওই হারে ভোট পেলে তাদের আসন হবে ১২৩টি।
জাতীয় পার্টি সবচেয়ে বেশি ৪২ শতাংশ ভোট পেয়েছিল ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে, সেবার তাদের আসন ছিল ১৫৩টি। আর ২০২৪ সালের নির্বাচনে দলীয় ইতিহাসে সর্বনিম্ন ৩ শতাংশ ভোট পেয়ে তাদের আসন হয়েছিল ১১টি। পিআর পদ্ধতিতে এ দুই ক্ষেত্রে তাদের আসন হত ১২৬ ও ৯টি।
জামায়তে ইসলামী ১৯৯১ সালে পেয়েছিল ১২ শতাংশ ভোট, সেটাই তাদের সর্বোচ্চ। সেবার সংসদে তাদের আসন ছিল ১৮টি। আর ১৯৮৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালের নির্বাচনে তাদের ভোটের হার ছিল ৪ শতাংশের উপরে। ওই তিন বছর তাদের পাওয়া আসন সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ১০, ১৭ ও ২টি।
আনুপাতিক পদ্ধতির নির্বাচন হলে এবং ৪ শতাংশ ভোট পেলে জামায়াতের আসন হবে ১২টি। আর দলীয় ইতিহাসের সেরা ১২ শতাংশ ভোট আবারও পেলে তাদের আসন হবে ৩৬টি।
বিএনপি ও জামায়াত কেন পিআর পদ্ধতি নিয়ে দুই রকম অবস্থান নিয়েছে, এই সরল অংকেই তা স্পষ্ট।
পুরনো খবর
হাসিনার 'ফ্যাসিবাদী' দলের স্থান বাংলাদেশে নেই: ইউনূস
আনুপাতিক ভোটের নামে জটিলতা তৈরি মানে স্বাধীনতাবিরোধীদের মদদ
যা আছে জামায়াতের সংস্কার প্রস্তাবে
'হিংসাত্মক রাজনীতির' সমাধান সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বে
সংসদে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব দরকার: খুশী কবির
সংলাপ: দলগুলোর ৫৩১ সুপারিশ ইসির কাছে
জাতীয় নির্বাচনে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি প্রবর্তনের দাবি
'সংস্কারের' পথ করতে সরে দাঁড়াল হাবিবুল আউয়াল কমিশন