এক দশক আগে ২০১৪ সালে বিএনপির বর্জনের ওই নির্বাচনেও ভোট পড়েছিল কম।
Published : 15 Jan 2024, 12:44 AM
ভোটকেন্দ্রের পরিবেশ জানার ও বোঝার কৌতূহল থেকেই প্রথমবার ভোট দিতে গিয়েছেন ঢাকার রূপনগরের নীলা ইসলাম। কোনো ঝুট ঝামেলা শুরু হওয়ার আগেই ৭ জানুয়ারি সকাল সকাল দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ভোট দেন তিনি।
একই এলাকার আরেকজন নতুন ভোটার মিতুল রহমান বলেন, “বাড়ির প্রায় সবাইকে এতদিন ভোট দিতে দেখেছি, তাতে আমারও ভোট দেওয়ার ইচ্ছা ছিল। এবার সুযোগ পেলাম, তাই হাতছাড়া করিনি।”
ভিন্ন ধর্মী কৌতুহল ও আগ্রহ নিয়ে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ঢাকার নতুন এ দুই ভোটার গেছেন কেন্দ্রে। তবে বিএনপির বর্জনের ভোটে জয়ের পাল্লা যেখানে যেখানে আওয়ামী লীগের নিজেদের প্রার্থীর দিকেই শতভাগ ঝুঁকেছে সেসব এলাকায় ভোট দিতে আগ্রহ কম ছিল সবার মাঝেই। এটিকেই ভোট দিতে না যাওয়ার কারণ হিসেবে তুলে ধরেছেন অনেক ভোটার ও বিশ্লেষকদের কয়েকজন।
এমনই একজন সাভারের রাজাশন এলাকার মনীর চৌধুরী। তিনি বলছিলেন, আসনটিতে মূল লড়াইয়ে নামা তিন প্রার্থীই আওয়ামী লীগের নেতা। এমন একটি পরিস্থিতিতে তার পরিবারের চারজন ভোটারের কেউই ভোট দিতে যায়নি।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “নির্বাচনে ক্ষমতার অনিশ্চয়তা তৈরি হলে মানুষ তার ভোটকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। তার একটি ভোট পছন্দের বা অপছন্দের দলের জয়-পরাজয়ের নির্ধারক হয়ে যেতে পারে।
“তখন মানুষ যেভাবেই হোক কেন্দ্রে যেতে চায়। এবার তো তেমন বিষয় ছিল না। আমি ভোট দিলেও যা হবে, না দিলেও তা-ই হবে। সে কারণে আর যাওয়া হয়নি। পুরান ঢাকায় আমার আত্মীয় থাকে, তারাও এ কারণে কেন্দ্রে যায়নি।”
ভোটারদের এমন ভিন্নধর্মী অবস্থানের মধ্যে গত ৭ জানুয়ারি ভোট দিতে কেন্দ্রে না যাওয়া মানুষের সংখ্যা ছিল বেশি।
এবার ভোটার উপস্থিতি কম হওয়া প্রসঙ্গে বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশে যেসব নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি বেশি ছিল সেগুলো ছিল ‘প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ’ এবং তাতে সব দলের অংশগ্রহণ ছিল। ‘পূর্ণ প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ’ নির্বাচন হলে ভোটাররা কেন্দ্রমুখী হন।
ভোটার কম হওয়ার মূল কারণ হিসেবে সব দলের অংশগ্রহণ না থাকার কথাও বলেন আরেক বিশ্লেষক। তার মতে, দেশে কমবেশি সব দলেরই সমর্থক আছে। একটা বড় দল যখন নির্বাচনে যায় না তখন তার সমর্থকরাও ভোট দিতে চান না।
ভোটারদের আগ্রহ-অনাগ্রহের এমন অবস্থায় হয়ে গেল দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন; যেখানে বিএনপির বর্জনের মধ্যে ভোট পড়েছে প্রায় ৪২%। স্বতন্ত্রদের প্রতিযোগিতায় অনেক আসনে ভোটের মাঠ সরব হলেও ভোটের হার আগের নির্বাচনগুলোর তুলনায় সামগ্রিকভাবে খুব বেশি হয়নি।
এর আগে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারিতে ২৭% এবং ২০১৪ সালে ৪০% ভোট পড়েছিল।
অবশ্য উপ নির্বাচনে ৫% ভোট পড়ার রেকর্ডও রয়েছে মহামারীকালে ঢাকা-১০ এর উপ নির্বাচনে।
গত ৭ জানুয়ারির ভোটে ২৯৮ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ২২২, জাতীয় পার্টি ১১, স্বতন্ত্র ৬২, জাসদ ১, ওয়ার্কার্স পার্টি ও কল্যাণ পার্টি ১টি আসন পেয়েছে।
ভোটার উপস্থিতি তুলনামুলক কম হতে পারে এটা ইসিরও শঙ্কা ছিল।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল ভোট শেষে সন্ধ্যায় নিজেদের স্বস্তির কথা বলেছিলেন এভাবে, “নির্বাচন কমিশনের শঙ্কা ছিল ভোটার উপস্থিতি হয়ত আরও কম হবে। কারণ, জাতীয় নির্বাচনে একটা বড় পক্ষ যখন ভোট বর্জন করে এবং পরোক্ষভাবে প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়ে থাকে তার একটা সিম্পটম কয়েকটি কেন্দ্রে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। এসব দেখে অনেকের মনে হয়ত শঙ্কা জেগেছে, যে নির্বাচনটা সহিংস হবে। কিন্তু না, আমরা দেখেছি কেন্দ্রে উপস্থিত হয়ে ভোটাররা স্বতস্ফুর্তভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছে।”
ইসির পক্ষ থেকে চেষ্টার ত্রুটি করা হয় নি বলে জানান তিনি।
কম ভোটার উপস্থিতি: যা বলছেন বিশ্লেষকরা
যাত্রাবাড়ীর ভোটার নাফিজুল রহমান ভোট দিতে যাওয়ার ভিন্ন একটি কারণ তুলে ধরলেন। নির্বাচন নিয়ে তেমন আগ্রহ না থাকলেও ভোট দেওয়ার ছবি তুলে রাখতেই কেন্দ্রে গিয়েছিলেন তিনি।
নাফিজুল বলেন, “ভোট দেওয়ার কোনো ইচ্ছা ছিল না আমার। তিনটার দিকে মনে হইল ভোট দেওয়া উচিত, তাই দিয়ে একটা ছবি তুলে চলে এলাম।”
তার মতো কেউ কেউ ভিন্ন কারণে কেন্দ্রে এলেও ভোটের যে মূল আকর্ষণ প্রার্থীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা তা এবার হয়নি বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরাসহ অনেকেই।
নরসিংদীর ভোটার লুৎফুন্নাহার ফুরকানের মনে হয়েছে প্রার্থীদের প্রচারণাও এবার ভোটের লড়াই জমাতে পারেনি।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “যখন ছোট ছিলাম তখনকার নির্বাচনগুলো জমজমাট হতো। এবার তেমন হয়নি, কিন্তু আমি চাইনি আমার ভোটটা বৃথা যাক। আমার মনে হয়, ভোট প্রদানে মানুষদের উৎসাহিত করা উচিত।”
বিশ্লেষকরা মনে করেন, নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ না হওয়ায় ভোটাররা কেন্দ্রে যেতে আগ্রহী হননি। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দ্বৈরথ ছাড়া নাগরিকদের ভোটমুখী হওয়ার ‘যুক্তিসঙ্গত বাস্তবতা’ দেখছেন না তারা।
প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ২০০৮ সালের নির্বাচনে ৮৭% ও ২০১৮ সালে ৮০% ভোট পড়ার রেকর্ডও সে কথাই বলছে।
আবার এক দশকের ব্যবধানে ২০১৪ ও ২০২৪ সালে দুই বর্জনের ভোটে উপস্থিতি ৪০ শতাংশের আশেপাশে চলে আসার বিষয়টি এক সূত্রে গাঁথা বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
নিজ দলের স্বতন্ত্রদেরও ভোটে অংশ নেওয়ার সুযোগ করে দিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ স্থানীয় পক্ষগুলোকে ভোটমুখী করতে পারলেও তা বেশির ভাগ সাধারণ ভোটারদের মধ্যে তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি। আওয়ামী লীগই আবার ক্ষমতায় থাকছে-নির্বাচনের আগেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যাওয়ায় সাধারণরা যেমন যাননি, তেমনি নিজ দলেরও অনেকে কেন্দ্রে যাননি।
নির্বাচন বিশ্লেষক আব্দুল আলীম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ভোটারদের সামনে প্রকৃত পছন্দ থাকলে তারা কেন্দ্রে যেতে উৎসাহিত বোধ করেন। দেশে যে নির্বাচনগুলোতে ভোটার উপস্থিতি বেশি ছিল, সেই নির্বাচনগুলো ছিল ‘প্রকৃত অর্থে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ’ এবং তাতে সব দলের অংশগ্রহণ ছিল। ‘পূর্ণ প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ’ নির্বাচন হলে ভোটাররা কেন্দ্রমুখী হবে।
তার পর্যবেক্ষণ, এবার সব দলের অংশগ্রহণ ছিল না। বাংলাদেশে তো কমবেশি সব দলেরই সমর্থক আছে; একটা বড় দল যখন নির্বাচনে না যায়, তার সমর্থকরা ভোট দিতে চায় না।
“একই সঙ্গে যখন ভোটাররা মনে করে- এই এলাকায় এই প্রার্থী বা ওই প্রার্থী নিশ্চিত জিতে যাচ্ছেন বা হেরে যাচ্ছেন, তাহলে আমার আর ভোট কেন্দ্রে যাওয়ার দরকার নাই। এই চিন্তাগুলো যখন তাদের থাকে তখন তারা ভোট দিতে যেতে চায় না।”
এর সঙ্গে নির্বাচনি পরিবেশকেও দায়ী করছেন মানবাধিকার কর্মী খুশী কবির।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রায় সময় ভোটকেন্দ্রে সংঘর্ষের মত ঘটনা ঘটে, এজন্য অনেক ভোটার আসতে চায় না। এবার হরতাল ছিল, অনেকে না মানলেও কেউ কেউ তো আবার ভয় পায়। ঝামেলায় পরে কি না, আবার প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচনে ভোট দিলেও কী আসে যায়-এসব ভাবে তারা।”
ভোটারদের মতামত না নিয়ে দলীয়ভাবে প্রার্থী ঠিক করার ফলেও নির্বাচন নিয়ে অনাগ্রহ রয়েছে বলে করেন তিনি।
“এমনটা বৈশ্বিকভাবেই দেখা যায়। এর ফলে কয়েকজন প্রার্থী থেকে তাদের সিলেকশন করতে হয়, পছন্দের প্রার্থী সেখানে নাও থাকতে পারে। এসব কারণে একঘেয়েমি চলে আসে ভোটারদের।”
ভোটারদের কেন্দ্রে টানতে ভোট ব্যবস্থার পরিবর্তনে নজর দিতে বললেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার মনে করেন, প্রতিপক্ষ দলগুলোর মধ্যে ভারসাম্য না থাকায় অনেক ভোটার কেন্দ্রে আসতে চান না।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “যখন কোনো দলের জয়ের ভিত্তি নিশ্চিত থাকে, তখন সে দলের ভোটারদের বড় একটি অংশ কেন্দ্রে আসতে চায় না। কোন দলের পরাজয় নিশ্চিত থাকলেও তাদের সমর্থকরা কেন্দ্রে আসতে চান না। হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হলে তারা ঘর থেকে বের হতে চান।”
তার পর্যবেক্ষণ, কোন নির্বাচনে ভোট কেমন পড়বে তা ভোটের সার্বিক পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে।
“এবার আওয়ামী লীগের জয় নিশ্চিত ছিল, বিএনপিও নির্বাচন ত্যাগ করেছে- লড়াইটা আসলে তাদের মধ্যেই হয়। দুইদলই নির্বাচনে আসলে আরো বেশি ভোটার আসত। আওয়ামী লীগ সমর্থকদের একটি অংশ আসেনি। বিএনপি সমর্থকরাও যদি গণহারে কেন্দ্রে গিয়ে আওয়ামী লীগ বিরোধীকে ভোট দিত তাহলে হয়ত ভোটের হার বাড়ত।”
ভোটকেন্দ্রে না যাওয়ার কারণ, কী বলছেন তারা
সাভারে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের আভাস থাকলেও ভোট না দেওয়ার বিষয়ে মনীর চৌধুরী বলেন, “স্বতন্ত্র হোক আর দলীয় প্রতীক হোক- যেই আসছে ঘুরে ফিরে তো একই দলের লোক। আর জাতীয় রাজনীতিতেও এর প্রভাব পড়বে খুবই কম।”
পরিবারসহ ভোট দিতে যাননি মিরপুরের ব্যবসায়ী সবুজ মিয়াও।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ক্ষমতায় আবার কে আসবে সেটা তো সবার জানাই আছে। শুধু শুধু ভোট দিতে গিয়ে কী করব? নির্বাচনের একটা গতি থাকলে না ভোট দিতে মন চায়।”
নির্বাচনের দিন হরতালের কর্মসূচি দিয়েছিল ভোট বর্জন করা বিএনপি। দলটির লাগাতার আন্দোলনের মধ্যে ভোটের আগে দেশজুড়ে বিভিন্ন নাশকতার ঘটনা ঘটেছে। ভোটের আগের রাতে বেশ কয়েকটি ভোট কেন্দ্রেও আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।
সবুজ মিয়া ভোট কেন্দ্রে না যাওয়ার কারণ হিসেবে রাজনৈতিক সহিংসতার শঙ্কাকেও সামনে এনেছেন।
“জাতীয় পার্টি তো আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ হওয়ার মতো শক্তিশালী দল না। এজন্য হাঙ্গামার ভয় নিয়ে কেন ভোট দিতে যাব? ফলাফল যা হয়েছে, আমি ভোট দিলেও অন্য কিছু হত না। বিকল্প ভোট দেওয়ার মত তো কেউ ছিলই না।”
নতুন ভোটার নায়মা ইসলাম নৈশি বলেন, “তেমন উৎসব উৎসব লাগেনি আমার কাছে। ছোট বেলায় দেখতাম অনেক মিছিল হইত, তেমন হলে ভোট দিতে টানে। উৎসবমুখর ভোট হলে সামনে ভোট দেব।”
আরও পড়ুন
কেন্দ্রে যেতে কতটা আগ্রহী ভোটার
‘গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে’ আড়াই কোটি তরুণ ভোটার
দিবস পাশে রেখে ভোটাররা আস্থার খোঁজে
ভোটের হার ৪১.৮ শতাংশ, সন্দেহ হলে চ্যালেঞ্জ করতে বললেন সিইসি
২৫ হাজারেরও কম ভোট পেয়ে সংসদ সদস্য