অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশে তিনি বলেন, “হঠাৎ আপনারা আনুপাতিক ভোটের নির্বাচনের কথা সামনে এনে জটিলতা তৈরি করবেন না।”
Published : 18 Oct 2024, 04:00 PM
অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়ার পর সংসদ নির্বাচনে সরাসরি ভোটের বদলে ‘সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির’ পক্ষে যে আলোচনা শুরু হয়েছে, তাতে বিপদ দেখছেন বিএনপি নেতা রুহুল কবির রিজভী।
সরকারের উদ্দেশে তিনি বলেছেন, “হঠাৎ আপনারা আনুপাতিক ভোটের নির্বাচনের কথা সামনে এনে জটিলতা তৈরি করবেন না। আনুপাতিক হারে নির্বাচনের নামে জটিলতা তৈরি মানে স্বাধীনতাবিরোধীদের মদদ দেওয়া। আপনারা সুপরিকল্পিতভাবে কোনো জটিলতা তৈরি করবেন না।”
শুক্রবার সকালে শেরেবাংলা নগরে জিয়াউর রহমানের কবরে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রিজভী। সেখানে সমসাময়িক রাজনীতির বিভিন্ন বিষয়ের সঙ্গে নির্বাচন পদ্ধতির প্রসঙ্গও আসে।
বিশ্বব্যাপী গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রধানত দুই ধরনের ব্যবস্থা রয়েছে। প্রথমত, একটি নির্বাচনী এলাকায় প্রার্থীদের মধ্যে যিনি সর্বোচ্চ ভোট পাবেন, তিনি নির্বাচিত হবেন। এ পদ্ধতিকে বলা হয় ‘ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট’। বাংলাদেশে সংসদসহ অধিকাংশ নির্বাচনের ক্ষেত্রে এ পদ্ধতিই চালু রয়েছে।
অন্য পদ্ধতি হল সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা বা ‘প্রফেশনাল রিপ্রেজেনটেশন সিস্টেম’। এ পদ্ধতিতে আসনভিত্তিক কোনো প্রার্থী থাকবে না। ভোটাররা ভোট দেবেন দলীয় প্রতীকে। একটি দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সে অনুপাতে সংসদে তাদের আসন সংখ্যা নির্ধারণ হবে। অনেক দেশে এ দুটি পদ্ধতির মিশ্র ব্যবস্থাও চালু রয়েছে।
রাষ্ট্র সংস্কারের অংশ হিসেবে অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়ার পর বিভিন্ন দল এ বিষয়ে তাদের মত প্রকাশ করছে।
রাজধানীতে গত সপ্তাহে একটি সেমিনারে সিপিবি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় পার্টি, এবি পার্টি, গণসংহতি আন্দোলন ও গণ অধিকার পরিষদের প্রতিনিধিরা সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচনের পক্ষে মত দেন।
জামায়াতে ইসলামী সম্প্রতি সংবাদ সম্মেলন করে যে সংস্কার প্রস্তাবে তুলে ধরেছে, সেখানেও জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি চালুর কথা বলা হয়েছে। তবে বিষয়টি নিয়ে আপত্তি জানিয়ে আসছে বিএনপি।
রিজভী বলেন, “পৃথিবীর অনেক দেশ এই (আনুপাতিক ভোট) পদ্ধতি চালু করে ফিরে এসেছে। নেপাল চালু করেছিল, এলোমেলো হয়ে গেছে। একটা নতুন পদ্ধতি তৈরি করতে হলে সমাজ এবং জনগণের আকাঙ্ক্ষার মিল থাকতে হবে। সুশীল সমাজ এটার ওপর বক্তব্য রাখছেন, আর এটার ওপর ভিত্তি করে আপনারা যদি মনে করেন এটা সঠিক, তাহলে নির্বাচন ব্যবস্থা আরো ভেঙে যাবে।”
এই বিএনপি নেতার যুক্তি, “আনুপাতিক পদ্ধতিটা বুঝতেই চলে যাবে ৫-১০ বছর।অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে প্রত্যেকটা দল সমর্থন করেছে। এটা গণতন্ত্রকামী মানুষের সমর্থিত সরকার, আপনাদেরকে জনগণের অন্তরের ভাষাটা আগে বুঝতে হবে।”
‘ভারতকে অবস্থান বদলাতে হবে’
যার বিরুদ্ধে ‘গণহত্যার’ অভিযোগে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে, সেই শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দিয়ে ভারত ‘অপরাধকে আশ্রয় দিচ্ছে’ বলে মন্তব্য করেছেন রিজভী।
তিনি বলেন, “পতিত স্বৈরাচার বসে নেই। গতকাল প্রতিবেশী দেশের একটা স্টেটমেন্ট দেখেছেন, তারা স্পষ্ট ভাষায় বলেছে, শেখ হাসিনা সেখানে (ভারত) আছে।
শেখ হাসিনাকে ‘সর্বশ্রেষ্ঠ শীর্ষ সন্ত্রাসী’ আখ্যা দিয়ে রিজভী বলেন, তাকে (শেখ হাসিনা) আশ্রয় দেওয়া মানে অপরাধকে আশ্রয় দেওয়া। অন্যায়কে আশ্রয় দেওয়া, খুনিকে আশ্রয় দেওয়া। গতকাল তাদের (ভারতের) বক্তব্য দেখে মনে হচ্ছে, তারা বিগ ব্রাদারের মত আচরণ করেছে। এই অবস্থান থেকে তাদের বেরিয়ে আসতে হবে।”
ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তি থাকার কথা মনে করিয়ে দিয়ে রিজভী বলেন, “গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হওয়ায় কূটনৈতিক আলাপ আলোচনার মাধ্যমে প্রত্যর্পণের বিষয়টি সমাধান করতে পারে, তাকে ফিরিয়ে আনতে পারে। তা না হলে বাংলাদেশে যত শীর্ষ সন্ত্রাসী আছে, তারা সেখানে (ভারতে) আশ্রয় পাওয়ার সুযোগ নেবে।”
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন দমনের চেষ্টায় ‘গণহত্যার’ দুই অভিযোগে বৃহস্পতিবার সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৪৬ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
গত ৫ অগাস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর থেকে সেখানেই আছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। তার সরকারের সেতুমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের বিরুদ্ধেও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। আগামী ১৮ নভেম্বরের মধ্যে আসামিদের আদালতে হাজির করার নির্দেশ দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল।
‘পতিত স্বৈরাচার এখনো সক্রিয়’
চেয়ারম্যানের অপসারণের দাবিতে পল্লী বিদ্যুতের কর্মীরা যে আন্দোলন শুরু করেছেন, তার পেছনে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের হাত দেখতে পাচ্ছেন বিএনপি নেতা রিজভী।
তিনি বলেন, “এখনো স্বৈরাচারের হিংস্র থাবা থেকে মুক্ত হতে পারছি না। গতকাল হঠাৎ করে বিদ্যুৎ ৫০-৬০টি জেলায় শাটডাউন করা হয়েছে। এরা কারা? আমরা কিন্তু প্রায় দিনই বলেছি, স্বৈরাচারের দোসররা ভেতরে আছে, এরা কিন্তু নাশকতা করবে।
বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা, প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান পল্লী বিদ্যুৎ সংস্থাটি গঠন করেছিলেন, সে কথা তুলে ধরে রিজভী বলেন, “এক মহৎ উদ্যোগ নিয়ে গোটা জাতিকে আলোকিত করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন জিয়াউর রহমান। যেহেতু এটি জিয়াউর রহমান প্রতিষ্ঠা করেছেন, এটি ধ্বংস করার জন্য স্বৈরাচার শেখ হাসিনা নানা ষড়যন্ত্র করেছিল। তারা এ নামটি রাখতে চায় না। গতকাল সে ঘটনা ঘটিয়েছে এটি একটি গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ।”
তিনি বলেন, “তাদের দাবি-দাওয়া থাকলে সরকারের কাছে আবেদন নিবেদন করতে পারত। কিন্তু তারা তা না করে গতকাল শাটডাউন করল কেন? করাণ এটি গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ, এটি নাশকতা। তারা শেখ হাসিনার আমলে এ কর্মসূচি নেয়নি কেন? কারণ এরা শেখ হাসিনার অনুচর।
“এ কর্মসূচির সাথে যারা জড়িত, তারা সরাসরি শেখ হাসিনার লোক। কথিত স্বৈরাচারের প্রেতাত্মারা ভৌতিক অস্তিত্ব নিয়ে ভিতরে ভিতরে ঢুকে আছে। এ প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করতে তারা ষড়য়ন্ত্র করছে।”
অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশে রিজভী বলেন, “আরও বেশি সতর্ক হোন, না হলে এই রক্তের বিনিময়ে যে অর্জন, বাচ্চা ছেলেদের, স্কুল কলেজের ছেলে মেয়েদের আত্মদানে যে অর্জন, আমরা গণতন্ত্রের পথে যে যাত্রা করছি, তা রোধ করে ফেলবে।
“আপনারা সংস্কারের কথা বলে যে বিলম্ব করছেন, তাতে মানুষের মনে সন্দেহ তৈরি হবে। যদি আপনাদের আন্তরিকতা থাকে, তাহলে দ্রুত সংস্কার করে জনগণের ক্ষমতা জনগণের হাতে ফিরিয়ে দিন।”
জিয়াউর রহমান ফাউন্ডেশনের ২৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে সংগঠনটির নেতা-কর্মীদের নিয়ে শুক্রবার সকালে শেরেবাংলা নগরে জিয়াউর রহমানের সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন রিজভী। জিয়াউর রহমান ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ফরহাদ হালিম ডোনার, অধ্যাপক মোর্শেদ হাসান খান, শামীমুর রহমান শামীম, পারভেজ রেজা কাকনসহ নেতৃবৃন্দ সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
১৯৯৯ সালের ১৮ অক্টোবর জিয়াউর রহমান ফাউন্ডেশনের যাত্রা শুরু। প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের স্মৃতি রক্ষায় এ প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান তিনি।
'একটি উদ্যোগ, একটু চেষ্টা এনে দেবে স্বচ্ছলতা, দেশে আসবে স্বনির্ভরতা' স্লোগান নিয়ে গরিব এবং অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে কাজ করে আসছে সংগঠনটি।
প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে বিকালে রমনার ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউশন মিলনায়তনে রয়েছে আল্চেনা সভা। সেখানে ইন্টারনেটের মাধ্যমে যুক্ত হয়ে বক্তব্য দেবেন তারেক রহমান।