তিনি বলেন, “এর মাধ্যমে বয়কট, সহিংসতা এবং অন্যান্য অপ্রীতিকর বিষয় দূর হবে। বিজয়ী সব কিছু নিয়ে নেবে, এটা আর ঘটবে না। কারণ, এক্ষেত্রে নিরঙ্কুশ বিজয়ী কেউ নেই।”
Published : 24 Dec 2023, 10:45 PM
বাংলাদেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের পরস্পরবিরোধী অবস্থান যে পর্যায়ে গেছে তাতে রাজনীতি ও নির্বাচনে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের কোনো আপাত সম্ভাবনা দেখছেন না স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ। তবে সংসদে সংখ্যানুপাতিক ভোটের পদ্ধতি চালু করা গেলে পরিস্থিতি পাল্টাবে বলে বিশ্বাস করেন তিনি।
কোনো দল জাতীয় নির্বাচনে যত শতাংশ ভোট পাবে, সংসদে তারা সেই অনুপাতে আসন পাবে, এই পদ্ধতি সুশাসন নিশ্চিতেও গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে বলে মনে করেন তিনি।
তার মতে, এখন ভোটের হিসাবে প্রধান দুই দলের মধ্যে তেমন পার্থক্য না থাকলেও সংসদে আসন সংখ্যায় ব্যাপক পার্থক্য হওয়ার কারণে ক্ষমতা কাঠামোতে ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়। কিন্তু সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনে সেটি হবে না। তখন আদর্শভিত্তিক ছোট দলগুলোও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে, তারা বড় দলগুলোতে চাপ দিতে পারবে। সে ক্ষেত্রে জোট হবে নির্বাচনের পরে আর বড় দলগুলো ছোটদের শর্ত মেনেই সে পথে হাঁটবে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের নিয়মিত আয়োজন ‘ইনসাইড আউট’ এ অংশ নিয়ে এই মত প্রকাশ করেন অধ্যাপক তোফায়েল।
ইংরেজি ভাষায় প্রচারিত এই আলোচনার এবারের বিষয় ছিল ভোট বর্জন এবং রাজনৈতিক বিভেদ। অনুষ্ঠানটি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের ফেইসবুক পেইজ ও ইউটিউব পেইজেও প্রচার করা হয়।
বাংলাদেশে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ভোট বর্জনের প্রবণতা, ক্ষমতায় থাকলে এবং ক্ষমতার বাইরে গেলে অবস্থান পাল্টে যাওয়া, নির্বাচনে সহিংসতা, যেনতেনভাবে জিতে আসার প্রবণতা নিয়ে একাধিক প্রশ্নে তোফায়েল আহমেদ প্রথমে হতাশা প্রকাশ করে বলেন, এখানে শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের কোনো সম্ভাবনা তিনি দেখেন না। কারণ, রাজনৈতিক দলগুলো পেশিশক্তিকে হাতিয়ার করতে চায়।
পরে এক প্রশ্নে তিনি বলেন, সংসদ নির্বাচনে আসনভিত্তিক জয়ের পদ্ধতির বদলে দলের ভোটের অনুপাতে সংসদে আসন বণ্টন পদ্ধতি চালু হওয়া একটি বিকল্প হতে পারে।
শ্রীলঙ্কা ও নেপালসহ ৯৭টি দেশে এই পদ্ধতিতে সরকারের গঠনের উদাহরণ টেনে তোফায়েল বলেন, “সুতরাং আমাদের দেশেও সব দলকে নির্বাচনে পাওয়ার জন্য এটা একটি উৎকৃষ্ট সমাধান হতে পারে।
“এবং এর মাধ্যমে বয়কট, সহিংসতা এবং অন্যান্য অপ্রীতিকর বিষয় দূর হবে। বিজয়ী সব কিছু নিয়ে নেবে, এটা আর ঘটবে না। কারণ, এক্ষেত্রে নিরঙ্কুশ বিজয়ীa কেউ নেই।”
নিজের বক্তব্যের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরতে গিয়ে ১৯৯১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত চারটি নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করার কথা জানান তোফায়েল।
তিনি বলেন, “তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে এই চার নির্বাচন অনেকটা ভালো ছিল। কিছু প্রশ্ন থাকলেও সেগুলো ভালো নির্বাচনই ছিল। ফল বিশ্লেষণ করলে আপনি কী দেখতে পাবেন?
“সব সময়ই যারা ভোটে সংখ্যালঘু ছিল তারাই শাসন করেছে। হয়ত ৩৫ শতাংশ ভোট বা সর্বোচ্চ ৪০ শতাংশ যারা পেয়েছে, ৬৫ ভাগ ভোটের উপর শাসন করেছে। এটা সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার পদ্ধতি।”
এই পদ্ধতি পাল্টে সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্বে পরিবর্তন করলে কী হত, তার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, “১৯৯১ সালে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের ভোটের পার্থক্য কিন্তু ছিল এক শতাংশেরও কম। কিন্তু বিএনপি একচেটিয়া শাসন করেছে।
“কিন্তু এই (সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব) পদ্ধতিতে তা ঘটত না। আমি হিসাব করে দেখিয়েছি, তখন বিএনপির আসন হত ৯৬ থেকে ৯৭টি আসন হত। আওয়ামী লীগের আসন হয়ত হত ৯৩ থেকে ৯৫টি।”
সমানুপাতিক পদ্ধতি, প্রত্যেকটি ভোটের হিসাব হয় জানিয়ে বর্তমান নির্বাচন পদ্ধতি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, “যদি কোথাও ১০০ ভোটের জন্য তিন জন প্রার্থী থাকে, একজন ৩০ শতাংশ আর বাকিরা ২৫ শতাংশ করে পেল। তাহলে যিনি ৩০ শতাংশ পেলেন, তিনি ৭০ শতাংশের ভোটারকে শাসন করবেন। কিন্তু সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব হলে যে (যারা) ২৫ শতাংশ ভোট পেয়েছে, তারও সমানুপাতে আসন থাকত।”
সমানুপাতিক পদ্ধতি রাজনীতিতেও গুণগত পরিবর্তন আনবে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “সুনিদিষ্ট আদর্শের ভিত্তিতে চলা ছোট ছোট দল বর্তমানে এক-দুটা আসন পাচ্ছে। কিন্তু সরকার ব্যবস্থাপনায় তারা কিছু বলতে পারে না। সমানুপাতিক পদ্ধতিতে তারা খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।
“সেখানে কোনো দলের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার ঘটনা বিরল। এজন্য সব সময় বড় দলগুলোর ছোটো দলগুলোকে দরকার হয়, তারা কোয়ালিশন করছে।”
সুইজারল্যান্ডে একশ বছর ধরে স্থায়ী কোয়ালিশন আছে বলেও জানান তিনি।
ভোট বর্জনের শেষ কোথায়?
আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি- তিন সরকারের আমলেই বিরোধী দলের ভোট বর্জনের কথা তুলে ধরে তোফায়েল বলেন, এটা বাংলাদেশে কোনো নতুন ঘটনা নয়। তিনি জানান, ১৯৮৬ সালে বিএনপির তৃতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জনের আগে উপজেলা নির্বাচন দুই প্রধান দলই বর্জন করেছে।
এরপর ১৯৮৮ সালে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ও তার সঙ্গে আন্দোলনে থাকা অন্যরা, ২০০৬ সালে আওয়ামী লীগ ও সমমনাদের এবং ২০১৪ সালে ও এবার বিএনপি ও তার সঙ্গে থাকা দলগুলোর বর্জনের কথা তুলে ধরেন তিনি।
এর সমাধান কীভাবে- সেই প্রশ্নে তোফায়েল বলেন, এটা কঠিন কিছু নয়, তবে সদিচ্ছা থাকতে হবে আর আলাপ আলোচনা করে আগাতে হবে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের দাবি মেনে বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করেছে।
২০০৭ সালে আওয়ামী লীগের আন্দোলনের মুখে সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছর ক্ষমতায় থাকা, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের কথাও তুলে ধরেন তিনি।
দুই প্রধান দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে এ রকম প্রচণ্ড আপসহীন মনোভাব গণতান্ত্রিক দর্শনের সঙ্গে যায় কি না- সে প্রশ্নে তিনি বলেন, “এটা একদমই যায় না। এ জন্য আপনাকে সংলাপ করতে হবে। সমস্যা সমাধানে আন্তরিকতা থাকতে হবে। যদি আপনার অঙ্গীকার থাকে, তাহলে সমস্যার সমাধান করতে পারবেন।
“আরেকটা সমস্যা হলো আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো কেবল ক্ষমতার জন্য রাজনীতি করে। রাজনীতি অবশ্যই ক্ষমতার জন্য। তবে তা হতে হবে ‘পাওয়ার প্লাস’। এখানে আরও অন্যান্য বিষয় আছে। আপনার কোনো না কোনো আদর্শ থাকতে হবে, আপনাকে দেশের মূল্যবোধের ভিত্তি থাকতে হবে, আপনাকে দেশের জনগণের কথা ভাবতে হবে। সেটা যদি না থাকে এবং কেবল ক্ষমতার জন্য রাজনীতি করেন, তাহলে এমন একগুঁয়ে ধরনের রাজনীতিই হবে।”
আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী উন্মুক্ত করার কী প্রভাব?
এবারের ভোট শান্তিপূর্ণ হবে কি না, এই প্রশ্নে তোফায়েল আহমেদ বলেন, “কেন নয়? কারণ এখানে বলার মতো প্রতিপক্ষ তো নেই। এখন যে লড়াই ও সহিংসতা দেখতে পারছেন, সেটা কিন্তু ‘ফ্রেন্ডলি ফায়ার’।”
তবে বাংলাদেশে এখনকার বাস্তবতায় সবার অংশগ্রহণে শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের কোনো আশা দেখছেন না তিনি। কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, “আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো তো শান্তিপূর্ণ না। তারা ভাবেন আন্দোলন করতে গেলে জনগণের জন্য ভোগান্তি তৈরি করতে হবে।
“আমাদের রাজনীতি ও রাজনৈতিক দলগুলো সহিংস। তারা সহিংসতাকে জয়ের হাতিয়ার করেছে। ফলে এখানে সহিংসতা হতেই থাকবে।”
স্বতন্ত্রদের সঙ্গে দলীয় প্রার্থীদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও সংঘাতের ফলে আওয়ামী লীগের শৃঙ্খলায় বড় কোনো প্রভাব পড়বে না বলে মনে করছেন তোফায়েল।
অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের স্বার্থে দলের অনুমতি নিয়ে প্রার্থীদের এই সুযোগ ব্যবহারের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আমি মনে করি না, দলের সর্বোচ্চ পর্যায়ে এটা কোনো সমস্যা তৈরি করবে। তবে তৃণমূলে কিছু সমস্যা তৈরি হবে। বিরোধ ইতোমধ্যে তৈরি হয়েছে, তা চালু থাকবে।”
স্বতন্ত্র প্রার্থী উন্মুক্ত করে দেওয়ায় ভোটের হারে প্রভাব পড়বে কি না- এই প্রশ্নে তোফায়েল বলেন, এটা হতে পারে। স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কারণে ভোটের হার বাড়তে পারে।
তিনি বলেন, “ভোটারদের কেন্দ্রে ধরে আনা হবে। কেউ তাদের দলের জন্য আসবে। কিন্তু গণ অংশগ্রহণটা সেভাবে হবে না।“
কীভাবে টেনে ভোটারদের টেনে আনা হবে, তার একটি ধারণা দিয়ে তোফায়েল আহমেদ বলেন, “আমি নিশ্চিত নই, তারা ভোটকেন্দ্রে স্বেচ্ছায় আসবে নাকি ফাঁদ পেতে আনা হবে। এক্ষেত্রে দু-তিনটি বিষয় কাজ করবে।
“যেমন, সরকার জনগণের মধ্যে কিছু সুবিধাভোগী তৈরি করেছে, ভিজিডি, ভিজিএফ বা সামাজিক নিরাপত্তার বিভিন্ন ভাতাভোগী। সুতরাং তারা এসব মানুষকে বাধ্য করছে যে, তোমাকে ভোট কেন্দ্রে আসতেই হবে। নয়ত কার্ড বাতিল হয়ে যাবে।
“আরেকটা বিষয় হচ্ছে, ‘তুমি যদি ভোট দিতে না যাও, আমরা ভাবব তুমি অন্য দলকে সমর্থন করো। সুতরাং নাগরিক হিসাবে যে সুবিধা পাও সেটা থেকে তোমাকে বঞ্চিত করা হবে। এসব বিষয় বর্তমানে মাঠে চলছে।”
‘প্রবাসী ভোটারদের বাদ দিয়ে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হয় না’
প্রায় দেড় কোটি প্রবাসী বাংলাদেশির ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ তৈরি আহ্বান জানিয়ে এক প্রশ্নে তোফায়েল আহমেদ বলেন, “আমরা অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা বলছি। তবে, এক-দশমাংশ ভোটারকে নির্বাচন পদ্ধতির বাইরে রেখে অংশগ্রহণমূলক কীভাবে হয়? আপনি এটা (অংশগ্রহণমূলক) করতে পারবেন না।”
প্রবাসী বাংলাদেশি ও অন্য কারণে ভোটকেন্দ্র থেকে দূরে থাকা নাগরিকদের ভোটের অংশগ্রহণের ব্যবস্থা করাকে ‘বিশাল ব্যাপার’ হিসাবে অভিহিত করেন এই রাজনীতি ও স্থানীয় সরকার বিশ্লেষক।
তিনি বলেন, “আমরা সত্যিকার অর্থে সংবিধানবিরোধী কাজ করছি। আপনি ১ কোটি ২০ লাখ বিদেশে কর্মরত জনগণকে ভোট থেকে বঞ্চিত করতে পারেন না।
“এবং যারা দেশে থাকলেও নানা কারণে কেন্দ্রে যেতে পারে না; অসুস্থ, বয়স্ক কিংবা কেন্দ্রে যাওয়া বেশ খরুচে হওয়া।”
এক্ষেত্রে পোস্টাল ব্যালটের আইনি পদ্ধতিকে বিস্তৃত পরিসরে কাজে লাগানোর সুপারিশ করে তোফায়েল বলেন, “পোস্টাল ব্যালট এখন খুব জনপ্রিয় হচ্ছে। সুইজারল্যান্ডে ৯০ শতাংশ ভোট পড়ে পোস্টাল ব্যালটে।”
“বাংলাদেশের নাগরিকদের পরিচয় এখন ডিজিটাইজড হয়েছে, জাতীয় পরিচয়পত্র রয়েছে। এবার সময় চলে গেছে, পরেরবার থেকে পোস্টাল ব্যালটের পদ্ধতি সবার জন্য উন্মুক্ত হোক। যারা পোস্টাল ব্যালটে বা অন্য কোনো ডিজিটাল ডিভাইসে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে চায়, তাদেরকে সেটার অনুমতি দেওয়া উচিত। এবং তেমন ভোটের পদ্ধতি চালু করা উচিত।”
এই ডিজিটাল ব্যবস্থাপনায় ভোটাধিকার প্রয়োগের পদ্ধতি তৈরির কাজ ‘জটিল হলেও অসম্ভব নয়’ বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “এটা সম্ভব। ভোটে সবার অংশগ্রহণের জন্য এটা গুরুত্বপূর্ণ।”