“কয়েকশ লোক মিছিল নিয়ে স্কুলে এসে আমার পদত্যাগ দাবি করে। তারা ককটেল ফাটিয়ে ভীতিকর পরিবেশ তৈরি করে।”
Published : 18 Apr 2025, 07:52 PM
দুর্নীতির অভিযোগ তুলে সীতাকুণ্ডের ভাটিয়ারী হাজী তোবারক আলী উচ্চ বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক কান্তি লাল আচার্য্যকে জোর করে পদত্যাগপত্রে সই করানোর ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে প্রশাসন।
কান্তি লাল অভিযোগ করেছেন, স্থানীয় ওয়ার্ড বিএনপির নেতাকর্মীদের ‘চাপে‘ জোর করে পদত্যাগপত্রে তার সই নেওয়া হয়। পরে তিনি বিচার চেয়ে স্থানীয় প্রশাসন ও চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ড চেয়ারম্যান বরাবর আবেদন করেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে শুক্রবার কান্তি লাল বলেন, ‘‘দুর্নীতি নয়, স্কুল পরিচালনায় অ্যাডহক কমিটি করা নিয়ে বিরোধের জেরে এ ঘটনা ঘটানো হয়েছে। মাইনরিটি হওয়ায় তারা আমার এ অবস্থা করতে পেরেছে।‘‘
ঘটনার বর্ণনায় কান্তি লাল বলেন, “বুধবার কয়েকশ লোক মিছিল নিয়ে স্কুলে এসে আমার পদত্যাগ দাবি করে। তারা ককটেল ফাটিয়ে ভীতিকর পরিবেশ তৈরি করে। এরপর জোর করে পদত্যাগপত্রে সই নেয় এবং গাড়িতে তুলে আমাকে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়।
“সেদিন স্কুল কমিটির সভাপতি মহিউদ্দিনও উপস্থিত ছিলেন। স্থানীয় বিএনপির সভাপতি নুরুল আনোয়ারও তখন ছিলেন এবং তার লোকজনই এ ঘটনা ঘটিয়েছে। আমার এক ছাত্রও তাদের হামলায় আহত হন।”
এ ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়।
ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান নুরুল আনোয়ার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ওই শিক্ষক ও তার লোকজন ১৭ বছর ধরে ঐতিহ্যবাহী এ স্কুল লুটেপুটে খাচ্ছে। সেজন্য এলাকাবাসী উনার পদত্যাগ চাইছে। ভাটিয়ারী এলাকার লোকজন সেখানে মিছিল নিয়ে গিয়েছিল, আমরাও তাদের সঙ্গে গিয়েছিলাম।”
কেউ জোর করে পদত্যাগ করায়নি দাবি করে তিনি বলেন, “উনি জনগণের চাপে পদত্যাগ করেছেন। ওনার দুর্নীতির বিচার করতে হবে।”
কান্তি লাল আচার্য্য বলেন, “গত ৬ এপ্রিল স্কুলের অ্যাডহক কমিটি বোর্ড থেকে অনুমোদন নেয়। কমিটির সভাপতি করা হয় মহিউদ্দিন আহমেদকে। এটা নিয়ে স্থানীয় বিএনপির লোকজনের মধ্যে প্রতিক্রিয়া হয়। গত পহেলা বৈশাখে স্কুলের অনুষ্ঠান পণ্ড করে দেওয়া হয়। বিষয়টি স্থানীয় উপজেলা প্রশাসনও অবগত।
অ্যাডহক কমিটি গঠন নিয়ে বিরোধ থেকেই জোর করে পদত্যাগপত্রে সই নেওয়া হয় দাবি করে তিনি বলেন, “সাধারণত কমিটির সভাপতি হিসেবে তিনজনের তালিকা দিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে পাঠাই। পরে সেটি চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন কার্যালয় থেকে শিক্ষাবোর্ড কার্যালয়ে পাঠানো হয়। বোর্ড থেকে একজনকে চূড়ান্ত মনোনয়ন দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে। এখানে আমার করার কিছুই নাই।”
৩৫ বছর ধরে ওই স্কুলে শিক্ষকতা করে আসা বাণিজ্য বিভাগের শিক্ষক কান্তি লাল বলেন, এভাবে জোর করে সই নিয়ে পদত্যাগ করানো দুঃখজনক। সংখ্যালঘু হওয়ায় সমস্যা বেশি করেছে এবং একই কারণে আমার এ অবস্থা করতে পেরেছে। আমি বর্তমানে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি।”
স্কুলের অ্যাডহক কমিটির সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, “আমি ওই স্কুল এবং ওই শিক্ষকের সরাসরি ছাত্র। কী কারণে তারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে, আমার বোধগম্য নয়। তারা তাণ্ডব চালিয়ে এসব করেছে।”
তিনি বলেন, “আমি পরিচালনা কমিটির সভাপতি হয়েছি সেটা তারা হয়তো মানতে পারছে না। এটি অনেক পুরাতন স্কুল। আমি এখানকার প্রাক্তন ছাত্র পরিষদের সদস্য সচিবও। তারা আমাকে বললে ওই শিক্ষকের সম্মান রক্ষার্থে আমি পদ ছেড়ে দিতাম।”
তদন্ত শুরু
চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ইলিয়াছ উদ্দিন আহাম্মদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ওই শিক্ষক আমাকে অভিযোগ দিয়েছেন। ঘটনাটি তদন্ত করতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। প্রতিবেদন পাওয়ার পর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
সীতাকুণ্ড উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফখরুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কোন শিক্ষককে এভাবে যেন হ্যারাস করে পদত্যাগ করানো না হয়, সে ব্যাপারে সরকারি নির্দেশনা আছে। কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে সেটা প্রয়োজনে তদন্ত করে বিচার হবে।
তিনি বলেন, “ওই স্কুলের ঘটনা জেনেছি। ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। এ ঘটনায় আইনগতভাবে যেটা করা দরকার, সেটা করা হবে।”
‘বাবার অপদস্ত দেখে ঘুমাতে পারছি না‘
জোর করে পদত্যাগ করানো এবং তাকে ‘হেনস্তার’ ভিডিওর একটি অংশ ফেইসবুকে দিয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন শিক্ষকের মেয়ে ভাবনা আচার্য্য।
তিনি লিখেছেন, ‘‘...জানেন, আমরা মেয়েরা বাবার অপদস্ত হওয়ার ভিডিও দেখে রাতে ঘুমাতে পারছিনা। ভাবুন উনি শিক্ষক নয় শুধু, উনি আমাদের বাবা। আপনার বাবার সাথে এমন হলে আপনার কেমন লাগবে বলুন!‘‘
ভাবনা আচার্য্য লিখেন, “স্কুলে ঝামেলা হওয়ার আগে বাবাকে মানা করা হয় যেতে। বলছিল, স্কুলে গেলে অপমান হতে হবে। বাবা সেই কথার উত্তরে বলেন, " আমি কোন অন্যায় করিনি, আমার কোন অপরাধ নেই। আমাকে পদ থেকে সরে যেতে বললে নির্দ্বিধায় আমি সরে যাবো। তবুও আমি স্কুলে যাব। আমি কেন পালিয়ে বেড়াবো। কেউ আমার অপরাধের প্রমাণ আনতে পারলে আনুক।"
হতাশার সুরে ভাবনা লেখেন, ‘‘কি সুন্দর তাই না! আমার বাবা কত মানুষকে ঘরে রেখে পড়িয়েছেন, কত মানুষকে টাকা ছাড়া পড়িয়েছেন, কত মানুষের ফি মওকুফ করেছেন। আজ একজন শিক্ষকের এই পরিণতি! আমার বাবা অসুস্থ হয়ে গেছে বিশ্বাস করেন। আমার বাবা এবং আমরা কেউ মানতে পারছিনা যে একজন মানুষ ৩৫ বছর চাকরিরত থাকার পর তাঁর এই পরিণতি।
ভাবনা লেখেন, “একজন শিক্ষকের এই অপমান! পৃথিবীতে একমাত্র হীন জাতি আমরা, যারা পদে পদে শিক্ষকদের টার্গেট করে এই অপমানজনক পরিস্থিতি উপহার দিচ্ছি।”