২০১২ সালে ছাত্রলীগ কর্মীদের হামলায় নিহত হন জুবায়ের।
Published : 10 Jan 2024, 06:06 PM
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র জুবায়ের আহমেদ হত্যার একযুগেও রায় কার্যকর না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছে পরিবার।
২০১২ সালের ৮ জানুয়ারি ইংরেজি বিভাগের ৩৭তম ব্যাচের (২০০৭-০৮ শিক্ষাবর্ষ) শিক্ষার্থী জুবায়ের আহমেদ বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ‘উপাচার্য মদদপুষ্ট’ বলে পরিচিত ছাত্রলীগ কর্মীদের হামলায় আহত হন। পরদিন ঢাকার ইউনাইটেড হাসাপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি।
হত্যাকাণ্ডের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন নিবন্ধক হামিদুর রহমান বাদী হয়ে আশুলিয়া থানায় মামলা করেন। পরে ওই বছর ৮ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৭তম ব্যাচের বিভিন্ন বিভাগের ১৩ ছাত্রের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেন আশুলিয়া থানার তদন্ত কর্মকর্তা মীর শাহীন শাহ পারভেজ। পরে আন্দোলনের মুখে মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে হস্তান্তর করা হয়।
মামলার রায় অনুযায়ী, ১৩ আসামির মধ্যে পাঁচজনকে মৃত্যুদণ্ড, দুইজনকে যাবজ্জীবন ও এবং ছয়জনকে খালাস দেওয়া হয়। যদিও ওই সাতজনের রায় এখনও কার্যকর করা সম্ভব হয়নি।
সাজা হওয়ার পরও কার্যকর না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছে জুবায়েরের বড় ভাই সিলেটের লিডিং ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আল মামুন।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা খুবই হতাশ যে প্রশাসন সাজা কার্যকরের ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। নিঃসন্দেহে এটা প্রশাসনের গাফিলতি। প্রশাসনের সদিচ্ছা থাকলে সাজা কার্যকর করা সম্ভব। আসলে তাদের সদিচ্ছা নেই। যদি থাকত তাহলে আসামির কাঠগড়া থেকে পালিয়ে বিদেশে চলে যেতে পারত না। নিশ্চয়ই প্রশাসনিক সুবিধা নিয়েই আসামিরা এসব করতে পেরেছিল।”
তিনি আরও বলেন, “আব্বা-আম্মা জুবায়েরের মৃত্যুর পর থেকেই অসুস্থ। জুবায়েরের প্রসঙ্গ আসলেই ওনারা হাউমাউ করে কান্নাকাটি করেন। আব্বা সব সময় বলেন, আসামিদের শাস্তি দেখে যেতে পারলে তিনি শান্তি পেতেন।”
রায় একদিন কার্যকর হবে বলে বিশ্বাস জুবায়েরের বড় ভাইয়ের। তিনি বলেন, “আমরা চাই, আসামিরা যেখানেই থাকুক তাদেরকে যেন দেশে প্রত্যাবর্তন করে শাস্তি নিশ্চিত করা হয়। যেন একটা দৃষ্টান্তমূলক কাজ হয়। সাজা যদি কার্যকর হয় তাহলে শিক্ষাঙ্গনে কেউ এরকম মার্ডার করতে সাহস করবে না।”
তৎকালীন উপাচার্য শরীফ এনামুল কবিরের মদদে জুবায়েরের হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল বলে দাবি করেন মামুন।
এ ব্যাপারে তিনি বলেন, “উপাচার্য এবং শিক্ষক হিসেবে তিনি ‘অনৈতিক’ একটি কাজ করেছিলেন। এটি একই সঙ্গে ‘বেআইনি’ও। আমরা এও দেখেছি ওই উপাচার্য আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু সরকার ওনাকে তিরস্কারের পরিবর্তে পিএসসির সদস্য বানিয়ে পুরস্কৃত করেছিল।
তিনি আক্ষেপ করে বলেন, “৯ জানুয়ারি আমাদের পরিবারের জন্য খুবই কষ্টের একটি দিন। শুনেছি আসামিরা বিদেশে অবস্থান করছে কেউ কেউ নাকি দেশে এসে ঘুরেও যাচ্ছে। শুনেছি মালয়শিয়া, ডেনমার্ক এসব দেশে নাকি আসামিরা আছে।
“আমি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে যারা আছেন তাদের কাছে অনুরোধ করব এরকম হত্যাকাণ্ডের পুনরাবৃত্তি যদি ঠেকাতে হয় তাহলে আসামিদের বিদেশ থেকে এনে তাদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।”
মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া পাঁচজন হলেন- খন্দকার আশিকুল ইসলাম, রাশেদুল ইসলাম, জাহিদ হাসান, মাহবুব আকরাম ও খান মোহাম্মদ রইস।
যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ পাওয়া আসামিরা হলেন- শফিউল আলম সেতু, অভিনন্দন কুণ্ডু অভি, কামরুজ্জামান সোহাগ, ইশতিয়াক মেহবুব অরূপ, মাজহারুল ইসলাম ও নাজমুস সাকিব তপু।
পরবর্তীতে ২০১৮ সালের ২৪ জানুয়ারি জুবায়ের আহমেদ হত্যা মামলায় পাঁচজনের ফাঁসি এবং দুই জনের যাবজ্জীবন সাজা বহাল রাখে হাই কোর্ট।
এ ছাড়া বিচারিক আদালতে যাবজ্জীবন সাজার রায় পাওয়া ছয় আসামির মধ্যে চারজনকে খালাস দেয় হয়।
যাবজ্জীবন বহাল থাকা দু’জন হলেন ইশতিয়াক মেহবুব ও নাজমুস সাকিব।
তৎকালীন সময়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর’ ব্যানারে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল তার অন্যতম সংগঠক ছিলেন ছাত্রফ্রন্ট জাবি শাখার তৎকালীন সভাপতি নাসির উদ্দিন প্রিন্স।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “জুবায়ের হত্যাকাণ্ডে আসামিরা পালিয়ে বেড়াচ্ছে। এটি বিচারহীনতার একটি ছাপ। সারা বাংলাদেশেই এটি চলছে। আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষগুলোও এখন ক্ষমতাসীন সংগঠনকে বিভিন্ন অপকর্মকে প্রশ্রয় দিচ্ছে যেটা জুবায়েরের হত্যার সময়ও ঘটেছিল। এগুলো নতুন কিছু না।”
এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক ও শিক্ষক মঞ্চের আহ্বায়ক রায়হান রাইন বলেন, “দেশের বিচারব্যবস্থা, রাজনীতি কিংবা শাসনব্যবস্থা সব তো এখন একাকার হয়ে আছে। সবকিছুতেই হচ্ছে একইরকম অবস্থা। এখানে ন্যূনতম ন্যায় বিচারের জায়গা নিশ্চিত হচ্ছে না।
সেখানে জুবায়ের হত্যার বিচার তো এ রকম হওয়াটাই স্বাভাবিক। যারা আসামি তাদের ধরে এনে শাস্তি দিবে এটা নিয়ে কেউ আসলে তাগাদা বোধ করছে না। অথচ এই বিচার হওয়াটা জরুরি ছিল। শিক্ষাঙ্গনে যতগুলো হত্যাকাণ্ড ঘটেছে তার কোনোটারই তো বিচার হয়নি।”
তিনি আরও বলেন, “অন্তত এই বিচারটা আন্দোলনের মাধ্যমে নিশ্চিত করতে পেরেছিলাম কিন্তু সেটাও কার্যকর হলো না। এটা খুবই দুঃখজনক।”
আরও পড়ুন:
জুবায়ের হত্যা: ১৩ ছাত্রলীগ কর্মী অভিযুক্ত
আরো লাশ ফেলার ‘হুমকি’ জুবায়ের হত্যার আসামির
জুবায়ের হত্যাকাণ্ড দ্রুত বিচারে
জুবায়ের হত্যা: ৬ আসামির বিষয়ে আদেশ ১৮ ফেব্রুয়ারি
জুবায়ের হত্যা মামলা আসামি গ্রেপ্তারে অবহেলার অভিযোগ
জুবায়ের হত্যা: সাক্ষ্য শেষে আত্মপক্ষ সমর্থনে তারিখ
জুবায়ের হত্যা: বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি
জুবায়ের হত্যার রায় পেছানোয় ক্ষোভ জাবিতে
জুবায়ের হত্যা: জাবি শিক্ষার্থীদের মশাল মিছিল
জুবায়ের হত্যা: ছাত্রলীগকর্মী জাহিদ রিমান্ডে
জুবায়ের হত্যা মামলায় সাক্ষ্য দিলেন বড় ভাই