পাহাড়ে অবশ্যই শান্তি ফিরবে, সে পথেই যাচ্ছি: বম পার্টি

বান্দরবানের রুমার বেথেল পাড়া কমিউনিটি সেন্টারে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি ও কেএনএফের মধ্যে দ্বিতীয়বারের মত সরাসরি এই বৈঠক হয়।

উসিথোয়াই মারমাবান্দরবান প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 March 2024, 01:39 PM
Updated : 5 March 2024, 01:39 PM

পাহাড়ের সশস্ত্র সংগঠন কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট-কেএনএফ এবং বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য গঠিত শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির সদস্যরা নিজেদের মধ্যে দ্বিতীয়বারের মত সরাসরি বৈঠক করেছেন। এতে সরকারের প্রতিনিধিরাও উপস্থিত ছিলেন। 

মঙ্গলবার সকাল ১০টা ৪০ মিনিটে রুমা সদরের বেথেল পাড়ার কমিউনিটি সেন্টারে এ বৈঠক শুরু হয়। দুপুর ১টা ২০ মিনিট পর্যন্ত সৌহার্দপূর্ণ পরিবেশে আলোচনা হয়েছে বলে জানিয়েছেন শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির মুখপাত্র ও বান্দরবান জেলা পরিষদের সদস্য কাঞ্চনজয় তঞ্চঙ্গ্যা।

এবার বৈঠকে নতুন ও পুরনো মিলে সাতটি বিষয়ে সমঝোতা স্মারক চুক্তি হয়েছে জানিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির সভাপতি ও বান্দরবান জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ক্য শৈ হ্লা মারমা সাংবাদিকদের বলেন, “যেগুলো প্রয়োজন, যতদূর সম্ভব- সেটা আমরা বাস্তবায়ন করব। বাদবাকি বিষয় সরকারের কাছে উত্থাপন করব। আগামী এপ্রিলে আবার বৈঠক হবে।”

বৈঠকে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির ১৩ জন এবং কেএনফের সাধারণ সম্পাদক লালজংময় বমের নেতৃত্বে আট সদস্য অংশ নেন।

বৈঠক শেষে কেএনএফ প্রতিনিধিদলের সদস্য লালসংলম বম বলেন, “বৈঠকে অনেকগুলো পয়েন্ট উত্থাপন করা হয়েছে। তার মধ্যে প্রথম শান্তি বৈঠকে যেসব পয়েন্ট নিয়ে আলোচনা করা হয়েছিল, স্বাক্ষর করা হয়েছিল- সেসব বিষয় থেকে যেগুলো বাস্তবায়িত হয়নি সেগুলোর সঙ্গে নতুন কিছু পয়েন্ট আমরা যুক্ত করেছি।

“এবারও ছয়-সাতটির মত বিষয়ে সমঝোতা স্বাক্ষরিত হয়েছে। আশা করছি, সেসব বিষয়ে উনারা (শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি) কাজ করবেন। একটা সুফল বয়ে আনবে বলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস।”

আলোচনার মাধ্যমে পাহাড়ে শান্তি ফিরে আসবে কিনা সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে লালসংলম বম বলেন, “অবশ্যই শান্তি ফিরে আসবে। আমরা সবসময় বিশ্বাস করি, সেই শান্তির পথ দিয়েই যাচ্ছি। একদিনে তো শান্তি হবে না। পারস্পরিক আলোচনা এবার দ্বিতীয়বারের মত হয়েছে। সামনে আরও হবে। পর্যায়ক্রমে শান্তি ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাব।”

কেএনএফ যারা পাহাড়ে ‘বম পার্টি’ নামে পরিচিত; তাদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংঘর্ষের পর ২০২৩ সালের ৩০ মে বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর সদস্যদের নিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি গঠিত হয়। এরপর ২০২৩ সালের জুলাই ও অগাস্টে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি ও কেএনএফের মধ্যে দুইবার ভার্চুয়ালি আলোচনা হয়। ভার্চুয়াল আলোচনার সময়ই কেএনএফকে সরাসরি বৈঠকের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির পক্ষ থেকে।    

একই বছরের ৫ নভেম্বর রুমা সদর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে মুনলাই পাড়ায় প্রথমবারের মত সরাসরি বৈঠক হয়। সেই বৈঠকে প্রথমবারের মত প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।

আলোচনা শুরুর পর পাহাড়ে ‘বম পার্টি’র সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহিংসতা কিছুটা কমে এসেছে বলে মনে করছেন পাহাড়িরা। বান্দরবানের বিভিন্ন উপজেলায় যে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা ছিল সেগুলোও তুলে নেওয়া হয়েছে।

এবার দ্বিতীয়বারের মত সরাসরি বৈঠক হল। সেখানেও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবদুল করিম বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। তবে তারা সাংবাদিকদের সঙ্গে কোনো কথা বলেননি।

বৈঠকের শুরুতেই কেক কেটে একে অপরকে খাওয়ান। পরে বম শিল্পীরা দেশাত্মবোধক গান পরিবেশন করেন।

বৈঠক শেষে এক সাংবাদিক কেএনএফ প্রতিনিধিদলের কাছে প্রশ্ন রাখেন- রোয়াংছড়ি, রুমা ও থানচি উপজেলায় কয়েক মাসে ২৭টির মত চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটেছে। এতে কারা জড়িত থাকতে পারে?

জবাবে কেএনএফ সদস্য লালসংলম বম বলেন, “চাঁদাবাজির বিষয়ে অনেকগুলো প্রতিক্রিয়া রয়েছে। আমাদের ইমেজ নষ্ট করার জন্য কিছু কুচক্রী মহল সবসময় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছেন। তারাই কিন্তু এগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ততা রয়েছে।

“গতবার থানচিতে পর্যটকদের কাছ থেকে চাঁদাবাজি এবং যে অপহরণের ঘটনা ঘটেছে সেগুলো আমাদের পক্ষ থেকে বিবৃতি দিয়ে স্পষ্ট করা হয়েছে। সেখানে আমরা উল্লেখ করেছি, এগুলোর সঙ্গে কেএনএফের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। আমাদের ইমেজ নষ্ট করার জন্য এগুলো আমাদের উপর দায়ভার চাপাচ্ছে।”

শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির মুখপাত্র ও বান্দরবান জেলা পরিষদের সদস্য কাঞ্চনজয় তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, “আমরা দুপক্ষই আশাবাদী। আলোচনা চলাকালে আমরা যেন সংযত আচরণ করি এবং এলাকাবাসীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করি। আগামী এপ্রিলে আবার সরাসরি বৈঠক হবে। আমরা আশাবাদী, তারা আমাদের ডাকে সাড়া দিয়ে শান্তির পথে ফিরে আসবে।

“আলোচনার মধ্যে যেগুলো মানবিক বিষয় সেগুলো আমরা বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করছি। যেগুলো মৌলিক বিষয় যেমন- অন্ন, খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা যেগুলো আমাদের পক্ষে সম্ভব সেগুলো আমরা চালিয়ে যাচ্ছি। জেলা প্রশাসন ও সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের অনেক কিছু দিয়েছি। যারা গৃহহীন হয়েছেন তাদের খাদ্য ও আর্থিক সহায়তা, যাদের ঘরবাড়ি নষ্ট হয়েছে তাদের ঢেউটিন থেকে শুরু করে অন্যান্য উপকরণ দিয়েছি।

“যারা অসুস্থ তাদেরকে সেনাবাহিনীর মাধ্যমে ক্যাম্প করে চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছি। সামনে যে জুমচাষের সময় আসছে, সেসময় তাদেরকে কৃষিঋণ, কৃষি উপকরণসহ নানাভাবে সহায়তা দেওয়া হবে।”

২০২২ সালের শুরুর দিকে বান্দরবানের রুমা উপজেলায় কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) নামে একটি সশস্ত্র সংগঠনের কথা সোস্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে জানা যায়। বম, পাংখোয়া, লুসাই, খিয়াং, খুমি ও ম্রোদের নিয়ে গঠন করা হয়েছে বলে দাবি করা হলেও সেখানে বম জনোগষ্ঠীর কিছু সংখ্যক লোকজন রয়েছে। যার কারণে সংগঠনটি পাহাড়ে ‘বম পার্টি’ নামে পরিচিতি পায়।

কেএনএফের ফেইসবুক পেইজে তারা জানায়, রাঙ্গামাটি জেলার বাঘাইছড়ি, বরকল, জুরাইছড়ি বিলাইছড়ি ও বান্দরবান জেলার রোয়াংছড়ি, রুমা, থানচি, লামা ও আলীকদমসহ নয়টি উপজেলা নিয়ে ‘কুকি-চিন রাজ্য’ হিসেবে গঠন করা হবে। পরবর্তীতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সশস্ত্র সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে তারা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে আতঙ্কে সেই সময় ভারতের মিজোরামে পালিয়ে আশ্রয় নেয় পাঁচ শতাধিক বম নারী-পুরুষ।

স্বাভাবিক পরিস্থিতি ও স্থিতিশীল পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে ৩০ মে বান্দরবান জেলার বিভিন্ন জাতিসত্তার প্রতিনিধি নিয়ে তৈরি করা হয় ‘শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি’। পরে জুন মাসে শেষ সপ্তাহে জেলা পরিষদের সভা কক্ষে সংবাদ সম্মেলন করে জানানো হয় শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির গঠন ও উদ্দেশ্য।

১৮ সদস্যের এই শান্তি প্রতিষ্ঠার কমিটি আহ্বায়ক হিসাবে রয়েছেন বান্দরবান জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ক্য শৈ হ্লা মারমা এবং সদস্যসচিব হিসাবে রয়েছে বম সোস্যাল কাউন্সিলে সভাপতি লালজারলম বম। জেলা পরিষদের সদস্য কাঞ্চনজয় তঞ্চঙ্গ্যাকে কমিটির মুখপাত্র হিসাবে রাখা হয়েছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে বান্দরবান জেলায় কুকিচিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ); যা ‘বম পার্টি’ নামে পরিচিত এই সশস্ত্র সংগঠনটি অর্থের বিনিময়ে নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’ সদস্যদের সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় বলে ২০২২ সালে অক্টোবর মাসে ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করে জানায় র‌্যাব।

এরপর ২০২২ সালের ১৭ অক্টোবর থেকে জঙ্গি ও কেএনএফ সদস্যদের বিরুদ্ধে রোয়াংছড়ি ও রুমা উপজেলার অভিযান চালায় র‌্যাব ও সেনা সদস্যের যৌথ বাহিনী। পরবর্তীতে এ অভিযান চালানো হয় থানচি উপজেলাতেও। এরই মধ্যে অভিযান চালাতে গিয়ে নিহত হয়েছে সেনাবাহিনীর বেশ কিছু সদস্যও। সংঘাতে প্রাণ গেছে কেএএনএফ সদস্যেরও।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের কারণে ২০২২ সালের অক্টোবর থেকে কয়েক দফা ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ বাড়িয়ে রোয়াংছড়ি, রুমা, থানচি ও আলীকদম উপজেলায় অনির্দিষ্টকালের জন্য দেশি-বিদেশি পর্যটক ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। পরে পর্যায়ক্রমে তিন উপজেলা থেকে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা নেওয়া হয়। কিন্তু রোয়াংছড়ি উপজেলা থেকে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা উঠে যায় ২০২৪ সালে জানুয়ারিতে।

আরও পড়ুন:

এবার সরকারি প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে ‘বম পার্টি’র সঙ্গে বৈঠক

এবার ‘বম পার্টি’র সঙ্গে সরাসরি সংলাপের প্রস্তাব

‘সংলাপ চলাকালে সংঘাত চায় না বম পার্টি, পর্যটন নিয়ে আপত্তি’

‘সব পক্ষের ইতিবাচক সাড়া’ পেয়েছে বান্দরবানে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি

বান্দরবানে ‘শান্তি ও স্থিতিশীল’ পরিবেশ ফেরানোর উদ্যোগ

শান্তিপূর্ণ সমাধান হলে সহিংসতায় যাবে না সেনাবাহিনী, বান্দরবানে সেনাপ্রধান

নতুন জঙ্গি দলের ‘পাহাড়ি যোগ’ পেয়েছে র‌্যাব

জঙ্গি আর পাহাড়ি দলের মিলে যাওয়ার বিপদ যেখানে

পাহাড়ে সশস্ত্র দল; এই ‘বম পার্টি’ কারা?

বান্দরবানে পানি-স্যালাইন বিতরণে গিয়ে বিস্ফোরণে সেনাসদস্য নিহত

কেএনএফ ক্যাম্পে অভিযানের সময় বিস্ফোরণে সেনাসদস্য নিহত

বান্দরবানে সেনা টহলে ফের বম পার্টির হামলা, দুই সৈনিক নিহত

দুর্গম পাহাড়ে ‘বম পার্টি’র গুলিতে সেনাসদস্য নিহত