২৯ মে বান্দরবানে সকল সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের মতবিনিময় সভায় ‘শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি’ গঠনের সিদ্ধান্ত হয়।
Published : 22 Jun 2023, 10:16 PM
বান্দরবানে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট-কেএনএফ ও সেনাবাহিনীর মধ্যে সংঘাতের একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান খোঁজার উদ্যোগে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের ইতিবাচক সাড়া পাওয়ার কথা জানিয়েছে এ লক্ষ্যে সদ্য গঠিত ‘শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি’।
বৃহস্পতিবার সকালে বান্দরবান জেলা পরিষদের সভাকক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানান শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির মুখপাত্র ও জেলা পরিষদের সদস্য কাঞ্চনজয় তঞ্চঙ্গ্যা।
তার লিখিত বক্তব্যের আগে বান্দরবান জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির আহবায়ক ক্য শৈ হ্লা মারমা জানান, গত ২৯ মে শহরে অরুণ সারকি টাউন হলে এখানকার সকল সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি নিয়ে একটা মতবিনিময় সভা করা হয়েছিল। সেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য একটি কমিটি গঠন করার প্রস্তাব দেন সবাই। কিছুসংখ্যক বম ছেলেমেয়ে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছে। তাদেরকে কীভাবে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা যায় সে ব্যাপারে কাজ করার জন্য ‘শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি’ গঠন করা হয়েছে।
পরে সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির মুখপাত্র কাঞ্চনজয় তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে বান্দরবানে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট-কেএনএফ এবং তাদের সামরিক শাখা কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মি-কেএনএ’র নানাবিধ তৎপরতায় বেশ কয়েকটি অঞ্চল ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। এসব তৎপরতা নিয়ন্ত্রণে সরকারি বাহিনীগুলোকে অভিযান পরিচালনা করতে হচ্ছে। এর ফলে স্থানীয় জনজীবনে অস্থিরতা ও নিরপাত্তাহীনতা তৈরি হয়েছে। জীবনযাপনের জন্য জুমচাষ বন্ধসহ জীবিকার সকল পথ বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়ে পড়েছে। একই কারণে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত পর্যটন এলাকাগুলোতে দেশি-বিদেশি পর্যটক ভ্রমণও বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে স্থানীয়দের বিকল্প আয়ের পথও বন্ধ রয়েছে।
তিনি বলেন, ইতিমধ্যে বিভিন্ন ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন দেশপ্রেমিক সেনা সদস্য ও স্থানীয় নিরীহ জনগণ। কেএনএ সদস্যদের হতাহতের ঘটনাও ঘটেছে। জীবন হারানোর এসব ঘটনা এখনও চলমান।
“আমাদের জানামতে, নিজেদের জন্য একটি বিশেষ অঞ্চল প্রতিষ্ঠার দাবিতে বিপথগামী কিছু বম যুবক অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছে। তাদের দাবি অনুযায়ী পাংখোয়া, লুসাই, খিয়াং, খুমী ও ম্রো জনজাতিসহ আরও অনেকেই তাদের সঙ্গে রয়েছে। কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে এসব দাবি-দাওয়া পূরণে আলোচনায় না গিয়ে সরাসরি অস্ত্র হাতে তুলে নেওয়ায় সমস্যাটি সংকটে রূপ নিয়েছে।
সে অবস্থার পরির্বতনে জেলা পরিষদ মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা নিয়ে বম সোস্যাল কাউন্সিল ও অন্যান্য সামাজিক সংগঠনদের নিয়ে একটি শান্তি উদ্যোগ হাতে নেওয়া হয়েছে জানিয়ে কাঞ্চনজয় তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, “এ শান্তির উদ্যোগ সরকারপক্ষ এবং কেএনএফ ও কেএনএ সদস্যরা সমর্থন করেন। শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির পক্ষ থেকে প্রাথমিক যোগাযোগে সবার কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়া পেয়েছি।”
তবে উদ্যোগটি এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে হলেও সংশিষ্ট সকল পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি রূপরেখা নিরুপণে সফল হবে জানিয়ে মুখপাত্র কাঞ্চনজয় তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, এর আগেও পার্বত্য চট্টগ্রামে দুই যুগেরও বেশি সময় বিরাজমান সমস্যা সমাধান হয়েছে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে। খুব শিগগির শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে আলোচনা শুরু করা হবে।
সংবাদ সম্মেলনের শুরুতে কমিটির পক্ষ থেকে শান্তি প্রতিষ্ঠায় কাজ করার জন্য একটি লিখিত কর্মপরিকল্পনাও তুলে ধরা হয়। তাদের এই কর্মপরিকল্পনায় উল্লেখ করা হয়েছে, শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, জেলা প্রশাসন ও পুলিশ বাহিনীসহ সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সমন্বয় সাধন করা; শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির মাধ্যমে একটি লিয়াজোঁ কমিটি গঠন করে কেএনএ-এর সঙ্গে জড়িত সকল সদস্যদেরকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আনার উদ্যোগ গ্রহণ; সংঘটিত ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সাধারণ জনগণের জানমালের ক্ষয়ক্ষতি অতি শীঘ্রই বন্ধ হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ; এলাকায় ক্ষয়-ক্ষতির একটি হিসাব তৈরি করা এবং এলাকার সাধারণ মানুষ যাতে নিজগৃহ ও ক্ষেত খামারে ফিরে আসতে পারে সে লক্ষ্যে অনুকূল পরিবেশ তৈরি উদ্যোগ গ্রহণ করা।
সংবাদ সম্মেলনে ১৮ সদস্যবিশিষ্ট শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির সদস্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন কমিটির সদস্য সচিব ও বম সোস্যাল কাউন্সিলের সভাপতি লালজারলম বম, কমিটির সদস্য ও বম সোস্যাল কাউন্সিলের উপদেষ্টা রেভারেন্ট পাকসিমবয়ত্লুং বম, জেলা পরিষদের সদস্য ও ম্রো সোস্যাল কাউন্সিলের উপদেষ্টা সিংইয়ং ম্রো, বাংলাদেশ খুমী কল্যাণ অ্যাসোসিয়েশনের উপদেষ্টা লেলুং খুমী, প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি মনিরুল ইসলাম মনু ও সাংবাদিক বুদ্ধজ্যোতি চাকমা।
বান্দরবানে জেলায় সক্রিয় সশস্ত্র সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট-কেএনএফ, যা ‘বম পার্টি’ নামে পরিচিত, অর্থের বিনিময়ে নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’ সদস্যদের সামরিক প্রশিক্ষণ দেয় বলে গত বছর অক্টোবরে ঢাকায় সংবাদ সম্মেলনে জানায় র্যাব।
এরপর অক্টোবর থেকে জঙ্গি ও কেএনএফ সদস্যদের বিরুদ্ধে রোয়াংছড়ি ও রুমা উপজেলার অভিযান চালায় র্যাব ও সেনাসদস্যের যৌথ বাহিনী। পরবর্তীতে এ অভিযান চালানো হয় থানচি উপজেলাতেও। ইতিমধ্যে অভিযান চালাতে গিয়ে কয়েকজন সেনাসদস্য প্রাণ হারিয়েছেন। র্যাবের অভিযানে গ্রেপ্তার হয়েছেন কেএনএফ ও জঙ্গি দলেও বেশ কয়েকজন সদস্য।
আইনশঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের কারণে কয়েক দফা ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ বাড়ানোর পর রোয়াংছড়ি, রুমা ও থানচি উপজেলায় এখনও অনির্দিষ্টকালের জন্য দেশি-বিদেশি পর্যটক ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
আরও পড়ুন:
বান্দরবানে ‘শান্তি ও স্থিতিশীল’ পরিবেশ ফেরানোর উদ্যোগ