শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি বলেছে, সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কোনো প্রস্তাবনা নিয়ে সংলাপ চালানো সম্ভব না।
Published : 04 Aug 2023, 05:45 PM
পাহাড়ে সশস্ত্র সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট-কেএনএফ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে সংঘাতের জেরে সৃষ্ট সহিংসতা নিষ্পত্তির জন্য দ্বিতীয় দফা ভার্চুয়াল সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়েছে।
সহিংসতা নিরসন করে বান্দরবানে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে গঠিত শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির সদস্যদের সঙ্গে কেএনএফ প্রতিনিধিদের এই সংলাপ শুক্রবার সকালে জেলা পরিষদের সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত হয়।
তিন ঘণ্টাব্যাপী এই ভার্চুয়াল সংলাপে কেএনএফকে এবার সরাসরি আলোচনার করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে বলে জানান শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির মুখপাত্র ও বান্দরবান জেলা পরিষদের সদস্য কাঞ্চনজয় তঞ্চঙ্গ্যা।
গত ১৯ জুলাই শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি ও কেএনএফর মধ্যে প্রথমবারের মত ভার্চুয়াল সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। তখন তারা আলোচনার জন্য কিছু দাবি উত্থাপন করেছিল। সেই সংলাপে কেএনএফের পক্ষে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মুনয়ার।
দুপুরে মুখপাত্র কাঞ্চনজয় তঞ্চঙ্গ্যা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কেএনএফ আগের বৈঠকে যেসব বিষয়ে দাবি তুলেছিল সেগুলো লিখিত আকারে পাঠাতে বলা হয়েছিল। কিন্তু তারা এখনও পাঠাতে পারেনি। তারা সেগুলো সিদ্ধান্ত নিয়ে পাঠানোর কথা বলেছে।
“এ ছাড়া কেএনএফের সঙ্গে সরাসরি বৈঠকের যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে সে বিষয়েও তারা সিদ্ধান্ত নিয়ে জানানোর কথা বলেছে। শান্তি প্রতিষ্ঠার সংলাপ চলমান। এগুলো ধারবাহিকভাবে চলতে থাকবে।”
প্রথম দফায় বৈঠকের সময় কেএনএফের পক্ষ থেকে এই সংলাপ চলাকালে কোনো ধরনের সংঘাত-অপহরণের ঘটনা যাতে না ঘটে তার নিশ্চয়তা চাওয়া হয়েছিল; পাশাপাশি পাহাড়ের পর্যটন নিয়েও আপত্তির কথা জানিয়েছিল প্রতিনিধিরা।
তখন তাদের এই দাবিগুলো সরকারের যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির সদস্যরা।
দ্বিতীয় দফার বৈঠকে সুনির্দিষ্ট কোনো বিষয়ে আলোচনা হয়েছে কি-না জানতে চাইলে মুখপাত্র কাঞ্চনজয় তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, “তারা (কেএনএফ) আগের বিষয়গুলো তুলে ধরেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তাদের ফেইসবুকে পেইজে তারা যেগুলো দিয়েছে, সেসব ব্যাপারে কথা বলেছে। কিন্তু আমরা তো এগুলো দেখিনি।
‘সংলাপ চলাকালে সংঘাত চায় না বম পার্টি, পর্যটন নিয়ে আপত্তি’
‘সব পক্ষের ইতিবাচক সাড়া’ পেয়েছে বান্দরবানে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি
বান্দরবানে ‘শান্তি ও স্থিতিশীল’ পরিবেশ ফেরানোর উদ্যোগ
শান্তিপূর্ণ সমাধান হলে সহিংসতায় যাবে না সেনাবাহিনী, বান্দরবানে সেনাপ্রধান
“আমরা বলেছি, তাদের দাবিগুলো লিখিত আকারে আমাদের কাছে জমা দিতে। কারণ ডকুমেন্ট ছাড়া আমাদের পক্ষে কথা বলা সম্ভব না। আমরা আরও বলেছি, দেশের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কোনো প্রস্তাবনা নিয়ে সংলাপ চালানো সম্ভব না।
মুখপাত্র আরও বলেন, “তবে আমাদের মূল কাজ আস্থা অর্জন করা। তাদের সঙ্গে সংলাপের প্রক্রিয়া চালিয়ে যাওয়া এবং সমাধানের জন্য তাদের দাবিগুলো সরকারের কাছে তুলে ধরা।”
দ্বিতীয় দফা সংলাপে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির অন্যান্য সদস্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বম স্যোসাল কাউন্সিলের সভাপতি লালজারলম বম, সাধারণ সম্পাদক লালথাং জেল বম, ধর্মীয় গুরু পাকসিম বম, কৃপা ত্রিপুরা, খুমি সোস্যাল কাউন্সিলের উপদেষ্টা লেলুং খুমি, অ্যাডভোকেট বাসিংথুয়াই মারমা, বাংলাদেশ মারমা অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মংচিংনু মারমা, সাংবাদিক বুদ্ধজ্যেতি চাকমা ও উজ্জ্বল তঞ্চঙ্গ্যা।
অন্যদিকে কেএনএফের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন মইয়া ওরফে লালজং সই বম, লিয়ানা ওরফে জেরসিং লিয়ান বম, ভাপুয়া ওরফে লালসাংলম বম এবং স্টে ওয়াড ওরফে লালসাং রেস বম।
২০২২ সালের শুরুর দিকে বান্দরবানের রুমা উপজেলায় কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) নামে একটি সশস্ত্র সংগঠনের কথা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জানা যায়। পরে অক্টোবরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জানায়, কেএনএফ বা ‘বম পার্টি’ নামে পরিচিত এই সশস্ত্র সংগঠন অর্থের বিনিময়ে নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’ সদস্যদের সামরিক প্রশিক্ষণ দিচ্ছে।
এরপর জঙ্গি ও কেএনএফ সদস্যদের বিরুদ্ধে রোয়াংছড়ি ও রুমা উপজেলার অভিযান চালায় র্যাব ও সেনা সদস্যের যৌথ বাহিনী। পরবর্তীতে এ অভিযান চালানো হয় থানচি উপজেলাতেও। অভিযান চালাতে গিয়ে নিহত হয়েছে সেনাবাহিনীর বেশ কিছু সদস্যও। সংঘাতে প্রাণ হারায় বম পার্টির সদস্যরাও।
এর জেরে আতঙ্কে ভারতের মিজোরামে পালিয়ে যায় বম জনগোষ্ঠীর পাঁচ শতাধিক নারী-পুরুষ। বন্ধ হয়ে যায় বান্দরবানের পর্যটকদের ভ্রমণও। জুম চাষের ক্ষতির পাশাপাশি সংঘাতপূর্ণ এলাকায় জনজীবন অস্থির ও নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে পড়ে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে পাহাড়ের ১১টি নৃগোষ্ঠীর নেতৃবৃন্দ ও অন্যান্য পেশাজীবীরা জনজীবন স্বাভাবিক করার লক্ষ্যে কেএনএফের সঙ্গে সংলাপের জন্য শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি গঠন করেন। মে মাসে মতবিনিময় করার পর জুনের শেষ সপ্তাহে এক সংবাদ সম্মেলনে কমিটি গঠন ও এর উদ্দেশের কথা জানানো হয়।
১৮ সদস্যের এই কমিটির আহ্বায়ক বান্দরবান জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ক্য শৈ হ্লা মারমা এবং সদস্যসচিব বম সোস্যাল কাউন্সিলের সভাপতি লালজারলম বম। এ ছাড়া কমিটির সদস্য হিসেবে আছেন- বম সোস্যাল কাউন্সিলের উপদেষ্টা রেভারেন্ট পাকসিমবয়ত্লুং বম, জেলা পরিষদের সদস্য ও ম্রো সোস্যাল কাউন্সিলের উপদেষ্টা সিংইয়ং ম্রো, বাংলাদেশ খুমী কল্যাণ অ্যাসোসিয়েশনের উপদেষ্টা লেলুং খুমী, প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি মনিরুল ইসলাম মনু ও সাংদিক বুদ্ধজ্যোতি চাকমা।
কমিটিতে সরকারি কোনো কর্মকর্তা বা প্রশাসনের কেউ নেই; তবে এ ধরনের সংলাপকে স্বাগত জানিয়েছিলেন বান্দরবান জেলা পুলিশ সুপার তারিকুল ইসলাম।
প্রথম দফায় বৈঠকের পর ১৯ জুলাই তিনি বলেছিলেন, “আমরা এই ধরনের সংলাপকে সাধুবাদ জানাই। কেউ পাহাড়ে সংঘাত চায় না। পাহাড়ে সবাই শান্তি চায়। যে ঘটনাগুলো ঘটেছে দ্রুত তার সমাধান হওয়া প্রয়োজন।”
জেলা পরিষদ মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা নিয়ে বম সোস্যাল কাউন্সিল ও অন্যান্য সামাজিক সংগঠনদের নিয়ে শান্তির উদ্যোগ নিয়েছে বলে আয়োজকদের পক্ষ থেকে জানানো হয়।
কেএনএফের ফেইসবুক পেইজে তারা জানিয়েছেন, রাঙ্গামাটি জেলার বাঘাইছড়ি, বরকল, জুরাইছড়ি বিলাইছড়ি ও বান্দরবান জেলার রোয়াংছড়ি, রুমা, থানচি, লামা ও আলীকদমসহ নয়টি উপজেলা নিয়ে ‘কুকি চিন রাজ্য’ হিসেবে গঠন করা হবে।
এরপর গত বছর অক্টোবর মাস থেকে জঙ্গি ও কেএনএফ সদস্যদের বিরুদ্ধে রোয়াংছড়ি ও রুমা উপজেলার অভিযান চালাচ্ছে র্যাব ও সেনা সদস্যের যৌথ বাহিনী। অভিযানের কারণে রোয়াংছড়ি, রুমা ও থানচি উপজেলায় অনির্দিষ্টকালের জন্য দেশি-বিদেশি পর্যটক ভ্রমণের উপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়।
তবে গত ১৪ জুলাই এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে রোয়াংছড়ি ছাড়া সব উপজেলায় ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নিয়েছে প্রশাসন।
আরও পড়ুন:
নতুন জঙ্গি দলের ‘পাহাড়ি যোগ’ পেয়েছে র্যাব
জঙ্গি আর পাহাড়ি দলের মিলে যাওয়ার বিপদ যেখানে
পাহাড়ে সশস্ত্র দল; এই ‘বম পার্টি’ কারা?
বান্দরবানে পানি-স্যালাইন বিতরণে গিয়ে বিস্ফোরণে সেনাসদস্য নিহত
কেএনএফ ক্যাম্পে অভিযানের সময় বিস্ফোরণে সেনাসদস্য নিহত