পাহাড়ে সশস্ত্র দল; এই ‘বম পার্টি’ কারা?

হত্যার অভিযান চালিয়ে সশস্ত্র শাখার অস্তিত্বের জানান দেওয়া কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) এখন পার্বত্য চট্টগ্রামে আলোচনার কেন্দ্রে।

রাজীব নূররাজীব নূরস্পেশাল অ্যাসাইনমেন্ট এডিটরবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 June 2022, 07:47 PM
Updated : 30 June 2022, 03:27 AM

পাহাড়িরা এই সংগঠনটিকে ‘বম পার্টি’ নামে চেনে। তাদের সক্রিয় হওয়ার খবর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছেও রয়েছে। তবে দলটির সংগঠকরা এখনও অধরা।

জুম্ম জাতীয়তাবাদী নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা (এমএন লারমা) গঠিত জনসংহতি সমিতি ভেঙে কয়েকটি দলের সক্রিয়তা রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামে।

তার মধ্যেই কেএনএফের সক্রিয় হয়ে ওঠার খবর মিলছে, যে দলটিকে নিয়ে অনেক প্রশ্নও দেখা দিয়েছে।

কেএনএফ নিজেদের পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রান্তিক অঞ্চলের অনগ্রসর জনজাতিগুলোর ‘প্রতিনিধিত্বকারী’ হিসেবে তুলে ধরছে। তারা ‘কুকি-চিন রাজ্যে’ নামে একটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল চাইছে; যেখানে চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরারা থাকবে না, থাকবে বম, খিয়াং, পাংখুয়া, লুসাই, খুমি ও ম্রোরা।

পাহাড়ে নতুন করে এই সংগঠনের আত্মপ্রকাশের পেছনে ভিন্ন উদ্দেশ্য দেখছেন পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির সভাপতি গৌতম দেওয়ান।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পাহাড়ের সাধারণ মানুষও জানে, কারা এসব দলের জন্ম দিচ্ছে। পাহাড়ে এখন সাতটা পার্টি। এক পার্টি দিয়ে আরেক পার্টিকে নিধন করা হচ্ছে। এক জাতি দিয়ে অন্য জাতির ওপর হামলা চালানো হচ্ছে।”

“জাতীয়তাবাদী চেতনাকে কাজে লাগানো হচ্ছে বিরোধ জারি রাখার জন্য,” বলেন রাঙামাটি জেলা পরিষদের প্রথম চেয়ারম্যান গৌতম।

হত্যাকাণ্ড, এরপর ফেইসবুকে বার্তা

গত ১৭ এপ্রিল ভোরে রাঙামাটির বিলাইছড়ি উপজেলার বড়থলি ইউনিয়নের বিলপাড়া নামে তঞ্চঙ্গ্যাদের গ্রামে সশস্ত্র হামলা চালিয়ে অ্যাকশন চাকমা নামের এক ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়।

কেএনএফই তা ঘটিয়েছে বলে স্থানীয়দের ধারণা। আর তা ভিত্তি পায় গত ২১ জুন আরেক হামলার পর ফেইসবুকে কেএনএফের নামে দায় স্বীকারের বার্তা এলে।

সেদিন বিলাইছড়িতেই দুর্গম বড়থলি ইউনিয়নের সাইজাম নতুন পাড়ায় তিনজনকে হত্যার পর ফেইসবুকে দায় স্বীকার করে কেএনএফের নামে বিবৃতি আসে।

সাইজাম পাড়া পার্বত্য তিন জেলার সবচেয়ে দুর্গম এলাকার একটি। উপজেলা সদর থেকে সেখানে যেতে তিন দিন সময় লাগে বলে জানান বিলাইছড়ির ইউএনও মিজানুর রহমান। তুলনামূলক কম সময় লাগে পাশের জেলা বান্দরবানের রুমা উপজেলা সদর থেকে। তবে দুই স্থান থেকেই হেঁটে যাওয়ার বিকল্প নেই।

হত্যাকাণ্ডের পর কেএনএফের নামে খোলা একটি ফেইসবুক পাতায় দলের ‘ইনফরমেশন ডিপার্টমেন্টের’ পক্ষে দেওয়া বার্তায় প্রথমে বলা হয়, “কেএনএফের স্পেশাল কমান্ডো ফোর্স ‘হেড-হান্টার টিম’ সন্ত্রাসী জেএসএসের সশস্ত্র বাহিনী জেএলএ-এর জাইজাম বেসমেন্ট ক্যাম্পে সফলভাবে হামলা চালিয়েছে। এতে জেএলএ বাহিনীর তিনজন গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলে নিহত হয়।”

হামলায় নিহতরা হলেন- সুভাষ চন্দ্র ত্রিপুরা (৩০), তার বাবা বিছাই চন্দ্র ত্রিপুরা (৫০) এবং প্রতিবেশী ধনরাং ত্রিপুরা (১৫)।

সুভাষের দুই শিশু সন্তান মাথা, মুখ ও দেহে গুলিবিদ্ধ হয়ে এখন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। ১৬ মাস বয়সী মেয়েটির অবস্থা আশঙ্কাজনক।

দুই সন্তানকে নিয়ে হাসপাতালে থাকা রুংদতি ত্রিপুরা বলছেন, হামলা করেছিল ২০-২৫ জন।

তারা কারা- জানতে চাইলে তিনি বলেন, “শুনেছি বম পার্টি।”

সন্তানকে নিয়ে হাসপাতালে রুংদতি ত্রিপুরা

কেএনএফের নামে আসা বিবৃতিতে নিহতদের ‘জেএসএস সন্ত্রাসী’ বলে দাবি করা হলেও স্থানীয়দের ভাষ্য ভিন্ন।

বাংলাদেশ ত্রিপুরা কল্যাণ সংস্থার সভাপতি সুশীল জীবন ত্রিপুরা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সাইজাম পাড়ায় যাদের হত্যা করা হয়েছে, তারা নিরীহ তিন ত্রিপুরা।”

হতাহতরা নিরীহ মানুষ বলে প্রচার হওয়ার পর কেএনএফের নামে খোলা ফেইসবুক পাতায় বিবৃতির সুর পাল্টে যায়।

গত সোমবার আরেক বিবৃতিতে বলা হয়, “বিগত সপ্তাহে রাঙ্গামাটি জেলার বিলাইছড়ি উপজেলার বড়থলি ইউনিয়নের সাইজাম পাড়ায় (সদ্য স্থাপিত জেএসএস সন্ত্রাসীর ট্রেইনিং ক্যাম্পে) আমাদের কেএনএফ-এর কমান্ডোদের সাথে জেএসএস বাহিনীদের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে জেএসএস সন্ত্রাসীদের নিজেদের পলায়নপর এলোপাতাড়ি ব্রাশফায়ারের গুলিতে বিদ্ধ হয়। জেএসএস সন্ত্রাসীরা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ করে অকুস্থলে শিশুটিকে ফেলে দিয়ে পালিয়ে যায়, আর ফেলে রাখা আহত শিশুটিকে রণক্ষেত্র থেকে বাঁচিয়ে তার মায়ের কাছে কেএনএফ কমান্ডোরা তুলে দেয়।”

“ইদানীং সেই আহত হওয়া শিশুটিকে কাজে লাগিয়ে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীকে জেএসএস নেতারা বিভিন্নভাবে মদদ দিচ্ছে,” বলা হয় পরিবর্তিত বার্তায়।

প্রয়াত এম এন লারমার ভাই জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমার (সন্তু লারমা) দল চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) নাম বিবৃতিতে জড়ানো হলেও এই দলটির আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য এখনও আসেনি।

জেএসএসের বড়থলি ইউনয়িন শাখার সভাপতি আতুমং মারমা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ওই গ্রামে কোনো রাজনৈতিক দলের ক্যাম্প ছিল না। থাকার সুযোগও নেই।”

বড়থলি ইউনিয়ন পরিষদেরও চেয়ারম্যানও আতুমং মারমা। তিনি বলেন, “দুর্গম এই পাড়াটিতে ত্রিপুরা, বম, খিয়াং ও তঞ্চঙ্গ্যাদের মোট ২২টি পরিবার থাকত। বছরের এপ্রিলের মাঝামাঝি দুর্বৃত্তদের একটি গ্রুপ হুমকি দিয়ে সেখানকার বাসিন্দাদের সরে যেতে বলে। তখন ওই পাড়ার বাসিন্দারা আশেপাশের স্বজনদের কাছে আশ্রয় নিয়েছিল। কিন্তু এই পরিবারগুলোর সবাই জুমচাষের উপর নির্ভরশীল হওয়ায় এবং গরু-ছাগল রেখে যাওয়ায় আক্রান্ত দুটি পরিবার গত ৬ জুন পাড়ায় ফিরে আসে। এরপর গত ২১ জুন ঘটল হত্যাকাণ্ড।”

রুংদতি ত্রিপুরাও একই কথা বলেন। 

ত্রিপুরা কল্যাণ সংস্থার সভাপতি সুশীল জীবন ত্রিপুরার সঙ্গে যোগাযোগ করতে গেলে তাদের আতঙ্কে থাকার বিষয়টি স্পষ্ট হয়।

অনেকবার কল করার পর ফোন ধরে তিনি পরিচয় জানার পর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলেন, “ভাই আতঙ্কে আছি। কখন যে কে চাঁদা চাইবে, হুমকি দেবে, সেই ভয়ে দিন কাটছে।”

স্বজাতির মানুষদের হতাহতের খবর শুনে সাইজাম পাড়ায় যাওয়ার কথা ভাবলেও পরে ক্ষ্যান্ত দেন সুশীল ত্রিপুরা।

এর কারণ দেখিয়ে তিনি বলেন, “পথের দুর্গমতা যতটা, তারও বেশি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ভয়।”

এর মধ্যেই ত্রিপুরা কল্যাণ সংস্থার পক্ষ থেকে আহত শিশুদের চট্টগ্রামে এনে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছেন বলে জানান তিনি।

জেএসএসের এক কেন্দ্রীয় নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ফেইসবুক পেইজে ঘোষণা দিয়ে মানুষ হত্যার দায় স্বীকার করা বেশ চাঞ্চল্যকর বিষয়। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ সকল সূত্র নিশ্চিত করছে যারা নিহত হয়েছেন, তারা সাধারণ নিরীহ গ্রামবাসী। কিন্তু প্রশাসন দুর্গমতার দোহাই দিয়ে বিষয়টি এড়িয়ে যাচ্ছে।

“কথিত কুকি-চিন বাহিনীর দাবি অনুসারে নিহতরা সশস্ত্র একটি গ্রুপের সদস্য হলেও প্রশ্ন থাকে, এই হত্যার দায়িত্ব তাদেরকে কে অর্পণ করল?”

‘বম পার্টি’ কে চালায়?

নাথান লনচেও বম

কেএনএফের নামে পরিচালিত ফেইসবুক পাতা ঘেঁটে দেখা গেছে, গত বছরের ১৬ ডিসেম্বর এটি খোলা হয়েছে। এখানে প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো পোস্ট দেওয়া হচ্ছে।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের পক্ষ থেকে ওই পাতায় মেসেজ দিয়ে কয়েকদিনেও কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।

ফেইসবুক পাতায় সংগঠনটির প্রধান হিসেবে নাথান বমের নাম উল্লেখ করা হয়েছে; যদিও তার সঙ্গে যোগাযোগের কোনো সূত্র পাওয়া যায়নি।

নানা সূত্রে জানা যায়, এই নাথান বমের পুরো নাম নাথান লনচেও বম। বান্দরবানের রুমা উপজেলার এডেন পাড়ার বাসিন্দা তিনি। পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ভাস্কর্য বিভাগে।

ছাত্রজীবনে জনসংহতি সমিতি সমর্থিত পাহাড়ি ছাত্র পরিষদে যুক্ত ছিলেন নাথান। পার্বত্য শান্তি চুক্তির পর খাগড়াছড়ি শহরের মহাজনপাড়া এলাকার লারমা স্কয়ারে এম এন লারমার একটি ভাস্কর্য নির্মাণ করেন সহশিল্পী নিম্মী দেওয়ানকে সঙ্গে নিয়ে। তখন হিল আর্টিস্টস গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি।

হিল আর্টিস্টস গ্রুপের সভাপতি ধনমনি চাকমা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “লারমা স্যারের ভাস্কর্য নির্মাণের সময় থেকেই হিল আর্টিস্টস গ্রুপ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে শুরু করে নাথান। মাঝে বহুদিন ওর আর খোঁজ জানা ছিল না আমাদের। আমি ভেবেছিলাম, ও (নাথান) হয়ত দেশের বাইরে চলে গেছে।”

নাথানদের নির্মিত লারমার আবক্ষ ভাস্কর্যটি উদ্বোধন করা হয় ২০০০ সালে। এরপর শিল্পী হিসেবে তার খ্যাতি বাড়ে। তিনি লেখালেখি করতে শুরু করেন। কুকি-চিনভুক্ত জাতিগোষ্ঠীর পরিচিতি নিয়ে ‘দ্য বমজৌ’ নামে একটি বই প্রকাশ করেন।

তখন থেকেই তিনি কুকি-চিন জাতীয়তাবাদী চিন্তার একটি বলয় তৈরির চেষ্টা করছেন বলে জানান হিল আর্টিস্টস গ্রুপের আরেক সদস্য।

খাগড়াছড়িতে এম এন লারমার এই ভাস্কর্য তৈরিতে যুক্ত ছিলেন নাথন বম

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই শিল্পী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কুকি-চিন নামে একটা জাতীয়তাবাদী চেতনা তৈরির উদ্যোগ আরও থেকেই ছিল নাথানের। এ নিয়ে লেখালেখিও করছিলেন তিনি।

“সেই সঙ্গে ২০০৮ সালে কুকি-চিন ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (কেএনডিও) নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। এই সংগঠনের পক্ষে নাথান ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে চেয়েছিলেন। মনোনয়নপত্র বাতিল হওয়ায় শেষ পর্যন্ত তার আর ভোট করা হয়নি। এর আগে নাথান ২০১৫ সালের দিকে ইউরোপের কয়েকটি দেশ ঘুরে আসেন।”

নাথান লনচেও বমের দূর সম্পর্কীয় এক আত্মীয় নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, গত বছরের নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসেও নাথানকে দেখেছেন তিনি।

“রুমার এডেন পাড়ায় বাড়ি হলেও নাথান কিছুদিন বান্দরবান শহরের উজানিপাড়াতে থাকতেন। বর্তমানে তার পরিবারের সদস্যদের মাঝেমধ্যে রুমাতে দেখা যায়।”

এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই শিল্পী জানান, নাথানের গড়ে তোলা কেএনডিও নাম বদলে হয় কুকি-চিন ন্যাশনাল ভলান্টিয়ার্স (কেএনভি)। আরও পরে ২০১৯ সালের দিকে হয়েছে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ)। এর সশস্ত্র উইংয়ের নাম দেওয়া হয় কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মি (কেএনএ)।

কেএনএফের নামে খোলা ফেইসবুক পাতায়ও তাদের একটি সশস্ত্র শাখা থাকার কথা স্বীকার করা হয়েছে।

গত ১৮ মে দেওয়া একটি পোস্টে বলা হয়, পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রান্তিক অঞ্চলের সুবিধাবঞ্চিত ও অনগ্রসর জাতিসত্তার প্রতি বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ‘বৈষম্যমূলক আচরণ ও নির্যাতন বন্ধসহ এ অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে’ নাথান কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। তাই তাদের অঞ্চলে ‘সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বন্ধ এবং নিরীহ জনগণকে রক্ষায় স্বনিরাপত্তার স্বার্থে’ সশস্ত্র শাখা তৈরি করেন।

নাথানের নেতৃত্বে সংগঠনের শতাধিক সদস্য মিয়ানমারের কাচিন প্রদেশে গিয়ে গেরিলা প্রশিক্ষণ নিয়ে এসেছেন বলেও দাবি করা হয় ওই পোস্টে। এতে আরও বলা হয়, ২০২১ সালে ওই দলটি ফেরার পর ২০২২ সালে আত্মগোপনে যায়।

আরেক পোস্টে বলা হয়েছে, “বৃহদাকারের সশস্ত্র শাখা থাকলেও কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মি (কেএনএ) সরকার বা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে কোনো ধরনের সশস্ত্র এবং নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড করেনি।”

দলটি কী চায়?

নিজেদের রাজ্যের এমন মানচিত্র তৈরি করেছে কেএনএফ

কেএনএফের ফেইসবুক পাতার বক্তব্য অনুযায়ী, তারা পার্বত্য চট্টগ্রামের অভ্যন্তরে তাদের অঙ্কিত মানচিত্রানুযায়ী স্বশাসিত একটি পৃথক রাজ্য চায়। রাজ্যটি হবে বাংলাদেশের অধীনে, তবে স্বায়ত্তশাসিত।

কল্পিত ‘কুকি-চিন রাজ্য’র মানচিত্রে পার্বত্য চট্টগ্রামের পূর্বাংশের রাঙামাটি জেলার সাজেক উপত্যকা বাঘাইছড়ি থেকে শুরু করে বরকল, জুরাইছড়ি, বিলাইছড়ি, রোয়াংছড়ি এবং বান্দরবানের উপকণ্ঠ থেকে চিম্বুক পাহাড় হয়ে রুমা, থানছি, লামা ও আলিকদমসহ নয়টি উপজেলা রাখা হয়েছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের সংখ্যাগরিষ্ঠ তিন জনজাতি চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরাদের পরিত্যক্ত করা হয়েছে কথিত এই রাজ্যে। রাখা হয়েছে বম, খিয়াং, পাংখুয়া, লুসাই, খুমি ও ম্রোদের।

সংখ্যার দিক দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরাদের পরেই রয়েছে ম্রো জনগোষ্ঠী। ১৯৯১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, ম্রোদের মোট জনসংখ্যা ২২ হাজার ১৭৮ জন। বম জনসংখ্যা ৬ হাজার ৯৭৮ জন। ম্রোদের দাবি, তাদের প্রকৃত সংখ্যা ৫০ হাজারের বেশি। বমরাও একই রকম দাবি করেন।

ইয়াং বম অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ভাননুন সিয়াম বম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তাদের নিজস্ব শুমারিতে ২০১৪ সালে বমদের সংখ্যা ছিল ১৭ হাজারের বেশি।

খিয়াং, পাংখুয়া, লুসাই, খুমিদের কারোর সংখ্যাই পাঁচ হাজারের বেশি হবে না।

খিয়াং, পাংখোয়া, লুসাই, খুমি ও ম্রোদের নেতৃস্থানীয় কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে কেএনএফের সঙ্গে বমদের কিছু তরুণ ছাড়া আর কেউ এখনও যুক্ত হয়নি বলে ধারণা পাওয়া গেছে।

“খিয়াংদের কেউ কুকি-চিন দলে নেই,” বলেন লেলুং খিয়াং। একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় কর্মরত এ তরুণ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বাংলাদেশে খিয়াংদের সংখ্যা বড় জোর সাড়ে চার হাজারের মতো। তাদের বাস বান্দরবান সদর, রোয়াংছড়ি ও থানছি এলাকায়। অল্প কিছু খিয়াং আছে রাঙামাটির চন্দ্রঘোনায়।”

সংখ্যায় কম হওয়ায় প্রায় সর্বত্রই খিয়াংদের সঙ্গে তার যোগাযোগ রয়েছে জানিয়ে লেলুং বললেন, “এখন পর্যন্ত খিয়াংদের কেউ ওই দলে যোগ দিয়েছে বলে শুনিনি।”

বম সোশ্যাল কাউন্সিলের সাধারণ সম্পাদক জনাথন বম এবং ইয়াং বম অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ভাননুন সিয়াম বম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, কেএনএফের অস্তিত্বের খবর এপ্রিলের দিকে তারা প্রথম জানতে পারেন।

তবে বম জনগোষ্ঠীর বড় সংখ্যক ওই দলে যোগ দেয়নি দাবি করে জনাথন বলেন, “বমদের থেকে দলে দলে লোকজন বম পার্টিতে যোগ দিচ্ছে, এমনটা ঘটলে আমাদের সমাজে প্রচার হত।”

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক সদস্য, শিক্ষাবিদ নিরূপা দেওয়ানের কাছে কুকি-চিন জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ইতিহাস আর নৃতত্ত্বের জটিল বিতর্কে যাওয়ার দরকার নেই, আমার এত জানাও নেই।

“তবে সাদা চোখে দেখতে পাচ্ছি, একটি স্বার্থান্বেষী মহল, পাহাড়ে যারা শান্তি চায় না, পাহাড় অশান্ত হলে যাদের লাভ হয়, তারাই একেক সময় একেক পার্টির জন্ম দেয়।”

আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী যা বলছে

হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ত্রিপুরারা

২২ জুনের হত্যাকাণ্ডে ‘বম পার্টি’র ‘দায়িত্ব স্বীকারের’ পর বারবার চেষ্টা করেও রাঙামাটির পুলিশ সুপার এবং বিলাইছড়ির ওসির কোনো বক্তব্য বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম পায়নি।

রাঙামাটির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অপরাধ) মাহমুদা বেগম ঘটনার দিন শুধু বলেছিলেন, দুর্গম এলাকা হওয়ায় সেখানে পৌঁছানো ‘কঠিন এবং সময়সাপেক্ষ’।

তবে কেএনএফের নামে দল গড়ে ওঠার কথা বছরের শুরুতেই শুনেছিলেন বলে জানান রুমা থানার ওসি আলমগীর হোসেন।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি রুমায় আসার কিছুদিন পর নাথান বমের নেতৃত্বে একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের জন্ম হয়েছে শুনেছি।”

এই পুলিশ কর্মকর্তা এ বছরের মার্চ মাসে বান্দরবানেরই নাইক্ষ্যংছড়ি থানা থেকে রুমায় বদলি হন।

নাথানের খবর জানতে চাইলে আলমগীর বলেন, “এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকে নাথানকে খোঁজ করা হচ্ছে। পুলিশ তার খোঁজ পায়নি। ধারণা করা হচ্ছে, নাথান দেশে নেই।”

এমন ধারণার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, “নাথানের পরিবার থেকে এমনটা বলা হয়েছে।”

তবে ওসির জানা নেই, নাথান বিদেশে গিয়ে থাকলে বৈধ নাকি অবৈধ পথে গেছেন। তা জানার চেষ্টা করছেন বলে জানান তিনি।

হত্যাকাণ্ড এবং কেএনএফের তৎপরতা নিয়ে জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (মিডিয়া) মো. কামরুজ্জামান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রতিটি হত্যাকাণ্ডই গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করা হয়।

“অপরাধী যেই হোক, কাউকে ছাড় দেওয়া হয় না। অপরাধীদের শনাক্ত, গ্রেপ্তার এবং আইনের আওতায় আনার ক্ষেত্রে সাইবার ইউনিটসহ পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট সমন্বয় করে সার্বক্ষণিক কাজ করে যাচ্ছে।”