ঈদে প্রাধান্য পেয়েছে মুক্তা, রঙিন পাথর আর অ্যান্টিক ব্রাস ম্যাটেরিয়ালের গয়না।
Published : 06 Apr 2024, 08:33 AM
‘ওই যে বড় লাল ঝুমকাটা দেখান, আর পাশের বড় নেকলেসটাও’-ক্রেতাদের এমন অনেক ফরমায়েশে ব্যস্ত রাজধানীর ধানমন্ডির সীমান্ত স্করায়ের ক্লাসি জুয়েলার্সের গয়নার দোকানের বিক্রেতারা।
সীমান্ত স্কয়ারের মত নিউ মার্কেট, গাউছিয়া, মিরপুর, বসুন্ধরা সিটি এবং ধানমন্ডির বিভিন্ন গয়নার দোকান এবং দেশীয় ফ্যাশন হাউজে ঘুরে দেখা গেছে, ঈদের কেনাকাটায় ক্রেতাদের পছন্দসই গয়না চোখের সামনে তুলে ধরতে বিক্রয়কর্মীরা দম ফেলার ফুরসত পাচ্ছেন না।
আর এসব জায়গার ইমেটিশনের নানা ধরনের গয়নায় সনাতনী আর প্রচলিত দুই ধারার নকশারই দাপট চলছে। প্রাধান্য পেয়েছে মুক্তা, রঙিন পাথর আর অ্যান্টিক ব্রাস ম্যাটেরিয়াল গয়না।
হালে জনপ্রিয়তা পাওয়া গয়নার অনলাইন পেইজগুলোতে ঘুরে দেখা গেছে সাবেকি-চলতি নকশার পাশাপাশি কাপড়, বীজ, কাঠ, মাটি বা পুঁতির গয়নার পসরাও ওয়েছে ঈদ ঘিরে।
চলতি ও সাবেকি দুই স্টাইল
ঈদের পোশাক সঙ্গে মিলিয়ে গয়না না পরলে সাজগোজ পূর্ণতা পায় না। আবার গয়না যদি শৈল্পিক না হয়, তাহলে আর বিশেষত্বও থাকে না।
দেশি ব্র্যান্ড আড়ংয়ে পোশাকের পাশাপাশি ভিন্নধর্মী ডিজাইনের গয়না জনপ্রিয়। সোনা ও রূপার দামী গয়না ছাড়াও মুক্তা, বিডস, অ্যান্টিক মেটাল, রঙিন পাথরের চলতি ও সাবেকি উভয় স্টাইলের গয়না রয়েছে এখানে।
আড়ংয়ের আসাদ গেইট শাখার গয়না বিভাগের কর্মীরা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে ঈদের গয়নার বিক্রিবাটা নিয়ে বলেছেন, কানের দুল, মালা, নেকলেস, আংটি ভালোই বিক্রি হচ্ছে। তরুণীরা বিডস, রঙিন পাথর, রেজিন ও মুক্তার হালকা গয়না বেশি পছন্দ করছেন।
মাঝ বয়সী নারীদের আগ্রহ রূপা, গোল্ড প্লেটেড ও অ্যান্টিক ব্রাস মেটেরিয়ালের মাঝারি ও ভারী গয়নার দিকে।
এছাড়া সাবেকি স্টাইলের কাটাই, ফুল, মিনাকারি গয়নাও অনেকে পোশাকের সঙ্গে মিলিয়ে কিনছেন অনেকে বলে জানালেন আড়ংয়ের বিক্রয়কর্মীরা।
আড়ংয়ের এই আউটলেটে ঈদের শাড়ির সঙ্গে মিলিয়ে কাটাই নকশা করা ঝুমকা কিনেছেন রাজধানীর তানিয়া তানভী।
তিনি বলেন, “পুরনো সময়ের নকশা আমার ভীষণ প্রিয়। মায়ের বিয়ের কাটাই গয়না দেখে এই গয়নাটি কিনলাম। আর গয়নার সাদা মুক্তার সঙ্গে শাড়ির সাদা রঙও মিলে গেছে।”
বসুন্ধরা সিটিতে দেশি ফ্যাশন ব্র্যান্ড বিবিয়ানার স্বত্বাধিকারী লিপি খন্দকার বলেন, “ঈদের বাজারে বিডস, মেটাল, সুতা, পুথি, কুন্দন, মিনাকারি, কাঠ, কড়ি ও পাথরের গয়না যেমন আছে তেমনি পুরনো ধাঁচের গলা জোড়া নেকলেস ও সীতাহারের আদলে করা সাবেকি গয়নাও রাখা হয়েছে।“
ফ্যাশন হাউস বিশ্বরঙে ঈদের জন্য যেসব গয়না তৈরি করেছে, সেগুলোর মধ্যে মেটাল, কুন্দন ও মিনাকারির ব্যবহার বেশি।
তবে ঈদের বাজের তারা হালকা গয়না কম তুলেছেন। চিক, নেকলেস, সীতাহার, ঝুলানো বড় মালা, চোকারে পুরনো দিনের নকশা ও আফগানি নকশার মিশেল রাখা হয়েছে বিশ্বরঙে।
অনলাইন শপে ভিন্নধর্মী নকশা
সারা বছর অনলাইনে গয়না বিক্রি করলেও ঈদ ঘিরে রোজার আগে থেকেই বিভিন্ন অনলাইন শপগুলোয় বাহারি গয়না তোলা হয়।
এই দোকানগুলোর মধ্যে কন্যা, ডিফারেন্ট লুক, কাদম্বরী, নিস্বন, সিক্স ইয়ার্ডস স্টোরি, স্টোরি অব পার্ল, নীলিমা, ভিন্টেজ ভাইভ, গ্লুড টুগেদার, রূপবান তাদের ঈদ আয়োজনে সাবেকি ও চলতি দুই ধরনের গয়নাই রেখেছে।
এসব পেইজ সেজে উঠেছে লহরি মালা, পঞ্চচিপ বা পাঁচ স্তরের মালা, তিন স্তরের রানিহার, হাঁসুলি, সীতাহার, জড়োয়া, চোকার, নবরত্ন হার, রতনচূড়, কানপাশা, মানপাশা, চাঁনবালি দুল, ঝুমকা, অনন্ত বালা, গোলাপ কাঁটা বালা, হাতের বাজু, কাঁকন, বিছার মত গয়না নিয়ে।
কয়েক যুগ পুরোনো মুলতানি, পলকি, মিনাকারি, কাটাই, ময়ূর, পদ্ম, হাঁসের মুখের মত, নানা রকম ফুলের নকশা এই গয়নাগুলোকে দিয়েছে সাবেকি ‘লুক’।
গয়নার পেইজ ‘রূপবান’ এর উদ্যোক্তা শিমুল মজলিশ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গয়নার সৃজনশীলতায় অনেক পরিবর্তন এসেছে। দেশের বাইরে থেকে গয়না আমদানির প্রচলন কমেছে। উদ্যোক্তাদের ভিন্নধর্মী নকশার কারণে দেশিয় গয়নায় ক্রেতাদের আগ্রহ অনেক বেড়েছে।”
ঈদের জন্য হালকা ডিজাইনের গয়না কিনেছেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী লামিয়া চৌধুরী। উৎসবের দিনে শাড়ির সঙ্গে চোকার পরবেন তিনি।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে এই তরুণী বলেন, “একটি অনলাইন পেইজ থেকে পদ্ম ও গোলাপ ফুলের মিশ্রণে নকশা করা চোকার কিনেছি। শাড়ির সঙ্গে গয়নাটি পরলে ট্র্যাডিশনাল লুক আসবে। অনেক অনলাইনেই পুরনো নকশার গয়না দেখেছি। একটি ঝুমকাও কিনব চোকারের সঙ্গে মিলিয়ে।”
আবার অনেক অনলাইন উদ্যোক্তা কেবল আধুনিক নকশার চলতি ধারার গয়না রেখেছেন। যেমন আধুনিক ও মিনিমাল ডিজাইনের মুক্তার লকেটসহ ও লকেটবিহীন মালা, চেইন, চোকার, নেকলেস মিলবে বিভিন্ন অনলাইন শপে।
কিছু অনলাইন শপে ঈদের গয়নায় পলিশ মুক্তা ছাড়াও ট্রেন্ডি অনিয়মিত আকৃতির বড় মুক্তা ব্যবহার করা হয়েছে। গয়নায় লম্বাটে, ডিম্বাকৃতির দুই আকার মিলানো মুক্তাও ডিজাইনাররা গয়নায় ব্যবহার করেছেন।
অনলাইন পেইজ ‘গ্লুড টুগেদার’র উদ্যোক্তা মেহনাজ আহমেদ আদিবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা রঙিন পলিশড পাথার ছাড়াও ঈদের হালকা ধরনের গয়নায় ব্যবহার করেছি আনকাট বা রাফ স্টোন। বাংলায় যাকে বলা যায় এবড়োথেবরো পাথর। আবার রেজিনের গয়নাতেও আসে পাথরের লুক। রেজিন একেবারেই আধুনিক গয়না।”
দোকান ও ফুটপাতের ঈদ গয়না
ঈদ যত এগিয়ে আসছে নিউ মার্কেট, গাউসিয়া, চাঁদনি চক, চন্দ্রিমা, মৌচাক, ধানমন্ডি ও মিরপুর এলাকার বিভিন্ন মার্কেট ও বিপণীবিতানের দোকানগুলোয় গয়নার দোকানে ভিড় বেড়েছে।
এসব জায়গায় গয়নার পসরা নিয়ে সাজিয়ে বসা ফুটপাতের দোকানগুলো উপচে উঠেছে নানা ধরনের গয়নায়।
মিরপুরের অর্নামেন্টস কর্নারের দোকানী মহাম্মদ ইউনুস বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন “অনেক ক্রেতারাই রেডিমেট গয়নার চেয়ে নিজেদের পছন্দের ডিজাইনের গয়না বানিয়ে নেন। ঈদে গোল্ড প্লেটেড, অ্যান্টিক মেটাল ও রঙিন পাথরের গয়নার চাহিদা বেশি।”
রাজধানীর সব বয়সী ও সব শ্রেণিপেশার নারীদের কাছে গয়না কেনাকাটায় গাউছিয়া ও নিউ মার্কেট সব সময়ই প্রিয়।
দোকান ছাড়াও ভবনের সিড়ির পাশের ছোট ছোট দোকানগুলো থেকেও দেদার বিক্রি হচ্ছে।
চাঁদনী চকে গয়না কিনতে আসা ফাহামিদা হোসেন ভিন্ন ভিন্ন পোশাকের জন্য আলাদা ডিজাইনের গয়না খুঁজছিলেন।
ফাহামিদা বলেন, “শাড়ি, সালোয়ার কামিজ ও কুর্তি তিন ধরনের পোশাক ঈদের তিন দিন পরব। তাই তিন ডিজাইনের গয়না কিনব। শাড়ি ও সালোয়ার কামিজের সঙ্গে পুরনো ডিজাইনের গয়না ও কুর্তির জন্য চেইনের মালা, আংটি, ব্রেসলেট, কানের ছোট দুল কেনার ইচ্ছা আছে।”
গাউছিয়া মার্কেটের সোনালি ইমিটেশনের ম্যানেজার আব্দুল কাসেম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ক্রেতারা বেশি পছন্দ করছেন নানা রকম পাথরের তৈরি করা সীতাহার, চোকার, লহরী মালা ও জরোয়া সেট। ছোট, মাঝারি ও বড় তিন রকমের পাথরেরই গয়নায় ব্যবহার করা হয়েছে।
“লাল, খয়েরি, সবুজ, ফেরোজা, গোলাপী, বেগুনি, নীল, ম্যাজেন্টাসহ মাল্টি কালার পাথরের গয়নার কাটতিও ভাল। মুক্তার সঙ্গে মিনাকারি করা গয়নাও বেশ চলছে।”
নিউ মার্কেটের ছোট ছোট দোকানের গয়নার দাম কিছুটা কম। চয়নিকা নামের একটি গয়না দোকানের বিক্রয়কর্মী ফাহিম আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মালা, হার, আংটি, ঝুমকা বেশি বিক্রি হচ্ছে। আবার অনেকেই ব্রাস মেটালের গোলাপ কাটা বালা, কাঁকন, বাজু, টিকলি কিনছেন।”
নিউ মার্কেট, গাউছিয়া, চন্দ্রিমা, চাঁদনী চকের বিভিন্ন গয়না দোকানীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দোকান ও ফুটপাতে বিক্রি করা বেশির ভাগ গয়না আসে সাভারের ভাকুর্তা গ্রাম থেকে।
এই গ্রামটি ‘গয়না গ্রাম’ নামেও পরিচিত। ওই গ্রাম থেকে ব্যবসায়ীদের অনেকে রেডিমেইড অথবা নিজেদের করা নকশা দিয়ে গয়না বানিয়ে আনেন বলে জানান ব্যবসায়ীরা।
বেশিরভাগ ব্যবসায়ী বলেছেন, ঈদের সময়ে গয়নার চাহিদা বাড়ে বলে কয়েক মাস আগে থেকেই কেনা ও অর্ডারের কাজ শুরু করে দিতে হয়।