জঙ্গি আর পাহাড়ি দলের মিলে যাওয়ার বিপদ যেখানে

পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এমন ঘটনা শুধু জাতীয়ই নয়, আঞ্চলিক নিরাপত্তাকেও হুমকির ‍মুখে ঠেলে দেব। তাই সরকারকে এখনই সতর্ক হতে হবে।

গোলাম মর্তুজা অন্তুবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 Oct 2022, 07:13 PM
Updated : 13 Oct 2022, 07:13 PM

পার্বত্যাঞ্চলে জঙ্গিদের আস্তানা গাঁড়া নতুন না হলেও পাহাড়ি কোনো সংগঠনের সঙ্গে তাদের মিলে যাওয়ার ঘটনাটি নতুন; আর তা বড় বিপদের কারণ হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন পর্যবেক্ষকরা।

তারা বলছেন, এমন ঘটনা শুধু জাতীয়ই নয়, আঞ্চলিক নিরাপত্তাকেও হুমকির ‍মুখে ঠেলে দেব। তাই সরকারকে এখনই সতর্ক হতে হবে।

সম্প্রতি র‌্যাব দেশে নতুন একটি ইসলামী জঙ্গি দলের সংগঠিত হওয়ার খবর দেয়, যার নাম বলা হচ্ছে ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’।

নিখোঁজ কিছু তরুণের খোঁজে গিয়ে এই দলটির সন্ধান মেলে। দলের সদস্যরা পার্বত্য জেলা বান্দরবানে প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন বলেও খবর দেয় র‌্যাব।

বাহিনীর মুখপাত্র খন্দকার আল মঈন সংবাদ সম্মেলন করে বলেছিলেন, জেএমবি, হুজিসহ পুরনো জঙ্গি দলগুলোর দলছুট সদস্যরা এই দল গঠন করেছে, আর তাদের মদদ দিচ্ছে পাহাড়ি বিচ্ছিন্নতাবাদী দুই-একটি সংগঠন।

এক সময়ে জঙ্গি সংগঠন হুজির পাহাড়ে আস্তানা গাঁড়ার খবর গণমাধ্যমে এসেছিল। আফগান ফেরতদের এই দলটি গঠনের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল মিয়ানমারের মুসলমান রোহিঙ্গাদের পক্ষ নিয়ে লড়াইয়ে অংশ নেওয়া।

নব্বইয়ের দশকে রোহিঙ্গাদের দুই সংগঠন রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও) এবং আরাকান রোহিঙ্গা ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন (এআরএনও) এর সঙ্গে হুজির সম্পর্কের খবরও আলোচনায় আসে।

উগ্রবাদ বিষয়ে তথ্য সংরক্ষণকারী সাউথ এশিয়া টেরোরিজম পোর্টালের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৩ সালের ২৬ ও ২৭ অগাস্ট বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির জঙ্গল থেকে পুলিশ, বিডিআর, সেনাবাহিনীর যৌথ অভিযানে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র উদ্ধার হয়েছিল।

তাদের ২০০৫ সালের মূল্যায়ন অনুযায়ী, বান্দরবানে জেএমবির বেশ তৎপরতা ছিল। তারা রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের কাছ থেকে অস্ত্র সংগ্রহের চেষ্টা করছিল।

এভাবে পাহাড়ে আশ্রয় নিলেও পাহাড়ি কোনো সংগঠনের সঙ্গে মুসলিম জঙ্গিদের যোগসাজশের খবর আগে পাওয়া যায়নি।

Also Read: নতুন জঙ্গি দলের ‘পাহাড়ি যোগ’ পেয়েছে র‌্যাব

একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি, লেখক ও সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, পাহাড়িদের মধ্যে কয়েকটি সংগঠন রয়েছে, পাহাড়ি-বাঙালি দ্বন্দ্ব আছে। তার মধ্যে আবার বাঙালিদের মধ্যে ঢুকে পড়েছে উগ্রবাদীরা। আবার আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ আছে।

“এসব মিলিয়ে সেখানকার পরিস্থিতি অনেক জটিল। এর মধ্যে সেখানে ধর্মীয় উগ্রবাদীদের সঙ্গে পাহাড়িদের মেলবন্ধন ভালো কিছুর ইঙ্গিত করে না। আমি বলব যে সেখানে সরকারকে কঠোর নজরদারি রাখতে হবে।”

মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদেরও এই জটিলতার মধ্যে গুরুত্বের সঙ্গে দেখছেন শাহরিয়ার কবির।

তিনি বলেন, “পার্বত্য চট্টগ্রাম ও আরাকানের একটা অংশ নিয়ে স্বাধীন দেশ গঠনের পরিকল্পনা বহুদিন থেকে করে আসছে কিছু রোহিঙ্গা গোষ্ঠী। ২০০৪ সালে ওদের একটি প্রকাশনা থেকে বিষয়টি প্রথম জানতে পারি।

তাই এখন এটাকে হালকাভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। এটা বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গে যেমন জড়িত, তেমনি জড়িত দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক নিরাপত্তার সঙ্গেও।
শাহরিয়ার কবির

র‌্যাব বলছে, তাদের হাতে গ্রেপ্তার কুমিল্লার মসজিদুল কোবার ইমাম হাবিবুল্লাহ দুই বছর ধরে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়িতে মাদ্রাসা চালাচ্ছিলেন। এছাড়া তারা দুর্গম এলাকায় আরও কিছু আস্তানার কথা জানতে পেরেছেন যেখানে পাহাড়ি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আশ্রয়ে নতুন জঙ্গি সংগঠনের সদস্যদের প্রশিক্ষণ চলছে।

নতুন জঙ্গি দলটির সঙ্গে পাহাড়ি সংগঠনের যোগসাজশের কথা বললেও কোনো সংগঠনের নাম বলেনি র‌্যাব।

তবে কেউ কেউ কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) বা বম পার্টি নামে নতুন পাহাড়ি সংগঠনটির দিকে আঙুল তুলেছে। তবে এই দলটির কোনো বক্তব্য বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের পক্ষে পাওয়া সম্ভবপর হয়নি।

Also Read: পাহাড়ে সশস্ত্র দল; এই ‘বম পার্টি’ কারা?

বাংলাদেশের উগ্রবাদের গতি-প্রকৃতি নিয়ে খোঁজখবর রাখা নূর খান লিটন বলেন, “পার্বত্য চট্টগ্রামের সশস্ত্র বম পার্টির কথা শোনা যাচ্ছে, পাশাপাশি আরও কয়েকটি দল রয়েছে। এর বাইরে সেখানে ভারতীয় ও মিয়ানমারের কিছু সশস্ত্র গ্রুপের অবস্থানের কথা জানা যায়।

“এটার সাথে জঙ্গিদের যদি একটা যোগসূত্র হয়ে থাকে, তাহলে ধরে নেওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে যে আমাদের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ছে।”

তবে এই ধরনের নিশ্চিত কোনো তথ্য এখনও পাননি বলে জানান তিনি।

“আমি এখন পর্যন্ত নিরপেক্ষ কোনো সূত্র থেকে জঙ্গিদের সঙ্গে পাহাড়ি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের যোগাযোগের সমর্থনে কোনো তথ্য পাইনি।”

“তবে ওই এলাকাগুলোতে এর আগে উগ্রবাদীদের আনাগোনার ইতিহাস রয়েছে। এর আগে সমন্বিত অভিযানে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের সঙ্গে হরকাতুল জিহাদের (হুজি) লোকজন ধরা পড়েছে, উদ্ধার হয়েছে বিপুল অস্ত্র। রোহিঙ্গা ও হুজির জঙ্গিরা একই মামলার আসামি হয়েছে,” একই সঙ্গে বলেন তিনি।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের (বিআইপিএসএস) ইনস্টিটিউট অব টেরোরিজম রিসার্চের প্রধান শাফকাত মুনীর এই ঘটনাপ্রবাহের উপর নজর রাখছেন।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই মুহূর্তে পার্বত্য চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত এলাকার নিরাপত্তা পরিস্থিতি বেশ নাজুক অবস্থায় রয়েছে। তাই বিষয়টিকে কোনোভাবে হালকা করে দেখার সুযোগ নেই।”

“তাই আমাদের উচিৎ হবে, এই মুহূর্তে জিনিসটিকে সামগ্রিকভাবে পর্যালোচনা করা। পাশাপাশি নতুন যে জঙ্গি সংগঠনটি গঠনের কথা আমরা শুনতে পাচ্ছি, সেটি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্য আরও বড় হুমকি হয়ে ওঠার আগেই তাদের সম্পূর্ণভাবে পরাস্ত করার পদক্ষেপ নিতে হবে,” বলেন তিনি।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক খন্দকার আল মঈন বলছেন, জঙ্গি গোষ্ঠী ও পাহাড়ি বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীটি সম্পর্কে পাওয়া তথ্য তারা পার্বত্য এলাকায় কর্মরত বাহিনীগুলোকেও দিয়েছেন। সেখানে এখন সমন্বিত অভিযান চলছে।