পূর্ব ক্ষোভের কারণে আওয়ামী লীগ নেতারা থানায় হামলা চালায় বলে উল্লেখ করা হয়েছে মামলার এজাহারে।
Published : 27 Aug 2024, 05:08 PM
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর থানায় হামলা চালিয়ে ১৫ পুলিশ সদস্যকে হত্যা এবং অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর, অস্ত্র ও গুলি লুটের ঘটনায় মামলা করা হয়েছে।
ঘটনার ২১ দিন পর পুলিশের করা এই মামলায় থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ চার নেতার নাম উল্লেখ এবং পাঁচ থেকে ছয় হাজার অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে।
রোববার রাতে এনায়েতপুর থানার এসআই আব্দুল মালেক বাদী হয়ে মামলাটি করেন বলে জানিয়েছেন সিরাজগঞ্জ পুলিশ সুপার আরিফুর রহমান মণ্ডল।
মামলার এজাহারভুক্ত আসামিরা হলেন, এনায়েতপুর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি আহমদ মোস্তফা খান বাচ্চু, সাধারণ সম্পাদক আজগর আলী বিএসসি, শাহজাদপুর উপজেলার খুকনী ইউপির চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি মুল্লুক চাঁন এবং বেলকুচি উপজেলার ভাঙ্গাবাড়ি ইউপির চেয়ারম্যান জহুরুল ইসলাম ভূইয়া।
পূর্ব ক্ষোভের কারণে আওয়ামী লীগ নেতারা থানায় হামলা চালায় উল্লেখ করে মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, গত ২৮ ফেব্রুয়ারি এনায়েতপুর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি আহমদ মোস্তফা খান বাচ্চু থানায় গ্রেপ্তার হওয়া এক আসামিকে ছেড়ে দেওয়ার দাবি করেন। পুলিশ তার দাবি না মেনে ওই আসামির বিরুদ্ধে মামলা নেয়।
এ কারণে আহমদ মোস্তফা খান বাচ্চুর নেতৃত্বে ৪৫০ থেকে ৫০০ জন থানা ঘেরাও করে। সেসময় থানার ওসি আব্দুর রাজ্জাকের অপসারণের দাবিও করেছিলেন তিনি।
এ ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে অবৈধ দাবি না মানায় থানা পুলিশের ওপরে আওয়ামী লীগ নেতা বাচ্চুর ক্ষোভ ছিল। এ কারণে এনায়েতপুর থানা পুলিশের ক্ষতি করার সুযোগ খুঁজতে থাকেন তিনি।
এজাহারে বলা হয়, এ অবস্থায় গত ৪ আগস্ট দুপুর ১২টার দিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা এনায়েতপুর থানার সামনে সমবেত হয়। এ সময় ওসি আব্দুর রাজ্জাক হ্যান্ড মাইকে সমবেত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার উদ্দেশে বক্তব্য দেন। বক্তব্যে ওসি রাজ্জাক বলেন, ‘এই থানা আপনাদের সাধারণ জনগণের। আপনারা থানার কোনো ক্ষয়ক্ষতি করবেন না।’ এ কথায় ছাত্র-জনতা থানা এলাকা থেকে চলে যায়।
এরপর আওয়ামী লীগ নেতা আহমদ মোস্তফা খান বাচ্চুর নেতৃত্বে এজাহারনামীয় আসামিসহ পাঁচ থেকে ছয় হাজার দুষ্কৃতকারী দেশিয় অস্ত্র হাতে থানায় হামলা চালায়। তখন আত্মরক্ষায় পুলিশ কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ করে। পরে আসামিরা পুলিশের কোয়ার্টার ও ওসির বাসভবনে আগুন ধরিয়ে দেয়।
আরও পড়ুন...
সিরাজগঞ্জে সাবেক এমপি মুন্না, হেনরী ও সচিব অপুর বিরুদ্ধে ৩ হত্যা মামলা
সিরাজগঞ্জের সাবেক এমপি মমিনের নামে আরও ২ হত্যা মামলা
সিরাজগঞ্জে ছাত্রের মৃত্যু: সাবেক এমপিসহ ৩৩ জনের নামে হত্যা মামলা
আগুন দেখে পুলিশ সদস্যরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। এ সময় আসামিরা থানায় ঢুকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে প্রথমে সাত পুলিশ সদস্যকে হত্যা করে। এরপর তারা থানা ভবনে ঢুকে পুলিশের ব্যবহারের সরকারি অস্ত্র ও জনসাধারণের জমা দেওয়া বেসরকারি অস্ত্র ও গুলি লুট করে।
এরপর তারা সেসব আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে থানার ভেতর ও বাইরে থাকা অফিসার ও ফোর্সদের দিকে এলোপাতাড়ি গুলি করে।
এজাহারে আরও বলা হয়, এ সময় থানার ওসি আব্দুর রাজ্জাকসহ পুলিশ সদস্যরা থানার পাশে অবস্থিত বাবু মিয়ার বাড়িতে আশ্রয় নেন। আসামিরা সেখানেও হামলা চালিয়ে কয়েকজনকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করে।
হামলার সময় নারী কনস্টেবল রেহেনা পারভীনকে মারধর করে এবং টানা-হেঁচড়া করে তার শ্লীলতাহানি করা হয়। এ ঘটনায় পর বিকালে সেনাবাহিনীর একটি দল থানা এলাকায় পৌঁছে হতাহত পুলিশ সদস্যদের উদ্ধার করে হাসপাতাল ও মর্গে পাঠায়।
আরও পড়ুন...
সিরাজগঞ্জে আহত আরও ২ পুলিশ সদস্যের মৃত্যু
সিরাজগঞ্জে ১৩ পুলিশসহ ২৭ জনের প্রাণহানি
সিরাজগঞ্জে এমপি হেনরির বাসায় অগ্নিসংযোগ, ২ মরদেহ উদ্ধার
এজাহারে বলা হয়, হামলার সময় আসামিরা পাঁচটি পিস্তল ও আটটি ম্যাগাজিন, একটি চায়না পিস্তল ও দুইটি ম্যাগাজিন, চারটি চায়না রাইফেল ও ৩৭টি চার্জার, দুইটি চায়না রাইফেল ও দুইটি ম্যাগাজিন, ছয়টি ১২ বোরের শটগান, একটি ৩৮ মিমি গ্যাস গান লঞ্চার, ১৬৮টি ৭.৬২/৩৯ মিমি গুলি, ১৬টি ৭.৬২/২৫ মিমি গুলি, ৬০টি ৯/১৯ মিমি গুলি, ১২ বোর শটগানের (রাবার কার্তুজ) গুলি ২২৭টি, ১২ বোর শটগানের (লেটবল কার্তুজ) গুলি ৩৫৯টি, লং রেঞ্জ গ্যাস শেল ৩৮টি এবং শর্ট রেঞ্জের ৩৬টি গ্যাস শেল লুট করে নিয়ে যায়।
এ ছাড়া আসামিরা থানায় থাকা একটি ডাবল কেবিন ও একটি সিঙ্গেল কেবিনের পুলিশ পিকআপ ভ্যান, পুলিশ সদস্যদের ব্যবহৃত ১৫টি মোটরসাইকেল ও একটি ট্রাক, বিভিন্ন সময় জব্দ করা নতুন ও পুরাতন ১২টি মোটরসাইকেল এবং থানার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ নথি, আসবাবপত্র, কম্পিউটার ও ওয়াকিটকি পুড়িয়ে দেয়।
এতে থানার চার কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে বাদী এজাহারে উল্লেখ করেছেন।
আরও পড়ুন...
রায়গঞ্জে আওয়ামী লীগের অফিসে হামলা করে ছয় জনকে হত্যা
সিরাজগঞ্জে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সংঘর্ষে নিহত ৩
সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুরে ১৩ পুলিশকে পিটিয়ে হত্যা
এ বিষয়ে মঙ্গলবার দুপুরে সিরাজগঞ্জ পুলিশ সুপার আরিফুর রহমান মণ্ডল বলেন, এনায়েতপুর থানায় হামলা-অগ্নিসংযোগের ঘটনায় সম্পূর্ন থানা ভবন ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ায় পাশেই একটি ভাড়া ভবনে বর্তমানে থানার কার্যক্রম চালানো হচ্ছে।
মামলার কোনো আসামিকে এখনো গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। ঘটনার পর থেকে তারা গা-ঢাকা দিয়েছেন। তাদের গ্রেপ্তার ও লুট হওয়া অস্ত্র-গুলি উদ্ধারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় গত চার অগাস্ট ছাত্র-জনতা ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষে এনায়েতপুরে আরও দুই শিক্ষার্থী ও এক ব্যবসায়ীর মৃত্যু হয়। ওই সব ঘটনায় থানায় আলাদা তিনটি হত্যা মামলা হয়েছে।
ওই সব মামলায় সাবেক সংসদ সদস্যসহ আব্দুল মমিন মণ্ডলসহ ২০৯ জন আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী এবং দেড় হাজার থেকে দুই হাজারের বেশি অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে।