চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বান্দরবানে ১৩ জনের মৃত্যু ও তিনজন নিখোঁজের খবর পাওয়া গেছে।
Published : 09 Aug 2023, 12:34 AM
সক্রিয় মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে কয়েকদিন ধরেই দেশের বেশিরভাগ স্থানে বৃষ্টি হচ্ছে। টানা বৃষ্টিতে সবচেয়ে দুর্দশায় পড়েছেন পার্বত্য অঞ্চলসহ চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষ।
মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত এসব জেলার বেশিরভাগ স্থানে পানিবন্দি অবস্থায় লাখো মানুষকে দিন কাটাতে হচ্ছে। পাহাড়ি ঢলে মানুষ ভেসে যাওয়া ও পাহাড় ধসে মাটিচাপার মতো ঘটনাও ঘটেছে বেশ কয়েকটি।
এসব জেলার কোথাও বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে, কোথাও নেই মোবাইল নেটওয়ার্ক। বিশেষ করে প্রত্যন্ত এলাকাগুলোয় দেখা দিয়েছে খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানিয়ের সংকট। যদিও এখন পর্যন্ত সব ধরনের সহায়তা নিয়ে পাশে থাকার কথা জানিয়েছে প্রশাসন।
এখন পর্যন্ত এসব জেলার বিভিন্ন স্থানে ১৩ জনের মৃত্যু ও তিনজন নিখোঁজের খবর পাওয়া গেছে।
এর মধ্যে সোমবার কক্সবাজারের চকরিয়া ও উখিয়ায় পাহাড় ধসে চারজনের এবং মাতামুহুরি নদী থেকে কাঠ সংগ্রহ করতে গিয়ে একজনের মৃত্যু হয়েছে। একই দিন বান্দরবানের পাহাড় ধসে এক কিশোরীর মৃত্যু হয়েছে; নিখোঁজ রয়েছেন তার মা।
মঙ্গলবার কক্সবাজারের রামুতে বাড়ির উঠানে বন্যার পানিতে ডুবে এক শিশু এবং পেকুয়ায় সাপের কামড়ে এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে।
এছাড়া শনিবার চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার বৈলগাঁও এলাকায় দেয়াল ধসে এক শিশু, সোমবার লোহাগাড়ায় বানের পানিতে ডুবে এক বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র এবং হাটহাজারীতে পানিতে পড়ে মৃত্যু হয়েছে এক কলেজছাত্রীর। রাউজানে নিখোঁজ রয়েছেন এক ব্যবসায়ী।
বান্দরবানের আলীকদম উপজেলায় ঢলে ভেসে একজন এবং পাহাড় ধসে একজনের মৃত্যু হয়েছে। নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার রিংও পাড়ার বাসিন্দা এক ম্রো যুবক ঢলে ভেসে নিখোঁজ রয়েছেন।
মূলত সোমবার থেকে কক্সবাজার ও তিন পার্বত্য জেলায় অতিবৃষ্টি শুরু হলেও চট্টগ্রামে টানা বৃষ্টি শুরু হয়েছে বৃহস্পতিবার থেকে।
ভারি বৃষ্টির সঙ্গে অস্বাভাবিক উচ্চতার জোয়ার যোগ হলে শুক্রবার বন্দর নগরীর বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। শনিবারও এসব এলাকা ছিল পানির নিচে। ওই দিন থেকে চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলায় পানি বাড়তে থাকে।
চট্টগ্রামের ১৫টি উপজেলার মধ্যে দক্ষিণের সাতকানিয়া, বাঁশখালী, পটিয়া ও আনোয়ারা এবং উত্তরের রাউজান, রাঙ্গুনিয়া, সীতাকুণ্ড, মীরসরাই, হাটহাজারী ও ফটিকছড়ির পানিতে তলিয়ে যাওয়া এলাকার পরিমাণ বেশি। রাঙ্গুনিয়ার শস্যভান্ডার খ্যাত গুমাই বিলসহ চট্টগ্রাম জেলার বিভিন্ন অংশের কৃষি জমি, সবজি খেত, হাঁস-মুরগি-গরুর খামার তলিয়ে গেছে।
রোববার বন্দর নগরীর নতুন নতুন এলাকা তলিয়ে যেতে শুরু করে। ফলে জলাবদ্ধ হয়ে উঠতে শুরু করে নগরীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। সোমবার সকাল থেকে চট্টগ্রাম-হাটহাজারী রোড এবং চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে পানি উঠতে শুরু করে।
শুরুতে স্বাভাবিকভাবেই জলাবদ্ধতা এমন দীর্ঘ হবে তা প্রত্যাশিত ছিল না চট্টগ্রামবাসীর। ফলে তেমন প্রস্তুতিও ছিল না তাদের। তারওপর খোলা ছিল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত।
তাই পানির মধ্যেই স্বাভাবিক জীবন চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে হয়েছে তাদের। এরমধ্যে বিদ্যুৎ ও পানির সংকট তীব্র হলে পরিস্থিতি বিরূপ আকার ধারণ করে।
জলাবদ্ধতার পরিস্থিতি পরিবর্তন না হওয়ায় মঙ্গলবার চট্টগ্রাম মহানগরীর সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়।
এরপরই খবর আসে পাহাড়ি ঢল আর জলাবদ্ধতায় পর্যুদস্ত চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বুধ ও বৃহস্পতিবার বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। তবে খোলা রয়েছে রাঙামাটির শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো।
জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, টানা বৃষ্টিতে পাহাড়ি নদীগুলোর পানি বেড়ে এবং খাল-জলাশয় উপচে চট্টগ্রামের ১৩ উপজেলার প্রায় ৬ লাখ ৩৫ হাজার মানুষ এখন পানিবন্দি। বন্দরনগরীর একটি বড় অংশের বাসিন্দাদেরও পোহাতে হচ্ছে ভোগান্তি।
ঢলের কারণে বান্দরবান শহরের ৬০ ভাগ এলাকা এখন জলমগ্ন। কিছু কিছু জায়গায় পাহাড় ধসের কারণে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে রোববার থেকে বান্দরবানের সঙ্গে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাঙ্গামাটি, কক্সবাজার, খাগড়াছড়ির যোগাযোগ কার্যত বন্ধ রয়েছে। জেলার বেশির ভাগ এলাকা বিদ্যুৎহীন থাকায় এবং মোবাইল নেটওয়ার্ক ও ইন্টারনেট সেবা ব্যাহত হওয়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রায় অচল হয়ে পড়েছে।
শহরে গুরুত্বপূর্ণ সরকারি দপ্তর জেলা প্রশাসক কার্যালয়, সদর উপজেলা কার্যালয়, ফায়ার সার্ভিস, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, চিফ জুডিসিয়াল কার্যালয়, নির্বাচন কমিশন অফিস, পাসপোর্ট অফিস ও বিআরটিএ অফিসে হাঁটু পানিতে তলিয়ে আছে বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে জেলা প্রশাসন।
কক্সবাজার জেলার সাতটি উপজেলার কমপক্ষে ৪৫টি ইউনিয়নের সাড়ে চার লাখ মানুষ পানিবন্দি, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়কে পানি উঠে যাওয়ায় বন্ধ রয়েছে যানচলাচল। কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়ক, সমুদ্র সৈকতের বিভিন্ন পয়েন্টসহ উপকূলীয় এলাকায় ভাঙন অব্যাহত রয়েছে।
টানা বর্ষণ আর পাহাড়ি ঢলে মাইনী নদীর পানি বেড়ে পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ির নিচু এলাকাও প্লাবিত হয়েছে। দীঘিনালা উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়নে এক হাজারের বেশি পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে বলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা জানিয়েছেন।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে চট্টগ্রাম ও বান্দরবানে দুর্গতদের সহায়তায় সেনা মোতায়েন করা হয়েছে।
আইএসপিআর জানিয়েছে, বন্যা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত সেনাবাহিনীর সহায়তা কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে।
রাঙামাটিতে টানা বৃষ্টিতে বড় কোনো পাহাড়ধসের ঘটনা না ঘটলেও প্রায় দুই শতাধিক স্থানে ছোটবড় ধস ও ভাঙনের খবর পাওয়া গেছে। মঙ্গলবার বিকাল পর্যন্ত জেলার ২৩৫টি স্থানে এসব ভাঙন বা ধসের ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছে জেলা প্রশাসন।
জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এসব ধসের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৩৮১টি বসতঘর। যার মধ্যে রয়েছে আশ্রয়ন প্রকল্পের ১০টি ঘরও। এসব ঘটনায় কোনো প্রাণহানি না হলেও আহতের সংখ্যা ১০।
ভারি বৃষ্টির কারণে জেলার বাঘাইছড়ি, জুরাছড়ি, বিলাইছড়ি, বরকল এবং কাপ্তাইয়ের বেশ কয়েকটি নিচু এলাকা জলমগ্ন হয়ে রয়েছে। যেখানে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন ৩০ হাজার মানুষ।
তীব্র স্রোতের কারণে কর্ণফুলি নদীতে বন্ধ হয়ে গেছে ফেরি চলাচল। সড়কে পাহাড় ধসে পড়ায় যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে রাঙামাটির বাঘাইছড়ি ও লংগদু উপজেলার সঙ্গে দীঘিনালা উপজেলা হয়ে খাগড়াছড়ির সড়ক যোগাযোগ।
অন্যদিকে, পর্যটনকেন্দ্র সাজেক ঘুরতে গিয়ে আটকা পড়েছেন প্রায় দুইশ পর্যটক। পাহাড়ি ঢলে দীঘিনালা-সাজেক সড়ক ডুবে যাওয়ায় মঙ্গলবার দুপুরের পর সাজেতের সঙ্গে সড়কপথে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আটকা পড়েছেন তারা।
জলমগ্ন এলাকাগুলোর মানুষদের জন্য প্রস্তুত রয়েছে কয়েকশ আশ্রয়কেন্দ্র। উপদ্রুত প্রতিটি উপজেলায় ইউএনওরা নৌকায় করে পানিবন্দি মানুষের কাছে যাচ্ছেন, তাদের পরিস্থিতি অনুযায়ী বুঝিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে যাচ্ছেন।
সেখানে তাদের প্রশাসনের পক্ষ থেকে রান্না করে খাওয়ানো হচ্ছে, প্রয়োজনীয় ত্রাণও দুর্গত মানুষকে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসনগুলো। এখন পর্যন্ত পর্যাপ্ত শুকনো খাবার ও বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা রয়েছে।
চট্টগ্রাম বিভাগের বড় অংশ যখন পানিবন্দি, তখন ভালো খবর দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। সবশেষ পূর্ভাবাস অনুযায়ী, বুধবার থেকে কমবে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ।
আবহাওয়াবিদ হাফিজুর রহমান জানিয়েছেন, শুধু চট্টগ্রাম না, ঢাকা এবং বরিশাল বিভাগেও বৃষ্টি কম হবে। তবে ভরা বর্ষায় বৃষ্টি একেবারে থামবে না।
এই মুহূর্তে চট্টগ্রাম, মোংলা, পায়রা সমুদ্রবন্দর এবং কক্সবাজারকে আগের মতোই ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্কতা সংকেত দেখিয়ে যেতে বলেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। সেইসঙ্গে, সকল মাছ ধরার ট্রলার ও নৌকাকে পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত উপকূলের কাছ থেকে সাবধানে চলাচল করতে বলা হয়েছে।
প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহায়তা করেছেন চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও কক্সবাজার প্রতিনিধি
আরও পড়ুন:
নেই মোবাইল নেটওয়ার্ক-ইন্টারনেট, বান্দরবান এখনও নিমজ্জিত
বান্দরবানে পাহাড় ধস: মেয়ের লাশ উদ্ধার, মা নিখোঁজ
পানিবন্দি বান্দরবানে খোলা হয়েছে দুই শতাধিক আশ্রয়কেন্দ্র
রাঙামাটিতে ছোটবড় ২৩৫ পাহাড় ধস, পানিবন্দি ৩০ হাজার মানুষ
বৃষ্টি-ঢল: চট্টগ্রামের ৪ জেলায় দুদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ
কক্সবাজারে বন্যার অবনতি, পানিবন্দি সাড়ে ৪ লাখ মানুষ
লোহাগাড়ায় বানে প্রাণ গেল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রের
টানা বর্ষণে প্লাবিত খাগড়াছড়ির নিম্নাঞ্চল, লংগদুর সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ
চট্টগ্রামে বৃষ্টিপাত কমার আভাস
বন্যা: চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলায় দেড় লাখ ঘর এখন বিদ্যুৎহীন