স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, বন্যা কবলিত এলাকাগুলোয় তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ খাবার পানির।
Published : 08 Aug 2023, 04:38 PM
বৃষ্টি, পাহাড়ি ঢল ও জোয়ারের পানিতে কক্সবাজারে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। নতুন করে প্লাবিত হচ্ছে বিভিন্ন এলাকা।
মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত জেলার সাতটি উপজেলার কমপক্ষে ৪৫টি ইউনিয়নের সাড়ে চার লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। পানির কারণে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে।
আবহাওয়া অফিসের কক্সবাজার আঞ্চলিক কার্যালয়ের জ্যেষ্ঠ পর্যবেক্ষণ কর্মকর্তা দুলাল চন্দ্র দাশ জানিয়েছেন, সোমবার সকাল ৬টা থেকে মঙ্গলবার সকাল ৬টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় জেলায় ১৬৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। মঙ্গলবার সকাল ৬টা থেকে বেলা ১২টা পর্যন্ত বৃষ্টি হয়েছে ১৭ মিলিমিটার।
আগামী তিন দিনেও বৃষ্টি অব্যাহত থাকবে। এতে পাহাড় ধসের আশঙ্কাও রয়েছে বলে জানান তিনি।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) বিভীষণ কান্তি দাশ জানান, সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত কক্সবাজারের প্লাবিত ইউনিয়নের সংখ্যা ছিল ৩১টি। মঙ্গলবার এসে ৪৫ ইউনিয়ন প্লাবিত হওয়ার তথ্য মিলছে। যেখানে ৭০ হাজারের বেশি পরিবারের সাড়ে ৪ লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি রয়েছে।
জেলার চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলায় সবচেয়ে বেশি এলাকা প্লাবিত হয়েছে। দুই উপজেলার একটি পৌরসভাসহ ২৫টি ইউনিয়ন প্লাবিত হওয়ার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। যেখানে আড়াই লক্ষাধিক মানুষ জলাবদ্ধতার শিকার হয়েছেন।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, জিদ্দাবাজার-কাকারা-মানিকপুর সড়কের কয়েকটি অংশের উপর দিয়ে মাতামুহুরী নদী থেকে উপচে আসা পাহাড়ি ঢলের পানি প্রবাহিত হওয়ায় চকরিয়ার সুরাজপুর-মানিকপুর ইউনিয়ন ও কাকারা ইউনিয়ন ৪-৫ ফুট পানির নিচে তলিয়ে আছে। তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ খাবার পানির।
সুরাজপুর-মানিকপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আজিমুল হক আজিম ও কাকারা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাহাব উদ্দিন জানান, তাদের ইউনিয়নগুলো মাতামুহুরী নদীর সাথে লাগোয়া। এজন্য পাহাড় থেকে নামা ঢলের পানি আগে আঘাত আনে ইউনিয়নগুলোতে। এই দুই ইউনিয়নে অধিকাংশ ঘরই পানির নিচে তলিয়ে রয়েছে। গত দুইদিন ধরে তাদের রান্নার কাজও বন্ধ। শুধু শুকনো খাবার খেয়ে রয়েছে মানুষ।
কক্সবাজারে ৩১ ইউনিয়নে পানিবন্দি লাখো মানুষ, ছুটছে আশ্রয়কেন্দ্রে
এ ছাড়া চকরিয়ার লক্ষ্যারচর, কৈয়ারবিল, বরইতলী, হারবাং, সাহারবিল, চিরিঙ্গা, পূর্ব বড় ভেওলা, বিএমচর, পশ্চিম বড় ভেওলা, ঢেমুশিয়া, কোনাখালী, ফাঁসিয়াখালী, বদরখালী, ডুলাহাজারা, খুটাখালী এবং পেকুয়া উপজেলার পেকুয়া সদর ইউনিয়ন, উজানটিয়া, মগনামা, রাজাখালী, টৈটং, শিলখালী, বারবাকিয়া ইউনিয়নের লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন।
এদিকে পেকুয়ার সদর ইউনিয়নের মেহেরনামার বেঁড়িবাধটি ভেঙে উজান থেকে নেমে আসা বন্যার পানি লোকালয়ে প্রবেশ করতে শুরু করেছে। এসব ইউনিয়নের নিচু গ্রামগুলোতে বেশি পানি উঠেছে ।
চকরিয়া পৌরসভার মেয়র আলমগীর চৌধুরী বলেন, অতিবৃষ্টির কারণে পৌরসভার অধিকাংশ ওয়ার্ড পানির নিচে তলিয়ে গেছে। স্ব-স্ব ওয়ার্ডের কাউন্সিলররা পানি যাতে দ্রুত নিচের দিকে নেমে যায়, সেজন্য কাজ করছেন। এছাড়াও ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ১নং বেঁড়িবাঁধটি রক্ষার জন্য বালির বস্তা ফেলা হচ্ছে।
শীলখালী ইউপির চেয়ারম্যান কামাল হোসেন বলেন, টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের কারণে অনেক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। তারা এখন পানিবন্দি হয়ে আছেন।
টইটং ইউপির চেয়ারম্যান জাহেদ চৌধুরী জানান, টানা বৃষ্টির পানিতে তার ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এতে অনেক পরিবারের ঘর-বাড়ি ডুবে গেছে।
পেকুয়া সদর ইউপি চেয়ারম্যান বাহাদুর শাহ জানান, দ্রুত সময়ের মধ্যে বেঁড়িবাধের ভাঙা অংশ মেরামত করা না হলে পেকুয়ার জন্য বন্যা পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে।
দ্রুত ভাঙা অংশ মেরামতের ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরের হস্তক্ষেপ কামনা করেন তিনি।
পেকুয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) পূর্বিতা চাকমা জানান, সকাল থেকে উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিদর্শন করেছি। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে অসংখ্য মানুষ। তাদের জন্য শুকনো খাবারের ব্যবস্থা করতে ইউপি চেয়ারম্যান-মেম্বারদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
চকরিয়ার ইউএনও জেপি দেওয়ান বলেছেন, বন্যাকবলিত এলাকাগুলো পরিদর্শন করেছি। প্রশাসনের হিসেব অনুযায়ী প্রায় দেড় লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। বন্যা কবলিত মানুষদের নিকটস্থ আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি। যেসব মানুষ কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে তাদের বিশুদ্ধ পানি ও শুকনো খাবার দেওয়া হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, এ ছাড়াও যারা ঘরবাড়ি ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্রে আসতে চাচ্ছে না সেসব পরিবারকে প্রাথমিকভাবে শুকনো খাবার দিতে চেয়ারম্যানদের নির্দেশ দিয়েছি।
একইসঙ্গে চকরিয়ার বন্যার ব্যাপারে জেলা প্রশাসককে অবহিত করে ত্রাণ বরাদ্দ চেয়েছেন বলে জানান তিনি।
এ ছাড়া রামু উপজেলায় নতুন করে প্লাবিত হয়েছে চার ইউনিয়ন। মিঠাছড়ি, খুনিয়াপালং, রশিদনগর ও জোয়ারিয়ানালা ইউনিয়নের বাঁকখালী নদী সংলগ্ন গ্রামের শতাধিক পরিবার বন্যা কবলিত হয়েছেন।
ঈদগাঁও উপজেলার ঈদগাঁও, জালালাবাদ, পোকখালী, ইসলামাবাদ ইউনিয়ন, কক্সবাজার সদরের পিএমখালী, খুরুশকুল, পৌরসভার কয়েকটি ওয়ার্ড, কুতুবদিয়ার ছয়টি ইউনিয়ন, মহেশখালীর তিন ইউনিয়ন প্লাবিত হওয়ার তথ্য জানিয়েছে জেলা প্রশাসন।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ শাহীন ইমরান বলেন, গত কয়েক দিন ধরে প্রবল বর্ষণ ও পূর্ণিমার উচ্চ জোয়ার অব্যাহত রয়েছে। এসব কারণে বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে।
“প্রতিটি উপজেলায় আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। প্রতিটি উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তারা মাঠে রয়েছেন। তারা বোট নিয়ে পানিবন্দি মানুষের ঘরে ঘরে যাচ্ছেন এবং তাদের আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসছেন।”