যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড অঙ্গরাজ্যের পোটোম্যাক শহরে দেখা ডক্টর আশরাফ আহমেদের সাথে। একজন প্রতিথযশা বিজ্ঞানী এবং সেইসাথে লেখালেখিও করেন। উপহার হিসেবে আমাকে দিলেন তার লেখা দুটো বই। আমেরিকা থেকে চীনে ফেরার সময়ে বাল্টিমোর থেকে আটলান্টা হয়ে সাংহাই, সেখান থেকে ছোংছিং হয়ে আমার কর্মস্থল লুঝৌ পৌঁছাতে যাত্রা আর যাত্রাবিরতি মিলিয়ে ৬০ ঘণ্টা লাগে। এই সুদীর্ঘ সময়ে বইদুটো যথার্থ বন্ধুর কাজ করেছে।
প্রথম যে বইটি শুরু করেছিলাম, সেটার নাম 'হৃদয় বিদারক'। এটি কোনও গল্প বা উপন্যাস বা প্রবন্ধ সংকলন নয়। অনেকটা আত্মজীবনীর মত, আবার আত্মজীবনীও নয় ঠিক। লেখক এখানে হৃদরোগে (হার্ট অ্যাটাক) আক্রান্ত হয়ে শল্যচিকিৎসা নেয়ার (ওপেন হার্ট সার্জারী) অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন একেবারে রোগ ধরা পড়া থেকে শুরু থেকে চিকিৎসাপর্বের শেষপর্যন্ত। লেখাগুলো সুপাঠ্য, ভাষা প্রাঞ্জল এবং মার্জিত। লেখার যে বিষয়টা আমাকে অবাক করেছে তা হল, অসুখবিসুখ, মৃত্যু ইত্যাদি বিষন্ন বিষয়গুলোর আলোচনাকে তিনি দারুন রস দিয়েছেন। সে হিসেবে এটিকে 'রম্যরচনা' বলেও চালিয়ে দেয়া যায়। অসুখবিসুখের এবং চিকিৎসার সময়ে হাসপাতালের চিকিৎসক, সেবিকাদের সাথে কিংবা বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন এবং পরিবারের একান্ত আপনজনদের সাথে রোগীর ভাব বিনিময় এবং মনস্তাত্ত্বিক আচরণের খুঁটিনাটি চমৎকারভাবে লেখক তুলে ধরেছেন।
হৃদরোগের কারণ এবং তা থেকে দূরে থাকার জন্য যে জীবনযাপন কিংবা খাদ্যাভ্যাস দরকার তার সুন্দর কিছু বর্ণনা দেওয়া হয়েছে এখানে। সেইসাথে হৃদরোগের আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের খুঁটিনাটিও আলোচনা করা হয়েছে। তবে বুঝতে হবে, লেখকের চিকিৎসা নেওয়ার অভিজ্ঞতা হয়েছে পৃথিবীর উন্নত দেশের প্রথম সারির এক হাসপাতালে। বাংলাদেশের একজন হৃদরোগী এর সাথে নিজের অভিজ্ঞতা মেলাতে গিয়ে হতাশ হতে পারেন। বইটি পড়তে পড়তে লেখকের জীবন দর্শনও অনেকটা পরিষ্কার হয়ে ওঠে। লেখক লিখছেন, "ধৈর্য কম বলে হার্ট অ্যাটাক হয়ে মৃত্যু আমার সবচেয়ে বেশি কাম্য। বিছানায় শুয়ে শুয়ে, বহুদিন লাগিয়ে ওষুধ-পথ্য খেয়ে, নিজে শারীরিক-মানসিক কষ্টে ভুগে এবং অন্যদের ভুগিয়ে মরার চাইতে হার্ট অ্যাটাক হয়ে মরতে পারাটা সময় ও খরচের দিক দিয়েও ভালো একটি ব্যবস্থা।" আমার ধারণা এখনকার সময়ে পরিণত বয়সের প্রায় সব মানুষ এভাবেই ভেবে থাকেন। আধুনিক এই ব্যস্ত সময়ের ব্যস্ত সমাজের প্রতি এ এক অভিমানও হতে পারে। যদিও কোনও মৃত্যুই 'সহজ' নয়, তবুও অন্যকে কষ্ট না দেওয়ার, অন্যের উপর নির্ভরশীল না হতে চাওয়া একজন আত্মমর্যাদাশীল মানুষের কামনা হতেই পারে।
'হৃদয় বিদারক' প্রথম প্রকাশ হয়েছে ২০১৭ সালে আগামী প্রকাশনী থেকে। যে কেউ চাইলে সংগ্রহ করে পড়তে পারেন। আমার ধারণা, পরিণত বয়সের যেকোনও মানুষ যারা পড়তে ভালোবাসেন, তাদের বইটি ভালো লাগবে। বইটি তাদেরও ভালো লাগবে যারা মৃত্যু নিয়ে চিন্তা করেন। বিজ্ঞানের (বিশেষ করে বায়োমেডিক্যাল সাইন্স কিংবা চিকিৎসা বিজ্ঞান) শিক্ষার্থীদের জন্য 'হৃদয় বিদারক' হতে পারে তথ্যের ভাণ্ডার। পরিশেষে আরেকটা ভালোলাগার বিষয় উল্লেখ করতে চাই। বইটি লেখক উৎসর্গ করেছেন "পৃথিবীর সব দেশে মহান নার্সিং পেশায় নিয়োজিতদের উদ্দেশ্যে"। আমারও শ্রদ্ধা পৃথিবীর সকল নার্স, ডাক্তার, এবং মহান বিজ্ঞানীদের যারা মানবসেবায় চির-নিয়োজিত। 'হৃদয় বিদারক' বইয়ের জন্য শুভকামনা।
দ্বিতীয় বইটির নাম "জলপরি ও প্রাণপ্রভা"। নামটি শুনতে ভারি রোমান্টিক মনে হলেও এটি আসলে বিজ্ঞানের বই। নিজের জীবনের বিজ্ঞান শিক্ষা আর গবেষণার বিষয়বস্তু লেখক এখানে সুন্দর সাবলীল ভাষায়, কিছুটা গল্পাকারে বর্ণনা করেছেন। যারা বিজ্ঞানের ছাত্র কিংবা বিজ্ঞান নিয়ে ভাবেন, তাদের কাছে বইটি বেশ ভালো লাগবে বলেই আমার মনে হয়। তবে বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ না থাকলে এই বইটি একটু খটোমটো লাগার কথা পাঠকের জন্য। মোট ১৩টি অধ্যায় বা গল্পে সাজানো হয়েছে। এ বইটিও প্রকাশ করেছে আগামী প্রকাশনী, ২০১৪ সালে।
লেখক শুরু করেছেন নিজের বিজ্ঞান-শিক্ষাগুরুদের দিয়ে, বিশেষ করে গত শতাব্দীর ষাট এবং সত্তরের দশকের দেশের প্রথিতযশা জীববিজ্ঞানীদের নিয়ে কিছু কথা। রয়েছে মারিও কাপোচ্চি নামক একজনের টোকাই থেকে জগদ্বিখ্যাত বিজ্ঞানী হওয়ার গল্প। ২০১৬ সালে ম্যাকাও এ এক সেমিনারে এই মহান বিজ্ঞানীর সাথে দেখা হয়েছিল এবং আমার সৌভাগ্য হয়েছিল সেমিনারের কফি বিরতিতে তার হাতে এক পেয়ালা কফি তুলে দেয়ার। নিজের ভালোবাসার কথা বলতে গিয়ে লেখক গল্প করেছেন ট্রিপ্টোফ্যান সিন্থেজ নামক প্রোটিনের ত্রিমাত্রিক গঠন আবিষ্কারের কাহিনী নিয়ে। বইয়ে আরো রয়েছে প্রাণ-প্রভা (বায়ো-লুমিনিসেন্স) এর আদ্যোপান্ত। ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লেখক গল্প করেছেন 'জেব্রাফিশ' আর আমাদের দেশীয় 'দারখিনা' মাছের, রয়েছে প্রাচীন ভারতীয় কাহিনীতে বর্ণিত 'দুধ সাগরের' বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা। খুব সহজ সুন্দর ভাষায় আমাদের দেহকোষের মৃত্যু কিংবা জীবনাবসান এবং তার সাথে মাইটোকন্ড্রিয়ার সম্পর্ক পেয়েছি কোনও এক গল্পে।
অতি অল্প পরিসরে বিজ্ঞানের মতো অসীম বিষয় নিয়ে লেখক বেশ চমৎকার লিখেছেন বলেই আমি মনে করি। একই সাথে এও মনে করিয়ে দিয়েছেন, "জ্ঞান ও বিজ্ঞান ধ্রুবসত্য নয়। জ্ঞান ও বিজ্ঞান এর অগ্রগতির ফলে 'সত্য' এর সংজ্ঞার-ও অগ্রগতি ঘটে।
লেখক: চীন প্রবাসী
ছবি কৃতজ্ঞতা: মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান খান
মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান খানের আরও লেখা