স্বতন্ত্রের জোয়ারের এবারের নির্বাচনে নৌকা থাকছে ২৬৯টি আসনে; লাঙ্গল লড়বে ২৮৩ আসনে।
Published : 18 Dec 2023, 12:48 AM
বিএনপির বর্জনের মধ্যেও ‘অংশগ্রহণমূলক’ নির্বাচন উপহার দিতে ‘ডামি প্রার্থির’ যে কৌশল আওয়ামী লীগ নিয়েছিল, মনোনয়নপর্বের পরীক্ষায় তা উৎরে গেল ভালোভাবেই। আসনে আসনে ক্ষমতাসীন দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মিছিল আর সংসদের বিরোধী দলের সঙ্গে সমঝোতার পথ ধরে নির্বাচনি ট্রেন পৌঁছে গেল ভোটের লড়াইয়ের চূড়ান্ত পর্বে।
ভোট আয়োজনের শেষ ধাপে এগোনোর পথে ‘এক দফার’ আন্দোলনে থাকা বিএনপি ও সমমনাদের বাধা যেমন বিপত্তি ছাড়াই ডিঙিয়েছে আওয়ামী লীগ, তেমনি আসন ভাগাভাগি নিয়ে রাজনৈতিক মিত্র জাতীয় পার্টির সঙ্গে নাটকীয়তাও সামলেছে সমানতালে।
শরিকদের জোটে ধরে রেখে ছাড় দেওয়ার কৌশলেও সফল হয়েছে ক্ষমতাসীন দলটি, আসন সংখ্যা আগের নির্বাচনের চেয়ে এক ধাক্কায় কমিয়ে এনেছে অর্ধেকে।
একই সঙ্গে নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনীতিতে প্রার্থিতা নিয়ে নিজেদের ঘর গুছিয়েছে সুচারু রূপে আর দলের নেতাদের স্বতন্ত্রের জোয়ারে নামিয়ে দেওয়ার কৌশলও কাজ করেছে; একতরফা ভোটের আলোচনায় যা দিয়েছে ভিন্ন আঙ্গিক।
এবারের ভোটের যাত্রা পথে একে অপরের বিরুদ্ধে প্রার্থীদের জোরালো আপিল যখন খবরের রসদ যুগিয়েছে, তখন সমঝোতার বৈঠকগুলোর কথামালাও নজর কেড়েছে। শেষ পর্ব শুরুর আগে সমঝোতায় প্রার্থিতা প্রত্যাহার শেষে ভোটের লড়াই এখন মাঠে গড়ানোর অপেক্ষা; যাতে প্রার্থী সংখ্যা প্রায় দুই হাজারের কাছে গিয়ে ঠেকেছে।
সোমবার হবে প্রতীক বরাদ্দ; প্রচার শুরু হওয়ার কথা এরপর। তবে আগেই প্রার্থী ও সমর্থকরা মাঠে নেমে পড়ায় প্রতিদ্বন্দ্বিতার রেশ ছড়াতে শুরু করেছে কোথাও কোথাও। রোববার রাতেও পক্ষে-বিপক্ষে শক্তি প্রদর্শন ও পাল্টাপাল্টি অবস্থান আর মারপিটের খবর এসেছে। একতরফা ভোটের আয়োজনের ছায়াকে যা কিছুটা হলেও হটিয়ে দিয়েছে।
২০১৪ সালে বিএনপি যখন নির্বাচন বর্জন করেছিল, অর্ধেকের বেশি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে গিয়েছিল আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা, যা নিয়ে এখনও দলটিকে নিন্দা-মন্দ শুনতে হয়। টানা তিন মেয়াদ ক্ষমতায় থাকা দলটি চায়নি, চতুর্থ দফা সরকারে যাওয়ার সময় সেই সমালোচনা তাদের সঙ্গী হোক।
তাছাড়া এবারের নির্বাচন যাতে অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ, অংশগ্রহণমূলক এবং গ্রহণযোগ্য হয়, সেজন্য চাপ দিয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের ইউরোপীয় মিত্ররা। ফলে বিএনপিকে ছাড়াও যে ‘অংশগ্রহণমূলক’ নির্বাচন সম্ভব, তা দেখানোর চ্যালেঞ্জ রয়েছে ক্ষমতাসীনদের সামনে।
এমন প্রেক্ষাপটে রাজনীতির মাঠে জয়ী হতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়া ঠেকাতে আওয়ামী লীগ এবার বেছে নেয় নতুন কৌশল। কোনো আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা যাতে একলা পড়ে না যান, সেজন্য মনোনয়নের বাইরে থাকা দলের নেতাদেরও স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার পথ খুলে দেওয়া হয়। তাতে রেকর্ড সংখ্যক স্বতন্ত্র প্রার্থীর মনোনয়নপত্র জমা পড়ে রিটার্নিং কর্মকর্তাদের দপ্তরে।
বাছাই, আপিল ও মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের আনুষ্ঠানিকতা শেষে এখন চূড়ান্ত ভোটের লড়াই আছেন মোট ১ হাজার ৮৯৬ জন। নিবন্ধিত ৪৪ দলের মধ্যে ভোটে আছে ২৭টি। অন্যদিকে বিএনপিসহ ১৫টি দল ভোট বর্জন করেছে।
অর্থাৎ, বর্জনকারীদের প্রায় দ্বিগুণ দল দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল মোটে ১২টি দল, সব মিলিয়ে প্রার্থী ছিলেন মোট ১ হাজার ৫৬৭ জন।
২০১৪ সালের মতো এবারও নির্বাচন ঠেকাতে হরতাল-অবরোধের মত কর্মসূচি নিয়ে আন্দোলনে আছে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো। তবে জনজীবনে হরতাল-অবরোধের প্রভাব এবার আগের মতো নেই। প্রার্থিতা নিয়ে আগ্রহীরা সরব হওয়ায় ভোটের হাওয়া বইতে শুরু করেছে। অবরোধ-আন্দোলন ছাপিয়ে পোস্টার সাঁটানো শুরু হয়ে গেছে সড়কে-সড়কে, পাড়া মহল্লায়।
আন্দোলনের হুমকি ও বাইরের চাপের সঙ্গে গত তিন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতায় থাকা জাতীয় পার্টিকে নিয়েও ক্ষমতাসীনদের ভাবতে হয়েছে। জাতীয় পার্টি ভোটে না থাকলে লাভ হবে বিএনপির। আবার নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য দেখাতে হলে বিরোধী দলও দরকার। সেজন্য জাতীয় পার্টির প্রার্থীদের জয় সহজ করতে গতবারের মতই ২৬টি আসন ছেড়ে দিয়েছে আওয়ামী লীগ। ১৪ দলের শরিকদের দেওয়া হয়েছে ছয়টি আসন, তারা নৌকা নিয়েই ভোট করবেন।
মনোনয়নপর্বে ‘ডামি’ প্রার্থীর কৌশলে নিজেদের মধ্যে কোন্দল এবং সহিংসতার ঝুঁকি ছিল আওয়ামী লীগের সামনে। কিন্তু সেরকম বড় ধরনের গোলযোগ এখনও কোথাও ঘটেনি।
কোথাও কোথাও স্বতন্ত্র হিসেবে দাঁড়িয়ে যাওয়া আওয়ামী লীগ নেতারা নৌকার মনোনীত প্রার্থীর পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়াতে পারেন, সে ঝুঁকি এখনও আছে। কিন্তু এ জুয়ায় লাভ হল, নৌকা হেরে গেলেও আওয়ামী লীগই জিতবে।
কতটা প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ?
তবে এক বিশ্লেষক বলছেন, আপাত দৃষ্টিতে অংশগ্রহণমূলক মনে হলেও ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে সংসদে বিরোধ দলের সমঝোতা ও ভাগাভাগির কারণে ভোটারের আগ্রহে ভাটা পড়বে। কেন্দ্রে যেতে আগ্রহ হারাতে পারেন অনেকেই।
নির্বাচন বিশ্লেষক আব্দুল আলীম বলছেন, দলগুলোয় আসন ভাগাভাগি নিয়ে এটা সমঝোতার নির্বাচন। সেই সঙ্গে স্বতন্ত্র প্রার্থীরাও তাদের দলের বিকল্প বা বিদ্রোহী প্রার্থী। প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ভোটের কথা বলা হলেও বাস্তবের চিত্র অন্যরকম।
তার মতে, “দল ও প্রার্থীরা আর ভোটারের কাছে যাচ্ছে না। এখন দলগুলোয় নিজেরা সমঝোতা করে নিচ্ছে কে কতটি আসনে থাকবে। প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করে সমঝোতার করার চেষ্টা করা হয়েছে। যেখানে বড় দলের প্রার্থী নেই, সেখানে অন্যরা সুযোগ পাচ্ছে। ভোটারের কথা কারও মাথায় নেই। এ নির্বাচন আসলে সমঝোতা আর ভাগাভাগির নির্বাচন। যেজন্য ভোটারদের কেন্দ্রে যাওয়ায় আগ্রহও কম থাকবে।”
বিশ্বাসযোগ্য ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন সবাই দেখতে চায় মন্তব্য করে এ নির্বাচন বিশ্লেষক বলেন, স্বতন্ত্র বা ডামি প্রার্থী রয়েছে অনেক জায়গায়। যেখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করে বরং তারা চুপ থাকবে কিংবা আরেকজনকে জেতাতে ছাড় দেবে। এতে হয় কিছু স্বতন্ত্র প্রার্থী জিতে আসবে। কিছু কিছু জায়গায় হয়ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতে পারে। কিন্তু মোটাদাগে হয়ত তা ভোটারদের টানতে পারবে না।
বরাবরের মতো এ নির্বাচনকে ‘একতরফা’ দাবি করে বিএনপি সমঝোতা ও ভাগাভাগির এ নির্বাচন বর্জন করতে আহবান জানিয়ে আসছে। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খানের ভাষায়, “যা হতে চলেছে, সেটি নির্বাচন নয়, হবে ভোট ভাগাভাগি। ভোটের সিট ভাগাভাগি করে যে ফলাফল নির্ধারণ করা হয়েছে ৭ তারিখে সেই ফলাফলই শুধুমাত্র ঘোষণা করা হবে।”
মিরপুরে বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে গিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “এই নির্বাচনের ফলাফল ঢাকায় বসে নির্ধারণ করা হচ্ছে। আজকে যেটা হচ্ছে সেটা নির্বাচন নয়, সেটা হচ্ছে বানরের পিঠে ভাগাভাগি… সেই কাজগুলো আপনারা (সরকার) প্রকাশ্যে করছেন।”
সুষ্ঠু ভোটে যদি আওয়ামী লীগ নির্বাচিত হয়, তাহলে তিনিই প্রথম দলটিকে অভিনন্দন জানাবেন বলেও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এই বিএনপি নেতা।
বিএনপির বর্জনের আহ্বানের বিপরীতে সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক ভোটের কথা বলে আসা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের রোববার দুপুরে দলের সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বিএনপির নেতৃত্বে কয়েকটি দল নির্বাচনকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ভাগাভাগি নির্বাচন বলছে। যে নির্বাচনে দুই হাজারের বেশি প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে, সেটি কি করে ভাগাভাগির নির্বাচন হয়?
মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন সংবাদ সম্মেলনে এসে জাতীয় পার্টি মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু জানান, সব মিলিয়ে ২৮৩টি আসনে লড়াই করবেন লাঙ্গল প্রতীকের প্রার্থীরা।
তিনি বলেন, “কিছু কিছু আসনে আমাদের যারা সিনিয়র নেতা, সেসব আসনে যারা নির্বাচন করে… রাজনৈতিক দল, তাদের সঙ্গে একটা সমঝোতা হয়েছে বা হবে, এমন একটা অবস্থান আছে। বাট নির্বাচনে আমরা যাচ্ছি, এটা হলো বড় কথা। এটা আমার দলের কৌশল, নির্বাচনে জয়লাভ করার বা সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পাওয়ার বা বেশি আসন পাওয়ার একটা নিজস্ব কৌশল থাকে”।
অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন আয়োজন করে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে তার দলের সর্বোচ্চ চেষ্টার কথা জানান জাপা মহাসচিব।
নৌকা থাকছে ২৬৯ আসনে, লাঙ্গল নেই ১৭টিতে
রোববার মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার শেষের হিসাবে দেখা গেছে নৌকা প্রতীকে ২৬৯ জন ও লাঙ্গল নিয়ে লড়বেন ২৮৩ জন। স্বতন্ত্রের জোয়ারে ভোটের পালে যে হাওয়া লেগেছে তাতে মোট প্রার্থী রয়েছেন ১ হাজার ৮৯৬ জন।
প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর তালিকা চূড়ান্ত হওয়ায় এখন ভোটারদের মনোযোগ আকর্ষণের পালা শুরু হলো। প্রতীক পেয়ে সোমবার থেকেই প্রচারণায় নামতে পারবেন তারা।
এ নির্বাচনে শরিক ও প্রতিদ্বন্দ্বী জাপার জন্য ৩০টি আসনে প্রার্থী রাখেনি আওয়ামী লীগ; সেই সঙ্গে বাছাই ও আপিলে বাদ পড়েছেন নৌকার আরও ৫ প্রার্থী।
রোববার নির্বাচন ভবনে আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া ব্রিফিংয়ে বলেন, শরিকরাও ছয় আসনে নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করবে।
জাতীয় পার্টি এখনও ‘সমঝোতার পথ খোলা’ রেখে ২৮৩ আসনে প্রার্থী রেখেছে। তারা ১৭টি আসনে লাঙ্গল প্রতীকের প্রার্থী দেয়নি।
এ দুই দল ছাড়াও জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয় পার্টি-জেপিসহ ভোটে রয়েছে ২৭ দল।
বিএনপি, সিপিবি, বাসদ, বিজেপি, জেএসডি, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশসহ ১৫টি দল রয়েছে ভোটের বাইরে।
>> ভোট ৭ জানুয়ারি
>> ৩০ নভেম্বর মনোনয়নপত্র জমার সময় দলীয় প্রার্থী ছিলেন ১ হাজার ৮৬৯ জন ও স্বতন্ত্র প্রার্থী ছিল ৭৪৭ জন।
>> বাছাইয়ে বাদ পড়েন ৭৩১ জন।
>> আপিল করে ফিরে আসেন পৌনে তিনশ’ জন প্রার্থী।
>> বাছাই ও আপিলে সাড়ে চারশ’ জন বাদ পড়ার পর বৈধ থাকে ২২৬০ জন।
>> প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ সময়ে ১৭ ডিসেম্বর ভোট থেকে সরে দাঁড়ান ৩৪৭ জন।
>> এখন ভোটের লড়াইয়ে প্রতিদ্বন্দ্বি প্রার্থী থাকল ১৮৯৬ জন।
>> সবশেষ একাদশ সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী ছিলেন ১ হাজার ৮৬১ জন। তাদের মধ্যে দলীয় প্রার্থী ১৭৩৩ জন; বাকি ১২৮ জন স্বতন্ত্র।
৩৪৭ জন সরলেন, ভোটের লড়াইয়ে ১৮৯৬ প্রার্থী
জাপার প্রার্থী ২৮৩ আসনে, সমঝোতার প্রশ্নে চুন্নুর জবাব ‘ধন্যবাদ’
টিকেট পেয়েও যাদের নৌকায় চড়া হল না
কেন্দ্রের অনুমতি ছাড়া স্বতন্ত্রদের বহিষ্কার কার্যকর হবে না: কাদের
সাঈদ খোকনের সঙ্গে ভোটে থাকলেন না জাপার ফিরোজ রশীদ
শেষ দিনের অপেক্ষায় রাখল জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগ
আপিলে পৌনে তিনশ ফেরায় ভোটের প্রার্থী এখন ২২৬০
৩২ নয়, ভোটে আসা দলের সংখ্যা ২৯টি: ইসি