আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন সমঝোতা নিয়ে উপর্যুপরি প্রশ্নে জাতীয় পার্টির নেতা বলেন, “এটা তো আমাদের দলের নিজস্ব কৌশল। সেটা তো আপনাকে জবাবদিহি করার দরকার নাই।”
Published : 17 Dec 2023, 03:34 PM
মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলনে এসে মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু ঘোষণা দিয়েছেন, তার দল ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে ২৮৩টি আসনে লড়াই করবেন লাঙ্গল প্রতীকের প্রার্থীরা।
তবে আওয়ামী লীগের কাছ থেকে কতগুলো আসনে জাতীয় পার্টি ছাড় পেয়েছে, সেই প্রশ্নের জবাব তার মুখ থেকে কোনাভাবেই বের করতে পারলেন না গণমাধ্যম কর্মীরা।
রোববার মোট দুইবার বনানীতে দলীয় চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে আসেন চুন্নু। বিকালে দ্বিতীয় সংবাদ সম্মেলনে এসে তার কাছে মূল প্রশ্ন ছিল আওয়ামী লীগ কতগুলো আসনে ছাড় দিয়েছে এবার।
বারবার একটি কথাই বলেন জাতীয় পার্টির নেতা।
“২৮৩টি আসনে আমরা নির্বাচন করছি।”
‘আমরা তো ২৬টি আসনের কথা শুনছি’, একজন গণমাধ্যমকর্মীর এই প্রশ্নে ‘ধন্যবাদ, ধন্যবাদ’ বলে উঠে চলে যান চুন্নু।
তাহলে সমঝোতার দরকারটা কী ছিল, দফায় দফায় এত বৈঠক কেন করলেন- একজন সাংবাদিক এই প্রশ্ন করলে চুন্নু বলেন, “এটা তো আমাদের দলের নিজস্ব কৌশল। সেটা তো আপনাকে জবাবদিহি করার দরকার নাই।
“এটা আমার দলের কৌশল, নির্বাচনে জয়লাভ করার বা সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পাওয়ার বা বেশি আসন পাওয়ার একটা নিজস্ব কৌশল থাকে। সেই কৌশলগুলো আমি তো আপনাকে সব খুলে বলব না।”
২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি অংশ নেয় জোট করে। গত সংসদ নির্বাচনেও ছিল এই জোট।
বিএনপি-জামায়াত ও সমমনাদের বর্জন করার পর ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচনে জোট না হলেও জাতীয় পার্টির সঙ্গে আসন সমঝোতা করে আওয়ামী লীগ। এবারও একই পথে হেঁটেছে দুই দল।
তবে এই আসন সমঝোতার আলোচনায় এবার ছিল লুকোচুরি। দুই দলের নেতারা অন্তত চারটি বৈঠক করলেও কোথায় বসেছেন, সেটিই প্রকাশ পায়নি।
আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শেষমেশ ২৬টি আসনে ছাড় দেওয়ার একটি বার্তা এসেছে। তবে জাতীয় পার্টির এসব বিষয়ে শুরু থেকেই মুখে ছিল কুলুপ।
সবশেষ গতরাতের বৈঠকে দুই পক্ষ একটি সিদ্ধান্তে এসেছে- এমন কথা চাউর হওয়ার পর সকালে একাধিক আসনে জাতীয় পার্টির মনোনয়নপ্রত্যাশীরা ছাড় না পেয়ে ক্ষোভও দেখান।
দুপুরে সংবাদ সম্মেলনে এনে চুন্নু বলেন, তারা ভোটে যাবেন কি না, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানাতে বিকালে সংবাদ সম্মেলনে আসছেন।
বিকাল চারটার আগে আগে সংবাদ সম্মেলনে এসে তিনি সব অনিশ্চয়তা এক পাশে ‘ঠেলে’ জানান, অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন আয়োজন করে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে তার দলের সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকবে।
‘নির্বাচনের পরিবেশ ভালো’
চুন্নু বলেন, “জাতীয় পার্টি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল এবং সেই লক্ষ্যেই কার্যক্রম করে আসছিল। আমাদের একটাই দাবি ছিল সরকারের কাছে এবং নির্বাচন কমিশনের কাছে; ভালো পরিবেশ যদি সৃষ্টি হয় এবং মানুষের যদি আস্থা থাকে, তাহলে জাতীয় পার্টি নির্বাচন করবে এবং নির্বাচনে থাকবে।
“এখন পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনের এবং সরকারের বিভিন্ন মহলের আশ্বাসে আমাদের মোটামুটিভাবে একটা আস্থা এসেছে, তারা নির্বাচনটা ভালোভাবেই করতে চান। সেই লক্ষ্যেই সরকার নির্বাচন কমিশনকে সহযোগিতা করে যাচ্ছে এবং নির্বাচন হওয়ার আগ পর্যন্ত যা যা সহযোগিতা করার তারা করবেন।
আরও পড়ুন:
আওয়ামী লীগের ছাড়ে জাপা পেল ২৬, চৌদ্দ দল ৬
আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্ররা কি ছাড়বেন? জাপার সামনে জটিল অঙ্ক
“সে কারণে জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে আমাদের চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদেরের পক্ষ থেকে আমি জাতীয় পার্টির সব প্রার্থী… তাদেরকে অনুরোধ করছি, আমরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করব এবং নির্বাচন যাতে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়, প্রতিযোগিতামূলক হয়, সেই লক্ষ্যে কাজ করে যাব। আমরা আশাবাদী এই নির্বাচনে দেশের মানুষ স্বতস্ফূর্তভাবে গণতন্ত্রকে রক্ষা করার জন্য, সাংবিধানিক ধারাবাহিকতাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ভোটে অংশগ্রহণ করবে।”
জাতীয় পার্টির নেতা বলেন, “এই নির্বাচনটা করার মাধ্যমে আমরা সব অপচেষ্টা দূর করে একটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েমের লক্ষ্যে কাজ করে যাব।
“সে জন্যই আমরা নির্বাচন করার জন্য সকল প্রার্থীকে চিঠি দিচ্ছি; তারা আগামীকালকে প্রতীক যাতে নেয়, সে জন্য তাদেরকে নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে।”
আসন সমঝোতা নিয়ে বারবার একই জবাব
সংবাদ সম্মেলনে চুন্নুর কাছে গণমাধ্যমকর্মীদের জিজ্ঞাসা একটি বিষয়েই ছিল। সেটি হলো আওয়ামী লীগ আসলে কতটি আসন জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দিয়েছে।
কিন্তু সুনির্দিষ্ট জবাব আসেনি একবারও।
প্রথম প্রশ্নের জবাবে চুন্নু বলেন, “আমরা ২৮৩টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করব। ২৮৩টি আসন বৈধ (মনোনয়নপত্র) হয়েছে, সেখানে আমরা নির্বাচন করব।”
সমঝোতা যে একটা হয়েছে, সেই ইঙ্গিত দিয়ে তিনি পরক্ষণেই বলেন, “কিছু কিছু আসনে আমাদের যারা সিনিয়র নেতা, সেসব আসনে যারা নির্বাচন করে… রাজনৈতিক দল, তাদের সঙ্গে একটা সমঝোতা হয়েছে বা হবে, এমন একটা অবস্থান আছে।
আরও পড়ুন:
আওয়ামী লীগের সঙ্গে ‘প্রেমের চিঠি’ এখনই প্রকাশ নয়: চুন্নু
জাতীয় পার্টির ভাবনায় ‘বিএনপির ভোট’
১৪ দল ও জাতীয় পার্টিকে ‘লড়াইয়ের বার্তা’ আওয়ামী লীগের
“বাট নির্বাচনে আমরা যাচ্ছি, এটা হলো বড় কথা।”
কতগুলো আসন, সেই সংখ্যাটি কি বলা যাবে?- চুন্নু বললেন, “এটা আপনারা জানতে পারবেন অথবা আপনারা মিডিয়ার মাধ্যমে জানবেন।“
আমরাই তো মিডিয়া-বললেন একজন গণমাধ্যমকর্মী।
চুন্নু বলেন, “আপনারাই মিডিয়া জানি। আপনারা জানতে পারবেন। এখন শুধু বলি, নির্বাচনে আমরা যাচ্ছি সকল বাধা অতিক্রম করে এবং নির্বাচনটা করব জোরদারভাবে। সেটাই আমরা জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে ঘোষণা দিচ্ছি।”
আওয়ামী লীগ আসন ছাড় দিলে সেখানে দলটির নেতারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়াইয়ে থাকবেন কি না, এই প্রশ্নে জাতীয় পার্টির নেতা বলেন, “আমরা নির্বাচন করছি ২৮৩টি আসনে, সেখানে অন্য কোন দলের প্রার্থী আছে কি স্বতন্ত্র আছে, বিদ্রোহী আছে, এগুলো আমরা চিন্তা করছি না। আমরা যুদ্ধ করে যাব।”
গণমাধ্যমকর্মীরা আসন সমঝোতা নিয়ে আবার প্রশ্ন করলে চুন্নু বলেন, “যেটা বলছেন, কিছু থাকতে পারে কোনো আসনের বিষয়ে। সেটা সুনির্দিষ্টভাবে আমাদের কিছু বলার সুযোগ নাই। আমাদের দলের কিছু কৌশল আছে, সেই কৌশলের বিষয়ে আপনাদের এখন বলছি না।”
আসন নিয়ে কৌশলে আওয়ামী লীগ যে ছাড় দিয়েছে, তাতে আপনারা সন্তুষ্ট কি না- এই প্রশ্নে তিনি আবার বলেন, “দেখুন, আমরা ২৮৩টি আসনে নির্বাচন করছি। যদি আমরা বেশিরভাগ আসনে জয়লাভ করতে পারি মানুষের ভোটে, তখনই আমরা সন্তুষ্ট।”
আরও পড়ুন
জাতীয় পার্টিতে দ্বন্দ্ব: প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে রওশনের ‘নালিশ’
জিএম কাদের ও চুন্নুকে দায় দিয়ে ভোটে না যাওয়ার ঘোষণা রওশনের
আরেক প্রশ্নে চুন্নু আবার বলেন, “আমি কিন্তু উত্তর দিয়েছি, ২৮৩টি আসনে আমরা নির্বাচন করছি।”
আওয়ামী লীগ কোনো আসনে নৌকা প্রত্যাহার করবে কি না- এমন প্রশ্নে তার সেই একই কথা।
“২৮৩টা আসনে নির্বাচন করছি, আওয়ামী লীগও নির্বাচন করছে। কিছু কিছু জায়গায় কৌশল থাকতে পারে, সেই কৌশলগুলো আমরা এখন বলার প্রয়োজন মনে করছি না, আপনাকে ধন্যবাদ।”
‘২৬টি আসনের বিষয়ে আমরা শুনতে পাচ্ছি’- মন্তব্য করেন একজন সাংবাদিক।
‘ধন্যবাদ ধন্যবাদ’ বলতে বলতে চেয়ার ছেড়ে উঠে যান চুন্নু।
নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পেছনে কোনো চাপ ছিল?
এর আগে এই প্রশ্নে জাতীয় পার্টির মহাসচিব বলেন, “আরও অনেক পার্টি নির্বাচনে আসনি, চাপ থাকলে তারাও আসত। জাতীয় পার্টি একটা স্বতন্ত্র দল, আমাদের নিজস্ব একটা রাজনীতি আছে, আমাদের দলের একটা গঠনতন্ত্র আছে, আমাদের নিজস্ব কর্মসূচি আছে।
“আমরা দেশের মানুষের জন্য কী করতে চাই, তার জন্য একটা রূপরেখা তৈরি করেছি এবং সেই লক্ষ্যে আমরা নির্বাচন করার জন্য স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”
অন্য এক প্রশ্নে চুন্নু বলেন, “নির্বাচনের পরিবেশ একদিনে সাড়ে তিন ঘণ্টায় হবে না। এটা নির্বাচনের দিন পর্যন্ত চলবে, চলমান। সে জন্য যারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে, সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আমাদের আলোচনা চলছে এবং আলোচনা আরও চলবে যাতে নির্বাচনটা অর্থবহ করা যায়।”