চুন্নু বলেন, “আমার ভোট আর বিএনপির ভোট কিন্তু সেইম। আমি সেই সুযোগই তো নিতে যাচ্ছি। বিএনপি নির্বাচনে আসেনি, তাদের ভোটারকে যদি আনতে পারি, তাহলে ৯১ সালের মত একটা নীরব ভোট বিপ্লব হয়ে যাবে।”
Published : 15 Dec 2023, 12:37 AM
যে যাই বলুক, শেষ মুহূর্তে নির্বাচন থেকে জাতীয় পার্টির সরে যাওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দিচ্ছেন দলটির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু; বরং বিএনপি অনুসারীদের ভোট নিজেদের বাক্সে টানতে পারলে এমনকি ক্ষমতায় যাওয়া সম্ভব বলে তিনি মনে করছেন।
দুই যুগ আগে সেনা শাসনের পথ ধরে ক্ষমতায় এসে দেশ শাসন করা জাতীয় পার্টি গত দুটি মেয়াদে সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকায় আছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ইচ্ছাতেই সেটা সম্ভব হয়েছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ভাষ্য।
তবে পার্টির মহাসচিব বলছেন, বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের যত ভোট, তার চেয়ে বেশি আওয়ামীবিরোধী ভোট। সেই ভোট যদি জাতীয় পার্টি টানতে পারে, তাহলে ১৯৯১ সালের মত একটি ‘চমক’ অপেক্ষা করছে এবার।
বিএনপি ও জাতীয় পার্টির ভোটাররা একই সরিতে অবস্থান করেন- এমন একটি ধারণা সামনে রেখেই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের ছক কষছে প্রয়াত সামরিক শাসক এইচ এম এরশাদের দল।
তবে একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলেছেন, আওয়ামী লীগকে হারাতে বিএনপি সমর্থকরা জাতীয় পার্টিকে ভোট দেবে, এমন সম্ভাবনা কম।
বিএনপি-জামায়াত জোটের বর্জনে ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচনের মত এবারও জাতীয় পার্টির অংশগ্রহণ নিয়ে নানা জল্পনা-কল্পনা চলে আসছে এক মাসের বেশি সময় ধরে।
বিএনপির বর্জনের পর জাতীয় পার্টি এবার মনোনয়নপত্র জমা দিলেও তারা ভোটে শেষ পর্যন্ত থাকে কি না, এ নিয়ে মন্ত্রিসভায় সংশয় প্রকাশ করেছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
ওই সংশয়ের মধ্যেই আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি ধারাবাহিক বৈঠক করে চলেছে। সংবাদমাধ্যমে বলা হচ্ছে, আসন সমঝোতাই এসব বৈঠকের উদ্দেশ্য। তবে জাতীয় পার্টি আসন সমঝোতার চেষ্টা অস্বীকার করছে।
প্রতিযোগিতা হবে, ‘কিছু বিষয়ে’ একও থাকতে চাই: চুন্নু
বিশ্বাস-অবিশ্বাসের প্রশ্নে আমরা নেই, ভোটে আছি: চুন্নু
ভোট থেকে সরে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা আছে কি না, সেই প্রশ্নে জাতীয় পার্টির মহাসচিব চুন্নু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “আমরা খেলোয়াড়, খেলতে এসেছি।
“নির্বাচন একটা খেলা, এই খেলায় আমাদের অভ্যাস আছে। নির্বাচনে আমরা অলওয়েজ সেন্টার ফরওয়ার্ড খেলি, কাজেই সরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।”
জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে যেসব বৈঠক হচ্ছে, সেগুলোর সঙ্গে আসন সমঝোতার প্রশ্ন নেই– এমন দাবি করে তিনি বলেন, “বাংলাদেশে এই বসাবসির সংস্কৃতি নেই। তাই এ নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।”
আওয়ামী লীগ নেতারা অবশ্য অন্য কথা বলছেন। তাদের ভাষ্য, জাতীয় পার্টির সঙ্গে আলোচনায় আসনের প্রশ্নও থাকছে।
ক্ষমতাসীন দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বাহাউদ্দিন নাছিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আসনের পাশাপাশি নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য, ভোটারদের কেন্দ্রমুখি করা, নির্বাচনটাকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করার বিষয়েও কথা বলছি।”
‘লক্ষ্য আওয়ামীবিরোধী ভোট’
বছর তিনেক আগে একটি সংস্থাকে দিয়ে করা জরিপের ফলাফলের ভিত্তিতে জাতীয় পার্টি এবার নির্বাচনি কৌশল সাজাতে চাইছে।
দলটির দাবি, সেই জরিপ অনুযায়ী এখন দেশে ভাসমান ভোট ৬০ শতাংশের মত, অর্থাৎ তারা কোনো নির্দিষ্ট দলের সমর্থক নন, ভোটের সময় কোনো একটি দলকে বেছে নেন। এক সময় এমন ভোটার ৪০ শতাংশের কম ছিল।
জাতীয় পার্টির বক্তব্য হল, ‘ফ্লোটিং’ (ভাসমান) ভোট যারা নিজেদের বাক্সে নিতে পারবে, তারাই সুবিধাজনক অবস্থায় থাকবে।
এছাড়া বিএনপির প্রতি সহানুভূতিশীল, কিন্তু কট্টর সমর্থক নন, এমন ভোটারদের সমর্থন পাওয়ার চেষ্টাও জাতীয় পার্টির থাকবে।
চুন্নু বলেন, “বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের যে সমর্থন, তার চেয়ে বিরুদ্ধে সমর্থন বেশি। আমার ভোট কিন্তু অ্যান্টি আওয়ামী লীগ। আমাদের লক্ষ্যই সেটা।
“আমার ভোট আর বিএনপির ভোট কিন্তু সেইম। আমি সেই সুযোগই তো নিতে যাচ্ছি। বিএনপি নির্বাচনে আসেনি, তাদের ভোটারকে যদি আনতে পারি, তাহলে ৯১ সালের মত একটা নীরব ভোট বিপ্লব হয়ে যাবে।”
১৯৯১ সালের পঞ্চম সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের জয়ের সম্ভাবনা নিয়েই আলোচনা বেশি ছিল। তবে ভোট শেষে দেখা যায়, সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জিতেছে বিএনপি।
চুন্নু বলেন, “বিএনপি কিন্তু আমাদের চেয়ে দুর্বল সংগঠন ছিল, কেবল তাদের ছাত্র সংগঠন শক্তিশালী ছিল। মূল দলে তিনশ আসনে প্রার্থী দেওয়ার লোক ছিল না। একশর ওপর আসনে বিভিন্ন ব্যক্তিকে এনে বা অবসরপ্রাপ্ত আমলা বা অন্য লোকদের এনে মনোনয়ন দিয়েছে।
“নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগে কে কোন পজিশন পাবে, সেটা চিন্তা করেছিল। কিন্তু নীরবে নিভৃতে ভোট ‘বিপ্লব’ হয়ে গেল, বিএনপি ক্ষমতায় এল। এবারও নীরবে নিভৃতে একটা বিপ্লব হয়ে যাবে। বলা যায় না, আমরা ক্ষমতায় চলেও আসতে পারি।”
জাতীয় পার্টির এ নেতার দাবি, তারা নিরপেক্ষ লোক দিয়ে জরিপ করিয়েছেন। জরিপকারীরা বলেছেন, কেন্দ্রে ভোটার যত বেশি আসবে, জাতীয় পার্টির তত লাভ।
“সে জন্যই আওয়ামী লীগের সঙ্গে বসছি বারবার। গত নির্বাচনগুলোর কারণে ভোটারের আস্থা নাই কেন্দ্রে আসার। বলছি, আপনারা আস্থাটা ফিরে আসার সুযোগ দেন। ক্ষমতায় আপনারা যাবেন, না হলে আমরা যাব। সমস্যা কী? নির্বাচনটা সুষ্ঠু হতে দেন।”
১৪ দল ও জাতীয় পার্টিকে ‘লড়াইয়ের বার্তা’ আওয়ামী লীগের
বিএনপি সমর্থকদের ভোট জাতীয় পার্টির বাক্সে আসার সম্ভাবনা কতটুকু- এই প্রশ্নে রাজনৈতিক বিশ্লেষক মোজাম্মেল হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিএনপি তো আন্দোলনে। তাদের কর্মী-সমর্থকরা নির্বাচনে কেন আসবে? আওয়ামী লীগবিরোধী হিসেবে জাতীয় পার্টিকে এই মুহূর্তে কেন ভোট দেবে? তাদের দাবি তো তত্ত্বাবধায়ক সরকার, আওয়ামী লীগকে হারানো নয়। কেন্দ্রে এলে তো নিজেদের বিপক্ষেই যাবে সেটি।
“আমার মনে হয়, আওয়ামী লীগের সঙ্গে দর কষাকষিতে সুবিধার জন্য এসব কথা বলছে জাতীয় পার্টি।”
টক্কর দেওয়ার ক্ষমতা আছে?
যদি আসন সমঝোতা না হয়, তাহলে আওয়ামী লীগকে মোকাবিলায় জাতীয় পার্টির সম্ভবনা কতটুকু, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে।
গত তিনটি জাতীয় নির্বাচনে জোট ও সমঝোতার মধ্যে যেসব আসনে দুই দলের উন্মুক্ত লড়াই ছিল, এমন আসনগুলোতে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আসতে পারেননি লাঙ্গলের প্রার্থীরা।
২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনেও জাতীয় পার্টি সেই ৩৪টি আসনেই জিতেছিল, যেসব আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী দেয়নি।
২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নবম সংসদ নির্বাচনেও একই ঘটনা ঘটে। জাতীয় পার্টি জেতে সেসব আসনে যেখানে আওয়ামী লীগ প্রার্থী রাখেনি। যে কটি আসন উন্মুক্ত রাখা হয়েছিল, সেগুলোতেও জয় পায় নৌকা।
রংপুর-৪ আসনে ১৯৯১ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তিনটি নির্বাচনে জয় পায় লাঙ্গল। নবম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সেখানে বর্তমান বাণিজ্য মন্ত্রী টিপু মুনশিকে প্রার্থী করে। লাঙ্গল নিয়ে লড়েন দুইবারের সংসদ সদস্য করিম উদ্দিন ভরসা।
টিপু মুনশি জেতেন ১ লাখ ২০ হাজার ৪৫১ ভোট পেয়ে। জাতীয় পার্টির প্রার্থী পান ১ লাখ ৫ হাজার ১৯২ ভোট।
একই ঘটনা ঘটে রংপুর-৫ আসনেও। সেখানে আওয়ামী লীগের এইচ এন আশিকুর রহমান পান ১ লাখ ২৪ হাজার ৮৯৪ ভোট। জাতীয় পার্টির এস এম ফখর উজ জামান পান ১ লাখ ১২৯ ভোট।
তবে চুন্নু একাদশ সংসদ নির্বাচনে বরিশাল-৩ এবং চলতি বছর ঠাকুরগাঁও-৩ আসনে উপনির্বাচনের ফলাফল সামনে এনে দাবি করছেন, তারা আওয়ামী লীগের সঙ্গে লড়াইয়ের যোগ্যতা রাখেন।
আসন সমঝোতার আলোচনা হয়নি, তবে হতেও পারে: চুন্নু
জাতীয় পার্টিকে ‘ছাড়’: ধোঁয়াশায় রাখল আওয়ামী লীগ
ওই দুটি আসনে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির লড়াই হয়নি। গত সংসদ নির্বাচনে বরিশাল-৩ আসনে ওয়ার্কার্স পার্টির শেখ মো. টিপু সুলতানকে মনোনয়ন দেয় মহাজোট। তিনি লড়েন নৌকা নিয়ে। তবে জাতীয় পার্টির গোলাম কিবরিয়া টিপু ছাড় দিতে রাজি না হওয়ায় আসনটি উন্মুক্ত রাখা হয়।
লাঙ্গল নিয়ে টিপু জেতেন ৫৪ হাজার ৭৭৮ ভোট পেয়ে। বিএনপির জয়নুল আবেদীন পান ৪৭ হাজার ২৮৭ ভোট। নৌকা নিয়ে ওয়ার্কার্স পার্টির টিপু পান ১৯ হাজার ২১৯ ভোট।
সেই নির্বাচনে ঠাকুরগাঁও-৩ আসনে জয়ী বিএনপির জাহিদুর রহমান গত বছরের শেষ দিকে দলের সিদ্ধান্তে পদত্যাগ করলে উপনির্বাচনে জেতেন জাতীয় পার্টির হাফিজ উদ্দিন।
উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিজের প্রার্থী না দিয়ে সেখানে সমর্থন দেয় ওয়ার্কার্স পার্টির ইয়াসিন আলীকে।
লাঙ্গল নিয়ে হাফিজ উদ্দিন পান ৮৪ হাজার ৪৭ ভোট। ইয়াসিন পান ১১ হাজার ৩৫৬ ভোট। স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে পীরগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক গোপাল চন্দ্র রায় পান ৫০ হাজার ৩০৯ ভোট।
তাহলে মোট কয়টি আসনে সরাসরি লড়াই করতে পারবে জাতীয় পার্টি?
চুন্নু বলেন, “আমরা ২৯৪টি দিয়েছিলাম (মনোনয়ন), তার মধ্যে ২৭২টি বৈধ হয়েছে। আপিলে ৬/৭টা বৈধ হয়েছে। আশা করছি ২৮০টার মত টিকবে। এই ২৮০টার মধ্যে আমরা লড়াই করব।”
ভোট ক্রমহ্রাসমান
১৯৮২ সালে সেনাপ্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতায় আসার পর জন্ম নেওয়া জাতীয় পার্টি ১৯৯০ সালে তার পতনের পর থেকে ক্রমশ ক্ষয়িষ্ণু।
১৯৯১ সালের পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে দলটি ৩৫টি আসন পায়।
সে সময় বৃহত্তর রংপুরের ২২টির মধ্যে ১৮টি, সিলেট বিভাগে ১৯টির মধ্যে আটটি আসন পায় জাতীয় পার্টি। এর বাইরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও কুমিল্লায় দুটি করে, রাজশাহীর, পিরোজপুর, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ ও নোয়াখালীতে একটি করে আসন পায় তারা।
দেশের বাকি অঞ্চলগুলোর মধ্যে বরিশাল, খুলনা ও ঢাকা বিভাগের কিছু এলাকায় অল্প বিস্তর আসনে ভোট পায় দলটি।
১৯৯৬ সালের সপ্তম সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির ভোট বেড়ে হয় প্রায় ১৭ শতাংশ, তবে আসন কমে হয় ৩২টি। নতুন কোনো এলাকায় ভোট টানতে তারা ব্যর্থ হয়।
এরপর এরশাদের দলে ভাঙন ধরে। আনোয়ার হোসেন মঞ্জু আলাদা হয়ে যান।
এরশাদ ১৯৯৯ সালে বিএনপি-জামায়াত ও ইসলামী ঐক্যজোটের সঙ্গে গঠন করেন চারদলীয় জোট। তবে ২০০১ সালের নির্বাচনে আগে সেই জোট থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর বড় ভাঙনের শিকার হয় জাতীয় পার্টি।
নাজিউর রহমান মঞ্জু ও এম এ মতিনের নেতৃত্বে বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি বা বিজেপি নামে দলের আরেকটি অংশ থেকে যায় চার দলের জোটে। এই দুই ভাঙনে জাতীয় পার্টির ভোটে অর্ধেক হয়ে যায়।
অষ্টম সংসদ নির্বাচনে ৭ শতাংশের কিছু বেশি ভোট পায় দলটি, আসন কমে হয় ১৭টি। বরিশাল বিভাগ, রাজশাহী, সিলেট, কুমিল্লা, নোয়াখালী, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অবস্থান হারিয়ে ফেলে তারা।
পরের তিনটি নির্বাচন জাতীয় পার্টি অংশ নিয়েছে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা করে। দেখা গেছে আওয়ামী লীগ যেসব আসনে ছাড় দিয়েছে, কেবল সেখানেই জিতে আসতে পারছেন লাঙ্গলের প্রার্থীরা।
এবার চুন্নু তার নিজের আসন কিশোরগঞ্জ-৩ এ ঝামেলায় পড়তে পারেন। গত তিনটি নির্বাচনে এখানে তিনি জিতেছেন আওয়ামী লীগের সমর্থনে। এবার সেখানে নৌকার হয়ে ভোটে লড়তে উপজেলা চেয়ারম্যানের পদ ছেড়েছেন নাসিরুল ইসলাম খান।
নৌকার বিরুদ্ধে এবার জিততে পারবেন চুন্নু?
তার জবাব, “১৯৯৬ সালে আমি পাই ৫১ হাজার ভোট, নৌকা পায় ৫২ হাজার। ২০০১ সালে আমি পাই ৬১ হাজার, নৌকা পায় ৬২ হাজার, বিএনপির ওসমান ফারুক পান ৬৩ হাজার।
“ওই সময় আমার সংগঠন জোরদার ছিল না, কাজও করিনি। গত ১৫ বছরে আমি এলাকায় অনেক কাজ করেছি, সংগঠনও জোরদার হয়েছে। ত্রিমুখী নির্বাচনটা হলে খেলতে আমার ভালো লাগত। দ্বিমুখীটা ভালো লাগছে না। আমি এমন খেলোয়াড়, যে নির্বাচন তিনবার ফেইল করেছি, দুইবার একেবারে কাছাকাছি।”
রওশন-জি এম কাদের দ্বন্দ্বের কী প্রভাব?
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের সঙ্গে দ্বন্দ্বে রওশন এরশাদ ও তার অনুসারীদের ভোট থেকে সরে যাওয়ার কী প্রভাব ভোটে পড়বে, এবার তা নিয়েও আছে প্রশ্ন।
রওশন এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে নালিশ করে এসেছেন। জাতীয় পার্টিকে যেন আসন ছাড় দেওয়া না হয়, সেই অনুরোধ করে এসেছেন।
চুন্নু দ্বন্দ্বের কথা অস্বীকার করলেও বলেছেন, “আমরা ক্ষতিগ্রস্ত। ম্যাডাম নির্বাচন করলে দলের জন্য ভালো হত সন্দেহ নাই, এটা দলের জন্য আরও সুনাম বয়ে আনত, আমার জন্য ভালো ছিল।”
জাতীয় পার্টিতে দ্বন্দ্ব: প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে রওশনের ‘নালিশ’
জিএম কাদের ও চুন্নুকে দায় দিয়ে ভোটে না যাওয়ার ঘোষণা রওশনের
তবে রওশন, তার ছেলে রাহগির আলমাহি সাদ এরশাদ এবং তার অনুসারীদের ভোটের বাইরে থাকার দায় নিতে নারাজ জাতীয় পার্টির মহাসচিব।
তিনি বলেন, “তিনি (সাদ এরশাদ) মনোনয়ন পাননি না, মনোনয়ন নেননি। আর উনি (রওশন) নির্বাচন করুক– চেয়ারম্যানসহ আমরা সবাই চেয়েছিলাম। আমি উনার সঙ্গে অনেকবার ফোনে কথা বলেছি। উনি আমাকে বলেছেন, ‘আমি ইলেকশন করব। আমার জন্য, আমার ছেলের জন্য ফরম রাখ, আরেকটি ফরম রাখ।’
“আমি রেখেছি। মনোনয়নপত্র দাখিলের আগের রাতে ১০টা পর্যন্ত তিনটা ফরম নিয়ে আমার অফিস সেক্রেটারি বসে ছিল। রাত ১০টার পর জানতে পারলাম, উনারা নির্বাচন করবেন না। সে ক্ষেত্রে আমরা আর কী করব?”
কতটা ‘সাবালক’ হয়েছে জাতীয় পার্টি?
আওয়ামী লীগের সঙ্গে বৈঠকের মধ্যে চুন্নু একদিন বলেছেন, তারা এখন ‘সাবালক’ হয়েছেন। কারও সমর্থন বা ছাড়ের দরকার নেই।
দলের বয়স প্রায় ৪০ হয়ে গেল। এখনও ‘সাবালক-নাবালকের’ প্রসঙ্গ কেন?
সাক্ষাৎকারে চুন্নু বলেন, “এ জন্য আসছে যে, আমরা কয়েকটা নির্বাচনে খুব বেশি ভালো ফলাফল করতে পারিনি। শক্তিশালী দুটি দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সমপর্যায়ে আমরা যেতে পারিনি। তাই বলছি, এখন আমরা দলটাকে এমন একটা অবস্থানে নেওয়ার চেষ্টা করছি।”
এরশাদ ‘স্বাধীনভাবে’ রাজনীতি করতে পারেননি দাবি করে তিনি বলেন, “দুটি বড় বড় দল গত ৩২ বছরে শাসন করেছে, সেই দুটি দলই এরশাদ সাহেবের বিরুদ্ধে ‘মিথ্যা, অহেতুক’ মামলা দিয়ে তার পায়ে জিঞ্জির পরিয়ে রেখেছিল। এখন সেই জিঞ্জিরটা নাই।
গৃহবিবাদ নিয়েই ভোটে জাতীয় পার্টি
“এখন যিনি নেতৃত্ব দিচ্ছেন গোলাম মোহাম্মদ কাদের, তার বিরুদ্ধে এ ধরনের কোনো মামলা নাই, আমার বিরুদ্ধেও নাই। থাকলেও আমরা অনেক এগিয়ে যাব, এখন আমরা অনেক ফ্রি আছি। আমরা দলটাকে গোছগাছ করছি, আমরা মনে করছি রাজনীতির দিক দিয়ে আমরা এখন অনেকটা পরিপক্ক অবস্থায় আছি। সে জন্য রূপক অর্থে আমি বলেছিলাম সাবালক।”
গত কয়েকটা নির্বাচনে ৩০০ আসনে প্রার্থী দেওয়ার মত লোক ছিল না জানিয়ে চুন্নু বলেন, “এবার প্রায় ১৮০০ ফরম বিক্রি হয়েছে। ২৯৪টি আসনে আমরা মনোনয়ন দিয়েছি। অনেকে মনোনয়ন না পেয়ে কান্নাকাটি করেছেন, গালাগাল করেছেন, দরজা ভেঙেছেন। এই অবস্থাটা আমাদের ১০/১৫ বছর আগে ছিল না।”
জাতীয় পার্টির আমলে নির্বাচন কেমন ছিল?
বাংলাদেশে বিরোধী দলের ভোট বর্জন শুরু জাতীয় পার্টির আমলেই। ১৯৮৬ সালে বিএনপি এবং ১৯৮৮ সালে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি- দুই দলই ভোট বর্জন করে।
সেই দুটি নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে ব্যাপক অভিযোগ আছে। ১৯৮৬ সালে আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত বৃহত্তর ফরিদপুরে গোপালগঞ্জের তিনটি আসন ছাড়া সবগুলোতেই জয়ী দেখানো হয় জাতীয় পার্টিকে।
ওই ফলাফল কি বাস্তবসম্মত ছিল? চুন্নু বলেন, “আপনি বলছেন বিজয়ী দেখানো হয়েছে। এ রকম কোনো তথ্য আমার কাছে নেই। সে সময় আমি নির্বাচন করেছি এবং আমি জয়লাভ করেছি। এখন আপনি যদি বলেন নির্বাচনে জয় দেখানো হয়েছে সেটা ভুল বলছেন।”
প্রবীণ সাংবাদিক মোজাম্মেল হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সেই নির্বাচনে বড় আকারের কারচুপির সন্দেহ ছিল। এরশাদের নির্বাচন ছিল জঘন্য।”
তিনি বলেন, “সে সময় গণনার পদ্ধতি ছিল অন্য রকম। কেন্দ্রে সে সময় ভোট গণনা করা হত না। সব ভোট নিয়ে যাওয়া হত রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে। তারপর কয়েক ঘণ্টা পরে ঘোষণা আসত। সেটাকেই আমরা বলি মিডিয়া ক্যু।”
প্রধান বিরোধী দলগুলোর বর্জনের মধ্যে ১৯৮৮ সালের নির্বাচনের পর যে সংসদ গঠিত হয়েছিল, তাদেরকে ‘গৃহপালিত বিরোধী দল’ ডাকা হত।
২০১৪ সালের নির্বাচনের পর থেকে জাতীয় পার্টি একই সঙ্গে বিরোধী দল ও সরকারে থাকায় একই তকমা তাদের কপালেও লেগেছে।
চুন্নু বলেন, “আমরা আওয়ামী লীগের সঙ্গে গত কয়েকটা নির্বাচনে জোট, মহাজোট, সমঝোতা করেছি। সেজন্য একটি পাবলিক পারসেপশন যে, আমরা বিরোধী দলে আছি কিন্তু আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভেতরে ভেতরে খাতিরও আছে। আপনারা যেটা বলেন ‘গৃহপালিত’।
“সেটা নিয়ে জনগণের মনে প্রশ্ন আসতেই পারে এবং আসাটাই যৌক্তিক। সেই আসার প্রেক্ষিতে বলব, গত দুই/তিন বছরে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও মহাসচিব সরকারের সম্পর্কে জনগণের পক্ষে পার্লামেন্ট ও বিভিন্ন মিডিয়াতে যে বক্তব্য রেখেছি, আমার মনে হয়, জনগণের মন থেকে সে কথাটা আস্তে আস্তে কেটে উঠছে।”
জাতীয় পার্টির মহাসচিবের ভাষ্য, “আগামীতে আমরা যদি ক্ষমতায় যাই, তাহলে জনগণ বুঝতে পারে। ক্ষমতায় যদি না যাই, যদি বিরোধী দলে যাই, তাহলে আপনারা বুঝতে পারেন আমাদের ভূমিকাটা কী।”
আরও পড়ুন:
আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্ত ‘বিনয়ের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান’ শরিকদের
১৪ দলের শরিকের আসন এক ধাক্কায় ৭