রেমিটেন্স বাড়াতে এবং ডলার সংকটের চাপ কমাতে নিরাপদ ও কার্যকর অভিবাসনে গুরুত্ব না দিয়ে আমাদের উন্নয়ন সহোযোগিতায় তুলনামূলকভাবে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে পুনরেকত্রীকরণের মতো বিষয়, যা শুধু অর্থনৈতিক চাপ বাড়াবে, কমাবে না।
Published : 29 Jun 2024, 04:42 PM
অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (২০২০-২০২৫) প্রণয়নের সময়টাতে অভিবাসন নিয়ে ভাবনার মূলে ছিল প্রবাসীদের অর্থনৈতিক সম্ভাবনার পূর্ণমাত্রায় সদ্ব্যবহার এবং তাদের জীবনযাত্রার মানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। প্রথমবারের মতো অভিবাসন নিয়ে আলাদা একটা অধ্যায় জুড়ে দেয়া হয়েছিল জাতীয় অর্থনৈতিক পরিকল্পনার অংশ হিসেবে। যারা সরাসরি কাজ করছিলাম অভিবাসন অধ্যায়টি নিয়ে, আমাদের ভাবনার মূলে ছিল প্রবাসী হতে চাওয়া জনগোষ্ঠীর মধ্যে একটা গুণগত পরিবর্তনের সূচনা করা, আর সেটি হচ্ছে শুধু প্রশিক্ষিত শ্রমিক নয় বরং শিক্ষিত এবং উচ্চ শিক্ষিতদের অভিবাসনে উদ্বুদ্ধ করা। কারণ, শিক্ষিত প্রবাসীদের বেশি আয়ের সম্ভাবনা যেমন থাকে, তেমনি তাদের প্রবাস-যাত্রায় এবং প্রবাসে প্রতারিত আর অত্যাচারিত হবার সম্ভাবনা কম থাকে।
অভিবাসন অধ্যায়ের শুরুটা লেখা হয়েছে একটা রাশভারি শব্দবন্ধ দিয়ে, ‘Paradigm shift’ বা সহজ ভাষায় কাঠামোগত পরিবর্তনের পাশাপাশি অভিবাসনের পাশার দান বদলে ফেলা। আর এ কারণেই ৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় অভিবাসন সংক্রান্ত দশটি লক্ষ্যের প্রথম নয়টি লক্ষ্যই ছিল ‘নিরাপদ, কার্যকরী (প্রবাসে আয় ও নিরাপত্তা) এবং মর্যাদাপূর্ণ অভিবাসন’ নিশ্চিত করতে পাঁচ বছরের সরকারি, বেসরকারি এবং উন্নয়ন সহোযোগীদের কার্যক্রম নির্ধারণ করে দেয়া। আর দশ নম্বর লক্ষ্যটি ছিল প্রবাস থেকে ফেরত আসা ব্যক্তিদের টেকসই পুনরেকত্রীকরণ, এই লক্ষ্যটির কথা বিভিন্ন কারণেই আলাদা করে বলতে হচ্ছে।
প্রসারের ক্ষেত্রে সরকারি পর্যায়ের কাজগুলো সীমাবদ্ধ থেকেছে অবকাঠামোর উন্নয়ন, ডলার ঘাটতি পোষাতে অধিক সংখ্যায় শ্রমিক পাঠানো এবং কিছু ক্ষেত্রে পুনরেকত্রীকরণ ও কল্যাণমূলক কার্যক্রমের মধ্যেই। অন্যদিকে, অভিবাসন নিয়ে ব্যবসায়ী পর্যায়ের কাজ মূলত আটকে থেকেছে আকাশচুম্বি খরচে বিদেশে শ্রমিক পাঠানো আর লাভের টাকা ঘরে তোলার মধ্যেই।
কিন্তু অবাক করা বিষয়টি হচ্ছে, ‘নিরাপদ, কার্যকরী এবং মর্যাদাপূর্ণ অভিবাসন’ প্রসার বিষয়ক কার্যক্রমে উন্নয়ন সহোযোগীদের প্রকাশ্য নীরব অবস্থান (Expressed silence) এবং সঙ্গত কারণেই অন্তর্জাতিক ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর অকার্যকর ভূমিকা।
বাংলাদেশে অভিবাসন নিয়ে কাজ করছে এমন অন্তর্জাতিক এবং বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর প্রকল্পের তালিকা এবং ধারণাপত্র (Concept Note) ও বর্ণনা পড়লে মনে হতেই পারে বাংলাদেশে অভিবাসনে সবচাইতে বড় সমস্যা হচ্ছে ফেরত আসা প্রবাসীদের পুনরেকত্রীকরণ; আর নিরাপদ ও আর্থিক-সামাজিকভাবে লাভজনক অভিবাসন প্রসারের লক্ষ্য যেন আমরা আগেই অর্জন করে ফেলেছি।
বৈশ্বিক উত্তরের ধনী দেশগুলোতে ডানপন্থী রাজনৈতিক দলের উত্থানের কারণে অভিবাসন বিরোধী কার্যক্রম বাড়িয়েছে ইউরোপীয় অনেকগুলো দেশ। জনতুষ্টির পথে হাঁটতে গিয়ে অর্থনীতিতে শ্রম অভিবাসনের অবদানকে ছোট করে দেখার পাশাপাশি অভিবাসন ও অভিবাসী বিরোধী অবস্থান নিয়েছে ধনী অর্থনীতির বেশ কয়েকটি সরকার। মূলত অভিবাসীদের অবদানকে অস্বীকার করে দেশে ফেরত পাঠাতে এবং এই সংক্রান্ত মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায় এড়াতে এই সরকারগুলো শ্রমিক পাঠায় এমন দেশগুলোতে পুনরেকত্রীকরণের প্রকল্পে টাকা ঢেলে যাচ্ছে।
এমনকি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDG) অর্জনে অভিবাসন ও রেমিটেন্সের অবদানকেও সচেতনভাবেই অগুরুত্বপূর্ণ করে রাখা হচ্ছে। আর এই অর্থায়নের সুযোগ পেতে অন্তর্জাতিক ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর কার্যক্রমে গুরুত্ব বেড়েছে পুনরেকত্রীকরণের। আর অভিবাসন নিয়ে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিকল্পণার মূল লক্ষ্য ‘নিরাপদ, কার্যকরী এবং মর্যাদাপূর্ণ অভিবাসনে’র প্রসার হারিয়েছে যথোপযুক্ত গুরুত্ব। সমতা আর বৈশ্বিক ন্যায্যতার কথা বলা সংস্থাগুলোও এই ডানপন্থী এবং অভিবাসন ও অভিবাসী বিরোধী অবস্থানকে মেনে নিয়েছে। সুকৌশলে এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে বৈশ্বিক দক্ষিণের দেশগুলোর অর্থনৈতিক পরিকল্পনাকে।
কোভিড আর ইউক্রেইন যুদ্ধ পরবর্তীকালে বৈশ্বিক অর্থনীতির ধীরগতির ধাক্কায় বাংলাদেশের মতো রপ্তানিমুখী ও রেমিটেন্সনির্ভর দক্ষিণী (Global South) অর্থনীতিগুলো ডলার সংকটে খাবি খাচ্ছে, শ্রীলঙ্কা সবে ফেরত আসতে শুরু করেছে দেউলিয়া হবার দোরগোড়া থেকে। আর এমন একটি সময়ে রেমিটেন্স আয় বাড়াতে ও ডলার সংকটের চাপ কমাতে নিরাপদ ও কার্যকর অভিবাসনে গুরুত্ব না দিয়ে আমাদের উন্নয়ন সহোযোগিতায় তুলনামূলকভাবে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে এমন একটি বিষয় যা শুধু অর্থনৈতিক চাপ বাড়াবে, কমাবে না। এমনকি বাংলাদেশ সরকার বিশ্ব ব্যাংকের ঋণে বাস্তবায়ন করছে পুনরেকত্রীকরণ প্রকল্প।
এ যেন রূপকথার সোনার হরিণ ধরতে গিয়ে আসল লক্ষ্য ভেস্তে দেয়ার গল্প। শ্রম অর্থনীতির ছাত্র হিসেবে এটা বলতেই পারি, ‘নিরাপদ, কার্যকরী এবং মর্যাদাপূর্ণ অভিবাসন’ কমিয়ে আনবে পুনরেকত্রীকরণের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক চাপ এবং স্থিতিশীলতা আনবে জাতীয়, স্থানীয় ও প্রবাসীদের পরিবারে আর্থিক অবস্থায়।
গ্রামদেশে একটা কথা আছে, ‘প্রথম হাল যেদিকে যায় পরের হালও সেই দিকেই যায়’, আর অভিবাসনের ক্ষেত্রেও নিরাপদ আর সফল অভিবাসন না হলে পুনরেকত্রীকরণের অর্থনৈতিক চাপ বাড়বেই। একটা বিষয় মনে রাখতে হবে যে, ফেরত আসা প্রবাসীদের একটা বড় অংশই কিন্তু দেশে থেকে যাবার চাইতে আবার বিদেশেই যেতে চান উপার্জন করতে। এক্ষেত্রে একটা ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে, কোভিডকালীন সময়ে ফেরত আসা প্রবাসীদের তালিকা ধরে অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে যোগাযোগ করা হয়েছিল রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে চাকরির বিষয়ে, যোগাযোগ করা হয়েছিল এমন হাজার জনের মধ্যে আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন মাত্র অল্প কয়েকজন। এমনকি পুনরেকত্রীকরণ প্রকল্পের সুবিধাভোগীদের অনেকেই কিন্তু আবারও পাড়ি জমিয়েছেন প্রবাসেই। এ কারণেই প্রবাসীদের পুনরেকত্রীকরণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে তারা কী চাইছেন তাতে গুরুত্ব দেয়া এবং তাদের সাফল্য নিশ্চিত করবার জন্য পরিবেশ তৈরি করা।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে জর্ডানের গার্মেন্টস খাতে কাজ করা শ্রমিকদের অর্ধেকের বেশি বাংলাদেশের নাগরিক, আর তাদের মধ্যে অধিকাংশই হচ্ছেন নারী শ্রমিক। জর্ডানের তৈরি পোশাক খাতে চাকুরিরত এই নারী শ্রমিকরা মধ্যাপ্রাচ্যের অন্যদেশগুলোতে গৃহকর্মে নিয়োজিত নারী শ্রমিকদের চাইতে অনেক বেশি নিরাপদ কর্মপরিবেশ উপভোগ করেন। তাই বলা যেতেই পারে, প্রবাসী শ্রমিক পাঠানোর ক্ষেত্রে সরকার এবং অভিবাসন খাতে সংশ্লিষ্টদের সবাইকে এমন খাত এবং দেশ খুঁজে বের করতে হবে যেখানে প্রবাসীদের সফল হবার সম্ভাবনা অধিকতর, যেমন তথ্যপ্রযুক্তি এবং ম্যানুফ্যাকচারিং খাত।
আগামী এক বছরের মধ্যেই ‘নবম (৯ম) পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা’র কাজ শুরু হবে যথানিয়মে। কিন্তু ৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার অভিবাসন লক্ষ্যমাত্রার মৌলিক লক্ষ্য কতটুকু অর্জন হয়েছে তা যথাযথভাবে মূল্যায়ন করা এবং এর ভিত্তিতে আগামীর কার্যক্রম সুনির্দিষ্ট করতে না পারলে আবারও এই একই চক্রে ঘুরপাক খাবে বাংলাদেশের অভিবাসন।