রোগীকে হাসপাতালে নেয়া হলো, সেখানে অ্যান্টিভেনমও ছিল—কিন্তু নানাবিধ জটিলতায় তা দেয়া গেল না। এরকম পরিস্থিতিতে মৃত্যুকে নিছক দুর্ঘটনা বা দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যু বলার সুযোগ নেই। এটি অপরাধ।
Published : 30 Jun 2024, 06:08 PM
স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন যেদিন (২৭ জুন) জানালেন যে, দেশের সব হাসপাতালে চন্দ্রবোড়া বা রাসেলস ভাইপার সাপের বিষের প্রতিষেধক আছে— তার ঠিক দুদিন পরেই (২৯ জুন) ঝালকাঠিতে সাপের বিষের প্রতিষেধক বা অ্যান্টিভেনম না পেয়ে সেলিম আকন নামে এক ব্যবসায়ীর মৃত্যু হয়েছে।
২৭ জুন বিএসএমএমইউতে সাম্প্রতিক সাপ আতঙ্ক নিয়ে এক সেমিনারে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, চন্দ্রবোড়া সাপে কামড়ের ওষুধ দেশের সব হাসপাতালে আছে। তাই কাউকে দংশন করলে যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলে যথাযথ চিকিৎসা নিশ্চিত করা যাবে।
এর দুদিন পরেই গণমাধ্যমের সংবাদ শিরোনাম: সাপের কামড়ে ব্যবসায়ীর মৃত্যু, অ্যান্টিভেনম না দেওয়ার অভিযোগ। খবরে বলা হয়, ঝালকাঠির কাঁঠালিয়া উপজেলায় সাপের কামড়ে মো. সেলিম আকন (৬০) নামে এক ব্যবসায়ীর মৃত্যু হয়েছে। শনিবার (২৯ জুন) সকালে উপজেলার তালতলা বাজারের দোকানে তাকে সাপ কামড় দেয়। স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে আমুয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেন। কিন্তু অ্যান্টিভেনম (প্রতিষেধক) থাকা সত্ত্বেও তা না দেওয়ার অভিযোগ করেছেন স্বজনরা। তারা বলছেন, চিকিৎসকরা তাদের জানিছেন, তাদের কাছে অ্যান্টিভেনম রাখার স্টোররুমের চাবি নেই, তাই চিকিৎসা দিতে পারছেন না। ঘণ্টাখানেক পর রোগীকে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। পথে সেলিমের মৃত্যু হয়।
এর আগে এই একই এলাকায়, অর্থাৎ ঝালকাঠির কাঁঠালিয়া উপজেলায় হ্যাপি আক্তার নামে আমার এক আত্মীয় সাপের দংশনে মারা যান। তাকেও প্রথমে আমুয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেয়া হয়েছিল। তাকেও বলা হয়েছিল যে অ্যান্টিভেনমন নেই। পরে নেয়া হয় ঝালকাঠি সদর হাসপাতালে। সেখানেও চিকিৎসা পেতে ব্যর্থ হয়ে স্বজনরা তাকে নিয়ে বরিশাল শের-ই বাংলা মেডিকেলে রওয়ানা হলে পথেই হ্যাপি আক্তারের মৃত্যু হয়। দুটি ছোট সন্তান রেখে তিনি মারা যান। তার স্বজনরাও বলছেন, তারা পরে শুনেছেন যে আমুয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অ্যান্টিভেনমন ছিল। কিন্তু কোনো কারণে সেই চিকিৎসা ওখানে পাওয়া যায়নি।
আমুয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের দায়িত্বপ্রাপ্ত কাঁঠালিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা তাপস কুমার পালের সঙ্গে আমি নিজেও কথা বলার চেষ্টা করেছি। ৩০ জুন দুবার ফোন দিয়ে পাইনি।
সবশেষ ব্যবসায়ী সেলিম আকনের মৃত্যুর ঘটনাটি নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকে ক্ষোভ প্রকাশ করলে ঘটনার দিনই তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তা ডা. শিউলী পারভীনকে সভাপতি করে গঠিত এই কমিটির সদস্য সচিব ঝালকাঠি সিভিল সার্জন অফিসের মেডিকেল অফিসার ডা. মো. মোস্তাফিজুর রহমান এবং সদস্য হিসেবে আছেন মেডিলে অফিসার ডা. মো. সিয়াম আহসান।
বাংলাদেশে সাপেকাটা রোগীর মৃত্যুর কারণ প্রধানত তিনটি।
১. সাপে দংশন করার পরে হাসপাতালে না নিয়ে ওঝার কাছে নেয়া বা নিজেরাই চিকিৎসা করা। যদিও এই প্রবণতা কমেছে। মানুষের মধ্যে সচেতনতা বেড়েছে।
২. হাসপাতালে অ্যান্টিভেনম না থাকা। অর্থাৎ কাউকে সাপে দংশন করলে সঙ্গে সঙ্গে তার ক্ষত স্থানের উপরে শক্ত করে বেঁধে নিয়ম অনুযায়ী রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে নেয়া হলো, কিন্তু অ্যান্টিভেনম দেয়া গেল না।
৩. রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে নেয়া হলো, সেখানে অ্যান্টিভেনমও ছিল—কিন্তু নানাবিধ জটিলতায় অ্যান্টিভেনম দিতে দেরি হলো কিংবা দেয়া গেল না। এরকম পরিস্থিতিতে মৃত্যু হলে সেটিকে নিছক দুর্ঘটনা বা দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যু বলার সুযোগ নেই। এটি অপরাধ। কেননা হাসপাতালে অ্যান্টিভেনমের মজুদ না থাকা কিংবা রোগীকে সময়মতো হাসপাতালে নিতে না পারায় মৃত্যু আর চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকার পরেও সেটি নিশ্চিত করতে না পারায় মৃত্যু এক কথা নয়।
ঝালকাঠির অভিযোগ যদি সত্য যে, স্টোররুমের চাবি ছিল না বলে সেলিম আকনের শরীরে অ্যান্টিভেনম প্রয়োগ করা যায়নি, তাহলে এই মৃত্যুর দায় কার? দায়ীদের বিরুদ্ধে কি অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগে মামলা হবে নাকি পরোক্ষভাবে এটি হত্যাকাণ্ড?
তদন্ত কমিটি হয়েছে। তারা তদন্ত করবে। তদন্তে অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হলে দায়ীদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা হয়তো নেয়া হবে। কিন্তু তাতে সেলিম আকনের জীবন ফিরবে না। তার স্ত্রী ও সন্তানরা তাকে ফিরে পাবে না। হ্যাপি আক্তারের দুই সন্তানের মুখেও হাসি ফুটবে না। তবে এই দুজন মানুষের জীবনের বিনিময়েও যদি দেশের হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলো ঠিক হয়; যদি এরপরে আর একজন সাপেকাটা রোগীও হাসপাতালে গিয়ে অন্তত বিনা চিকিৎসায় মারা না যায়— সেটি হবে বড় সান্ত্বনা।
কিন্তু অতীত অভিজ্ঞতা বলছে, মানুষের জীবনের বিনিময়েও এই দেশের কোনো সিস্টেম বদলায় না। অনেক বড় আন্দোলন-সংগ্রামের পরেও বেঘোরে মৃত্যু বন্ধ হয় না। যেমন নিরাপদ সড়কের দাবিতে ২০১৮ সালে সারা দেশে কিশোর-তরুণরা যে ঐতিহাসিক আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন এবং যে আন্দোলনের কারণে সড়ক পরিবহন আইন করা হয়—তখন অনেকের মনেই এই বিশ্বাস জন্মেছিল যে, এবার হয়তো দেশের সড়কে শৃঙ্খলা ফিরবে। প্রশ্ন হলো, সড়কে শৃঙ্খলা কি ফিরেছে? সড়কে ফিটনেসবিহীন গাড়ি, অদক্ষ চালক, বেপরোয়া ড্রাইভিং, ত্রুটিপূর্ণ সড়ক ও সেতু, মহাসড়কের জন্য অবৈধ/আনফিট যানবাহনের কারণে মানুষের মৃত্যু কি বন্ধ হয়েছে? হয়নি।
সুতরাং অ্যান্টিভেনম থাকার পরেও কেন সাপেকাটা রোগীর শরীরে প্রয়োগ করা হলো না; কার গাফিলতি কিংবা কার দায়— সেটি হয়তো তদন্তে বেরিয়ে আসবে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে হয়তো দোষীরা শাস্তির আওতায় আসবেন। কিন্তু এই ঘটনার পরে দেশে আর একজন সাপেকাটা রোগীও হাসপাতালে গিয়ে বিনা চিকিৎসায় বা এন্টিভেনমের অভাবে মারা যাবেন না— সেটি কি জোর গলায় বলা যাবে?
আমাদের দেশের সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি, অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা। যখনই কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠান সেবা দিতে ব্যর্থ হয় বা তাদের বিরুদ্ধে যখনই কোনো অভিযোগ ওঠে, তখন খোঁড়া অজুহাত দিয়ে বলা হয় লোকবল সংকট, বাজেট নেই, ইত্যাদি। অথচ যে লোকবল ও বাজেট আছে, সেটিরই সদ্ব্যবহার হয় কি না; যারা দায়িত্বে নিয়োজিত, তারাই সঠিকভাবে কাজটি করেন কি না; যে বাজেট দেয়া হয়, তারই বা কত শতাংশ মানুষের জন্য খরচ করা হয় আর কত শতাংশ চুরি করা হয়—সেই প্রশ্নও জনমনে রয়েছে।
তারপরও মানুষকে আশাবাদী হতে হয়। বিশেষ করে ডা. সামন্ত লাল সেনের মতো একজন জনবান্ধব চিকিৎসককে সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিয়োগ করার পরে দলমত নির্বিশেষে দেশের সব মানুষের মধ্যেই স্বাস্থ্য খাত নিয়ে একটা আশার সঞ্চার হয়েছে। সকলেই এটা বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন যে, ডা. সামন্ত লাল সেন স্বাস্থ্য খাতের নৈরাজ্য রাতারাতি দূর করতে না পারলেও অন্তত পরিবর্তনের সূচনাটা তিনি করতে পারবেন।
এই একুশ শতকেও অন্তত কেউ সাপের কামড়ে আহত হয়ে বিনা চিকিৎসায় মারা যাবে না—এটুকুর নিশ্চয়তা দিতে পারাটাও কম কথা নয়। দেশের বিভিন্ন স্থানেই যেহেতু সাপের উপদ্রব বেড়েছে বলে জানা যাচ্ছেন এবং মানুষের মনে এটা নিয়ে দারুণ আতঙ্ক তৈরি হয়েছে; বর্ষার এই সময়ে নদী-খাল-জলাশয় অধ্যুষিত অঞ্চলে সাপের উপদ্রব যেহেতু এমনিতেই বেড়ে যায়, অতএব আর একজন সাপেকাটা মানুষও হাসপাতাল বা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যাওয়ার পরে অন্তত প্রতিষেধকের অভাবে মারা যাবেন না—এটুকু প্রত্যাশা আমরা করতেই চাই।
হাসপাতালে অ্যান্টিভেনমের মজুদ রাখা এবং সময়মতো এটি সাপেকাটা রোগীর শরীরে প্রয়োগ নিশ্চিত করার পাশাপাশি এখন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আরেকটি জরুরি কাজ করার সময় হয়েছে। সেটি হলো, সত্যিই রাসেল’স ভাইপার বা অন্য কোনো বিষধর সাপের উপদ্রব বেড়েছে কি না; বাড়লে কোন কোন এলাকায় বেড়েছে এবং সম্প্রতি সত্যিই কতজন মানুষের মৃত্যু হয়েছে- সেই পরিসংখ্যানটি জানানো। এজন্য বস্তুনিষ্ঠ অনুসন্ধান প্রয়োজন। কোনো তথ্য লুকানো কিংবা অতিরঞ্জিত করে প্রকাশের প্রয়োজন নেই। বরং মানুষ যাতে সঠিক প্রস্তুতি নিতে পারে, সেজন্য তার সঠিক তথ্য প্রয়োজন।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, বাংলাদেশে যত ধরনের সাপ আছে, তার মধ্যে ৯০ শতাংশেরও বেশি নির্বিষ। অর্থাৎ সেসব সাপ দংশন করলেই মানুষের মৃত্যু হয় না। আবার অনেক সময় বিষধর সাপ দংশন করলেও মৃত্যু হয় না। বিশেষ করে গোখরো সাপ দংশন করলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মানুষের শরীরে বিষ ঢেলে দেয় না। কিন্তু যেকোনো সাপই আক্রান্ত হওয়ার ভয় করলে অর্থাৎ তার নিজের জীবন বিপন্ন বোধ করলে আত্মরক্ষার্থে ছোবল দেয়। তাতে সে বিষধর হোক কিংবা নির্বিষ। কিন্তু মানুষ যেহেতু সব সাপ চেনে না এবং কোনটি বিষধর আর কোনটি বিষধর নয়; বিষধর সাপে দংশন করলেও সে তার শরীরে বিষ প্রয়োগ করলো কি না—সেটিও যেহেতু সঙ্গে সঙ্গে বোঝা যায় না—ফলে মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। বলা হয়, সাপেকাটা রোগীদের বিরাট অংশই মারা যায় এই আতঙ্কজনিত হার্ট অ্যাটাকে।
অতএব হাসপাতালে অ্যান্টিভেনমের মজুদ নিশ্চিত করা; সেটি হাতের নাগালে রাখা (স্টোররুমে তালা মেরে রেখে চাবি নিয়ে বাড়ি চলে না যাওয়া) এবং সাপেকাটা রোগী গেলে সঙ্গে সঙ্গে তার শরীরে এর প্রয়োগ নিশ্চিত করার পাশাপাশি সাপ নিয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোও জরুরি। সাপ যে প্রকৃতির জন্য জরুরি; অন্তত চন্দ্রবোড়া বা রাসেলস ভাইপার না থাকলে যে মাঠের ফসল ইঁদুরের দখলে চলে যাবে এবং সেই ইঁদুর মারতে গিয়ে রাসেল’স ভাইপারের চেয়েও বিষাক্ত ওষুধ ফসলের মাঠে প্রয়োগ করতে হবে—সেই কথাটিও মানুষের বোঝা দরকার। এক্ষেত্রে সরকার, স্থানীয় সরকার এবং স্থানীয় পর্যায়ের গণমাধ্যমকর্মীদের দায়িত্ব অনেক বেশি। কোনো একটি খবর পেলেই সেটিকে রঙ চড়িয়ে পরিবেশন করার মধ্য দিয়ে সারা দেশে চাঞ্চল্য তৈরি করার চেয়ে দায়িত্বশীল সাংবাদিকতা করা অনেক বেশি জরুরি।