এরশাদপত্নী বলেন, “দলের পরীক্ষিত নেতাকর্মীদের মনোনয়ন প্রদান করা হয়নি। এমতাবস্থায় দলের ও নেতাদের অবমূল্যায়ন করার কারণে নির্বাচনে আমার অংশগ্রহণ করা সম্ভব নয়।"
Published : 29 Nov 2023, 10:59 PM
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের ও মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুর বিরুদ্ধে অসহযোগিতার অভিযোগ এনে আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন দলটির সংসদ নেত্রী রওশন এরশাদ।
জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা ও জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক জানান, দলের ‘পরীক্ষিত’ নেতারা মনোনয়ন না পাওয়ায় তিনিও ভোটে আসছেন না।
আগামী ৭ জানুয়ারির দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ভোটে অংশ নিতে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় শেষ হওয়ার আগের দিন বুধবার রাতে অনুসারীদের নিয়ে বৈঠক করে এই সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেন তিনি।
তবে জাতীয় পার্টির মহাসচিব বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন, তাদের ওপর দোষারোপ করাটা ‘ন্যায়সঙ্গত নয়।’
জাতীয় পার্টিতে মনোনয়নে রওশন অনুসারীরা বাদ পড়ে যাওয়ার ঘটনায় বছরের পর বছর ধরে চলে আসা গৃহবিবাদ নতুন করে সামনে আসে।
এর মধ্যে বুধবার রাতে গুলশানে নিজ বাসায় অনুসারীদের ডাকেন বিরোধীদলীয় নেতা। দুই ঘণ্টার রুদ্ধদ্বার বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সামনে একটি লিখিত বক্তব্য পড়েন তিনি।
রওশন বলেন, "আমি দেশ ও গণতন্ত্রের স্বার্থে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলাম। এবারও নির্বাচনের তফসিলকে স্বাগত জানিয়েছিলাম। বর্তমানে নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিলাম।
"বর্তমানে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার ক্ষেত্রে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও মহাসচিব সহযোগিতা না করার কারণে, দলের পরীক্ষিত নেতাকর্মীদের মনোনয়ন প্রদান করা হয়নি। এমতাবস্থায় দলের ও নেতাদের অবমূল্যায়ন করার কারণে নির্বাচনে আমার অংশগ্রহণ করা সম্ভব নয়।"
সংবাদ সম্মেলনে সাধারণত লিখিত বক্তব্যের পর প্রশ্ন করার সুযোগ থাকে। তবে জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক কাউকে প্রশ্ন করার সুযোগ দেননি।
মনোনয়ন নিয়ে কী হয়েছে জাতীয় পার্টিতে
২০১৯ সালে প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুর পর জাতীয় পার্টির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে রওশন ও জি এম কাদেরের মধ্যে যে টানাপড়েন চলছে, তার প্রভাব পড়েছে এবারের মনোনয়নে।
গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী রওশন তার নিজের পাশাপাশি সাবেক মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গার জন্য রংপুর-১, ছেলে রাহগির আলমাহি সাদ এরশাদের জন্য রংপুর-৩, ময়মনসিংহ জাতীয় পার্টির সাবেক সভাপতি কে আর ইসলামের জন্য ময়মনসিংহ-৬, রুস্তম আলী ফরাজীর জন্য পিরোজপুর-৩ সহ কয়েকটি আসন চেয়েছিলেন।
কিন্তু জি এম কাদের রাঙ্গার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারে রাজি নন, তার আসনে প্রার্থী করা হয়েছে জি এম কাদেরের ভাতিজা আসিফ শাহরিয়ারকে। জি এম কাদের নিজে দাঁড়াবেন রংপুর-৩ আসনে। এমনকি ১৯৯১ সাল থেকে জাতীয় পার্টি, বিএনপি ও স্বতন্ত্র মিলিয়ে চার চারবার সংসদ সদস্য রুস্তম ফরাজীকেও মনোনয়ন দেওয়া হয়নি।
জাতীয় পার্টি সাদ এরশাদকে ময়মনসিংহ-৭ আসন দেওয়ার পক্ষে ছিল, যদিও সেই আসনে অন্য একজনকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। কে আর ইসলামকে ময়মনসিংহ-৬ আসন দিতে অবশ্য আপত্তি ছিল না। তবে তাকে দুই বছর আগে জি এম কাদের বহিষ্কার করেছেন, সেই আদেশ ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে কি না, সেটি এখনও নিশ্চিত নয়।
কী বলছেন চুন্নু
রওশন অসহযোগিতার যে অভিযোগ এনেছেন, তার জবাবে জাতীয় পার্টির মহাসচিব বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এর জবাব হলো, আপনারা সাক্ষী, সমস্ত টিভি, ইলেকট্রনিক মিডিয়া, প্রিন্ট মিডিয়া সাক্ষী। আমি বলে আসছি, ম্যাডাম (রওশন), ম্যাডামের ছেলে (সাদ এরশাদ) ও আরেকটা আসন তিনি চেয়েছিলেন, যদি তিনি লোক পাঠান, ফরম পাঠায়া দিব, হুকুম দিলে আমি নিজে দিয়ে দিয়ে আসব। কিন্তু ওনারা আসেননি, আমাকেও বলেননি। এখন আমাদের দোষারোপ করাটা অন্যায়।“
বিরোধীদলীয় নেতা যে বলেছেন, আপনারা ‘ত্যাগী’ নেতাদের বাদ দিয়ে দিয়েছেন, তার কী জবাব দেবেন- এই প্রশ্নে চুন্নু বলেন, “মনোনয়নপ্রতাশী প্রা্র্থী অনেক ছিল, কেউ না কেউ তো বাদ পড়বেই। ত্যাগী যদি তিন জন থাকে, তাহলে একজনকে দিতে হবে, দুই জন তো বাদ পড়বেই। একটি দলে তো একই এলাকায় একাধিক ত্যাগী থাকেন।”
রওশনের আসন আবু মুসা
রওশন এই সিদ্ধান্ত জানানোর আগেই তার ‘সম্মানে’ ফাঁকা রাখা ময়মনসিংহ-৪ আসন দলের ময়মনসিংহ জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক আবু মুসা সরকারকে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় জাতীয় পার্টি।
দুই দিন আগে মনোনয়ন ঘোষণার দিন আসনটি ফাঁকা রেখে রওশনের প্রতি সম্মান দেখানোর কথা বলেছিলেন চুন্নু।
২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচন থেকে ওই আসনেই ভোট করে আসছেলেন এরশাদপত্নী। এই দুটি নির্বাচনের পর তিনি সংসদে বিরোধীদলীয় নেতাও হন।
তবে ২০১৯ সালে জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুর পর দলের কর্তৃত্ব নিয়ে জি এম কাদেরের সঙ্গে যে বিরোধ তৈরি হয়, তাতে কার্যত তিনি হেরে গেলেন।
দশম নির্বাচন থেকেই রওশন ‘বড় নাম’
আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি ২০০৮ সালে মহাজোট করে ভোটে অংশ নেওয়ার পর রওশন এরশাদের ছেড়ে দেওয়া রংপুর-৩ আসনে সংসদ সদস্য হন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে পরের নির্বাচন বর্জন করে আন্দোলনে যায় বিএনপি-জামায়াত ও সমমনা দলগুলো। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির সেই নির্বাচনে যাওয়ার প্রশ্নে জাতীয় পার্টির দ্যোদুল্যমান অবস্থার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেন রওশন।
সেই নির্বাচনের মনোনয়নপত্র জমা দিলেও পরে প্রার্থিতা তুলে নেওয়ার নির্দেশ দেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তখন দলে রওশনকে ঘিরে তৈরি হয় আরও একটি বলয়। তারা জানান, ভোট করবেন।
দশম সংসদ নির্বাচনের পর থেকে রওশন এরশাদ সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা হন। বর্তমান সংসদেও তিনি একই পদে আছেন।
জি এম কাদের সে সময় তার ভাইয়ের নির্দেশ মেনে ভোট থেকে দূরে ছিলেন। তবে এরশাদের মনোনয়নপত্র ঢাকা থেকে প্রত্যাহার হলেও রংপুর-৩ ও লালমনিরহাট-১ আসনে থেকে যায়।
ব্যাপক সহিংসতার মধ্যে সেই নির্বাচনে এরশাদকে রংপুর থেকে জয়ী ঘোষণা করা হয়, পরাজিত দেখানো হয় লালমনিরহাটে।
এরশাদ প্রথমে বলেন, তিনি শপথ নেবেন না। তবে তার আগেই জাতীয় পার্টির ৩৪ জন সংসদ সদস্যের বেশিরভাগের পছন্দে রওশন এরশাদ সংসদীয় দলের নেতা-নির্বাচিত হন এবং তাকে বিরোধীদলীয় নেতা করা হয়।
পরে এরশাদ অভিমান ভুলে একেবারে শেষ দিনে শপথ নিয়ে সংসদ সদস্য হন। তাকে মন্ত্রীর মর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত করা হয়।
নির্বাচনের পর জাতীয় পার্টি সেবার বিরোধী দলে থাকলেও দলের কয়েকজন মন্ত্রিত্ব নেন। দলটির দ্বিমুখী ওই ভূমিকা সমালোচনার মুখে পড়ে।
একাদশ সংসদ নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত ও সমমনা দলগুলো অংশ নেওয়ার ঘোষণা দিলে আবার জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগ এবং ১৪ দল নিয়ে হয় মহাজোট।
নির্বাচনের পর জোট ভেঙে দেওয়া হলে জাতীয় পার্টি বসে বিরোধী দলে। ফের বিরোধীদলীয় নেতা হন রওশন।
এবারও নির্বাচনের আগে জাতীয় পার্টি যখন সুনির্দিষ্ট বক্তব্য দিচ্ছিল না, সে সময় গত ১৮ নভেম্বর নির্বাচন কমিশনে চিঠি দিয়ে রওশন এরশাদ জানান, জাতীয় পার্টি নির্বাচনে যাবে এবং মহাজোটের প্রতীক ব্যবহার করবে।
তবে চুন্নু আরেক চিঠিতে জানান, জাতীয় পার্টির মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষমতাপ্রাপ্ত হলেন জি এম কাদের।
এরপর দল যখন ২০ নভেম্বর থেকে মনোনয়ন ফরম ছাড়ে এবং মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ শুরু করে, সেই কার্যক্রমে ডাকাই হয়নি রওশন বা তার অনুসারীদের।
আরও পড়ুন:
রওশনের ‘সম্মানের আসন’ মুসাকে দিল জাতীয় পার্টি
স্বতন্ত্র প্রার্থী হচ্ছেন রাঙ্গা, জাতীয় পার্টিকে বললেন ‘পরগাছা’