এবার মহাজোট না হলেও জাতীয় পার্টির সঙ্গে আসন সমঝোতার ইঙ্গিত এসেছে আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতাদের কাছ থেকে।
Published : 21 Nov 2023, 12:13 AM
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ভোটে না এলে জাতীয় পার্টিকে নিয়ে মহাজোট করার কোনো প্রয়োজন দেখছে না আওয়ামী লীগ। সেক্ষেত্রে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির দশম সংসদ নির্বাচনের মত এবারও সংসদে বিরোধী দলটিকে বেশ কিছু আসনে ছাড় দিতে পারে ক্ষমতাসীন দল।
আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির একজন সদস্য বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন, “বিএনপি নির্বাচনে না এলে আমরা মহাজোট করব না। সেক্ষেত্রে জাতীয় পার্টি লাঙ্গল প্রতীক নিয়েই নির্বাচন করবে। তবে আমরা নির্দিষ্ট সিটে কোনো প্রার্থী দেব না।"
একই প্রশ্নে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আব্দুর রহমান বলেন, "জাতীয় পার্টি জোটবদ্ধভাবে নির্বাচন করার ইচ্ছা পোষণ করছে কি না সেটা হল বিষয়।"
মহাজোট হলে বা না হলে জাতীয় পার্টিকে কিছু আসন আওয়ামী লীগ ছাড়বে কি না– সেই প্রশ্নে তিনি বলেন, "সেই চান্স তো থাকছেই।"
২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচন থেকে তিনটি নির্বাচনের প্রতিটিতেই জাতীয় পার্টি এবং ১৪ দলের শরিকদের সঙ্গে আসন সমঝোতা করেছে আওয়ামী লীগ।
এর মধ্যে নবম ও একাদশ সংসদ নির্বাচনে মহাজোট করে বিএনপি ও তার শরিকদের মোকাবিলা করেছে ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা দলটি।
বিএনপি-জামায়াত জোট দশম সংসদ নির্বাচন বর্জন করার পর ১৪ দলের সঙ্গে জোট বজায় রাখে আওয়ামী লীগ। জাতীয় পার্টি জোটে না থাকলেও তারা প্রার্থী হয়েছে, এমন ৩৪টি আসনে প্রার্থী দেয়নি তারা। সেসব আসনেই জয় পায় জাতীয় সংসদে গত দুইবারের প্রধান বিরোধী দলটি।
এবারও আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলের পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দিয়ে জোটবদ্ধ নির্বাচনের কথা বলা হয়েছে। জাতীয় পার্টির পক্ষ বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদও এ ধরনের একটি চিঠি দিয়েছেন। তবে দলের মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু যে চিঠি দিয়েছেন, তাতে মহাজোট করার বিষয়ে কোনো কিছু বলা হয়নি।
কোনো নাটকীয় পরিবর্তনে বিএনপি ভোটে চলে এলে তফসিল না পাল্টালে তারা জোটবদ্ধ হতে পারবে না। কারণ, এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনকে জানানোর যে বাধ্যবাধকতা আছে, সেই সময়সীমা শেষ হয়ে গেছে।
শরিকদের কোন কোন আসনে ছাড় দেওয়া হবে, সে বিষয়ে একটি খসড়া তালিকা আওয়ামী লীগের আছে। ২০০৮ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত তিনটি নির্বাচনের হিসাব তাদের সামনেই আছে। ওই তিন নির্বাচনে যেসব আসনে সমঝোতা হয়েছে, এর বাইরে ছাড় দেওয়ার সম্ভাবনা কম।
তবে যেসব আসনে ছাড় দেওয়া হবে, সেই আসনগুলোর বাইরে শরিক দলগুলো পরস্পরের সঙ্গে লড়াই করবে না এমন নয়। গত সংসদ নির্বাচনে মহাজোটের আসন সমঝোতার বাইরে বেশ কিছু আসনে উন্মুক্ত লড়াই হয়েছিল।
আগামী নির্বাচনে জাতীয় পার্টিকে নিয়ে মহাজোট করবেন কি না এমন প্রশ্নে আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো চেয়ারম্যান কাজী জাফরউল্লাহ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অনেকের সঙ্গে কথা হচ্ছে। জোট থাকছে, ১৪ দলের সবাই তো এখনও জোটেই আছে।”
একই প্রশ্নে ১৪ দলীয় জোটের শরিক বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা ওয়ার্কার্স পার্টি জোটগতভাবে নির্বাচনে যাব। আর এর বাইরে হয়ত আরও কয়েকটা দল বাড়তে পারে।”
১৪ দলের আরেক শরিক তরীকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরাও আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটগত ভাবে নির্বাচন করব।”
তফসিল প্রত্যাখ্যান করে বিএনপি আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। তারা বর্তমান সরকারের অধীনে ভোটে না আসার সিদ্ধান্তে অটল। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সংলাপের আহ্বান জানিয়ে তিন প্রধান দলকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
বিএনপির পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য আসেনি। তবে আওয়ামী লীগ পাল্টা চিঠি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে বলেছে, এই মুহূর্তে সংলাপের সময় নেই। তবে রাষ্ট্রপতি যদি সংলাপের আহ্বান জানান, তাহলে আওয়ামী লীগ তাতে যোগ দেবে বলে জানিয়েছেন নেতারা।
জাতীয় পার্টি কী বলছে
জাতীয় পার্টি এখনও এসব বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো বার্তা দিচ্ছে না। তারা তিনশ আসনে প্রার্থী দেওয়ার প্রস্তুতির কথা বলছে। আগ্রহীদের কাছে মনোনয়ন ফরম বিক্রি করছে। আবার বলা হচ্ছে, ভোটে অংশগ্রহণ এখনও নিশ্চিত নয়।
শনিবার দলের মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু নির্বাচন কমিশনে চিঠি দিয়ে জানান, তাদের দলের হয়ে মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি হচ্ছেন চেয়ারম্যান জি এম কাদের।
একই দিন দলের পৃষ্ঠপোষক ও সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদের পক্ষ থেকে আরেকটি চিঠি দেওয়া হয়। বলা হয়, জাতীয় পার্টি তার নিজস্ব প্রতীকের পাশাপাশি মহাজোটের প্রতীকও ব্যবহার করতে পারবে।
সোমবার থেকে জাতীয় পার্টি আগ্রহী প্রার্থীদের কাছ মনোনয়ন ফরম বিক্রি করছে। আগামী ২৩ নভেম্বর পর্যন্ত ফরম বিক্রি ও জমা দেওয়ার কার্যক্রম চলবে। প্রতিটি ফরমের দাম রাখা হবে ৩০ হাজার টাকা।
রোববার মহাসচিব চুন্নু সাংবাদিকদের বলেন, “সঠিকভাবে যদি ভোট হয় আমরা এককভাবে ৩০০ আসনে প্রার্থী দিতে চাই। আমরা জোট, মহাজোট ইত্যাদি করতে চাই না।”
অবশ্য তিনি এও বলে রেখেছেন, নির্বাচন কমিশনে যে চিঠি দিয়েছেন, সেটি রুটিন কাজ। এর মানে এই নয় যে তারা ভোটে আসছেন।
জোটবদ্ধ নির্বাচনের ইতিহাস
বাংলাদেশে জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচন ১৯৯১ সালেও হয়েছিল। সে সময় আওয়ামী লীগ ও বামপন্থিদের পাঁচদলীয় জোট এবং বিএনপি ও কয়েকটি ছোট দল মিলিয়ে সাত দলীয় জোট পরস্পরকে মোকাবিলা করে।
এরপর ১৯৯৬ সালে হয় দুটি নির্বাচন। ১৫ ফেব্রুয়ারি একটি এবং বিএনপি সরকার পদত্যাগ করলে ওই বছরের ১২ জুন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আরও একটি নির্বাচন হয়। সেই নির্বাচনে সবগুলো দলই এককভাবে লড়াই করে।
জোটবদ্ধ নির্বাচনের প্রভাব বেশি দেখা গেছে ২০০১ সালের অষ্টম সংসদ নির্বাচন থেকে। সে সময় আওয়ামী লীগের মোকাবিলায় বিএনপির চারদলীয় জোট ব্যাপক সফল হয়। জামায়াতে ইসলামী, কওমিপন্থীদের ইসলামী ঐক্যজোট এবং বিজেপি নামে জাতীয় পার্টির একাংশের শক্তি জয় পায় বড় ব্যবধানে।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ভোটের হার প্রায় সমান সমান হলেও আসন সংখ্যায় ব্যবধান ছিল বিশাল। নৌকা প্রতীক নিয়ে যেখানে ৬২ আসনে প্রার্থীরা নির্বাচিত হন, সেখানে ধানের শীষ নিয়ে প্রার্থীরা জেতেন দুইশর বেশি আসন।
২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচনে বামপন্থিদের একাংশ নিয়ে ১৪ দল এবং জাতীয় পার্টিকে নিয়ে মহাজোট করে আওয়ামী লীগও। এর ফলও পায় তারা।
মূলত জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগের ভোট যোগ হওয়ার পর সাধারণত ভোটের ব্যবধান কম থাকে এমন আসনগুলোতে বড় জয় পায় মহাজোট। রাজনীতিতে তৈরি হয় নতুন মেরুকরণ।
ওই নির্বাচনের পর উচ্চ আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করলে ২০১১ সালে ঘটে আরও বড় পরিবর্তন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হয়ে নির্বাচিত সরকারের অধীনে ভোটের ব্যবস্থা ফেরে।
তত্ত্বাবধায়ক ছাড়া ভোট নয়, এমন সিদ্ধান্তে অটল থেকে ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচন বর্জনের পাশাপাশি প্রতিহতের আন্দোলনে যায় বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বে ১৮ দলীয় জোট।
সেই আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার পর ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনে বিএনপি তার ২০ দলীয় জোটের পাশাপাশি জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নামে নতুন জোট করে ভোটে আসে। আওয়ামী লীগও ফেরে মহাজোটে।
বিএনপির আন্দোলন নিয়ে কী মূল্যায়ন আওয়ামী লীগে
বিএনপি আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে ভোট বর্জনের ঘোষণা দিয়ে আন্দোলন শুরু করেছে। দলটির নেতারা দাবি করছেন, ২০১৪ সালে সরকার নির্বাচন করতে পারলেও এবার আর পারবে না।
তবে আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, গত ২৯ অক্টোবর থেকে হরতাল ও অবরোধের যে কর্মসূচি বিএনপি দিচ্ছে, তা সরকারকে চাপে ফেলতে পারছে না। শুরুতে যান চলাচল কম থাকলেও ধীরে ধীরে তা বাড়ছে। এমনকি দূর পাল্লার বাসও কিছু কিছু চলছে এখন।
শুরুতে বিএনপির হরতাল বা অবরোধ কর্মসূচির মধ্যে রাজপথে পাল্টা অবস্থান করলেও তফসিল ঘোষণার পর দলের নেতাকর্মীরা এখন নির্বাচনমুখী।
দুই দিন ধরে দলের মনোনয়ন ফরম বিক্রিকে ঘিরে নজর এখন বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে। মঙ্গলবার মনোনয়ন ফরম জমা দেওয়ার সময় শেষ হচ্ছে। এরপর মনোনয়ন বাছাই এবং ৩০ নভেম্বরের মধ্যে তা নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়ার পালা। এরপর আসনে আসনে ভোটারদের কাছে যাবেন নেতাকর্মীরা। এর আগেই শরিকদের মধ্যে আসন সমঝোতার বিষয়টি চূড়ান্ত হয়ে যাবে।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের রোববার সন্ধ্যায় বলেন, “তফসিল ঘোষণার পর সারাদেশে গণজাগরণের ঢেউ উঠেছে। নির্বাচন নিয়ে জনগণের আগ্রহ প্রবল।”
ক্ষমতাসীন দল এবার কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি বাড়ানোতে জোর দেবে বলে জানিয়েছেন নেতারা। তারা বলছেন, বিএনপি না থাকলেও যে ভোটার আসে, এবারের সিটি করপোরেশন নির্বাচন তার প্রমাণ।
কোথাও ৫০ শতাংশ, কোথাও তার চেয়ে বেশি ভোট পড়েছে সিটি নির্বাচনে। এমনকি বরিশালে একটি কেন্দ্রে হাঙ্গামার পর সিলেট ও খুলনা সিটি নির্বাচন থেকে ইসলামী আন্দোলন সরে যাওয়ার পরও সিলেটে ভোট পড়েছে ৪৬ শতাংশ।
২০১৪ সালের মত কোনো আসন যেন প্রতিদ্বন্দ্বীহীন না হয়ে যায়, সেদিকেও নজর থাকবে ক্ষমতাসীন দলের। নেতারা মনে করছেন, চ্যালেঞ্জ জানানোর মতো প্রার্থী থাকলেই ভোটারকে কেন্দ্রে আনা সহজ হবে।
আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো চেয়ারম্যান কাজী জাফরউল্লাহ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নির্বাচনের পরিবেশ বলতে আমরা যা দেখছি, মানুষের এই নির্বাচনে ব্যাপক আগ্রহ। নির্বাচনের তফসিলের পরে তারা এখন দুই দিনের হরতাল দিয়েছে। রাস্তাঘাটের অবস্থা দেখেন, দোকান পাট খোলা, রাস্তায় গাড়ি চলছে, অর্থাৎ বিএনপির এই হরতাল অবরোধ মানুষ মানছে না। তারা নির্বাচনে আসল কি না সেটা নিয়েও জনগণের আগ্রহ নেই।”
আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম বিক্রি কার্যক্রমে ব্যাপক ভিড়ের বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আমাদের দলীয় মনোনয়নের এখানে এত ভিড় যে আমি নিজেও ফরম কিনতে যেতে পারিনি।”
ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, “চ্যালেঞ্জটা হল নির্বাচনে ভোটারের অংশগ্রহণ। আমি মনে করি দেশের মানুষ নির্বাচনে আসবে।”
বিএনপি ভোটে না এলে ভোটার কি আসবে?- এ প্রশ্নে তিনি বলেন, “তাদের আনার জন্য আমাদের পরিশ্রমটা হয়ত বাড়বে। কিন্তু জনগণ নির্বাচনে আসবে এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হবে।”
তরীকত ফেডারেশনের সভাপতি নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী বলেন, “আমি মনে করি দেশের মানুষ উন্মুখ হয়ে আছে নির্বাচনে ভোট দেওয়ার জন্য। দিন শেষে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হবে, সেটা আপনারাই বলবেন।”