চট্টগ্রামের ডিসি বলছেন, মহাসড়ক অবরোধ করে যারা ভাঙচুর ও জনভোগান্তির সৃষ্টি করেছে, তাদের অধিকাংশ ‘জামাত-বিএনপির লোক’।
Published : 24 Aug 2022, 12:01 AM
প্রায় চার ঘণ্টা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করে দুপাশে কয়েক হাজার গাড়ি আটকে ভূমির স্থায়ী বন্দোবস্ত ও পানি-বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের দাবি জানালো সীতাকুণ্ডের জঙ্গল সলিমপুরের বাসিন্দারা।
তাদের বিক্ষোভের কারণে মঙ্গলবার বেলা সোয়া ১টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত দেশের প্রধান মহাসড়কে আটকা পড়ে বিভিন্ন শিল্প কারখানার পণ্যবাহী হাজারো যানবাহন। বাসে, ব্যক্তিগত গাড়িতে আটকে পড়া হাজার হাজার নারী, শিশু, বৃদ্ধ ও অসুস্থ মানুষ চরম ভোগান্তির শিকার হয়।
শেষ পর্যন্ত তাদের সরিয়ে সড়কে যান চলাচল শুরু করতে বল প্রয়োগ করতে হয় পুলিশকে। সে সময় পুলিশের সাথে অবরোধকারীদের সংঘর্ষ বাঁধে।
জঙ্গল সলিমপুরের বাসিন্দাদের দাবি, ওই এলাকার দুই অংশ ছিন্নমূল ও আলীনগরের সব বাসিন্দাকে সরকারি খাস জমি স্থায়ী বন্দোবস্ত দিয়ে সেখানে সরকারি প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে। তবে প্রশাসন বলছে, প্রকৃত ভূমিহীনদেরই শুধু পুনর্বাসন করা হবে।
গত প্রায় দুমাস ধরে সলিমপুরের বাসিন্দাদের সাথে প্রশাসনের বিরোধ চলছে। সেখানে আলীনগরে অবৈধ বসতি উচ্ছেদে এখন পর্যন্ত নয় বার অভিযান চালানো হয়েছে।
এর প্রতিবাদে মঙ্গলবার বেলা ১২টার দিকে সলিমপুরের ছিন্নমূল এবং আলীনগরের বাসিন্দারা একযোগে বায়েজিদ লিংক রোডের এশিয়ান উইমেন ইউনিভার্সিটির সীমানা সংলগ্ন অংশে অবরোধ করে।
পুলিশ সেখান থেকে সরিয়ে দিলে তারা হেঁটে বায়েজিদ লিংক রোড যেখানে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে এসে মিশেছে, সেখানে গিয়ে অবস্থান নেয় এবং মহাসড়ক অবরোধ করে।
আন্দোলনকারীরা বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিকাল অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিসেসের (বিআইটিআইডি) সামনের মোড়ে অবস্থান নেওয়ায় ঢাকা ও চট্টগ্রামমুখী দুদিকের গাড়ি চলাচলই বন্ধ হয়ে যায়। সংলগ্ন আউটার রিং রোডেও মহাসড়কমুখী লেনটি যায় আটকে।
সড়ক অবরোধের পর সীতাকুণ্ডের ইউএনও শাহাদাত হোসেন, সহকারী কমিশনার (ভূমি) আশরাফুল আলম, সীতাকুণ্ড সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আশরাফুল করিম, সলিমপুরের চেয়ারম্যান সালাউদ্দিন আজিজ এসে লাগোয়া ফৌজদারহাট ট্রাফিক পুলিশ বক্সের সামনের সড়ক দ্বীপে অবস্থান নেয়।
তবে আন্দোলনকারীদের একক নেতৃত্ব না থাকায় সাধারণ আন্দোলনকারীরা কেউ কারো নেতৃত্ব মানছিল না। এসময় কয়েকজন এগিয়ে এসে হ্যান্ডমাইকে নিজেদের দাবি ঘোষণার চেষ্টা করলে হট্টগোল বাঁধে।
আকলিমা আক্তার নামের এক নারী বলেন, “গত তিন সপ্তাহ ধরে আমাদের এলাকায় কারেন্ট নাই। সারাদিনে দুয়েকবার আসে। ১৫ মিনিট পর আবার চলে যায়। মোটর চালাতে পারি না, তাই পানি নাই। পানির অভাবে বাচ্চাদের খাবার দিতে পারি না।
“ছেলেমেয়েগুলো গরমে আর পানির অভাবে অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে। আমরা বহু বছর ধরে এখানে আছি। কোথাও জমি নাই বলে এখানে টাকা দিয়ে জমি নিয়ে ঘর করেছি। আমাদের তুলে দিলে কোথায় যাব?”
অবরোধে অংশ নেওয়া অধিকাংশ নারীর হাতেই ছিল পানির খালি কলসি। কয়েকজন আন্দোলনকারী জমির স্থায়ী বন্দোবস্ত, পানি ও বিদ্যুতের সরবরাহ নিশ্চিতের দাবি জানান। প্রশাসনের কর্মকর্তারা তখন ছিন্নমূল অংশের ‘প্রকৃত ভূমিহীনদের’ পুনর্বাসন এবং বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক করার আশ্বাস দেন।
কিন্তু আন্দোলনকারীরা তখন আলীনগরের বিষয়ে সিদ্ধান্ত, স্থানীয় সাংসদ দিদারুল আলমের উপস্থিতি এবং দাবি পূরণের লিখিত আশ্বাস চেয়ে সড়কে অবস্থান চালিয়ে যেতে থাকেন।
২৫ কিলোমিটার যানজট, ভোগান্তিতে মানুষ
অবরোধ শুরুর পর সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে দুই দিকে আটকে থাকা গাড়ির লাইন দীর্ঘ হতে থাকে। এসব গাড়িতে থাকা হাজার হাজার মানুষের তখন তীব্র গরমে হাঁসফাঁস অবস্থা। ক্ষুধা তৃষ্ণায় কাতর হয়ে অনেককে গাড়ি থেকে নেমে পানি-বিস্কুট কিনে খেতে দেখা যায়।
ফেনী থেকে নগরীর হালিশহরের নাথ পাড়ায় স্ত্রীকে নিয়ে ফিরছিলেন ষাটোর্ধ্ব মো. হারুন। ট্রলি ব্যাগ ও বস্তা নিয়ে কয়েক কিলোমিটার দূরে ফৌজদারহাটে নেমে হাঁটতে শুরু করেন তারা।
হারুন বলেন, “কেন গাড়ি চলছে না তাও আমরা জানি না। এতদূর হেঁটে এসে এখন আর পারছি না। মালপত্র নিয়ে কীভাবে বাড়ি যাব বুঝতে পারছি না।”
দোকানের জন্য পণ্য নিয়ে নগরীতে জালাল গেট এলাকায় ফিরছিলেন ব্যবসায়ী মো. সাগর। তিনি বলেন, “একে খান মোড়ে নেমে মালের বস্তা কাঁধে নিয়ে হাঁটা শুরু করেছি।”
মরদেহবাহী গাড়ি নিয়ে চট্টগ্রাম নগরী থেকে চাঁদপুরের উদ্দেশে রওনা দেওয়া অনলাইন অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিসের চালক কামাল হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রাস্তা বন্ধ শুনে বায়েজিদ লিংক রোড ধরে এসেছি। অনেক কষ্টে ঘুর পথে রাস্তার এ পারে আসছি। লাশ আছে বলার পর গাড়ি ছাড়ছে। এখন চাঁদপুর যাব।”
শুরু থেকেই অবরোধকারীরা অ্যাম্বুলেন্স, লাশবাহী গাড়ি, বিদেশযাত্রীদের বহনকারী যানবাহন আউটার রিং রোডের একটি লেইন এবং খোলা থাকা ঢাকামুখী লেইন দিয়ে পার করে দেয়।
কিন্তু লম্বা যানজটের কারণে দুপাশেই অনেক অ্যাম্বুলেন্স আটকা পড়ে। যানজটে আটকা পড়া গাড়ির চালক ও আন্দোলনকারীদের সহযোগিতায় এসব অ্যাম্বুলেন্স বিআইটিআইডি মোড় পার হতে দেখা যায়।
বেলা ৩টার দিকে আন্দোলনকারীদের একাংশ স্থানীয় প্রশাসনের আশ্বাসে ফিরে যেতে চাইলেও আলীনগরের বাসিন্দারা তাতে রাজি হননি। এ সময় সলিমপুরে বিদ্যুৎ আসার খবর নিশ্চিত করেন ইউএনও শাহাদাত হোসেন।
আন্দোলনকারী মো. আমজাদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রশাসন আগেও বহুবার আমাদের নানা রকম আশ্বাস দিয়েছে। কিন্তু হয়েছে এর উল্টোটা। এখানে যারা এসেছে তারা সবাই সাধারণ মানুষ। আর টিকতে না পেরে তারা রাস্তায় নেমেছে।”
বিকাল ৪টার দিকে যানজট বাড়বকুণ্ড পর্যন্ত পৌঁছায়। আর চট্টগ্রাম নগরীর যানজট বন্দর এলাকা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। দফায় দফায় আলোচনা করেও সড়ক অবরোধকারীদের সরাতে ব্যর্থ হয় প্রশাসন।
এক পর্যায়ে ঘটনাস্থলে বাড়তি পুলিশ আসে। বিকেল পৌনে ৫টার দিকে পুলিশ আন্দোলনকারীদের সরিয়ে দিতে এগিয়ে গেলে সংঘর্ষ বাঁধে।
এসময় অবরোধকারীরা পুলিশের ধাওয়ায় বায়েজিদ লিংক রোড ধরে এগিয়ে যায়। এর মধ্যেই তারা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট ছুঁড়তে শুরু করে।
ইটের আঘাতে ঘটনাস্থলে থাকা স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক বদিউল আলমসহ ১০ জনের মত পুলিশ সদস্য আহত হন।
তখন স্থানীয় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা লাঠি ও রড নিয়ে পুলিশের সাথে যোগ দেয়। আন্দোলনকারীদের ইটের আঘাতে গোটা দশেক যাত্রীবাহী গাড়ি ও ট্রাক-কভার্ড ভ্যানের কাচ ভাঙে। এক পর্যায়ে সলিমপুরের বাসিন্দারা বায়েজিদ লিংক রোড ধরে এগিয়ে গেলে পুলিশ তাদের ধাওয়া করে।
সলিমপুর পর্যন্ত প্রায় চার কিলোমিটার এলাকা পুলিশের দিকে ইট ছুড়তে ছুড়তেই যায় বিক্ষোভকারীরা। প্রায় এক ঘণ্টা পর তারা সলিমপুর পৌঁছায় সন্ধ্যা ৬টার দিকে।
কঠোর অবস্থানে প্রশাসন
সীতাকুণ্ডের ইউএনও শাহাদাত হোসেন বলেন, “প্রকৃত ভূমিহীনদের এখানেই পুনর্বাসনের কথা শুরু থেকে বলে আসছি। পানি-বিদ্যুতের দাবির কথা বলে কিছু চিহ্নিত সন্ত্রাসী স্থানীয়দের জড়ো করে মহাসড়ক অবরোধ করেছিল।
“আমরা অপেক্ষা করেছি যাতে জানমালের ক্ষতি না হয়। কিন্তু তারা কোনো অনুরোধ শোনেনি। গাড়ি ভাংচুর করায় আমরা বাধ্য হয়ে কিছু বল প্রয়োগ করেছি।”
চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সলিমপুরের ভূমিদস্যু, পাহাড়খেকো ও সন্ত্রাসীদের অবশ্যই উচ্ছেদ করা হবে। সেখানে প্রকৃত ভূমিহীন মোট ২ হাজার ৭০০। তাদের পুনর্বাসন করা হবে।
“কিন্তু নিজ জেলায় জমি আছে, আবার এখানে বাড়ি করেছে, তাদের বিষয়ে কম্প্রোমাইজ করা সম্ভব না।”
মহাসড়ক অবরোধ করে যারা ভাঙচুর ও জনভোগান্তি সৃষ্টি করেছে, তাদের অধিকাংশ ‘জামাত-বিএনপির লোকজন’ মন্তব্য করে জেলা প্রশাসক বলেন, “যারা এসব করেছে, সব তথ্য আছে। সড়কে প্রতিবন্ধকতা, পুলিশের ওপর হামলা, ভাঙচুর, সরকারি কাজে বাধাদান, জানমালের ক্ষতিসাধন করা এসবই অপরাধ। জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
“চট্টগ্রামের পরিবেশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় আমরা অনড়। এখনই নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে ভবিষ্যতে নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। কারণ এখানে বে-টার্মিনাল, বঙ্গবন্ধু টানেল ও মহাসড়কসহ সব গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। সরকার যে পরিকল্পনা নিয়েছে তা অবশ্যই বাস্তবায়ন করা হবে।”
বিকাল ৫টার পর থেকে মহাসড়কে যানবাহন চলাচল শুরু হলেও দীর্ঘ জটের রেশ থেকে যায় আরও ঘণ্টা। রাত সোয়া ৯টার দিকেও সীতাকুণ্ডের বিভিন্ন অংশে মহাসড়কে যানবাহন চলছিল ধীর গতিতে।