মহামারীর মধ্যেই চলছে পাহাড় কাটা, উচ্ছেদও বন্ধ

করোনাভাইরাস সঙ্কটের মধ্যেও চট্টগ্রামে থেমে নেই পাহাড় কাটা। তাছাড়া মহামারীর কারণে এখনও শুরু করা যায়নি পাহাড় থেকে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ।

মিঠুন চৌধুরীমিঠুন চৌধুরী চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 June 2020, 10:43 AM
Updated : 12 June 2020, 10:43 AM

এমন পরিস্থিতিতে পাহাড় কাটা থামানো না গেলে পরিবেশ বিপর্যয় ও মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।

গত ‍দুই সপ্তাহে নগরী ও উপজেলায় চারটি পাহাড় কাটার ঘটনায় জড়িতদের প্রায় ৮১ লাখ টাকা জরিমানা করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর।

এর মধ্যেও বায়েজিদ লিংক রোড সংলগ্ন এলাকায় নির্বিচারে চলছে পাহাড় কাটা।

১ জুন নগরীর এস এস খালেদ সড়কে টিনের ঘেরার আড়ালে বহুতল ভবন নির্মাণের জন্য একটি পাহাড়ের ২৮ হাজার বর্গফুট পাহাড় কাটায় সনজিৎ দত্ত ও দারদাউস শাহ নামের দুই ব্যক্তিকে ২৮ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।

৮ জুন রাউজান উপজেলার কদলপুরে বন বিভাগের পাহাড় কেটে রাস্তা তৈরি করায় মেসার্স মাজেদা এন্টারপ্রাইজ নামের এক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে তিন লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।

৯ জুন বায়েজিদ আরেফিন নগর এলাকায় লিংক রোডের পাশে পাহাড় কেটে সুড়ঙ্গ ও পাহাড়ের উপরের অংশ কেটে ঘর তৈরি করায় মো. আবু তৈয়বকে ৩২ লাখ ৬০ হাজার টাকা এবং পাহাড়তলির ফয়’স লেক এলাকায় পাহাড় কাটায় আলী শাকের মুন্নাকে ১৮ লাখ টাকা জরিমানা করে পরিবেশ অধিদপ্তর।

এসব অভিযানে ক্ষতিপূরণের পাশাপাশি পাহাড়ের কাটা অংশ আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেয়ারও নির্দেশ দেয়া হয়।

এছাড়া ৪ জুন বায়েজিদ আরেফিন নগরে লিংক রোড সংলগ্ন এলাকায় কয়েকটি স্থানে পাহাড় কেটে ঘর নির্মাণ করতে দেখা গেছে।

পরিবেশবাদী সংগঠন পিপলস ভয়েসের সভাপতি শরীফ চৌহান বলেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যেসব ঘটনা গণমাধ্যমে আসে সেগুলোতেই অভিযান চালানো হয়। এর বাইরে আরো অনেক জায়গায় পাহাড় কাটা চলছে।

“জরিমানা করেই তারা দায়িত্ব শেষ করে। এরপর পাহাড়কে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেয়ার বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের উল্লেখযোগ্য কোনো পদক্ষেপ নেই। ফলে পরিবেশের যে ক্ষতি হয় সেটা অপূরণীয়।”

পরিবেশ অধিদপ্তর, চট্টগ্রাম মহানগরের পরিচালক মোহাম্মদ নুরুল্লাহ নূরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “করোনাভাইরাস সংক্রমণে মানুষের অনেক স্বাভাবিক কাজ থমকে গেলেও পাহাড় কাটায় জড়িতদের আগ্রাসী মনোভাব আগের মতই আছে।

“খবর পেলেই আমরা অভিযান চালিয়ে ব্যবস্থা নিই। বায়েজিদ লিংক রোডে দুয়েক জায়গায় পাহাড় কেটে টিনশেড ঘর তৈরির বিষয়টি আমাদেরও নজরে এসেছে। দুয়েকদিনের মধ্যেই ব্যবস্থা নেয়া হবে।”

এস এস খালেদ সড়কের পাহাড় কাটার ঘটনায় ধার্য ক্ষতিপূরণের টাকা পরিশোধের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, “সেখানে কোনো অবকাঠামো নির্মাণ করতে দেয়া হবে না। প্রয়োজনে ফৌজদারি মামলা করা হবে।”

শরীফ চৌহানের অভিযোগের প্রসঙ্গে জানালে নুরুল্লাহ নূরী বলেন, “সাধ্যমত চেষ্টা করি যতটুকু পারা যায়। কাটা পাহাড় আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেয়া অনেক কঠিন। তবে এই নির্দেশনা থাকলে আর নতুন করে কাটে না।”

পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য সচিব ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “করোনাভাইরাস সংক্রমণ নিয়ে প্রশাসনসহ অনেকেই ব্যস্ত এবং মানুষ ঘরবন্দি। এই সুযোগটাই যারা পাহাড় কাটে তারা নিচ্ছে। কিন্তু খবর পেলেই ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।

“প্রকৃতি ধ্বংসের ক্ষতিকর ফল কী তা করোনাভাইরাস সংক্রমণে বুঝা যাচ্ছে। তাই সবারই আরো সচেতন হওয়া দরকার।”

এ বিষয়ে পিপলস ভয়েসের সভাপতি শরীফ চৌহান বলেন, “পাহাড় কেটে পরিবেশ ধ্বংস চলতে থাকলে ভবিষ্যতে করোনাভাইরাসের মত আরো মহামারী এবং পরিবেশ বিপর্যয়ের ভয়াবহ ফলাফল অপেক্ষা করছে।

“পাহাড় রক্ষায় টানা অভিযান দরকার। পাশাপাশি রাজনৈতিকভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে পাহাড় অবৈধ দখলমুক্ত করাও জরুরি।”

এদিকে নগরীতে আগে থেকে যেসব পাহাড়ে অবৈধ বসতি আছে এবছর সেগুলোতে উচ্ছেদের কোনো উদ্যোগ এখনও নেয়া হয়নি।

২০১৯ সালের ১৬ এপ্রিল পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় আহ্বায়ক চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার পরবর্তী এক মাসের মধ্যে ১৭টি ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় থেকে ৮৩৫টি পরিবারকে উচ্ছেদের নির্দেশ দেন।

উচ্ছেদ পরিচালনায় পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মহানগরের পরিচালককে প্রধান করে বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়ে একটি কমিটিও করে দেয়া হয়।

এরপর নগরীর লালখান বাজার এলাকায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতৃবৃন্দের বাধা পেরিয়ে ৯ মে পর্যন্ত উচ্ছেদ চালিয়ে গ্যাস-পানি-বিদ্যুতের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার পর অভিযানে ছেদ পড়ে।

রোজার কারণে বন্ধ হওয়া সে অভিযান আর শুরুই হয়নি গত বছর। গত বর্ষায় মাইকিং করে পাহাড়ের বাসিন্দাদের সরিয়ে আনা হয়।

আসন্ন বর্ষায় করণীয় ঠিক করতে রোববার বৈঠকে বসবে ওই সমন্বয় কমিটি। 

চলতি বছরের ৬ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে এক সভায় পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রী মোহাম্মদ শাহাব উদ্দিন পরবর্তী এক মাসের মধ্যে পাহাড়ের অবৈধ বসতিগুলোতে গ্যাস-পানি-বিদ্যুতের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার নির্দেশ দেন।

পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য সচিব মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন বলেন, “ওই সভার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট সব সংস্থাকে চিঠি দিয়েছি। তাদের চাওয়া অনুসারে ছয়জন ম্যাজিস্ট্রেটও দিয়েছিলাম।

“এছাড়া পাহাড়ে যারা ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে সেসব সংস্থা ও ব্যক্তিকে ইতিমধ্যে চিঠি দিয়ে করণীয় জানিয়েছি। এবার পরিস্থিতি একটু ভিন্ন। এখনই লোকজনকে পাহাড় থেকে নামিয়ে আনা সম্ভব না। তাছাড়া নামিয়ে যেখানে রাখা হবে সেখানে সংক্রমণের ঝুঁকিও থাকবে।”

আসন্ন বর্ষায় করণীয় বিষয়ে মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন বলেন, “গতবারও বর্ষায় মাইকিং করে পাহাড় থেকে লোকজন সরিয়ে নিয়েছিলাম। ২০১৯ সালে পাহাড় ধসে কোনো প্রাণহানি হয়নি। করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে এবার মানবিক দিক বিবেচনায়, পরপর দুই দিন বৃষ্টি হলে মাইকিং করে পাহাড় থেকে লোকজনকে সরিয়ে নেয়া হবে, যাতে প্রাণহানি না হয়।”

২০০৭ সালের ১১ জুন টানা বর্ষণে চট্টগ্রাম অঞ্চলে পাহাড় ও দেয়াল ধসে এবং মাটি চাপায় মৃত্যু হয়েছিল ১২৭ জনের। এরপর থেকে প্রায় প্রতিবছরই পাহাড় ধসে চট্টগ্রামে প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে।

২০১৭ সালের ১২-১৩ জুন রাঙামাটিতে পাহাড় ধসে ১১০ জন, চট্টগ্রামে ২৩ জনসহ মোট ১৫৬ জন মারা যায়।