সীতাকুণ্ডের পাহাড় রক্ষার পথ খুঁজছে প্রশাসন

টিনের ঘের দিয়ে এক সপ্তাহ ধরে কাটা হচ্ছিল জঙ্গল সলিমপুর এলাকার পাহাড়। আড়াল করে চলা এমন কার্যক্রম থামাতে গিয়ে দেখা যায় প্রায় এক একর এলাকার পাহাড় কেটে ফেলা হয়েছে।

মিঠুন চৌধুরীমিঠুন চৌধুরীও উত্তম সেনগুপ্ত, চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 June 2022, 04:52 AM
Updated : 5 June 2022, 08:12 AM

বায়েজিদ লিংক রোডের ৪ নম্বর ব্রিজের কাছে গত ১৭ মে ওই অভিযানে গিয়ে মাটি খনন করার দুটি এক্সকেভেটর ও একটি বুলডোজার জব্দ করলেও পাহাড় কাটায় জড়িত কাউকে পায়নি স্থানীয় প্রশাসন।

এভাবে পাহাড় কাটা চলছে নগরীর উত্তর পাহাড়তলি মৌজা, হাটহাজারীর জালালাবাদ মৌজা এবং সীতাকুণ্ডের জঙ্গল সলিমপুর মৌজায়। এসব এলাকার পাহাড়গুলো সীতাকুণ্ড পাহাড় শ্রেণির অংশ।

ফৌজদারহাট থেকে বায়েজিদ পর্যন্ত বায়েজিদ লিংক রোডের দুপাশে এসব পাহাড়ের অবস্থান। এই পাহাড়গুলো রক্ষায় করণীয় ঠিক করতে অনুসন্ধান কমিটি করেছে পরিবেশ সংরক্ষণ কমিটি।

শনিবার বায়েজিদ লিংক রোড এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, দুপাশে জঙ্গল সলিমপুর, উত্তর পাহাড়তলি ও জালালাবাদ অংশে কয়েকটি স্থানে সীমানা প্রাচীর দিয়ে পাহাড় ঘিরে রাখা হয়েছে।

সড়ক লাগোয়া অংশে পাহাড় কাটা না হলেও ভিতরের দিকে পাহাড় কেটে বিভিন্ন স্থাপনা গড়ে তোলার কাজ চলছে। এরমধ্যে টিনশেড, সেমিপাকা ও বহুতল ভবন আছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বায়েজিদ লিংক রোডের কারণে ভাগ হয়ে গেছে সীতাকুণ্ড পাহাড় শ্রেণি। সড়কের দুপাশের ভেতরের অংশে এভাবে পাহাড় কাটা চলতে থাকলে এই এলাকার সব পাহাড় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশবিদ্যা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. দানেশ মিঞা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আন্দোলন করেও পরিবেশবাদীরা বায়েজিদ লিংক রোডে পাহাড় কাটা বন্ধ করতে পারেনি।

“এই সড়কের জন্য পাহাড় কাটায় সীতাকুণ্ড পাহাড় শ্রেণি বিচ্ছিন্ন হয়েছে। এতে সবচেয়ে ক্ষতিকর প্রভাব পড়েছে বণ্যপ্রাণীর ওপর। সড়কের দু’পাশে বণ্যপ্রাণিরা বিভক্ত হয়ে গেছে। এতে তাদের বংশবৃদ্ধি ও জীবনযাপন মারাত্মক হুমকির মুখে।”

তিনি বলেন, “পাহাড় কাটায় রাজনৈতিক ক্ষমতাবান ও প্রভাবশালীরা জড়িত। সরকারের কঠিন প্রতিজ্ঞা না থাকলে এ অবস্থা থেকে উত্তরণ নেই। আর সরকারি প্রতিষ্ঠান যখন পাহাড় কাটে তখন পরিবেশ অধিদপ্তর তাদের থামাতে পারে কী?”

সীতাকুণ্ড উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শাহাদাত হোসেন বলেন, “জঙ্গল সলিমপুর এলাকার বাসিন্দারা সমিতির নামে একটি রিট করে, পুনর্বাসনের আগে তাদের উচ্ছেদ করা যাবে না, উচ্চ আদালত থেকে এমন স্থগিতাদেশ নিয়েছে।

“এখন ওই এলাকায় অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা যাচ্ছে না। কিন্তু সেখানে পাহাড় কেটে স্থাপনা সম্প্রসারণ ঠিকই চলছে।”

এই কর্মকর্তা বলেন, “লিংক রোডের দুপাশে ভেতরের দিকে পাহাড় কাটা চলছে। সেখানে শুরুতে ছোট টিনশেড ঘর করে বসবাসের জন্য লোকজনকে রাখা হয়।

“তারপর পাহাড়ের গাছ কাটা হয়। পরে মাটিও কেটে নিলে বর্ষায় পাহাড় ধসে পড়ে। কিন্তু তা আগে থেকে বোঝা যায় না। সেখানে প্লট করেও বিক্রি করা হচ্ছে।”

থামবে কী করে?

চট্টগ্রাম নগরীর কেন্দ্রে যেসব পাহাড় ছিল সেগুলোতে অনেক আগেই হাজার হাজার স্থাপনা নির্মাণ হয়েছে। গত এক দশকে ভারি বর্ষায় পাহাড় ধসে বহু প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে।

নগরীতে পাহাড় আর তেমন নেই জানিয়ে পাহাড় রক্ষায় পরিবেশবাদী সংগঠন পিপল’স ভয়েসের সভাপতি শরীফ চৌহান বলেন, “শহরে এখন পাহাড় শুধু নামেই আছে। বেশিরভাগ কেটে ভবন নির্মাণ করা হয়ে গেছে।

“চট্টগ্রামের অন্যতম বড় পাহাড় শ্রেণি হলো সীতাকুণ্ড পাহাড় শ্রেণি। যা সীতাকুণ্ড থেকে নগরী এবং অন্য দিকে জালালাবাদ পর্যন্ত বিস্তৃত। এখন সেই পাহাড়গুলো ধ্বংস করছে পাহাড়খেকোরা।”

চট্টগ্রামের বায়েজিদ চন্দ্রনগরের নাগ-নাগিনী পাহাড়ের নিচ থেকে কেটে রাখা হয়েছে, যাতে অতিবৃষ্টিতে সহজেই ধসে পড়ে মাটি। ছবি: উত্তম সেন গুপ্ত

এভাবে চলতে থাকলে জেলায় আর কোনো পাহাড় অবশিষ্ট ‘থাকবে না’ বলে মনে করেন পাহাড় রক্ষায় দুই দশক ধরে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া এ সংগঠনটির নেতা।

এই অংশের পাহাড় যে হুমকিতে তা চিহ্নিত করেছে পরিবেশ সংরক্ষণ কমিটিও। গত মার্চ মাসের সভায় এ বিষয়ে করণীয় ঠিক করতে একটি অনুসন্ধান কমিটি করা হয়েছে।

কমিটির এক সদস্য জানান, যারা পাহাড় কাটে তাদের তালিকা দেবে পরিবেশ অধিদপ্তর ও সংশ্লিষ্ট থানাগুলো। আর কোন কোন জায়গায় পাহাড় আছে সেই তালিকা দেবে সহকারী কমিশনাররা (ভূমি)।

“সলিমপুরে যাতে আরও পাহাড় কাটতে না পারে সেজন্য উচ্চ আদালতে আবেদন করে কোনো আদেশ আনা যায় কি না সেই প্রস্তাবও করেছে স্থানীয় প্রশাসন। পাশাপাশি অভিযান, নিয়মিত টহল ও জরিমানার সুপারিশ করা হয়।”

অনসুন্ধান কমিটির প্রধান চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এলএ) মাসুদ কামাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রতিবেদন আমরা ইতোমধ্যে জমা দিয়েছি। সংশ্লিষ্ট ইউএনও এবং ওসিদের কাছ থেকে আমরা মতামত নিয়েছি।

“সমাধানের জন্য তাদের সুপারিশও নিয়েছি। পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করবেন বিভাগীয় কমিশনার মহোদয়।”

আছে আইনি সীমা ও সমন্বয়হীনতা

চট্টগ্রাম নগরীর বেশ কিছু পাহাড়ের মালিকানা সরকারি বিভিন্ন সংস্থার। কিন্তু বেশিরভাগ সরকারি পাহাড় সীমানা দিয়ে চিহ্নিত করা নেই।

গত মাসে পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বিষয়টি উপস্থাপন করে সরকারি পাহাড় ও সেসবের সীমানা লাল পতাকা দিয়ে চিহ্নিত করার প্রস্তাব দেন।

বায়েজিদ বোস্তামি থানার ওসি মো. কামরুজ্জামান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কোনটা সরকারি সংস্থার পাহাড় আর কোনটা ব্যক্তিমালিকানাধীন তা চিহ্নিত নয়।

“ফলে অনেক খাস খতিয়ানের পাহাড় কাটা হচ্ছে। পাহাড় ন্যাড়া করে দেওয়া হয় বর্ষার আগে। বৃষ্টি হলে যাতে ধসে পড়ে।”

পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় সহকারী কমিশনার ভূমি, পরিবেশ অধিদপ্তর ও পুলিশের সমন্বয়ে মাসে অন্তত একবার অভিযান পরিচালনার সুপারিশ করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।

ওসি বলেন, “পাহাড় কাটার অভিযানে পুলিশ গেলেও অনেক সময় সেখানে গিয়ে কাউকে পাওয়া যায় না। আর যাদের পাওয়া যায় তারা শ্রমিক। মূল লোকজন থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে।

“বিভিন্ন পাহাড়ে বেশ কিছু ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান আছে। তারা পাহাড়গুলোকে নিজেদের সম্পত্তি দাবি করে স্থাপনা নির্মাণ চালাতে থাকে।”

জেলা প্রশাসনের একজন কর্মকর্তা বলেন, “রাতের বেলায় পাহাড় কাটা থামাতে আমরা অভিযান পরিচালনা করি। কিন্তু তখন পরিবেশ অধিদপ্তরের লোকজনকে পাওয়া যায় না।”

চট্টগ্রামের বায়েজিদ চন্দ্রনগরের নাগ-নাগিনী পাহাড় অবাধে কেটে সমান্তরাল করা হচ্ছে। ছবি: উত্তম সেন গুপ্ত

এছাড়া বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ২০১০ অনুসারে একটি পাহাড় নিয়ে একবার মামলা হলে একই পাহাড় কাটায় পরবর্তীতে আবার মামলা করায় সীমাবদ্ধতা আছে। কমিটির সভায় বিষয়টি উত্থাপন করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর।

পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম জেলার পরিচালক মফিদুল আলম  বলেন, “পাহাড় রক্ষা কমিটির সভায় আমরা বিষয়গুলো জানিয়েছি। যেসব এলাকায় নিয়মিত কাটা হচ্ছে সেখানে কিছু পাহাড়কে আমরা ঝুঁকিপূর্ণ মনে করছি।

“সেগুলো রক্ষায় আমরা কিছু উদ্যোগ নিয়েছি। প্রথমত পাহাড়গুলো চিহ্নিতকরণ। কী পরিমাণ পাহাড় কাটা হয়েছে সেটা যাচাই করা এবং কারা কারা পাহাড় কাটার সাথে জড়িত তাদের চিহ্নিত করা ও তাদের আইনের আওতায় আনা।”

এ লক্ষ্যে গঠিত অনুসন্ধান কমিটির প্রতিবেদন পেলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান মফিদুল আলম।

পাহাড় রক্ষায় পরিবেশ অধিদপ্তরের অভিযান অব্যাহত আছে জানিয়ে তিনি বলেন, “সীতাকুণ্ড, হাটহাজারী ও সলিমপুর এলাকার পাহাড়গুলো এখন সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। গত এক বছরে আমরা অনেক অভিযান চালিয়েছি।

“৯৯টি মামলা করে ৯৭টিতে অভিযোগপত্র দিয়েছি। আদালতে তো বিচার শেষ হতে সময় লাগে।”

অনুসন্ধান কমিটির সদস্য হাটহাজারীর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শাহিদুল আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গত কয়েক মাসে পাহাড় ও গাছ কাটা বন্ধে অভিযান চালিয়ে ১৮ লাখ টাকা জরিমানা করেছি।

জালালাবাদ অংশে পাহাড় কাটার প্রবণতা বেশি জানিয়ে তিনি বলেন, “শুধু জরিমানা নয় পরিবেশ অধিদপ্তর যদি মামলা করে এবং কিছু মামলা নিষ্পত্তি হয়ে দোষীদের শাস্তি হয় তাহলে দৃষ্টান্ত হবে।”