মুক্তিযোদ্ধা, কবি, সাংস্কৃতিক সংগঠক ও সংশ্লিষ্টদের দাবি, চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারটি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য উন্মুক্ত করা হোক।
Published : 16 Dec 2024, 04:11 PM
নির্মাণ কাজ শেষ হলেও চালু হয়নি চট্টগ্রামের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। মিউনিসিপ্যাল মডেল হাই স্কুল মাঠের অস্থায়ী শহীদ মিনারে এবার ছিল না কোনো আয়োজন।
তবু বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী ও সাংস্কৃতিক সংগঠন বিজয় দিবসের সকালে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ও অস্থায়ী শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন।
মুক্তিযোদ্ধা, কবি, সাংস্কৃতিক সংগঠক ও সংশ্লিষ্টদের দাবি, চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারটি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য উন্মুক্ত করা হোক।
তবে সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরগুলো এ বিষয়ে সিদ্ধান্তের জন্য একে অন্যের দিকে তাকিয়ে আছে। এভাবে আরো একটি বিজয় দিবস পেরিয়ে গেল চট্টগ্রামে।
২০২২ সালের জানুয়ারিতে নগরীর কে সি দে রোডে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তরের অধীনে সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স প্রকল্পের আওতায় পুরনো শহীদ মিনারটি ভেঙে নতুন শহীদ মিনার নির্মাণের কাজ শুরু হয়।
ওই বছর থেকে অদূরে মিউনিসিপ্যাল মডেল হা ইস্কুলের মাঠে নির্মিত অস্থায়ী শহীদ মিনারে জাতীয় দিবসগুলোতে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হত।
এরপর ২০২৪ সালের ২৩ মার্চ নগরীর এক প্রান্তে উত্তর কাট্টলীতে সাগর তীরে অস্থায়ী স্মৃতি সৌধের উদ্বোধন করা হয়। সেদিন জানানো হয়, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধের আদলে একই স্থানে একটি স্থায়ী স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করবে। সেটিরও তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি।
চলতি বছরের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে মিউনিসিপ্যাল মডেল হাই স্কুল মাঠের অস্থায়ী শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদনসহ অন্যান্য কর্মসূচি পালন করেছিল চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। আর উত্তর কাট্টলীতে অস্থায়ী স্মৃতি সৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছিল চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন।
সোমবার বিজয় দিবসে উত্তর কাট্টলীর অস্থায়ী স্মৃতি সৌধ ‘মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিস্তম্ভ’, কে সি দে রোডের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এবং মিউনিসিপ্যাল মডেল হাই স্কুলের অস্থায়ী শহীদ মিনার- এই তিন স্থানেই শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়েছে।
নির্মাণ কাজ শেষ হলেও নগরীর কে সি দে রোডের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারটির নকশা নিয়ে আপত্তি গত বছরের নভেম্বরে আপত্তি জানায় চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক সংগঠক ও বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ।
এরপর একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয় সে সময়ের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীর নেতৃত্বে। ওই কমিটি নকশা সংশোধনের ১০টি সুপারিশ করলেও সেগুলোর বাস্তবায়নে কোনো অগ্রগতি নেই।
চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারসহ সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্সের প্রকল্প বাস্তবায়নকারী গণপূর্ত বিভাগের চট্টগ্রাম অঞ্চলের নির্বাহী প্রকৌশলী-১ কামরুল হাসান খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ডিজাইন অনুসারে আমরা কাজ শেষ করেছি আগেই। কেউ নকশায় পরিবর্তন চান, কেউ চান না। সপ্তাহখানেক আগে গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মহোদয় পরিদর্শনে এসেছিলেন। তিনিও জানতে চেয়েছেন, শহীদ মিনারে কেন ফুল দেওয়া হচ্ছে না।
“গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনকে চিঠি দেওয়া হলে এরপর সিটি করপোরশেন শহীদ মিনার চালুর বিষয়ে তাদের সিদ্ধান্ত জানাবে হয়ত।”
সোমবার সকালে খেলাঘর চট্টগ্রাম মহানগরীর সহ-সভাপতি কবি আশীষ সেন তার সংগঠনের সদস্যদের নিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন মিউনিসিপ্যাল মডেল হাই স্কুল মাঠের অস্থায়ী শহীদ মিনারে।
জানতে চাইলে কবি আশীষ সেন বলেন, “আমরা সবসময় জাতীয় দিবসগুলোতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানিয়েছি। আনুষ্ঠানিকভাবে সিদ্ধান্ত না হলে সেখানে তো ফুল দিতে পারছে না মানুষ।
“সেখানে নতুন নির্মিত শহীদ মিনারটি নিচ থেকে দৃশ্যমান নয়। এছাড়া ডিজাইনের কিছু ত্রুটির বিষয়ে আপত্তি জানানো হয়েছিল। সেগুলোর বিষয়ে কোনো সুরাহা হয়নি। এসব ত্রুটি সারিয়ে অবিলম্বে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার সবার জন্য উন্মুক্ত করা উচিত।”
চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানাতে আসা একটি পেশাজীবী সংগঠনের এক নেতা বলেন, “এখানে কোনো ব্যবস্থাপনা নেই। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে কোন পরিচ্ছন্নকর্মী গত কয়েকদিনে ঝাড়ু দিতেও আসেনি। তবু আমরা শ্রদ্ধা জানাতে এসেছি। কিন্তু উপস্থিতি দেখে খুবই হতাশ হলাম।”
সোমবার ৮-১০টি সংগঠনের পক্ষ থেকে সেখানে শ্রদ্ধা জানানো হয়। আর সন্তানদের নিয়ে হাতেগোনা কয়েকজন অভিভাবক এসে ফুল দিয়ে শহীদদের সম্মান জানান। শহীদ বেদীর বিশাল চত্বর প্রায় ফাঁকা ছিল।
অদূরে মিউনিসিপ্যাল মডেল হাই স্কুলের মাঠে প্রতিবছর বিজয় দিবসে সিটি করপোরেশনের ব্যবস্থাপনায় শ্রদ্ধা নিবেদনের আয়োজন করা হত। গতবছরও সেখানে মেয়রসহ স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারা শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
সোমবার সকালে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, এবার সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে কোনো আয়োজন নেই। যারা ফুল দিতে আসছেন, তারা নিজ দায়িত্বে ফুল দিয়ে ফিরে যাচ্ছেন। উপস্থিতিও ছিল অন্য বছরের তুলনায় কম।
এবার কোনো আয়োজন না থাকার কারণ জানতে চাইলে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ চট্টগ্রাম মহানগরের কমান্ডার মোজাফফর আহমদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দুর্ভাগ্য আমাদের, খুব দুঃখজনক পরিস্থিতি। কোন ধরনের আয়োজন নেই। মুক্তিযোদ্ধারা এসেছেন হৃদয়ের তাগিদে।”
শ্রদ্ধা নিবেদন করতে আসা বোধন আবৃত্তি পরিষদের সাধারণ সম্পাদক প্রণব চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখানে কোনো মাইক নেই, বাজছে না কোনো দেশের গান। কোনো সংস্থাই কোনো ব্যবস্থাপনা করেনি। এরকম পরিস্থিতি আগে দেখিনি।”
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার আনুষ্ঠানিকভাবে চালু না হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ডিজাইন নিয়ে কিছু সমস্যা হয়েছিল। আগে একবার আমরা সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়ে জানিয়েছিলাম। নতুন মেয়র মহোদয় আসার পর বিষয়টি নিয়ে এখন পর্যন্ত উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব হয়নি।
“মেয়র মহোদয় জানতে চেয়েছিলেন কয়েকদিন আগে। উনাকে পরিস্থিতি জানিয়েছি। পরবর্তীতে উনার সাথে আলোচনা করে এ বিষয়ে করণীয় ঠিক করা হবে। মেয়র মহোদয় সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, এবার আমরা জেলা প্রশাসনের সাথে উত্তর কাট্টলীতে বিজয় দিবসের শ্রদ্ধা নিবেদন করব। আমরা সবাই সেখানে অংশ নিয়েছি।”
শহীদ মিনারের নকশা সংশোধনের জন্য গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটির সদস্য সচিব নাট্যজন আহমদ ইকবাল হায়দার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সবশেষ গত মার্চে এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছিল। এরপর আরে কেউ যোগাযোগ করেনি। আর্থিক বা অন্য কোনো কারণে প্রস্তাবিত সংশোধনীগুলো হয়ত হয়নি।
“কাট্টলীতে জাতীয় স্মৃতিসৌধের আদলে একটি স্মৃতিসৌধ হওয়ার কথা ছিল। সেখানে জমি অধিগ্রহণও করা হয়েছে বলে জানি। সেটিও সম্পূর্ণ করা জরুরি।”
২০১৮ সালের জানুয়ারিতে এই সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স প্রকল্পটির কাজ শুরু হয়। তখন ব্যয় ধরা হয় ২৩২ কোটি টাকা। পরে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রকল্পটির ব্যয় বেড়ে হয় ২৮১ কোটি ৩৯ লাখ টাকা।
এরপর ২০২৩ সালের ১৮ নভেম্বর এক সভায় চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক সংগঠক ও বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষরা নতুন শহীদ মিনারের নকশা নিয়ে আপত্তি জানায়। সেই প্রেক্ষিতে ২ ডিসেম্বর আরেকটি সভা হয়। তাতে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধিরা অংশ নেন।
তাদের আপত্তির বিষয় হল, নতুন শহীদ মিনারটি নিচের সড়ক থেকে দৃশ্যমান নয়। এছাড়া প্লাজার দু’পাশ থেকে বেদীতে ওঠার সিঁড়ি অপ্রশস্ত, যা জাতীয় দিবসে বড় জন সমাগমের উপোযোগীয় নয়।
গত বছরের ২ ডিসেম্বরের সভায় এসব আপত্তি জানিয়ে, ১৬ ডিসেম্বর নব নির্মিত শহীদ মিনারে বিজয় দিবসের কর্মসূচি পালন না করে মিউনিসিপ্যাল মডেল হাই স্কুল মাঠের অস্থায়ী শহীদ মিনারে সেই কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত হয়। সে অনুযায়ী গতবার বিজয় দিবস পালিত হয়েছিল।
নগরীর কেসি দে রোডে পাহাড়ের পাদদেশে প্রথম শহীদ মিনারটি নির্মাণ করা হয় ১৯৬২ সালে। পরে ১৯৭৪ সালে এর নতুন রূপ দেওয়া হয়।
২০২১ সালে সে সময়ের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিনের উপস্থিতিতে সাংস্কৃতিক কর্মীদের সঙ্গে সভা করে পুরনো শহীদ মিনারটি ভেঙে ফেলার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়।
মেয়র নাছিরের মধ্যস্থতায় পুরনো শহীদ মিনারটি ভেঙে, তার আদল অপরিবর্তিত রেখে নতুন শহীদ মিনার নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়। সে সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২০২১ সালের ডিসেম্বরে পুরনো শহীদ মিনার ভাঙা হয় এবং মিউনিসিপ্যাল মডেল হাই স্কুল মাঠে অস্থায়ী আরেকটি শহীদ মিনার নির্মাণ করে দেয় গণপূর্ত অধিদপ্তর।
পুরনো খবর-
চট্টগ্রামের কাট্টলীতৈ অস্থায়ী স্মৃতিসৌধ উদ্বোধন
চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার সংস্কারে যেসব সুপারিশ করল বিশেষজ্ঞ কমিটি
চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের ৩ সমস্যা চিহ্নিত
চট্টগ্রামের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার 'দৃশ্যমান' করার প্রস্তাব
নতুন করে গড়তে ভাঙা হল চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার
সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স: চট্টগ্রাম শহীদ মিনার 'আপাতত' সরানোর প্রস্তাব