চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার সংস্কারে যেসব সুপারিশ করল বিশেষজ্ঞ কমিটি

১৯৭৪ সালে স্থাপিত চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের স্থপতি আহমদ জিল্লুর চৌধুরীর পরামর্শ নেয় বিশেষজ্ঞ কমিটি।

চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 Feb 2024, 03:36 PM
Updated : 7 Feb 2024, 03:36 PM

চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার দৃশ্যমান করতে, মিনারের উচ্চতা বাড়াতে এবং প্লাজার ওপরের বেদিতে ওঠানামা সহজ করতে ১০টি সুপারিশ করেছে বিশেষজ্ঞ কমিটি।

বুধবার নগরীর টাইগারপাসে অস্থায়ী নগর ভবনে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (সিসিসি) মেয়রের সাথে দেখা করে কমিটির স্থপতি ও প্রকৌশলীরা এসব সুপারিশ করেন।

তবে নির্মিত প্লাজাটি রেখেই এসব পরিবর্তনের সুপারিশ করা হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কমিটির সদস্য স্থপতি আশিক ইমরান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শহীদ মিনার দৃশ্যমান করার জন্য আমরা কয়েকটি সুপারিশ করেছি। প্রথম যিনি শহীদ মিনারের নকশা করেছিলেন উনার পরামর্শও নিয়েছি।”

১৯৭৪ সালে স্থাপিত চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের স্থপতি আহমদ জিল্লুর চৌধুরীর পরামর্শ নেয় বিশেষজ্ঞ কমিটি।

স্থপতি আশিক ইমরান বলেন, “তিনি জানিয়েছেন, তখনই শহীদ মিনারের স্তম্ভগুলো আরো উঁচু করার ডিজাইন তিনি করেছিলেন। কিন্তু বাজেট স্বল্পতায় তা সম্ভব হয়নি। উনার পরমার্শ অনুযায়ী শহীদ মিনারের চারটি স্তম্ভ এর উচ্চতা বাড়ানোর সুপারিশ করেছি।

“পাশাপাশি শহীদ মিনারের বেদিটি বর্তমান অবস্থান থেকে আরো দেড় ফুট উঁচু করা। প্লাজার দুইপাশের দেয়ালগুলোর উচ্চতা কিছুটা হ্রাস করা অথবা পারফোরোটেড টাইপ (ছিদ্রযুক্ত) করে দৃশ্যমান করার প্রস্তাব করা হয়েছে।”

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে কমিটির সুপারিশগুলো জানানো হয়।

সুপারিশগুলোর মধ্যে আছে- প্লাজার দক্ষিণ পূর্বের উন্মুক্ত মঞ্চের পিছনে থাকা গ্রিনরুমের দেওয়ালের উচ্চতা ফ্লোর লেভেল হতে ৬ ফুট বা মঞ্চ হতে ৪ ফুট রেখে অবশিষ্ট অংশ অপসারণ করা।

এছাড়াও দক্ষিণ পশ্চিমে থাকা ‘লিলি পন্ড ওয়াটার বডি’ অপসারণ, মূল বেদীর দুই পাশে বাঁকানো গাইড ওয়ালের উচ্চতা কমানো, পূর্ব পার্শ্বের প্রবেশ র‌্যাম্প ও সিঁড়ির মধ্যেকার দেয়াল অপসারণ করে পূর্ণাঙ্গ র‌্যাম্প করার সুপারিশ করেছে কমিটি।

স্থপতি আশিক ইমরান বলেন, “জাতীয় দিবসগুলোতে অনেক মানুষের সমাগম হয় শহীদ মিনারে। জনগণের নিরাপদে শ্রদ্ধা নিবেদনের সুবিধার্থে প্লাজার দক্ষিণ পশ্চিম দিকে একটি নতুন র‌্যাম্প নির্মাণ এবং র‌্যাম্পের পিছনে দক্ষিণ পাশে কৃষ্ণচূড়া, পলাশ, শিমুল জাতীয় দেশিয় গাছ লাগানোর পরামর্শ দেয়া হয়েছে।”

এছাড়া পূর্বের শহীদ মিনারের পাশে থাকা খোলা জায়গাটি দর্শনার্থীদের একত্রিত হওয়ার জন্য অগ্রভাগ হিসাবে উন্মুক্ত রাখা ও সবুজ পরিসর হিসাবে সংরক্ষণের প্রস্তাব দিয়েছে কমিটি। শহীদ মিনার মূল বেদির দুই পাশের দুটি দেয়াল শহীদ মিনার দেখতে বাধাগ্রস্ত করছে। ওই দুটি দেয়াল অপসারণ করারও প্রস্তাব দেয়া হয়েছে।

স্থপতি আশিক ইমরান বলেন, “অবকাঠামোগত পুরো কাজই প্রায় শেষ। বেশি কিছু করার সুযোগ নেই। যেসব উদ্যোগ নিলে শহীদ মিনার দৃশ্যমান হবে এবং জনসমাগম ঝুঁকিমুক্ত হবে সেসব প্রস্তাব আমরা করেছি।

“আমরা মেয়র মহোদয়কে সব বিস্তারিত দিয়েছি। উনি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়কে জানাবেন। মন্ত্রণালয় নির্দেশনা দিলে স্থাপত্য অধিদপ্তরের স্থপতি যিনি নকশা করেছেন, তিনি সংশোধন দেবেন। তারপর হয়ত বাস্তবায়নকারী সংস্থা কাজ করবে।”

বৈঠকে মেয়র এম রেজাউল করিম চৌধুরী কমিটির সদস্যদের সুপারিশগুলো বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেন এবং এজন্য পদক্ষেপ নেবেন বলে আশ্বাস দেন। 

এসময় কমিটির সদস্যদের মধ্যে গণপূর্ত অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. বদরুল আলম খান, ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশের চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সাবেক সভাপতি প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদার, নাট্যজন আহমেদ ইকবাল হায়দার, স্থপতি আশিক ইমরান, স্থপতি সোহেল মোহাম্মদ শাকুর, সিসিসি’র সহকারী স্থপতি আবদুল্লাহ আল ওমর উপস্থিত ছিলেন।

২০১৮ সালের জানুয়ারিতে এই সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স প্রকল্পটির কাজ ‍শুরু হয়। তখন ব্যয় ধরা হয় ২৩২ কোটি টাকা। পরে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রকল্পটির ব্যয় বেড়ে হয় ২৮১ কোটি ৩৯ লাখ টাকা।

গত বছরের ২৮ অক্টোবর চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স প্রকল্পটি উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। এর আওতায় ১৫ তলা গণগ্রন্থাগার ভবন, ৮ তলা মুসলিম ইনস্টিটিউট হল ভবন ও নতুন শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়।

এরপর গত ১৮ নভেম্বর এক সভায় চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক সংগঠক ও বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষরা নতুন শহীদ মিনারের ডিজাইন নিয়ে আপত্তি জানান। সেই প্রেক্ষিতে ২ ডিসেম্বর আরেকটি সভা হয়। এতে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধিরা অংশ নেন।

চট্টগ্রামের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের আপত্তি হলো, নতুন শহীদ মিনারটি নিচের সড়ক থেকে দৃশ্যমান নয়। এছাড়া প্লাজার দু’পাশ থেকে বেদিতে ওঠার সিঁড়ি অপ্রশস্ত, যা জাতীয় দিবসে বড় জন সমাগমের উপোযোগীয় নয়। 

২ ডিসেম্বরের সভায় এসব আপত্তি জানিয়ে ১৬ ডিসেম্বর নব নির্মিত শহীদ মিনারে বিজয় দিবসের কর্মসূচি পালন না করে মিউনিসিপ্যাল মডেল হাইস্কুল মাঠের অস্থায়ী শহীদ মিনারে সেই কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত হয়। সেই অনুযায়ী এবার বিজয় দিবস পালিত হয়েছে।

ওই সভার সিদ্ধান্ত অনুসারে গত ২৪ ডিসেম্বর সিটি মেয়র রেজাউল করিমকে আহ্বায়ক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আহমদ ইকবাল হায়দারকে সদস্য সচিব করে চট্টগ্রামের স্থপতি ও প্রকৌশলীদের নিয়ে বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়।

সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স প্রকল্পের আওতায় নগরীর কে সি দে সড়কের এক পাশের মুসলিম ইনস্টিটিউট ও গণগ্রন্থাগার ভবনকে অন্য পাশের শহীদ মিনারের সাথে যুক্ত করা হয়েছে ২১ ফুট উঁচু একটি প্লাজার মাধ্যমে।

শহীদ মিনার অংশে মুক্তমঞ্চ, মিউজিয়াম, শহীদ মিনার এবং প্লাজা নির্মাণ করতে যে নকশা করা হয়, তাতে আগে শহীদ মিনারটির ভিত্তি ভেঙে পুরনো নকশা অপরিবর্তিত রেখে প্লাজার উপরের বেদিতে স্থাপন করা হয়েছে নতুন শহীদ মিনারের কাঠামো।

এটি নির্মাণ করতে ২০২১ সালে সে সময়ের মেয়রের উপস্থিতিতে সাংস্কৃতিক কর্মীদের সাথে সভা করে পুরনো শহীদ মিনারটি ভেঙে ফেলার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। পুরো কমপ্লেক্সের নকশাও উপস্থাপন করা হয় সভায়।

মেয়র নাছিরের মধ্যস্থতায় পুরনো শহীদ মিনারটি ভেঙে আদল অপরিবর্তিত রেখে নতুন শহীদ মিনার নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়। এজন্য মিউনিসিপ্যাল স্কুল মাঠে অস্থায়ী আরেকটি শহীদ মিনার নির্মাণ করে গণপূর্ত অধিদপ্তর। সে সিদ্ধান্ত মতে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে পুরনো শহীদ মিনার ভাঙা হয়।

১৯৬২ সালে নগরীর কেসি দে রোডে পাহাড়ের পাদদেশে প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়। পরে ১৯৭৪ সালে এটি বর্তমান রূপ লাভ করে। 

নবনির্মিত সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্সের নকশা করেছে স্থাপত্য অধিদপ্তরের স্থাপত্য বিভাগ। প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে গণপূর্ত বিভাগ।

Also Read: চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের ৩ সমস্যা চিহ্নিত

Also Read: চট্টগ্রামের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ‘দৃশ্যমান’ করার প্রস্তাব

Also Read: নতুন করে গড়তে ভাঙা হল চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার

Also Read: সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স: চট্টগ্রাম শহীদ মিনার ‘আপাতত’ সরানোর প্রস্তাব