সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স প্রকল্পের কাজের জন্য চট্টগ্রামের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ‘সাময়িকভাবে’ সরাতে চায় গণপূর্ত অধিদপ্তর। প্রকল্প শেষ হওয়ার পর একই নকশায় শহীদ মিনারটি তৈরি করে দেওয়ার কথা বলছে সরকারি এই দপ্তর।
Published : 25 Jun 2021, 09:12 PM
গণপূর্ত অধিদপ্তর প্রস্তাব দিয়েছে, প্রকল্পের নির্মাণ কাজ শেষ করতে দেড় বছরের জন্য চট্টগ্রামের কেন্দ্রীয় শহীদ সরিয়ে নিয়ে বিকল্প স্থানে নির্মাণ করে দেবে তারা।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (সিসিসি) মেয়র এম রেজাউল করিম চৌধুরীর সঙ্গে মঙ্গলবার দেখা করে এ প্রস্তাব দেয় সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের প্রকল্পটির পূর্ত কাজের দায়িত্ব পাওয়া গণপূর্ত বিভাগ।
শহীদ মিনার ‘বাঙালির আবেগের স্থান’, তাই এ বিষয়ে স্থানীয় প্রশাসন, রাজনীতিক, মুক্তিযোদ্ধা, সুশীল সমাজের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা বলছেন মেয়র।
তবে আগের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন বলছেন, শহীদ মিনার অক্ষুণ্ন রেখেই প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রস্তাব করেছিলেন তিনি।
আর নকশায় কী আছে তা দেখে এবং প্রয়োজনে তা পরিবর্তন করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার বলে মত চট্টগ্রামের সংস্কৃতিকর্মীদের।
২৩২ কোটি টাকার প্রকল্পটির কাজ শুরু হয় ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে। প্রকল্পের অধীনে মুসলিম ইন্সটিটিউট হল ও পাবলিক লাইব্রেরির অংশের পুরনো স্থাপনা ভেঙে ১৫ তলা গণগ্রন্থাগার ও আট তলা অডিটরিয়াম ভবন নির্মাণ চলছে।
সড়কের বিপরীত পাশে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার অংশে সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স প্রকল্পের আওতায় ২৫০ জন ধারণক্ষমতার একটি উন্মুক্ত গ্যালারিসহ মুক্তমঞ্চ এবং পশ্চিম পাশে নিচতলায় ক্যাফে ও দুই তলায় মিউজিয়াম হবে। মাঝের অংশে শহীদ মিনারই থাকবে।
সড়কের দুই পাশে সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্সের দুই অংশের মধ্যে সংযোগ ঘটাতে রাস্তার ২১ ফুট উপর দিয়ে একটি প্লাজা নির্মাণ করা হবে। এই প্লাজা দিয়ে হেঁটে কমপ্লেক্সের উভয় অংশে চলাচল করা যাবে।
এ কারণেই সেটা সাময়িকভাবে সরাতে চায় গণপূর্ত বিভাগ। শহীদ মিনার অংশের সব কাজ ২০২২ সালের ডিসেম্বরের আগেই শেষ করতে চায় তারা।
গণপূর্তের নির্বাহী প্রকৌশলী রাহুল গুহ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “২০১৮ সালে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে তৎকালীন সংস্কৃতিমন্ত্রীর উপস্থিতিতে সভায় এ বিষয়ে আলোচনা হয়। তখন শহীদ মিনারের নতুন একটি ডিজাইনও করা হয়েছিল।
“সভায় সে সময়ের মেয়র বলেছিলেন, নতুন নকশায় নয় এখন যেরকম শহীদ মিনার আছে সেরকমই করতে। সেভাবেই সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।”
রাহুল গুহ বলেন, “একই স্থানে একই নকশায় শহীদ মিনার থাকবে। কিন্তু কমপ্লেক্সের নকশা অনুসারে বাকি কাজ করতে হলে বর্তমান শহীদ মিনারটি সাময়িকভাবে সরাতে হবে। কমপ্লেক্সের দুই অংশের সংযোগে যে প্লাজা হবে সেটি সড়কের ২১ ফুট উপরে। প্লাজার উচ্চতার সাথে সামঞ্জস্য রেখে নকশা করা হয়েছে। নকশা অনুসারে নির্মাণ কাজের জন্য শহীদ মিনার নতুন করে করতে হবে।”
নতুন নকশায় এখন যেভাবে শহীদ মিনারের পাদদেশে সিঁড়ি আছে তার পরিবর্তে দুই পাশে সিঁড়ি থাকবে।
নির্বাহী প্রকৌশলী রাহুল গুহ বলেন, “শহীদ মিনারের স্থানটি সিটি করপোরেশনের। সেটি রক্ষণাবেক্ষণও তারাই করে। মেয়র মহোদয়কে বলেছি বিভিন্ন সরকারি সংস্থা ও সংশ্লিষ্টদের নিয়ে একটি সভা করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে। তিনি সম্মত হয়েছেন।”
মঙ্গলবারের সভায় মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, শহীদ মিনার বাঙালির আবেগের সাথে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত। চলমান সংস্কৃতিক প্রকল্প বাস্তবায়ন শহীদ মিনার প্রধান অনুষঙ্গ। এই শহীদ মিনারকে ঘিরেই চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক বলয়ের মূল প্রেরণা।
তাই প্রকল্প বাস্তবায়নের স্বার্থেই শহীদ মিনার আপাতত কোথায় স্থানান্তর করা হবে সে ব্যাপারে রাজনীতিক, মুক্তিযোদ্ধা, সাংস্কৃতিক, সুধী ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
“শহীদ মিনারকে ঘিরে সাংবাৎসরিক দিবসমূলক অনুষ্ঠানিকতা চলমান থাকতে পারে। সে দিকে খেয়াল রেখেই প্রকল্প বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষকে নির্দেশনা দেওয়া হবে,” বলেন মেয়র।
এ বিষয়ে সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম মানিক বলেন, “যে নকশা করা হয়েছে সেটি খুব সুন্দর হয়েছে। এই নকশায় শহীদ মিনারটি না সরিয়ে কাজ করার সুযোগ নেই। ভিত্তি, উচ্চতা এবং প্লাজার সমন্বয় ঘটাতে হলে শহীদ মিনার নতুন করে করতে হবে।
“যেহেতু এখানে অতিরিক্ত কোনো জমি নেই। তারা কাছাকাছি মিউনিসিপ্যাল স্কুলের মাঠে অস্থায়ীভাবে একটি শহীদ মিনার করার প্রস্তাব দিয়েছে। সেখানে প্রবেশ ও বের হওয়ার আলাদা পথ আছে, মাঠটিও বড়। জাতীয় দিবসে কর্মসূচি পালনে সমস্যা হবে না।”
সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন বলেন, “তখন যে ডিজাইন করা হয়েছিল তাতে শহীদ মিনারটা অপরিবর্তিত রেখেই করা হয়েছিল। পত্রিকায় দেখলাম শহীদ মিনার সাময়িকভাবে সরানো হবে। কিন্তু শহীদ মিনার না ভেঙে করতেই সভাতে বলেছিলাম। তারা সম্মতও হয়েছিলেন।
সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আহমেদ ইকবাল হায়দার বলেন, “দীর্ঘদিন ধরে সাংস্কৃতিক বলয় নির্মাণের জন্য দাবি জানিয়ে আসলেও নকশা চূড়ান্ত করার বিষয়টি আমরা জানি না। তখনকার সংস্কৃতিমন্ত্রীর উপস্থিতিতে সভায় মেয়রসহ কয়েকজন শহীদ মিনার বিষয়ে করা প্রস্তাবে আপত্তি জানিয়েছিলেন।
“তখন মন্ত্রী আসাদু্জ্জামান নূর বলেছিলেন, শহীদ মিনারের নকশা বদল ঠিক হবে না। এরপর কোন ডিজাইনে কাজ চলছে তা আমাদের জানানো হয়নি। এখন দেখছি পাবলিক লাইব্রেরি ভবনের কাজ দ্রুত হচ্ছে কিন্তু হলের কাজ হচ্ছে ধীরে। জনগণকে তো জানতে হবে কোন নকশায় কী কাজ হচ্ছে।”
শহীদ মিনার এলাকায় কোনো ফুড কোর্ট করা উচিত নয় মন্তব্য করে তিনি বলেন, “শহীদ মিনার সরানোর কথা যে বলা হচ্ছে, কাজ কখন শেষ হবে? পরে যে একই ডিজাইনে হবে, এসবের নিশ্চয়তা কে দেবে? প্রয়োজনে নকশা বদলে এই শহীদ মিনার রাখা যায়। কারণ এটি আমাদের আবেগের অংশ। মেয়র যে সব পক্ষকে নিয়ে সভার কথা বলেছেন তা দ্রুত করা হোক। সেখানে নকশাসহ বিস্তারিত জানানো হোক।”
সিসিসির প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম মানিক জানিয়েছেন, দ্রুততম সময়ের মধ্যে মেয়রের উদ্যোগে ওই সভা আয়োজন করা হবে। সেখানে গণপূর্তের পক্ষ থেকে নকশার বিস্তারিত উপস্থাপন করা হবে।
১৯৬২ সালে নগরীর কেসি দে রোডে পাহাড়ের পাদদেশে প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়। পরে ১৯৭৪ সালে এটি বর্তমান রূপ লাভ করে।
চট্টগ্রামে কোনো স্মৃতি সৌধ না থাকায় একুশে ফেব্রুয়ারি, ১৬ ডিসেম্বর, ২৬ মার্চসহ জাতীয় দিবসগুলোতে এখানেই কর্মসূচি পালন করা হয়।