মহামারীকালের বাজেটে সঙ্কট উত্তরণের দিশা কই?

করোনাভাইরাস মহামারীকালে ৬ লাখ কোটি টাকার যে বাজেট অর্থমন্ত্রী দিয়েছেন, তার অনেক কিছুই অর্থনীতি বিশ্লেষকদের সন্তুষ্ট করতে পারেনি, স্বাস্থ্য খাত নিয়ে পরিকল্পনায় অস্পষ্টতা তার একটি।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 June 2021, 08:14 PM
Updated : 4 June 2021, 03:40 PM

মহামারী মোকাবেলার স্পষ্ট কোনো দিক-নির্দেশনা বাজেটে না দেখে হতাশা প্রকাশ করেছেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর।

প্রতিরক্ষা খাতের (৬.২%) চেয়েও স্বাস্থ্য খাতে (৫.৪%) বরাদ্দ কম রেখেছেন আ হ ম মুস্তফা কামাল। যা দেখে বিএমএর সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশীদ-ই-মাহবুবও হতাশ।

মহামারী রুখতে ‘জরুরি প্রয়োজন’ মেটাতে অতিরিক্ত ১০ হাজার কোটি টাকা রাখার প্রস্তাব হলেও তা যথেষ্ট মনে করছেন না সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন।

অবশ্য গত বছর মহামারীর প্রাদুর্ভাবের পর স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়ালেও তার এক-তৃতীয়াংশও খরচ করতে পারেনি স্বাস্থ্য বিভাগ।

নতুন বাজেটে বরাদ্দ টাকার অংকে আরও কিছুটা বেড়েছে, কিন্তু বাজেট বাস্তবায়নের সামর্থ্য বাড়ানোর কোনো পদক্ষেপ না দেখে হতাশা প্রকাশ করেছেন সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান।

কোভিড-১৯ সঙ্কটকালে দেশে দরিদ্রের তালিকায় যত নতুন মুখ যোগ হয়েছে, তাদের নিয়েও স্পষ্ট কোনো নির্দেশনা পাওয়া যায়নি বাজেটে। উপেক্ষিত থেকেছে মহামারীকালে চাকরি হারিয়ে বেকার হয়ে পড়ারাও।

ফলে ‘জীবন ও জীবিকায় প্রাধান্য দিয়ে সুদৃঢ় আগামীর পথে’ শিরোনামে যে বাজেট মুস্তফা কামাল হাজির করেছেন, তাতে নামের সঙ্গে পরিকল্পনার বিস্তর ফারাক থেকে যাচ্ছে।

অবশ্য রপ্তানিমুখী শিল্পে কর অবকাশসহ নানা সুবিধা ঘোষণা করা হয়েছে, তাতে এটা ভাবার অবকাশ থাকছে যে ব্যবসায়ী অর্থমন্ত্রী বেসরকারি খাতে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করতে চাইছেন।

কিন্তু শিক্ষাখাতে মহামারীর যে প্রভাব পড়েছে, তা থেকে শিক্ষাব্যবস্থাকে টেনে তোলার কোনো দিশা বাজেটে নেই।

তাতে হতাশা প্রকাশ করে গণস্বাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বলেছেন, “এ বাজেট যতখানি ব্যবসা সহায়ক, ততখানি শিক্ষা সহায়ক হয়নি।”

২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করতে বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে জাতীয় সংসদ ভবনে ঢুকছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। ছবি: পিএমও

গত বছর মহামারীর বিরূপ প্রভাব অর্থনীতিতে পড়ার পর সরকারি ব্যয় বাড়িয়ে বাজারে অর্থ সরবরাহের দিকটিতে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছিলেন অর্থনীতিবিদরা।

সেই ধারায় এবারও আগের চেয়ে ১২ শতাংশ বাড়িয়ে ২০২১-২২ অর্থবছরের ব্যয়ের ফর্দ তৈরি করেছেন মুস্তফা কামাল; আর তাতে ২ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকার যে ঘাটতি থাকছে, তা পূরণে জোগান আসা নিয়েও সংশয় রয়েছে অর্থনীতিবিদদের মধ্যে।

মহামারীর হানার মধ্যেও ২০২০-২১ অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ৮ দশমিক ২ শতাংশ ধরেছিলেন অর্থমন্ত্রী। সেটা অর্জিত না হওয়ায় বাস্তবতা মেনে এবার তা ৭ দশমিক ২ শতাংশে নামিয়ে আনলেও তা অর্জন নিয়েও ধন্দ কাটছে না অর্থনীতিবিদদের।

সব মিলিয়ে এবারের বাজেট ‘বাস্তবায়নযোগ্য নয়’ বলেই মনে করছেন জরুরি অবস্থার সময় দুটি বাজেট দেওয়া এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম।

রাজনৈতিক অঙ্গনেও একই সুর এসেছে সংসদে বিরোধীদলীয় উপনেতা জি এম কাদেরের কথায়। তার ভাষায়, ‘আন্দাজে’ করা ‘কল্পনাপ্রসূত, মনগড়া ও অবাস্তব’ এই বাজেট ‘বাস্তবায়নযোগ্য নয়’।

চার্টার্ড অ্যাকাউনটেন্ট মুস্তফা কামাল তার তৃতীয় বাজেটে দিতে গিয়ে আগেরটির খুব একটা নড়চড় করেননি।

যা দেখিয়ে বিএনপি নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, মহামারীকালে এমন ‘গতানুগতিক’ বাজেট জনগণ চায়নি।

অবশ্য ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের চোখে এটি ‘সময়োপযোগী’ বাজেট হিসেবেই ধরা দিয়েছে।

 

বাজেট এক নজরে

আকার: ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা

অর্থ সংস্থান: রাজস্ব বোর্ড কর্তৃক আয়-  ৫৪.৭ শতাংশ

                 রাজস্ব বোর্ড বহির্ভূত কর-  ২.৬ শতাংশ

                 কর বহির্ভূত রাজস্ব আয়-  ৭.১ শতাংশ

                 অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণ- ১৮.৮ শতাংশ

                 বিদেশি ঋণ:   ১৬.২ শতাংশ

জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য: ৭ দশমিক ২ শতাংশ

মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য: ৫ দশমিক ৩ শতাংশ

ব্যয়ের উল্লেখযোগ্য খাত:

                বেতন-ভাতা পরিশোধ- ১৮.৭ শতাংশ

                শিক্ষা ও প্রযুক্তি- ১৫.৭ শতাংশ

                পরিবহন ও যোগাযোগ- ১১.৯ শতাংশ

                ঋণের সুদ পরিশোধ- ১১.৪ শতাংশ

                স্থানীয় সরকার-পল্লী উন্নয়ন- ৭ শতাংশ

                প্রতিরক্ষা- ৬ দশমিক ২ শতাংশ

                সামাজিক নিরাপত্তা- ৫.৭ শতাংশ

                স্বাস্থ্য- ৫ দশমিক ৪ শতাংশ

কোভিড ‘ফোকাস’ কই?

অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল তার বাজেট বক্তৃতায় করোনাভাইরাস মহামারীর এই সময়কে ‘ক্রান্তিকাল’ বলেছেন, কিন্তু তার বরাদ্দের প্রস্তাবে তার প্রতিফলন ঘটেনি।

তিনি আগামী ১২ মাসে ব্যয়ের জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে মোট বরাদ্দ দিতে চাইছেন ৩২ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা। এর সঙ্গে মহামারীকালে জরুরি প্রয়োজন মেটাতে অতিরিক্ত থোক বরাদ্দ ১০ হাজার কোটি টাকা।

টিকার জন্য আলাদা করে কোনো অর্থ না রাখলেও ৮০ ভাগ মানুষকে টিকা আওতায় আনার লক্ষ্যের কথা বলেছেন অর্থমন্ত্রী।

বিএমএর সাবেক মহাসচিব রশীদ-ই মাহবুব মহামারীর মধ্যে এই বরাদ্দ নিয়ে বলেন, “স্বাস্থ্যখাতকে মেরামত করা প্রয়োজন, কিন্তু হয়নি। থোক বরাদ্দের যে ১০ হাজার কোটি টাকা রাখা হয়েছে, তা দিয়ে টিকা ক্রয় ও অন্যান্য কাজ করা যাবে। কিন্তু সাধারণ অর্থে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার জন্য এই বাজেটে সেই অর্থে কোনো বরাদ্দ রাখা হয়নি।”

এই বাজেটের বরাদ্দ আর দৃষ্টিভঙ্গিকে মহামারীর চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ বলে মনে করতে পারছেন না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ।

তিনি বলেন, “দেশের স্বাস্থ্যখাতের একটা পরিবর্তন দরকার, করোনাভাইরাস মহামারী সে সুযোগ তৈরি করে দিয়েছিল। কিন্তু এবারের বাজেটে তার প্রতিফলন নেই।

“(সংস্কারের) কাজটা শুরু করতে হত এখনই। প্রথমে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে হবে। বাজেটে তার প্রতিফলন থাকবে। আমাদের সেই চিন্তা নাই, সেই চিন্তা অনুযায়ী পরিবর্তনেরও কোনো ইনপুট নাই এবং বাজেটও নাই।”

আহসান এইচ মনসুর

পিআরআইর নির্বাহী পরিচালক আহসান মনসুর বলেন, “সরকার বলছে বাজেট কোভিড ফোকাসড। বলছে যে, বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। ভালো কথা।

“যে জিনিসটা মিসিং সেটা হচ্ছে- এক নম্বর, হোয়াট ইজ আওয়ার প্ল্যান টু ট্যাকলড কোভিড? কোনো প্ল্যান আছে? গত বছরও ১০ হাজার কোটি টাকা ভ্যাকসিনেশনের জন্য রাখা ছিল। গত বছরও বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছিল। রেজাল্ট কী?

“আশা করেছিলাম, সরকার আউটলাইন দেবে। কীভাবে ১২ কোটি মানুষকে টিকা দেবে?” প্রশ্ন করেন তিনি।

সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, গত বছরও বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছিল, কিন্তু খরচ করা যায়নি।

“বরাদ্দ খরচ করা কিংবা বাজেট বাস্তবায়ন করার জন্য সুনির্দিষ্ট কী পদক্ষেপ আসছে, সেটা আমরা আশা করেছিলাম।”

স্বাস্থ্য খাতের অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি ও সক্ষমতার অভাব নিয়ে বাজেটে আলোচনার প্রয়োজন ছিল বলে মনে করেন তিনি।

স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দের সঠিক ব্যবহারে উচ্চ পর্যায়ের বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠনের প্রস্তাবও তিনি দিয়েছেন।

সঙ্কটে পড়াদের কী হবে?

মহামারীকালে সঙ্কটে পড়া প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষের সহায়তায় বাড়তি নজর দেওয়ার অংশ হিসেবে সামাজিক সুরক্ষা ও কল্যাণে বরাদ্দ বাড়িয়ে ১ লাখ ৭ হাজার ৬১৪ কোটি টাকা রাখার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী, যা চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের বরাদ্দের তুলনায় ১১ হাজার ৮৪০ কোটি টাকা বেশি।

এই বরাদ্দ বাজেটের ১৭ দশমিক ৮৩ শতাংশ এবং জিডিপির ৩ দশমিক ১১ শতাংশ।

বাজেটে প্রতিবন্ধী, তৃতীয় লিঙ্গ, বেদে, ভূমিহীন দরিদ্র পরিবারসহ পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর সুরক্ষায় সরকারের লক্ষ্য তুলে ধরেছেন মুস্তফা কামাল।

বাজেটের এই 'ফোকাস পয়েন্টগুলোকে' এগিয়ে রেখে মির্জ্জা আজিজ বলেন, “বাজেটের ভালো দিক হচ্ছে- সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনি, কৃষিখাত, কর্মসংস্থান সৃষ্টি- এগুলো সম্পর্কে বলা হয়েছে এবং বরাদ্দও বাড়ানো হয়েছে।”

তবে বরাদ্দের ক্ষেত্রে ফাঁকি ধরা পড়ার কথা জানিয়েছেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন।

তিনি বলেন, “সামাজিক নিরাপত্তা খাতে কিছু বরাদ্দ বেড়েছে। তবে আগের মতোই সেখানে সরকারি কর্মচারীদের পেনশন রয়েছে। তাই এটাকে যত বড় দেখা যাচ্ছে, আসলে এতটা বড় নয়।”

সেলিম রায়হান

সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হলেও সেটি যথেষ্ট নয়।

“মহামারীকালে নতুন করে দরিদ্র্য হয়েছেন যারা, তাদের জন্য বাজেটে বিশেষ কিছু নেই এবং এক্ষেত্রে আরও বিস্তৃতভাবে নগদ ও খাদ্য সহায়তা, বেকার ভাতা দেওয়ার পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেত,” বলেন তিনি।

তিনি বলেন, কর্মসংস্থানের ৮৫ শতাংশই যেই ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পখাতে সেখানে কর্মসংস্থান বাড়ানোর কোনো উদ্যোগ বাজেটে দেখতে পাইনি। অথচ মহামারীতে এই খাতগুলোই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং ব্যাপক কর্মহীনতার সৃষ্টি করেছে।

“বিশেষ করে কোভিডকে বিবেচনায় নিলে বা শ্রম বাজারে বড় ধরনের যে সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে, সেটা সমাধানে স্পষ্ট কিছু বাজেটে দেখিনি।”

জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের বলেন, “যারা করোনাকালে কর্মহীন হয়েছে এবং দারিদ্রসীমার নিচে চলে গেছেন, তাদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি বা তাদের জন্য কিছু বাজেটে নেই।”

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী মনে করেন, বাংলাদেশে নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য যে সহায়তা দেওয়া হচ্ছে, তা এই অঞ্চলের মধ্যে সবচেয়ে কম।

“যারা হতদরিদ্র, দিন আনে দিন খায়, অনানুষ্ঠানিক খাতে যারা কাজ করে, যারা রিকশাওয়ালা, ঠেলাগাড়িওয়ালা, যারা খাবার বিক্রি করে, চা দোকানদার, তারা তো বসে গেছে। তাদের জন্য প্রণোদনা বা ক্যাশ ট্রান্সফার হয়নি।”

সানেমের গবেষণা পরিচালক ড. সায়মা হক বিদিশা বলেন, “বাজেটে শহরের ভাসমান দরিদ্রদের জন্য তেমন কিছুই নেই। যুব এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্যও যথেষ্ট পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। মহামারীর এই সঙ্কটে দুরবস্থায় পড়া নারীদের জন্য সুর্নির্দিষ্ট তেমন কিছু নেই।”

শিক্ষার রথ উঠবে কী করে?

শিক্ষা ও প্রযুক্তিতে প্রস্তাবিত বাজেটে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৯৪ হাজার ৮৭৭ কোটি টাকা, যা গত অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের ২১ শতাংশের মতো বেশি।

বিদায়ী অর্থবছরের বাজেটে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে ৮৫ হাজার ৭৬২ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হলেও সংশোধনে তা ৭৮ হাজার ৬৮৪ কোটি টাকায় নেমে আসে।

আগামী অর্থবছরের জন্য প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়কে ২৬ হাজার ৩১১ কোটি টাকা, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগকে ৩৬ হাজার ৪৮৬ কোটি টাকা এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা বিভাগকে ৯ হাজার ১৫৪ কোটি ৬০ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে সরকার।  

তবে গত ১৪ মাসে শিক্ষাখাতে মহামারীর যে প্রভাব পড়েছে, তা থেকে শিক্ষাব্যবস্থাকে টেনে তুলতে বড় বিনিয়োগ আর সংস্কার প্রয়োজন ছিল বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম

শিক্ষাখাতে বরাদ্দ বাড়লেও সেটাকে বাড়তি গুরুত্ব দিতে নারাজ মির্জ্জা আজিজ। তিনি বলেন, “শিক্ষাখাতে বরাদ্দ বাড়ালেই যে মানোন্নয়ন হবে, সেটা বলা মুশকিল। এগুলো তো টাকার অঙ্কে মাপা যায় না।”

আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের শিক্ষা খাত জিডিপির ৬ শতাংশ বা বাজেটের ২০ শতাংশ বরাদ্দ পেলে তা আদর্শ ধরা হয়। অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল তার বাজেটে আগামী অর্থবছরে শিক্ষা ও প্রযুক্তিতে যে বরাদ্দের প্রস্তাব করেছেন, তা জিডিপির ২.৭৫ শতাংশ।

গণস্বাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরীর ভাষায়, শিক্ষাব্যবস্থায় 'পুনরুদ্ধার কার্যক্রম' চালাতে যে বরাদ্দ প্রয়োজন ছিল, তার দিশা বাজেটে পাওয়া যায়নি।

“শিক্ষায় গত দেড় বছরে যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে এবং ক্ষতি হয়ে চলেছে, সেই ক্ষতি থেকে পুনরুদ্ধারের জন্য সরকারের মন্ত্রণালয়গুলোর পরিকল্পনা ছিল। সেই পুনরুদ্ধার পরিকল্পনার জন্য যে বরাদ্দের প্রয়োজন, সেই প্রতিফলন এই বাজেটে হয়নি।”

ব্যবসাবান্ধব?

প্রস্তাবিত বাজেটে বিরাট ছাড় এসেছে করপোরেট করের ক্ষেত্রে, যা ছিল ব্যবসায়ীদের দীর্ঘদিনের দাবি। তালিকাভুক্ত ও অতালিকাভুক্ত কোম্পানির ক্ষেত্রে করপোরেট কর নামিয়ে আনা হয়েছে আড়াই শতাংশ করে।

এছাড়া ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ ব্র্যান্ডের তৈরির লক্ষ্যে ভারী শিল্পের ক্ষেত্রে কর অবকাশ সুবিধা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী।

বাংলাদেশে বিশ্ব ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, “বাজেট ব্যবসাবান্ধব। তবে সব ব্যবসা নয়।

“করপোরেট ট্যাক্স রেট কমানোর বিষয়ে অনেকদিন ধরেই সবাই একমত ছিল। এই যে আড়াই শতাংশ কমানো হলো সেটা ঠিক পথেই আছে। কিন্তু এটা কাদের উপকারে আসবে? সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজলে আপনি পাবেন যে যারা বড় ব্যবসায়ী তাদের উপকার হবে।”

মহামারীকালে রাজস্ব আদায় তলানিতে ঠেকায় অর্থ আহরণে দ্রুত বর্ধিষ্ণু মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস কোম্পানিগুলোর উপর নতুন করে ৫ থেকে সাড়ে ৭ শতাংশ কর আরোপ করতে চাইছেন।

জাহিদ হোসেন

জাহিদ হোসেন বলেন, “মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসে কর বাড়ানোটার যৌক্তিকতাও বোঝা গেল না। এটা অলরেডি ৩২ এর ওপরে ছিল। প্রয়োজন ছিল ৩০ এর নিচে নামিয়ে আনা। এটা ৪০ শতাংশে নিয়ে যাওয়াটা কেমন হয়ে গেল।”

“যখন এমএফএস করোনা মোকাবেলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। ই কমার্সের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে। মানুষ লেনদেন করছে। সেখানে হঠাৎ করে এটার পেছনে অর্থনৈতিক যুক্তিটা কী?” বলেন তিনি।   

দরিদ্র মানুষদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের কারণে এই পদক্ষেপের সঙ্গে একমত না হওয়ার কথা বলেন আহসান মনসুরও।

“মোবাইল ব্যাংকিং সার্ভিসটা হচ্ছে দরিদ্র লোকদের ফাইন্যান্সের সাথে সম্পৃক্ত করার একটা মাধ্যম। এটা একটা ডেভেলপিং ইন্ডাস্ট্রি। এটাতে প্রচুর বিনিয়োগ লাগবে, ফরেন ইনভেস্টমেন্ট লাগবে।”

দেশীয় শিল্পের জন্য কিছু করছাড় দেওয়া হলেও বাজেটে দীর্ঘমেয়াদী নীতি নির্ধারণ হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন সেলিম রায়হান।

তিনি বলেন, “বিনিয়োগের ব্যাপারগুলো দীর্ঘমেয়াদী ব্যাপার। এগুলো শুধু ভ্যাট-ট্যাক্সের ওপর নির্ভর করে না। দীর্ঘমেয়াদে এখানে নীতি নির্ধারণ করা প্রয়োজন। সেগুলো বাজেটে ছিল না।”

বাস্তবায়নযোগ্য?

বিশাল ঘাটতির বাজেটে অর্থ সংস্থান কীভাবে হবে, বাস্তবায়ন কীভাবে হবে, সেটাই বড় প্রশ্ন হয়ে উঠেছে; যেখানে মহামারীর কারণে আগামী অর্থবছরেও যে অর্থনীতি স্বাভাবিক হবে না, সেই শঙ্কার কথা বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী নিজেই বলেছেন।

প্রস্তাবিত বাজেটে রাজস্ব খাতে আয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা। এই অঙ্ক বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত রাজস্ব আয়ের প্রায় ১১ শতাংশ বেশি।

বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।

আয় ও ব্যয়ের হিসাবে সামগ্রিক ঘাটতি থাকছে ২ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকার মত, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় ঘাটতির এই পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে ৬.২ শতাংশের মতো।

গত এক যুগে সরকার ঘাটতির পরিমাণ জিডিপির ৫ শতাংশের মধ্যে রেখে বাজেট প্রণয়নের চেষ্টা করলেও মহামারীর সঙ্কটে প্রণোদনার টাকা জোগানোর চাপ থাকায় গতবার তা ৬ দশমিক ১ শতাংশে পৌঁছায়। এবার তা আরও বেড়ে ৬ দশমিক ২ শতাংশ হল।

এবারের বাজেটের ছয় লাখ কোটি টাকা খরচ করতে হলে অর্থমন্ত্রীকে এর এক-তৃতীয়াংশই ঋণ করতে হবে। সেজন্য বিদেশ থেকে ১ লাখ ১ হাজার ২২৮ কোটি টাকা এবং অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ১ লাখ ১৩ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকা ঋণ করার পরিকল্পনা জানিয়েছেন কামাল।

রাজনীতিবিদ জি এম কাদের বলছেন, এই বাজেট সরকার বাস্তবায়নই করতে পারবে না। বিশাল ঘাটতি পূরণে যে ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে, তা বাস্তবসম্মত নয়। ফলে এই বাজেট ব্যাপকভাবে সংশোধন বা রদবদল করতে হবে।

“বাজেটের ঘাটতি পূরণে বিদেশি ঋণ, স্বল্প সুদে ঋণ এবং বিভিন্ন খাত থেকে অর্থ প্রাপ্তির যে কথা বলা হয়েছে, তা সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। রাজস্ব প্রাপ্তিতে যেমন বিশাল সমস্যা হতে পারে, তেমনিভাবে বাজেট অনুযায়ী অর্থায়নেও সমস্যা হতে পারে।”

জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে ফাহমিদা খাতুন বলেন, “৭ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হলে আগামী অর্থবছরে অনেক বেশি বিনিয়োগ হতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ না বাড়লে প্রবৃদ্ধি কোথা থেকে হবে, তা বাজেটে স্পষ্ট নয়।”

রাজস্ব আহরণের উচ্চাকাঙ্ক্ষী লক্ষ্য নিয়ে সেলিম রায়হান বলেন, আগামী অর্থ বছরে ট্যাক্স জিডিপি প্রাক্কলন করা হচ্ছে ১১ দশমিক ৩ শতাংশ হারে, যেটা বাংলাদেশের ইতিহাসে কখনও হয়নি।

“অতীতের পর্যালোচনার আলোকে এটা আমার কাছে অনেক বেশি এবং অবাস্তব মনে হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে ট্যাক্স থেকে এত বড় রাজস্ব আদায় করা সম্ভব নয়।”

দেশীয় ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে প্রায় ৮৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ নেওয়ার যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছেন অর্থমন্ত্রী, দেশে ব্যাংকিং খাতের সঙ্কটের এই সময়ে তাও সম্ভব হবে কি না, সন্দেহ রয়েছে তার।

এই পরিস্থিতিতে ব্যয় কমাতে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতা কাটা এবং অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পে অর্থায়ন কমিয়ে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন সেলিম রায়হান।

করোনাভাইরাস সংক্রমণ এড়াতে বাজেট উপস্থাপনের সময় সংসদে ঢোকার সুযোগ না পেয়ে বাজেটের তথ্যাবলির বই নিয়ে বেরিয়ে আসেন গণমাধ্যমকর্মীরা। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

রাজস্ব আহরণ বাড়ানোর ক্ষেত্রে সরকারের কোনো পদক্ষেপ না দেখার কথা বলেন আহসান মনসুর।

বাজেট ঘাটতি নিয়ে চিন্তিত না হলেও মির্জ্জা আজিজ বলেন, “আমার মনে হয়, আমাদের প্রশাসনিক যন্ত্রে বাজেট বাস্তবায়নের যে দক্ষতা রয়েছে, সেটাকে পরিপূর্ণভাবে বিবেচনায় নেওয়া হয়নি।”

আর সার্বিক বাজেট নিয়ে সেলিম রায়হান বলেন, “অর্থমন্ত্রীর হয়ত আন্তরিকতার অভাব নেই। বাস্তবতা বিবেচনার একটা প্রচেষ্টাও হয়ত ছিল। কিন্তু করোনাকালীন প্রত্যাশার সঙ্গে বাজেটের বড় ডিসকানেক্ট দেখা গেছে।

“বিশেষ করে বর্তমান যে কঠিন সময় যাচ্ছে, তার একটা মূল্যায়ন বাজেটে থাকার প্রয়োজন ছিল। কারণ মূল্যায়ন ছাড়া কিভাবে রিমেডি মেজারগুলো হতে পারে? সেখানে বড় ধরনের গ্যাপ আছে।”

বাজেটের আরও খবর