বাজেট: ঘুরে দাঁড়ানোর বরাদ্দ শিক্ষায় 'আসেনি'

আসছে নতুন অর্থবছরের বাজেটে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে টাকার অঙ্কে বরাদ্দ কিছুটা বাড়লেও মহামারীর মধ্যে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য তা ‘যথেষ্ট নয়’ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 June 2021, 04:17 PM
Updated : 3 June 2021, 04:17 PM

তারা বলছেন, গত ১৪ মাসে শিক্ষাখাতে মহামারীর যে প্রভাব পড়েছে, তা থেকে শিক্ষাব্যবস্থাকে টেনে তুলতে বড় বিনিয়োগ আর সংস্কার প্রয়োজন ছিল। সেই সঙ্গে বিশেষ প্রণোদনাও সুফল দিত, যার কোনো দিশা বাজেটে নেই।  

গণস্বাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরীর ভাষায়, “এ বাজেট যতখানি ব্যবসা সহায়ক, ততখানি শিক্ষা সহায়ক হয়নি।”

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বৃহস্পতিবার যে বাজেট প্রস্তাব জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করেছেন, তাতে শিক্ষা  ও প্রযুক্তিতে বাজেটে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৯৪ হাজার ৮৭৭ কোটি টাকা, যা গত অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের ২১ শতাংশের মত বেশি।

গেল অর্থবছরের বাজেটে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে ৮৫ হাজার ৭৬২ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হলেও সংশোধনে তা ৭৮ হাজার ৬৮৪ কোটি টাকায় নেমে আসে।

আগামী অর্থবছরের জন্য প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়কে ২৬ হাজার ৩১১ কোটি টাকা, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগকে ৩৬ হাজার ৪৮৬ কোটি টাকা এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা বিভাগকে ৯ হাজার ১৫৪ কোটি ৬০ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে সরকার। 

আর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে ২১ হাজার ২০৪ কোটি টাকা এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিতে ১৭২০ কোটি টাকা রাখা হয়েছে।

সব মিলিয়ে শিক্ষা ও প্রযুক্তিতে বরাদ্দের অংক দাঁড়াচ্ছে মোট বাজেটের ১৫.৭ শতাংশের মত, যা গত অর্থবছরের মূল বাজেটে ১৫.১ শতাংশ ছিল। অর্থাৎ, মোট বাজেটের অনুপাতে বরাদ্দ সেভাবে বাড়েনি।   

আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের শিক্ষা খাত জিডিপির ৬ শতাংশ বা বাজেটের ২০ শতাংশ বরাদ্দ পেলে তা আদর্শ ধরা হয়। অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল তার বাজেটে আগামী অর্থবছরে শিক্ষা ও প্রযুক্তিতে যে বরাদ্দের প্রস্তাব করেছেন, তা জিডিপির ২.৭৫ শতাংশ।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী মনে করেন, শিক্ষাব্যবস্থায় 'পুনরুদ্ধার কার্যক্রম' চালাতে যে বরাদ্দ প্রয়োজন ছিল, তার দিশা বাজেটে পাওয়া যায়নি। 

“স্বাভাবিকভাবেই করোনা বিপর্যয়ের বিষয়টি মাথায় রেখে সরকার জীবন, জীবিকা, কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্যের ওপর গুরুত্ব দিয়েছে। এটি যতখানি ব্যবসা সহায়ক, ততখানি শিক্ষা সহায়ক হয়নি।

“শিক্ষায় গত দেড় বছরে যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে এবং ক্ষতি হয়ে চলেছে, সেই ক্ষতি থেকে পুনরুদ্ধারের জন্য সরকারের মন্ত্রণালয়গুলোর পরিকল্পনা ছিল। সেই পুনরুদ্ধার পরিকল্পনার জন্য যে বরাদ্দের প্রয়োজন, সেই প্রতিফলন এই বাজেটে হয়নি।"

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ায় গত বছরের ১৭ মার্চ থেকে দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। পরিস্থিতি 'খুব বেশি প্রতিকূল না হলে' আগামী ১৩ জুন থেকে স্কুল-কলেজ খুলে দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। 

টাকার অংকে এবার শিক্ষাখাতে যে বরাদ্ধ বেড়েছে, তাকে যথেষ্ট মানতে নারাজ গণস্বাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “একদিকে শিক্ষা খাতের পুনরুদ্ধার ও ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া এবং অন্যদিকে শিক্ষাখাতে বাংলাদেশের অর্জনগুলো ধরে রাখার জন্য শিক্ষা খাতে এই কয়েক হাজার কোটি টাকার বাজেট বাড়ানো যথাযথ হয়নি বলে আমি মনে করি।”

তিনি বলেন, বিভিন্ন খাতের জন্য বাজেটে নানা ধরনের কথা এসেছে। শিক্ষা খাত যে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে,তাতে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান- এই চার দিক মাথায় রেখে প্রণোদনার ঘোষণা থাকা উচিত ছিল।

“কিন্তু সেটা আসে নাই। এই বাজেটের ফলে জীবনও চলবে, জীবিকাও বাড়বে, কর্মসংস্থানও হবে। কিন্তু মানব সক্ষমতা বিনির্মাণে শিক্ষায় বিনিয়োগ যদি যথাযথ না হয়, তাহলে কোন উন্নয়নই টেকসই হবে না।"

প্রত্যাশিত বরাদ্দ না আসায় শিক্ষা খাতের সফলতাগুলো চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে বলেও মনে করছেন রাশেদা কে চৌধুরী।

“বলা হচ্ছে, মানবসম্পদ উন্নয়নে সবচেয়ে বড় বরাদ্দ রাখা হয়েছে, সেটা একটা শুভঙ্করের ফাঁকির মত। আসলে শিক্ষায় বরাদ্দ মাত্র কয়েক দশমিক শতাংশ বেড়েছে। করোনাভাইরাসের এই মহামারীর সময়ে শিক্ষা খাতে যে কঠিন বাস্তবতা দেখা দিয়েছে, তার তুলনায় এটা একেবারেই নগণ্য। আমাদের শিক্ষাখাতের অর্জনগুলো তাহলে ধরে রাখব কী করে?”

বাজেটে শিক্ষা খাতে যেসব বিষয়ে গুরুত্ব

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিত করা ও দক্ষ বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা প্রসারে নজর দেওয়ার কথা জানিয়েছেন।

বাজেট বক্তৃতায় তিনি বলেন, "অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার শিক্ষা খাতের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে প্রাধান্য দেব ও গুরুত্ব অনুযায়ী প্রয়োজনীয় বরাদ্দও রাখছি। পাশাপাশি ব্যয়ের সক্ষমতা বৃদ্ধির ও তা পরিবীক্ষণের দিকেও আমরা গুরুত্ব দেবো।"

প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী, স্কুলের প্রতি শিক্ষার্থীকে বছরের শুরুতে কিট এ্যালাউন্স (ড্রেস, জুতা ও ব্যাগ) বাবদ প্রাথমিকভাবে ১ হাজার টাকা এবং উপবৃত্তির মাসিক হার ১০০ টাকার পরিবর্তে ১৫০ টাকা প্রদান করতে এবার বাড়তি বরাদ্দ রাখা হয়েছে।

"এজন্য বর্তমান অর্থবছরে ৩ হাজার ৭১২ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছি আমরা, যার মধ্যে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা কিট এ্যালাউন্স বাবদ এবং অবশিষ্ট টাকা উপবৃত্তি বাবদ ব্যয় হচ্ছে।"

অর্থমন্ত্রী জানান, পর্যায়ক্রমে দেশের সকল উপজেলা বা থানার সকল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চালু করার লক্ষ্যে জাতীয় স্কুল মিল নীতিমালা অনুযায়ী আগামী জুলাই থেকে ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত মেয়াদে 'প্রাইমারি স্কুল মিল প্রকল্প' শীর্ষক নতুন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে।

বাজেট বক্তৃতায় আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, "শিক্ষা ক্ষেত্রে আঞ্চলিক বৈষম্য কমিয়ে আনার অংশ হিসেবে হাওর এলাকায় নির্ধারিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের উন্নয়ন প্রকল্পের বাস্তবায়ন চলতি অর্থবছরে শুরু করা হয়েছে, যা আগামী অর্থবছরেও অব্যাহত থাকবে।"

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিভিত্তিক শিক্ষা নিশ্চিতে ২০২১-২০২২ অর্থবছরে ২.১০ লক্ষ শিক্ষককে এবং আইসিটি বিষয়ে ২.৭৫ লক্ষ শিক্ষককে প্রশিক্ষণ প্রদান করবে সরকার।

মন্ত্রী বলেন, "নির্ধারিত বেসরকারি কলেজসমূহের উন্নয়ন আরো ১৬০টি উপজেলায় আইসিটি ট্রেনিং ও রিসোর্স সেন্টার স্থাপন এবং সমন্বিত শিক্ষা তথ্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি প্রণয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হবে।"

মন্ত্রী জানান, সরকারি কলেজে বিজ্ঞান শিক্ষার সুযোগ সম্প্রসারণে প্রকল্প ও সারা দেশে ৩২৩টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও শিক্ষার গুণগতমান বৃদ্ধির লক্ষ্যে কার্যক্রমের বাস্তবায়ন চলমান রয়েছে।

"এতে কলেজ পর্যায়ে অতিরিক্ত প্রায় ২ লক্ষ ও মাধ্যমিক পর্যায়ে অতিরিক্ত ৩.২৯ লক্ষ শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ সৃষ্টি হবে।"

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এবি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম বলেন, শুধু বরাদ্দ নয়, এর পাশাপাশি অন্যান্য দিকেও নজর দিতে হবে।

“শিক্ষাখাতে বরাদ্দ বাড়ালেই যে মানোন্নয়ন হবে, সেটা বলা মুশকিল। এগুলো তো টাকার অঙ্কে মাপা যায় না।”