কিন্তু টাকার অংকে তিনি যে বরাদ্দের কথা জানালেন, তাতে গেল অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের চেয়ে ব্যয় বাড়ল ৪ শতাংশ।
‘জীবন-জীবিকায় প্রাধান্য দিয়ে’ ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য অর্থমন্ত্রী ৬ লাখ কোটি টাকার যে বাজেট প্রস্তাব বৃহস্পতিবার সংসদে তুললেন, তার ৫ দশমিক ৪ শতাংশ থাকল স্বাস্থ্য খাতের জন্য।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মহমারীর বাস্তবতায় স্বাস্থ্যের এই বরাদ্দ প্রত্যাশা কিংবা প্রয়োজন, কোনোটার সঙ্গেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। স্বাস্থ্য খাতের সংস্কারের জন্যও কোনো দিক নির্দেশনা তারা বাজেটে পাননি।
বাজেটে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জন্য মোট বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৩২ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা। এর সঙ্গে ‘মহামারীকালে জরুরি প্রয়োজন মেটাতে’ ১০ হাজার কোটি টাকা থোক বরাদ্দের প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী।
গত অর্থবছরও মুস্তফা কামালাকে বাজেট দিতে হয়েছিল মহামারীর বাস্তবতা মাথায় রেখে, তাতে স্বাস্থ্য খাত বরাদ্দ পেয়েছিল ২৯ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা। পরে সংশোধনে তা বেড়ে ৩১ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা হয়। জরুরি চাহিদা মেটানোর জন্য গেল বাজেটেও তিনি ১০ হাজার কোটি টাকার থোক বরাদ্দ রেখেছিলেন।
মূল বরাদ্দের হিসাবে তার এবারের স্বাস্থ্য বাজেটে টাকার অংকে বরাদ্দ বেড়েছে ১ হাজার ২৫৯ কোটি টাকা, অর্থাৎ ৪ শতাংশ। গেল অর্থবছরের স্বাস্থ্য বরাদ্দের আকার ছিল মূল বাজেটের ৫ দশমিক ১ শতাংশ, এবার তা ৫ দশমিক ৪ শতাংশ হয়েছে।
করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। ছবি: পিএমও
কিন্তু তার বাজেট থেকে স্বাস্থ্য খাতের জন্য খুব বেশি আশার আলো দেখতে পাচ্ছেন না এ খাতের বিশেষজ্ঞরা।
স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলন সম্পর্কিত জাতীয় কমিটির চেয়ারম্যান এবং বিএমএর সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই-মাহবুব বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, স্বাস্থ্যখাতের বরাদ্দে তার প্রত্যাশা পূরণ হয়নি।
“গত বছর স্বাস্থ্যে বরাদ্দ ছিল ২৯ হাজার কোটি টাকার বেশি, সংশোধিত বাজেট দাঁড়ায় ৩১ হাজার কোটি টাকায়। তার মানে যেটা বেড়েছে তাতে বাজারে জিনিসপত্রের যে দাম হবে, সেটা ইনফ্লেশনেই চলে যাবে। যদি অন্যভাবে চিন্তা করি, বাজেটে স্বাস্থ্যের জন্য বরাদ্দ জিডিপির ১ শতাংশও হয় নাই।”
ডা. রশিদ-ই-মাহবুবের ভাষায়, দেশের স্বাস্থ্যখাতের বর্তমান কাঠামো ‘অনেক বেশি পুরোনো’, যা ঢেলে সাজানোর দিক নির্দেশনা বাজেটে আসবে বলে তিনি আশা করেছিলেন।
“স্বাস্থ্যখাতকে মেরামত করা প্রয়োজন, কিন্তু হয়নি। থোক বরাদ্দের ১০ হাজার কোটি টাকা রাখা হয়েছে তা দিয়ে টিকা ক্রয় ও অন্যান্য কাজ করা যাবে। কিন্তু সাধারণ অর্থে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার জন্য এই বাজেটে সেই অর্থে কোনো বরাদ্দ রাখা হয়নি।”
নতুন অর্থবছরের বাজেটে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের জন্য ২৫ হাজার ৯১৪ কোটি টাকা রাখা হয়েছে। এর মধ্যে ১২ হাজার ৯১৪ কোটি টাকা ব্যয় হবে বেতনভাতা ও অন্যান্য খাতে, ১৩ হাজার কোটি রাখা হয়েছে উন্নয়ন খাতে।
স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের বরাদ্দ ৬ হাজার ৮১৭ কোটি টাকার মধ্যে বেতনভাতা ও অন্যান্য খাতে ৪ হাজার ২৫৯ কোটি টাকা যাবে। ২ হাজার ৫৫৮ কোটি টাকা রাখা হয়েছে উন্নয়ন বরাদ্দ।
এবার টিকার জন্য আলাদা কোনো বরাদ্দ না রাখলেও অর্থমন্ত্রী বলেছেন, নতুন অর্থবছরে টিকা কেনার জন্য এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক থেকে ৯৪০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পাওয়ার লক্ষ্য ঋণচুক্তি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। পাশাপাশি ইউরোপিয়ান ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক এবং এআইআইবি থেকে টিকা কেনার জন্য সহায়তা পাওয়া যেতে পারে।
তবে এই বাজেটের বরাদ্দ আর দৃষ্টিভঙ্গিকে মহামারীর চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ বলে মনে করতে পারছেন না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “দেশের স্বাস্থ্যখাতের একটা পরিবর্তন দরকার, করোনাভাইরাস মহামারী সে সুযোগ তৈরি করে দিয়েছিল। কিন্তু এবারের বাজেটে তার প্রতিফলন নেই।
“কাজটা শুরু করতে হত এখনই। প্রথমে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে হবে। বাজেটে তার প্রতিফলন থাকবে। আমাদের সেই চিন্তা নাই, সেই চিন্তা অনুযায়ী পরিবর্তনেরও কোনো ইনপুট নাই এবং বাজেটও নাই।”
আবদুল হামিদের ভাষায়, সরকার কোভিড ব্যবস্থাপনাকে গুরুত্ব দিয়েছে, স্বাস্থ্যখাতকে নয়।
“স্বাস্থ্যের যে বহুমাত্রিক যে দিক আছে, সেটাকে পরিবর্তনের জন্য যে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন ছিল তা দেওয়া হয়নি।”
থোক বরাদ্দ হিসেবে রাখা অর্থ কোথা থেকে আসবে সেই উৎসও ঠিক করে রাখার ওপর জোর দেন স্বাস্থ্য অর্থনীতির এই অধ্যাপক।
“যখন দরকার হয় তখন যেন টাকাটা পেয়ে যায়। সেই অর্থ যদি সুষ্ঠুভাবে খরচ করা হয়, যদি দুর্নীতি কম হয়, তাহলে আমি মনে করি কোভিড-১৯ ব্যবস্থাপনায় একটা গতি আসতে পারে।”
আরও যা থাকছে
এবারের বাজেটে স্বাস্থ্যখাতে বেশকিছু বিষয়ে কর অব্যাহতি সুবিধা দেওয়া হয়েছে।
নারীর স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদিত স্যানিটারি ন্যাপকিনের ওপর প্রযোজ্য সব ধরেন ভ্যাট অব্যাহতির প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী।
স্যানিটারি ন্যাপকিন ও ডায়াপার উৎপাদনের জন্য কিছু কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে বিদ্যমান ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা ২ বছরের জন্য বাড়ানো হয়েছে।
কোভিড-১৯ টেস্ট কিট, পিপিই এবং ভ্যাকসিন আমদানি, উৎপাদন ও ব্যবসায়ী পর্যায়ে ভ্যাট অব্যাহতির সুবিধা বহাল রাখা হয়েছে।
অটিজম সেবার কার্যক্রমের ওপর ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য মেডিটেশন সেবার উপর ভ্যাট অব্যাহতি আরো ১ বছর বাড়ানোর ঘোষণা এসেছে বাজেটে।
করোনাভাইরাস টেস্টিং কিট, বিশেষ ধরনের মাস্ক ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার, মাস্ক ও পিপিই উৎপাদনে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানির উপর প্রযোজ্য শুল্ককর আগেই মওকুফ করা হয়েছে।
আরটি-পিসিআর কিট তৈরিতে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধার মেয়াদ ২০২২ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী।
হৃদযন্ত্রে ত্রুটি নিয়ে জন্ম গ্রহণকারী শিশুদের চিকিৎসায় ব্যবহৃত ইমপ্ল্যান্টেবল অক্লুডার আমদানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেওয়ারও প্রস্তাব এসেছে বাজেটে।
ওষুধ শিল্পের সুরক্ষায় স্থানীয়ভাবে এপিআই উৎপাদনের জন্য কিছু কাঁচামাল বিদ্যমান রেয়াতি সুবিধায় অন্তর্ভুক্ত করারও প্রস্তাব দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী।