“আগে বিনিয়োগকারীদের নিয়ে ভাবতে হবে। এটা না করে অন্য যাই করুক পুঁজিবাজারে আস্থা ফিরবে না,” বলেন হতাশ এক বিনিয়োগকারী।
Published : 17 Nov 2024, 01:27 AM
সরকার পতনের পর পুঁজিবাজারে চার কর্মদিবস উত্থান দেখে বিনিয়োগ করে নতুন করে বিপাকে পড়েছেন অনেক বিনিয়োগকারী। তাদের টাকা আটকে গেছে, প্রায় প্রতিদিনই কমছে এর আকার।
এরপর থেকে বাজারে একদিন সূচক বাড়লে তিন দিন কমে, অল্প সংখ্যক কোম্পানির শেয়ারদরে ঊর্ধ্বগতির বিপরীতে অর্ধেকেরও নিচে নেমে গেছে বহু কোম্পানির দর।
২০১০ সালের মহাধসের ক্ষত প্রায় দেড় দশক ধরে বয়ে বলা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের আস্থা এখন তলানিতে। এ থেকে উত্তরণের পথ কী- এই প্রশ্নে বাজারের সঙ্গে জড়িতদের পরামর্শও সুনির্দিষ্ট নয়।
এ অবস্থায় বিনিয়োগকারীরা মিছিল, বিক্ষোভে নিজেদের মনোভাব প্রকাশ করছেন, যা বাজারে আত্মবিশ্বাস ফেরানোর ক্ষেত্রে আরেক অন্তরায় হিসেবে দেখা হচ্ছে।
অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, যার অনেকগুলোই বিনিয়োগকারীদের আতঙ্কিত করেছে, যাকে দেখা হচ্ছে নতুন সংকট হিসেবে।
নাম প্রকাশ না করে একজন বিনিয়োগকারী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘‘হঠাৎ করে ২৭ কোম্পানিকে ‘জেড’ এ পাঠাল। দোষ তো কোম্পানির। বিনিয়োগকারীদের তো কোনো দোষ ছিল না। তাদের (বিএসইসি) সিদ্ধান্তে তো আমার অনেক শেয়ারের দাম ৪০ শতাংশ পর্যন্ত কমে গেছে।”
তার ভাষ্য, “বিনিয়োগকারীদের ক্ষতি হয় এমন সিদ্ধান্ত নিলে বাজার তো পড়বেই। আগে বিনিয়োগকারীদের নিয়ে ভাবতে হবে। এটা না করে অন্য যাই করুক পুঁজিবাজারে আস্থা ফিরবে না।”
আরেক বিনিয়োগকারী রঞ্জন দাস বলেন, ‘‘নতুন কমিশনের এই কয় মাসে কয়েকটা কোম্পানির শেয়ারের দাম তো অনেক বেড়েছে, কারণ কিন্তু কেউ জানে না। এগুলা নিয়ে অনেক গুঞ্জন আছে।''
বাজার নিয়ে যে টাস্কফোর্স গঠন হয়েছে, তারা কী করছে, সেটিও ‘স্পষ্ট নয়’, ভাষ্য তার।
সংকট উত্তরণে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার সক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি তালিকাভুক্ত কোম্পানির ‘ছল-চাতুরি’ বন্ধ করার পরামর্শ দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ শাহাদাত হোসেইন সিদ্দিকী।
স্টক ব্রোকারদের সমিতি ডিবিএর সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেছেন, “সরকারের পক্ষ থেকে দৃশ্যমান উদ্যোগ প্রয়োজন। স্বতন্ত্র কমিটি গঠন করে পুঁজিবাজারের অনিয়মগুলো চিহ্নিত করা হোক।”
বাংলাদেশের পুঁজিবাজার নিয়ে বহু বছর ধরে আলোচনা যে, এখানে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর অভাব, ব্যক্তিশ্রেণির বিনিয়োগকারীরা কোম্পানির ব্যবসায়িক পরিস্থিতি বিবেচনা না করেই বিনিয়োগ করেন। দর যখন বাড়তে থাকে, তখন তারা শেয়ার কেনে, আবার দর যখন কমে তখন দেখা দেয় বিক্রির প্রবণতা।
বিনিয়োগ শিক্ষার এই অভাবের পাশাপাশি আছে কারসাজি থেকে শুরু করে অন্য সংকট। কিন্তু বছর যায়, সেই সমস্যার আর সমাধান হয় না।
অপরদিকে অর্থনীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশের পুঁজিবাজার এগোতে পারেনি কখনও। ২০২০ সালে করোনাভাইরাস মহামারী ছিল আরেক ধাক্কা।
সেই ধাক্কা সামলে ওই বছরের শেষ প্রান্তিক থেকে টানা এক বছর বিনিয়োগকারীদের জন্য ছিল সুসময়।
তবে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেইন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে আরও অবনতি হয় পরিস্থিতির। ডলার সংকট, রিজার্ভ ক্ষয়, মূল্যস্ফীতির লাফ, কোম্পানির লোকসান, রাজনৈতিক অস্থিরতা, সরকার পতন, সুদহার লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকা, বিনিয়োগে মন্দা- সব মিলিয়ে এখন অর্থনীতির জন্যই কঠিন সময়, এই পরিস্থিতি পুঁজিবাজারের জন্য আরও চ্যালেঞ্জের।
আরও পড়ুন: পুঁজিবাজার: ‘মেয়াদ’ ফুরাচ্ছে বিদ্যুৎকেন্দ্রের; এরপর কী সেই প্রশ্নে বেকায়দায় বিনিয়োগকারীরা
এমন অবস্থার মধ্যে দুর্বল ও রুগ্ন কোম্পানিকে সবল দেখিয়ে তালিকাভুক্তি করে শত শত কোটি টাকা তোলার পর মুনাফায় থাকা কোম্পানিগুলো লোকসানিতে পরিণত হওয়ার কাহিনীও সামনে আসছে।
আবার নির্ধারিত মেয়াদকালের বিদ্যুৎ কোম্পানি প্রিমিয়াম দিয়ে বাজারে তালিকাভুক্তি করা হয়েছে। বুক বিল্ডিংয়ের নামে যে দরে কোম্পানিকে তালিকাভুক্ত হয়েছে বাজারে লেনদেন শুরুর পর ওই দর ধরে রাখতে পারেনি শেয়ার।
আবার শক্তিশালী মৌলভিত্তির অনেক কোম্পানি যে মুনাফা দেখায়, তা তাদের ব্যবসার গতির সঙ্গে মানানসই নয়; কিন্তু এসব বিষয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো কখনও গা করেনি।
আশা দেখিয়ে ফের হতাশা
২০১০ সালের মহাধসের পর পুঁজিবাজার ফের আলোচনায় আসে ২০২০ সালে। কোভিড মহামারীর শুরুতে শেয়ারদর যখন লাফিয়ে লাফিয়ে কমছিল, তখন প্রতিটি কোম্পানির শেয়ারের একটি সর্বনিম্ন মূল্য বেঁধে দেয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি।
২০২০ সালের ১৭ মে বিএসইসির চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম। প্রায় তিন মাস বাজার বন্ধ থাকার পর চালু হতে শুরু হয় উত্থান। তবে সেই উত্থান সমানুপাতিক ছিল না। সাধারণ বীমা কোম্পানির শেয়ারদর বেড়ে কোনোটি দ্বিগুণ, কোনোটি চার গুণ, কোনোটি ১০ গুণ হয়ে যায় যা তাদের ব্যবসায়িক প্রবৃদ্ধির সমান্তরাল ছিল না।
এরপর দুর্বল মৌলভিত্তির আরও বহু কোম্পানির ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটে, বড় মূলধনি কোম্পানি বেক্সিমকো লিমিটেডের শেয়ারদর ১৩ টাকা থেকে ১৯৫ টাকায় উঠে যায়।
এর মধ্যে সমবায় কর্মকর্তা আবুল খায়ের হিরু ও তার সঙ্গীদের একটি চক্রের কথা শোনা যায়, বেশ কয়েকটি কোম্পানির শেয়ার কারসাজির দায়ে জরিমানাও হয় তাদের।
২০২০ সালের সেপ্টেম্বর থেকেই দর সংশোধনের বৃত্তে থাকা পুঁজিবাজার ২০২২ সালের শুরুর দিকে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে শুরু করে। কিন্তু ওই বছরের ফেব্রুয়ারির শেষে ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা, দেশে রিজার্ভে পতন, ডলার সংকটসহ নানা কিছুর প্রভাব পড়ে বাজারে।
আরও পড়ুন: পুঁজিবাজার: কারসাজি বোঝে সবাই, মেলে না যোগসূত্র
২০২২ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি সূচক ছিল ৭ হাজার ৮৯ পয়েন্টে। তবে ২২ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেইন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে যে পতন শুরু হয়, তা আর থামেনি।
এর আড়াই বছর পর ২০২৪ সালের ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর চার কর্মদিবসে সূচক প্রায় ৮০০ পয়েন্ট বেড়ে যাওয়ার পর পুঁজিবাজার গতিশীল হবে- এমন একটি আশায় অনেক বিনিয়োগকারী শেয়ার কিনতে থাকেন।
সরকার পতনের দিন লেনদেন বন্ধ ছিল পুঁজিবাজারে। এর আগের দিন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ-ডিএসইর সূচক ছিল ৫ হাজার ২২৯ পয়েন্ট। চার কর্মদিবসে ৭৮৬ পয়েন্ট বেড়ে ১১ অগাস্ট সূচক দাঁড়ায় ৬ হাজার ১৫ পয়েন্টে।
কিন্তু এ উত্থান স্থায়ী হয়নি। ১৪ অগাস্ট থেকে যে দরপতন শুরু হয়েছে, তা এখনও থামেনি।
সরকার পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর পাল্টে যায় পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা-বিএসইসির নেতৃত্বও। নতুন নেতৃত্ব বেক্সিমকো লিমিটেডের শেয়ার কেনাবেচায় কারসাজির অভিযোগে ৯ জন বিনিয়োগকারীর ৪২৮ কোটি ৫২ লাখ টাকা জরিমানা, বেশি কিছু কোম্পানির শেয়ারদর বৃদ্ধি নিয়ে তদন্তের উদ্যোগ, লভ্যাংশ ঘোষণা করেও বিতরণ করা করায় সেগুলোকে জেড শ্রেণিতে পাঠানোসহ আরও বেশ কিছু আদেশ আসে।
ব্যক্তি শ্রেণির বেশ কয়েকজন বড় বিনিয়োগকারীর ব্যাংক ও বিও হিসাব অবরুদ্ধ হয়েছে।
ব্যক্তি বিনিয়োগকারীদের ওপর ভর করে চলা পুঁজিবাজারে এসব পদক্ষেপ নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে বলে জোর আলোচনা আছে। বিএসইসির নতুন চেয়ারম্যানের পদত্যাগের দাবিতে বিনিয়োগকারীরা কর্মসূচিও পালন করেছেন।
এসব বিষয়ে বিএসইসির নতুন চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদের বক্তব্য পায়নি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম। তিনি ফোন ধরেননি, বক্তব্য জানতে চেয়ে হোয়াটস অ্যাপে পাঠানো বার্তারও জবাব আসেনি।
তবে নিয়ন্ত্রক সংস্থার মুখপাত্র নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ রেজাউল করিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘‘বর্তমান কমিশন পুঁজিবাজারের লেনদেনসহ রুটিন কাজে কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করবে না। এমন করতেও চায় না। বাজার তার মত করে চলবে।
“কমিশন শুধু দেখবে কোনো রং ডুইং হচ্ছে কি না। ইনসাইডার ট্রেডিং, শেয়ার নিয়ে গ্যাম্বলিংয়ে কেউ জড়িত হচ্ছে কি না, সেরকম তৎপরতা দেখতে পেলেই আইন অনুযায়ী পদক্ষেপ নিতে দেরি করবে না।’’
আরও পড়ুন: পুঁজিবাজারের কোম্পানি: আর্থিক প্রতিবেদনের খবর নেই, প্রতিকারও নেই
টানা দরপতনে লেনদেন তলানিতে নেমেছে, শেয়ারের ক্রয়াদেশও কম। তবে এই সময়ে ইসলামী ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক, ইবনে সিনা, ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাকো, গ্রামীণফোনসহ অল্প কিছু কোম্পানির শেয়ারদর অনেকটাই বেড়েছে, যা বাজারে মূল্যসূচক বাড়িয়েছিল।
তবে ৫০টিরও বেশি কোম্পানির শেয়ারদর ৫০ শতাংশ বা তার চেয়ে বেশি কমে গেছে, এখন বিনিয়োগকারীরা এই লোকসান কীভাবে পূরণ করবেন, নতুন করে শেয়ার দিনে গড় দাম কমিয়ে আনবেন কিনা, সেই সিদ্ধান্তে আসাও কঠিন, কারণ দর কেবলই পড়ছে।
বাজারের এ দীর্ঘমেয়াদি পতনের কারণ অনুসন্ধানে বিএসইসি তদন্ত কমিটি গঠন করে ১০ কর্মদিবস সময় বেঁধে দিয়েছিল গত ২৭ অক্টোবর, ১২ কর্মদিবস পেরিয়ে গেলেও সেই প্রতিবেদনও জমা পড়েনি।
অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা সালেহ উদ্দিন আহমেদ বিএসইসির সঙ্গে বৈঠক করে আসার পর মূলধনি মুনাফার উপর করহার কমিয়ে আনে সরকার। তবে এখন বাজারের যে পরিস্থিতি, তাতে মুনাফা করতে পারছেন খুব কম সংখ্যক মানুষই।
পুঁজিবাজার উন্নয়নে যে টাস্কফোর্স গঠন হয়েছে, তারা কী করছে, সেই প্রশ্নেরও কোনো উত্তর নেই। আবার কেন্দ্রীয় ব্যাংককে তিন হাজার কোটি টাকা ঋণ দিতে চিঠি দিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় ঋণ পরিশোধের জামিনদার হবে বলে জানিয়েছে।
সংকট আসলে কোথায়
দীর্ঘমেয়াদে সংকটের অন্যতম কারণ হিসেবে তালিকাভুক্ত বেশির ভাগ কোম্পানির দুর্বল মৌলভিত্তিকে দায়ী করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ শাহাদাত হোসেইন সিদ্দিকী।
তার ভাষ্য, কোম্পানিগুলো তালিকাভুক্তির পর থেকে আর্থিক অবস্থা দুর্বল হচ্ছে, যা স্বাভাবিক নয়। তারা প্রত্যাশিত লভ্যাংশ দিচ্ছে না।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “কোম্পানিগুলো বাজার থেকে পুঁজি নিয়ে ব্যবসা করছে। কিন্তু লভ্যাংশ দেওয়ার সময়ে আর্থিক প্রতিবেদন ‘কারসজি করে’ বঞ্চিত করছে। এই ছল-চাতুরি ও শেয়ারদর ‘কারসাজির’ ঘটনাগুলো সময়মত নজরে আনতে পারছে না নিয়ন্ত্রক সংস্থা।’’
এমনও দেখা গেছে তালিকাভুক্ত হওয়ার পর কোম্পানি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, ঘোষণা না দিয়ে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে মালিকদের শেয়ার। কিন্তু তাদের শাস্তির আওতায় আনা যায়নি।
‘ভালো কোম্পানি’ বিবেচনায় প্রিমিয়ামে শেয়ার ছাড়ার অনুমতি পেয়েছে–তেমন অনেক কোম্পানিও লোকসানে; কিছু কোম্পানি উৎপাদনে নেই, এমনকি আর্থিক প্রতিবেদনও প্রকাশ করছে না।
কত কোম্পানি এভাবে কত শত বা হাজার কোটি টাকা নিয়ে গেছে, সেই হিসাব কেউ রাখেনি। বেশি দরে শেয়ার কিনে বিনিয়োগকারীর কত হাজার কোটি টাকা আটকে গেছে, তাও জানা যাবে না কখনও।
আরও পড়ুন: পুঁজিবাজারে এসে এত কোম্পানি ডোবে কেন
অধ্যাপক শাহাদাত বলেন, ‘‘এসব কারসাজি ও প্রতারণা সক্ষমতা থাকতে হবে নিয়ন্ত্রক সংস্থার। বিনিয়োগকারীদের একটি আস্থার জায়গা দিতে হবে, যেখানে তারা বিশ্বাস করবেন তালিকাভুক্ত কোম্পানির অনিয়ম গুরুত্বের সঙ্গে দ্রুত ধরা হয়। এটি করা না পর্যন্ত পুঁজিবাজার উন্নয়নে কোনো সংস্কারই কাজে আসবে না।’’
প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগের খরা কাটবে কবে
বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী কম, এ কথা বারবার আলোচনায় আসছে।
সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি, মিউচুয়াল ফান্ড, পেনশন ফান্ড, ব্যাংক, মার্চেন্ট ব্যাংক- এসব প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী হিসেবে বিবেচিত হয়। ডিএসইর যত ডিলার আছে তারাও এই তালিকায় পড়ে। আইসিবিও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী। আরেকটা হলো করপোরেট বিনিয়োগকারী।
দেশে মিউচুয়াল ফান্ডের আকার ১৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি। কিন্তু প্রায় সবগুলোর ইউনিট দর অভিহিত মূল্যের চেয়ে নিচে। বিশ্বের দেশে দেশে পুঁজিবাজার স্থিতিশীলতায় এ ফান্ডগুলোর ভূমিকা ব্যাপক। কিন্তু বাংলাদেশে সম্পদ ব্যবস্থাপকদের বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত ভালো ছিল না। নিয়মিত লভ্যাংশই দিতে পারে না সেগুলো।
বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকারস অ্যাসোসিয়েশন-বিএমবিএ এর সভাপতি মাজেদা খাতুন মনে করেন, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর অংশগ্রহণ কম থাকাটা পুঁজিবাজারের দুর্বলতার একটি কারণ, তেমনি দুর্বল পুঁজিবাজার প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে না পারার একটি কারণ।
মাজেদা রাষ্ট্রায়ত্ত ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ-আইসিবির প্রতিষ্ঠান আইসিবি ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্টের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাও।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, ‘‘কল্যাণ ফান্ড, গ্র্যাচুইটি ফান্ড, পেনশন ফান্ড তো মূলধন হারানোর মত ঝুঁকি কোনো অবস্থাতেই নেবে না। আমাদের মার্কেটে ডেরিভেটিভস পণ্য নেই। মিউচুয়াল ফান্ড, বন্ড মার্কেট গড়ে উঠতে পারেনি।
‘‘আসলে এই জায়গাগুলোতে মনোযোগ দেওয়া হয়নি। পুঁজিবাজারকে অর্থনীতির মূল অনুষঙ্গ ধরে গুরুত্ব দিলে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের জন্য কোনো সুবিধা দেয়া হত। নীতি সুবিধা ও পণ্য না দিলে কীভাবে গড়ে উঠবে? তাদের তো আসার পথটা দিতে হবে।”
কষ্ট লাগে বলে পোর্টফোলিও দেখেন না আক্তারুজ্জামান
লোকসান করতে করতে পুঁজিবাজারের লেনদেন দেখাই ছেড়ে গিয়েছেন আক্তারুজ্জামান।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, ‘‘কষ্ট করে টাকা কামাইছিলাম। দুই কোটি টাকার বিনিয়োগ এখন কত লোকসানে আছে জানি না, খোঁজও নেই না। নিলেই তো কষ্ট বাড়ে।’’
আরেক বিনিয়োগকারী মিজানুর রহমান মিন্টু বলেন, ‘‘ইনসাইডার ট্রেডিং ও কারসাজি চক্রকে সময়মত ধরতে গোয়েন্দা মাঠে রাখতে হবে সব সময়। দুই-নম্বরি করলেই ধইরা জেলে দিতে হবে। জরিমানা করে কোনো লাভ নাই।’’
পুঁজিবাজার চলার শক্তি হচ্ছে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ও স্বচ্ছতা বলে মনে করেন ডিএসইর তালিকাভুক্ত ব্রোকারেজ প্রতিষ্ঠানদের সংগঠন ডিবিএ সভাপতি সাইফুল ইসলাম।
তিনি বলেন, ‘‘পুঁজিবাজারের জন্য একটি বার্তা প্রয়োজন সরকারের পক্ষ থেকে। বার্তাটি সরকারের দায়িত্বশীল জায়গা থেকে এলে বিনিয়োগকারীরা আস্থা পাবে। সেই আস্থার বার্তা ধরে রাখতে নিয়ন্ত্রক সংস্থাসহ স্টেকহোল্ডার (অংশীজন) কাজ করলে বাজার ঘুরে দাঁড়াবে।’’
গত দেড় দশকে পুঁজিবাজারে কোম্পানি তালিকাভুক্তির ক্ষেত্রে অনিয়মের অভিযোগ এনে তিনি বলেন, ‘‘পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে লাখ লাখ ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এজন্য অগ্রাধিকার দিয়ে পুঁজিবাজারের সার্বিক বিষয় নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে একটি স্বাধীন তদন্ত কমিটি গঠন করা দরকার। তারা পুরো বাজারের বিষয়গুলো দেখবে।’’
ডিএসইর সাবেক চেয়ারম্যান ইউনুসুর রহমান বলেন, ‘‘আস্থাহীনতায় বাজার এগোতে পারছে না। আস্থা আনতে বাজার সংশ্লিষ্ট প্রতি জায়গায় ভারসাম্যপূর্ণ নেতৃত্ব বসাতে হবে। বদলাতে হবে কিছু আইন, নিয়ম ও আচার।’’
আরও পড়ুন
বিএসইসির ফটক আটকে 'বিনিয়োগকারীদের' বিক্ষোভ
টানা দরপতনে 'পুঁজি হারিয়ে' মাঠে বিনিয়োগকারীরা
পুঁজিবাজার: তদন্ত কমিটি গঠনের ঘোষণার পর আরও পতন
পুঁজিবাজার: দুইদিনে বাজার মূলধন কমল সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকা
পুঁজিবাজার: দুই মাসে বাজার মূলধন কমল ৪০ হাজার কোটি টাকা
'কারসাজির অনিবার্য পরিণতি': পুঁজিবাজারে 'ধস' নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়
পুঁজিবাজারে মূলধনি মুনাফায় কর কমল
একীভূতের 'পাকে' বিনিয়োগকারী, কার ভুলে এত লোকসান?
পুঁজিবাজার: বিএসইসিতে অর্থ উপদেষ্টা, এখনই বলবেন না পরিকল্পনা
আইসিবিকে ৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ: জামিনদার হতে রাজি সরকার
পুঁজিবাজার: লভ্যাংশ ঘোষণায় নিয়ম রক্ষা, বিতরণের বেলায় নিয়ম উধাও