দুটি কোম্পানির সঙ্গে অন্য দুটি কোম্পানি একীভূত হওয়ার পর কমে গেছে শেয়ার সংখ্যা। দর সমন্বয় হয়েছে, তবে ফ্লোর সমন্বয় হয়নি। ফলে বিপুল লোকসান হচ্ছে বিনিয়োগকারীর।
Published : 03 Nov 2023, 07:40 AM
পুঁজিবাজারে সব শেয়ারের সর্বনিম্ন মূল্য বা ফ্লোর প্রাইস কার্যকর থাকার পরও দুটি কোম্পানিতে বিনিয়োগকারীদের টাকা কার্যত উবে যাচ্ছে।
কোম্পানি দুটি অন্য দুটি কোম্পানির সঙ্গে একীভূত হওয়ার পর তাদের পরিশোধিত মূলধন কমে গেছে। ফলে একটি কোম্পানির ক্ষেত্রে প্রতি তিনটি শেয়ার পরিণত হয়েছে একটিতে। আরেকটি কোম্পানির প্রতি ৫.৫৯টি শেয়ার পরিণত হয়েছে একটিতে।
শেয়ার কমে যাওয়ার পর দুটি কোম্পানিরই দাম সমন্বয় হয়েছে। পুঁজিবাজারে করপোরেট ঘোষণার পর বোনাস বা রাইট শেয়ার দিলে শেয়ার সংখ্যা যত বাড়ে, নতুন ফ্লোর প্রাইসও সেই হারে কমিয়ে আনা হয়। কিন্তু এই হিসাবে ফ্লোর প্রাইস সমন্বয় করে বাড়িয়ে না দেওয়ায় দুই দিনেই বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন বিনিয়োগাকারীরা; সেই ক্ষতি আরও বাড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
বিনিয়োগকারীরা ক্ষুব্ধ, তারা হতাশ, কিন্তু কার কাছে যাবেন, সেটি বুঝতে পারছেন না। পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট ফেইসবুক পেইজে তারা তাদের বক্তব্য তুলে ধরছেন।
নতুন ফ্লোর প্রাইস না থাকার কারণে রেকর্ড ডেট শেষে পরপর দুই দিন কমেছে দাম। একটি কোম্পানিতে বিনিয়োগকারীর লোকসান এরই মধ্যে প্রায় ৪০ শতাংশে পৌঁছে গেছে, আরেকটি কোম্পানির লোকসান ১১ শতাংশের বেশি।
কোম্পানি দুটি হলো ফার কেমিকেলস ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ও আর এন স্পিনিং মিলস লিমিটেড। এতদিন ফ্লোরের সীমার কারণে দর কমতে না পারলেও একীভূত হওয়ার পর শেয়ারদর তার সেই ফ্লোর প্রাইসেই নেমে আসার সুযোগ তৈরি হয়েছে।
লোকসান কত
বস্ত্র খাতের কোম্পানি আরএন স্পিনিং মিলস একীভূত হয়েছে সামিন ফুডের সঙ্গে। সামিন ফুডের সব সম্পদ ও দায় আরএন স্পিনিং মিলসের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এ দুই কোম্পানির বিদ্যমান সব ইকুইটি শেয়ার বাতিল করা হয়েছে।
হাই কোর্টের নির্দেশ ছিল, আরএন স্পিনিং মিলসকে সামিন ফুডের শেয়ারধারীদের কোম্পানিটির ২৩ কোটি ৩১ লাখ ৮৬ হাজার ৫৮৪টি শেয়ারের বিপরীতে নিজেদের সমসংখ্যক শেয়ার ইস্যু করতে হবে।
সেই হিসাবে সামিন ফুডের একটি শেয়ারের বিপরীতে আরএন স্পিনিং একটি নতুন শেয়ার ইস্যু করেছে। কিন্তু নিজেদের একটি শেয়ার হয়ে গেছে ০.১৭৯ টিতে। অর্থাৎ প্রতি ৫.৫৯টি শেয়ার একটি শেয়ারে পরিণত হয়েছে।
অন্যদিকে ওষুধ ও রসায়ন খাতের ফার কেমিকেলসের সঙ্গে একীভূত হয়েছে এস এফ টেক্সটাইল। এ ক্ষেত্রে ফার কেমিকেলসের প্রতি তিনটি শেয়ার পরিণত হয়েছে একটি শেয়ারে।
সোমবার রেকর্ড ডেটের আগের দিন রোববার আর এন স্পিনিং মিলসের প্রতিটি শেয়ার লেনদেন হয়েছে ৬ টাকা ২০ পয়সায়। রেকর্ড ডেট শেষে মঙ্গলবার শেয়ারটির দর স্থির হয় ২৩ টাকা ২০ পয়সায়। অথচ ৫.৫৯টি শেয়ারের দর রোববার ছিল ৩৪ টাকা ৬৫ পয়সা। অর্থাৎ একীভূত হওয়ার কারণে প্রথম দিনই বিনিয়োগকারীর লোকসান হয় ১১ টাকা ৪৫ পয়সা।
শুধু তাই নয়, দ্বিতীয় দিনের লেনদেনে সেই ২৩ টাকা ২০ পয়সা থেকে ৯.৯১ শতাংশ কমে দাম দাঁড়িয়েছে ২০ টাকা ৯০ পয়সায়।
অর্থাৎ দুই দিনেই আরএন স্পিনিংয়ের বিনিয়োগকারীরা হারিয়েছেন ৩৯.৬৮ শতাংশ দাম।
ফার কেমিকেলসের ক্ষতি সেই তুলনায় কম। কোম্পানিটি শেয়ারদর গত কয়েক মাস ধরে তার ফ্লোর প্রাইস ১০ টাকা ৬০ পয়সার নিচে নামতে পারছিল না। মঙ্গলবার একীভূত হওয়ার কারণে প্রতি তিনটি শেয়ার পরিণত হয় একটিতে। সেই হিসাবে দর সমন্বয় হওয়ার কথা ছিল ৩১ টাকা ৮০ পয়সায়। কিন্তু দিন শেষে দর স্থির হয় ৩১ টাকা ৩০ পয়সায়।
ফ্লোর প্রাইসে পরিবর্তন না আসার কারণে আসল ক্ষতিটা হয় বুধবার। শেয়ারের দর প্রায় ১০ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ২৮ টাকা ২০ পয়সায়। আগের হিসাবে প্রতিটি শেয়ারের দর হয় ৯ টাকা ৪০ পয়সা। অর্থাৎ এই কোম্পানির বিনিয়োগকারীরা দুই দিনে হারিয়েছেন ১১.৩২ শতাংশ।
ডিএসইর ‘নিষ্ক্রিয়তায়’ ডিবিএর বিস্ময়
আর এন স্পিনিং ও ফার কেমিকেলসের বিনিয়োগকারীদের এই আর্থিক ক্ষতির ঘটনটিকে ‘বিস্ময়কর’ বলেছেন বাংলাদেশ স্টক ব্রোকার অ্যাসোসিয়েশন ডিবিএর সভাপতি রিচার্ড ডি রোজারিও।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “এখানে যা হয়েছে এটা অস্বাভাবিক। এই দুই কোম্পানির ট্রেন্ড তো এভাবে শুরু হওয়া উচিত হয়নি। আমাদের পক্ষ থেকে ডিএসইকে মৌখিকভাবে জানিয়েছিলাম ফ্লোর প্রাইস সমন্বয় না হওয়া পর্যন্ত দুটি কোম্পানির লেনদেন স্থগিত থাকুক। কিন্তু তারা আমাদের কথা শোনেনি। এখন বিনিয়োগকারী লোকসানের সাগরে পড়ে গেল। শুধু তাই না, লোকসান আরও বাড়তে পারে।”
পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের শিক্ষক আল আমিনের প্রতিক্রিয়া রোজারিওর মতই।
তিনি বলেন, “কোন ভিত্তিতে এই ঘটনাটি ঘটল, তা তো স্পষ্ট নয়। একীভূত করার পর লেনদেনের প্রথম দিনেই তো কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে একটি সুস্পষ্ট নির্দেশনা বা ঘোষণা থাকা উচিত ছিল। ট্রেডারদের প্রতিও নির্দেশনা থাকা উচিত ছিল। আমি মনে করে এটার জন্য পুরোপুরি দায়ী ডিএসই। এখানে বড় ধরনের কমিউনিকেশনস গ্যাপ ছিল।”
ডিএসইতে ফ্লোর প্রাইস সমন্বয়সহ নানা বিষয়ে এর আগেও ‘অদ্ভুত’ ঘটনা ঘটেছে। ২০২০ সালে করোনাভাইরাস মহামারীর সময় প্রথমবারের মত ফ্লোর প্রাইস দেওয়ার পর একটি কোম্পানি ৫০ শতাংশ রাইট শেয়ার অনুমোদন করার পর কোম্পানির শেয়ার সংখ্যা বাড়লেও ফ্লোর প্রাইস সমন্বয় হয়নি। ফলে বিনিয়োগকারীর স্বয়ংক্রিয় মুনাফা তৈরি হয়।
একাধিক কোম্পানি বোনাস শেয়ার ইস্যুর পরেও ফ্লোর প্রাইস সমন্বয় হয়নি একইভাবে।
এসব বিষয়ে আল আমিন বলেন, “অনিয়ম ও আরও নানা বিষয় নিয়ে আমি অনেক ফোরামে কথা বলেছি, কিন্তু কোথাও কিছু হয়নি, আর হবে বলে মনেও হয় না। দিন শেষে সাধারণ বিনিয়োগকারীই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কারণ এখানে কোনো জবাবদিহিতা নেই।
“বোনাস শেয়ার নিয়ে কত কিছু ঘটেছে। দাম সমন্বয়ের পর বিএসইসি বোনাসের প্রস্তাব নাকচ করেছে। আবার কোনো কোম্পানির নগদ ও বোনাস শেয়ারের রেকর্ড ডেট একটিই ছিল, কোনো কোম্পানির ক্ষেত্রে এটি হয় আলাদা। কোনো কোম্পানির বোনাস শেয়ারের প্রস্তাব অনুমোদন হয় দুই মাসেই, কোনোটার ক্ষেত্রে আবার তা অনুমোদন হতে হতে ১০ বা ১১ মাস লেগে যায়।”
পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে এই পুঁজিবাজার বিশ্লেষক বলেন, “আপনারা বলেন পুঁজিবাজার নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থার সংকট। এই যদি অবস্থা হয়, তাহলে কেন হবে না?”
দাম আর কত কমতে পারবে?
যোগাযোগ করা হলে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ-ডিএসইর প্রকাশনা ও জনসংযোগ বিভাগের উপমহাব্যবস্থাপক শফিকুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, দুটি কোম্পানির দর আবার তার ফ্লোর প্রাইসে নেমে আসতে পারবে।
অর্থাৎ আর এন স্পিনিং মিলসের শেয়ার দর আবার ৬ টাকা ২০ পয়সায় আর ফার কেমিকেলসের দর ১০ টাকা ৬০ পয়সায় নামা সম্ভব।
যেহেতু হাতের শেয়ার কমে গেছে, তাই সমন্বয় করে ফ্লোর প্রাইস দেওয়া না হলে তো বিনিয়োগকারীর ব্যাপক ক্ষতি হবে, এই প্রশ্নে তিনি বলেন, “এর জবাব আমি দিতে পারব না। আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বলতে পারবে।”
‘নীতিমালা নেই, কীভাবে ফ্লোর সমন্বয়’
শফিকুরের পরামর্শে যোগাযোগ করা হলে ডিএসইর ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও চিফ অপারেটিং অফিসার এম. সাইফুর রহমান মজুমদার দাবি করেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন বা বিএসইসি ফ্লোর প্রাইস সমন্বয়ের যে নীতিমালা করেছে, তার আলোকে তাদের করার কিছু ছিল না।
বোনাস ও রাইট শেয়ার দিলে সেই অনুপাতে ফ্লোর প্রাইস সমন্বয় করা হলে এখানে কেন নতুন ফ্লোর দিয়ে বিনিয়োগকারীকে সুরক্ষা দেওয়া হয়নি- এই প্রশ্নে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ফ্লোর প্রাইস সমন্বয়ের যে নির্দেশনা আছে, সেটি হল কোম্পানির লভ্যাংশের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নিচের দিকে সমন্বয়। কিন্তু মার্জার বা অন্য কোনো কারণে ওপরের দিকে সমন্বয়ের কোনো নির্দেশনা বিএসইসির নেই। যদি কমিশনের নির্দেশনা না থাকে, তাহলে আমাদের কী করার আছে।
“এই যে মার্জার হয়েছে, সেটাও আমাদের দেশে বিরল। আমাদের পুঁজিবাজারে তো নয়ই। কোনো দুটি কোম্পানি মার্জার হলে সাধারণত তৃতীয় একটি কোম্পানি হয় বা একটি কোম্পানি আরেকটি কোম্পানিকে অধিগ্রহণ করে। কিন্তু এখানে তার কিছু হয়নি।”
তিনি বলেন, “এখানে অনেক জটিল হিসাব আছে। বিশেষ সাধারণ সভায় বিনিয়োগকারীরা তা অনুমোদন করেছে এরপর তা আদালতও অনুমোদন করেছে। এরপর আমাদের কাছে এসেছে। এখন আদালতের নির্দেশের বাইরে কিছু করতে গেলে তো আদালতের আরেকটি আদেশ লাগবে। আমাদের তো তা নেই।”
বিনিয়োগকারীদের লোকসানের বিষয়টি বুঝিয়ে বলা হলে তিনি বলেন, “আপনার কথা আমি বুঝেছি। কিন্তু আমার তো মার্জারের কারণে ফ্লোর প্রাইস বাড়িয়ে দেওয়ার নির্দেশনা থাকতে হবে। সেটা তো নেই। তাহলে আমি কোন হিসাবে কাজ করব?”
দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র রেজাউল করিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এ বিষয়টি যেভাবে হয়েছে, সেটি আইনসম্মত না হলে পরবর্তীতে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”