সাড়ে তিনশর বেশি কোম্পানির বাজারে একশর কাছাকাছি যখন রুগ্ন হয়, প্রিমিয়ামে শেয়ার বিক্রি করা কোম্পানি যখন ব্যবসা হারিয়ে ফেলে-তখন কী বলবেন? মির্জ্জা আজিজের উত্তর, ‘মূল্যায়ন সঠিক হয়নি।’
Published : 21 Jan 2024, 12:13 AM
তালিকাভুক্ত হওয়ার আগে বিপুল মুনাফা, ব্যবসা বাড়াতে পুঁজিবাজারে এসে বিপুল পরিমাণে অর্থ উত্তোলন, এরপর তালিকাভুক্তির চেয়ে বেশি দরে শেয়ার বিক্রি; শেষে কোম্পানির ডুবে যাওয়া। ফলাফল-পুঁজিবাজারে টাকা খাটিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত লাখো বিনিয়োগকারী।
বাজার সংশ্লিষ্টদের মতে, কোম্পানি ডুবে গেলেও মালিকদের কিছুই লোকসান হয় না। তারা তাদের বিনিয়োগের কয়েক গুণ অর্থ তুলে নিয়ে যান। অথচ তাদেরকে বিচারের মুখোমুখি করতে পারে না সরকারের কোনো সংস্থা।
এমনও দেখা গেছে তালিকাভুক্ত হওয়ার পর কোম্পানি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, ঘোষণা না দিয়ে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে মালিকদের শেয়ার। কিন্তু তাদের শাস্তির আওতায় আনা যায়নি।
‘ভালো কোম্পানি’ বিবেচনায় প্রিমিয়ামে শেয়ার ছাড়ার অনুমতি পেয়েছে–তেমন অনেক কোম্পানিও লোকসানে; কিছু কোম্পানি উৎপাদনে নেই, এমনকি আর্থিক প্রতিবেদনও প্রকাশ করছে না।
পুঁজিবাজারে বছরের পর বছর ধরে আস্থাহীনতার কথা বলাবলি হচ্ছে। অথচ কত কোম্পানি এভাবে কত শত কোটি টাকা নিয়ে গেছে, সেই হিসাব কেউ রাখেনি। বেশি দরে শেয়ার কিনে বিনিয়োগকারীর কত হাজার কোটি টাকা আটকে গেছে, তাও জানা যাবে না কখনও।
এর মধ্যেই পুঁজিবাজারে যখনই মন্দাভাবের কথা বলা হয়, তখনই তারল্য সংকটের আলোচনা হয়। কিন্তু বিনিয়োগকারীদের আটকে যাওয়া অর্থের বিষয়টি কখনও উঠে আসে না।
বর্তমানে তালিকাভুক্ত সাড়ে তিনশর বেশি কোম্পানি ও ৩৭টি মিউচুয়াল ফান্ড। এর মধ্যে ৭০টির বেশি রুগ্ন কোম্পানি, সব মিলিয়ে শ-খানিক লোকসানি। এসব কোম্পানি নিয়ে যা যা হয়েছে, সেটি পুঁজিবাজারকে কতটা শক্তিশালী করবে তা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও নেই জবাব।
অথচ তালিকাভুক্তির আগে টানা তিন বছর মুনাফায় থাকার শর্ত আছে। পুঁজিবাজারে আসার আগে মুনাফায় থাকার তথ্য দিলেও পরে অনেকগুলোই লোকসানি হয়ে যায়।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা মির্জ্জা এ বি আজিজুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন, “এসব নিয়ে বিএসইসি ও স্টক এক্সচেঞ্জ কর্তৃপক্ষের দেখা উচিত। তারা আর্থিক বিবরণীতে কারসাজি করেছে কি না, সেটা দেখা উচিত। কারসাজি হলে আইনি ব্যবস্থা নিয়ে জেল জরিমানা করতে হবে।”
বিশ্লেষণে দেখা গেছে, পুঁজিবাজার থেকে টাকা তোলার পর পর আর্থিক অবস্থা খারাপ হয়েছে, এমন কোম্পানির মধ্যে সবচেয়ে বেশি অনুমোদন পেয়েছে ২০১১ সালের পর যখন এম খায়রুল হোসেন বিএসইসির চেয়ারম্যান ছিলেন।
পুঁজিবাজার থেকে টাকা তোলার পর কোম্পানির বসে যাওয়ার বিষয়ে প্রশ্নে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “অনেক কিছু বিষয় আছে। কোম্পানির দায় দায়িত্ব আছে। যখন তারা পুঁজিবাজারে এসেছে তখন তাদের প্রোফাইল ভালো ছিল। পরে ব্যবসা ধরে রাখতে পারেনি। এখন কী করার?”
কোম্পানিগুলোকে বাজার থেকে টাকা তুলতে দেওয়া বা প্রিমিয়ামে শেয়ার বিক্রির সুযোগ দিতে মূল্যায়নে ভুল ছিল কি না-এ প্রশ্নে তিনি বলেন, “মূল্যায়নের ঘাটতি ছিল না। কমিশনের কাছে যা যা করণীয় ছিল, সব কিছু করেই অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। পরে কোম্পানি কী করে, তাতে তো নিয়ন্ত্রক সংস্থার কিছু করার নেই।”
একটি কোম্পানির উদাহরণ টেনে সাবেক এই বিএসইসি চেয়ারম্যান বলেন, “সেই কোম্পানিটি ১৫০ টাকায় আসতে চেয়েছিল। পরে আমরা তার অর্ধেক দাম দিয়েছি। কিন্তু বাজরে এসে সেটি দাম ধরে রাখতে পারেনি। এটা ভারতেও হয়। সেখানেও ৬০ শতাংশ কোম্পানি পুঁজিবাজারে আসার পর শেয়ারদর ধরে রাখতে পারে না।”
গত দেড় দশকে পুঁজিবাজারে আসার পর ব্যবসায় প্রবৃদ্ধি হয়েছে গ্রামীণফোন, মারিকো, ওয়ালটন, ইউনাইটেড পাওয়ার, শাহজিবাজার পাওয়ার, এডিএন টেলিকম, একমি ল্যাবরেটরিজ, জেএমআই সিরিঞ্জ, বাংলাদেশ সাবমেরিন কেবল কোম্পানি, মতিন স্পিনিং মিলস, প্যারামাউন্ট টেক্সটাইলের মতো অল্প কিছু কোম্পানির।
অ্যাপোলো ইস্পাত বন্ধ, মালিকপক্ষের পকেট ‘ফোলা’
২০১৩ সালে প্রকৌশল খাতের কোম্পানিটি ১০ কোটি শেয়ার বাজারে ছেড়ে ২২০ কোটি টাকা তোলে। ১০ টাকার শেয়ার বিক্রি করা হয় ১২ টাকা প্রিমিয়ামসহ ২২ টাকায়।
রানি মার্কা ঢেউটিন বিক্রি করত কোম্পানিটি। তালিকাভুক্ত হওয়ার পর পাঁচ বছর বোনাসের কারণে শেয়ার সংখ্যা এখন ৪০ কোটির বেশি। এর ৯ কোটির মত আছে উদ্যোক্তাদের হাতে। এই হিসাবে তালিকাভুক্ত হওয়ার পর মালিকপক্ষ আরও ১৬ কোটি শেয়ার বিক্রি করেছে।
প্রথম কর্মদিবসেই কোম্পানির শেয়ারদর হয়েছিল ৪০ টাকা। পরে বাড়ে আরও। নানা সময় উদ্যোক্তা পরিচালকরা সেই বাড়তি দরেই শেয়ার বিক্রি করেছেন। ১৬ কোটি শেয়ার গড়ে ৩০ টাকা দরে বেচলেও প্রায় ৫০০ কোটি টাকা পেয়েছেন তারা। অর্থাৎ সব মিলিয়ে ৭০০ কোটি টাকার বেশি পেয়েছে মালিকপক্ষ।
তালিকাভুক্তির পর চার বছর মুনাফা দেখালেও ২০১৮ সাল থেকে লোকসান দেখানো শুরু। ২০১৯ সালে ৯২ কোটি টাকার বেশি লোকসান দেখানোর পর এখন কোম্পানির কোনো তথ্যই পাচ্ছে না বিনিয়োগকারীরা।
২০২১ সালে শেয়ারদর ৫ টাকা ১০ পয়সায় নেমে আসে। ওই বছরই সংবাদমাধ্যমে কারখানা বন্ধের খবর আসে। ওই বছর চেয়ারম্যান দ্বীন মোহাম্মদ মারা গেলে উত্তরাধিকারীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ রফিকুল কাউকে না জানিয়ে বিদেশে চলে গেছেন।
কোম্পানিটির ওয়েবসাইট অকার্যকর, কোম্পানি সচিবের নম্বর পর্যন্ত দেওয়া নেই ডিএসইর ওয়েবসাইটে।
রতনপুর স্টিলে যা ঘটেছে
২০১৪ সালে আড়াই কোটি শেয়ার ছেড়ে বাজার থেকে ১০০ কোটি টাকা তোলে আরএসআরএম স্টিল। প্রতি শেয়ারে ৩০ টাকা প্রিমিয়ামসহ দাম নেওয়া হয় ৪০ টাকা। ওই বছর কোম্পানিটি শেয়ার প্রতি আয় বা ইপিএস দেখায় ৫ টাকা ৬৩ পয়সা।
পুঁজিবাজারে আসার আগে মালিকপক্ষের হাতে শেয়ার ছিল ২ কোটি ৯৬ লাখ। চার বছর বোনাস শেয়ার দেওয়ার পরও তাদের হাতে ৩ কোটি ২ লাখের কিছু বেশি।
তালিকাভুক্তির পর আড়াই কোটির বেশি শেয়ার মালিকপক্ষ বিক্রি করেছে আইপিও দরের চেয়ে বেশিতে। এ হিসাবেও তারা পেয়েছে ২০০ কোটি টাকার বেশি। অথচ আইপিওতে আসার আগে ২ কোটি ৯৬ লাখ শেয়ারের বিপরীতে তাদের মূলধন ছিল ৩০ কোটি টাকার কম।
তালিকাভুক্তির পর প্রতি বছর আয় কমে ২০২০ সালে বন্ধ হয়ে যায় উৎপাদন। ২০২১ সালে শেয়ারপ্রতি ৩ টাকা ৭৫ পয়সা লোকসান দেখানোর পর আর কোনো তথ্যই দিচ্ছে না তারা।
ওই বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর স্টক এক্সচেঞ্জে চিঠি দিয়ে আরএসআরএমের কারখানা উৎপাদনে যাওয়ার কথা জানানো হয়। কিন্তু উৎপাদন শুরু হয়নি।
২০২২ সালের জানুয়ারিতে খেলাপি ২০১ কোটি টাকা আদায়ে চট্টগ্রামে আরএসআরএম এর সম্পত্তি নিলামে তুলতে সংবাদমাধ্যমে বিজ্ঞাপন দেয় সোনালী ব্যাংক। এ নিয়েও কিছু জানানো হয়নি বিনিয়োগকারীদের।
খেলাপি ঋণের মামলাসহ নানা অভিযোগে ২০২২ সালের জুনে এর ব্যবস্থাপনা পরিচালককে গ্রেপ্তার করে র্যাব।
আরআসআরএম স্টিলের কোম্পানি সচিব মঈন উদ্দিনের ফোনে কল করা হলে তিনি তা কেটে দেন। এরপর সংবাদ প্রকাশের জন্য বক্তব্য প্রয়োজন জানিয়ে এসএমএস পাঠালেও সাড়া মেলেনি।
কোম্পানির পরিচালক মারজানুর রহমানের মোবাইলে কল দিয়ে সেটি বন্ধ পাওয়া গেছে।
মুখ থুবড়ে পড়ল রানার অটোমোবাইল
২০১৯ সালে পুঁজিবাজারে আসার আগের তিন বছর মোটরসাইকেল সংযোজনকারী কোম্পানিটি গড় ইপিএস দেখায় ৩ টাকা ৩১ পয়সা।
প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে ৭৫ টাকায় এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে ৬৮ টাকায় শেয়ার বেচে তারা।
২০২৩ সালে শেয়ারপ্রতি ৭ টাকা ৭৫ পয়সা লোকসান দেখানোর পর চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে লোকসান দেখিয়েছে ২ টাকা ২৭ পয়সা। দেড় বছর ধরে ফ্লোর প্রাইস ৪৮ টাকায় ক্রেতা ছিল না।
রানার বাজারে ছেড়েছিল ১ কোটি ৩৯ লাখ ৩০ হাজার ৩৪৮টি শেয়ার। আইপিওতে আসার পরেও তারা বিক্রি করেছে ৫ কোটির বেশি। ২০২২ সালে এক কোটি শেয়ার বিক্রি হয়েছে ৫৭ টাকা দরে। এর আগে দর ছিল আরও বেশি। এ প্রক্রিয়ায় মালিকপক্ষ পেয়েছে ৩৫০ কোটি টাকার বেশি।
পুঁজিবাজার থেকে টাকা তোলার পরের বছর থেকেই ব্যবসার নিম্নগতি কেন-এ প্রশ্নের জবাব পেতে কোম্পানি সচিব মিজানুর রহমানের কাছে প্রশ্ন রাখা হয় শুক্রবার। তিনি বাইরে আছেন জানিয়ে শনিবার কল করতে বলেন।
তবে শনিবার দিনভর একাধিকবার ফোন করলেও তিনি তা রিসিভ করেননি। মাঝে একাধিকবার কল ওয়েটিং দেখা গেছে।
ভূপাতিত ওয়েস্টার্ন মেরিন
২০১৪ সালে মোট সাড়ে ৪ কোটি শেয়ার ছেড়ে ১৫৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা তোলে এ কোম্পানি। ১০ টাকার শেয়ারে প্রিমিয়াম নেওয়া হয় ২৫ টাকা। ইপিএস দেখানো হয় ৩ টাকা ৮৭ পয়সা।
আইপিওতে আসার আগে কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন ছিল ৬৫ কোটি টাকার মত। মালিকপক্ষের হাতে ছিল ছয় কোটি ৪৫ লাখ শেয়ার।
বোনাস শেয়ার দিতে দিতে এখন পরিশোধিত মূলধন হয়েছে প্রায় চার গুণ। কিন্তু মালিকপক্ষের শেয়ার সংখ্যা ৭ কোটির কিছু বেশি। এ হিসাবে তালিকাভুক্তির পর আরও প্রায় সাত কোটি শেয়ার তারা বিক্রি করেছে। যদি আইপিওর দরেও বিক্রি হয়, তাহলেও তারা পেয়েছেন ৩০০ কোটি টাকার মত।
অর্থাৎ সব মিলিয়ে ৪৫০ কোটি টাকার বেশি বাজার থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে। অথচ বিনিয়োগকারীরা অনিশ্চয়তায়।
২০২১ থেকে কোম্পানিটি লোকসানে। কোম্পানি টিকবে কি না, সেই সংশয় প্রকাশ করেছেন নিরীক্ষক। খেলাপি ঋণের কারণে কোম্পানির শিপইয়ার্ড নিলামে তোলার একাধিক উদ্যোগও নিয়েছে ব্যাংক।
৩৫ টাকায় আইপিওতে আসা কোম্পানির দর এখন ১২ টাকার ঘরে।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) ওয়েবসাইটে কোম্পানি সচিবের নাম ও ফোন নম্বর দেওয়া নেই। পরে কোম্পানির নির্বাহী পরিচালক তারেক মো. নসরুল্লাহর ফোনে ও হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে একাধিকবার কল করে ও এসএমএম পাঠিয়েও তার সাড়া পাওয়া যায়নি।
গোপনে শেয়ার বিক্রি
২০১৩ সালে ফ্যামিলিটেক্স সাড়ে তিন কোটি শেয়ার ছেড়ে ৩৫ কোটি টাকা তোলে। ওই বছর ৭ টাকা ২৬ পয়সা ইপিএস দেখিয়ে ১০০ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ ঘোষণা করা হয়। শেয়ারদর ওঠে ৭৪ টাকা ৮০ পয়সায়।
২০১৭ সালে লোকসান দেখানো শুরু। এর মধ্যে উদ্যোক্তা পরিচালকরা ঘোষণা না দিয়েই হাতে থাকা প্রায় সব শেয়ার বেচে দিয়েছেন। ৩৫ কোটি ৪০ লাখ শেয়ারের মধ্যে মাত্র ৪.০২ শতাংশের মালিক তারা।
সম্প্রতি ডিএসই কর্তৃপক্ষ কারখানা ও ঢাকায় প্রধান কার্যালয় পরিদর্শন করে সেটি বন্ধ পেয়েছে। অথচ কোম্পানির উৎপাদন বন্ধের ঘোষণা নেই।
সিঅ্যান্ডএ টেক্সটাইল ২০১৫ সালে ৪৫ কোটি টাকা তোলার পর দুই বছরে গোপনে সব শেয়ার বেচে দেয় মালিকপক্ষ। ২০১৭ সালে উৎপাদন বন্ধ করে দেওয়া হয়। এক পর্যায়ে শেয়ারদর নেমে আসে দুই টাকার নিচে। গত বছর কোম্পানিটি অন্য এক গ্রুপের অধীনে নতুন করে চালু হয়েছে।
এমন কোম্পানির সংখ্যা এখানেই শেষ নয়। ২০১৭ সালে ৪৩ কোটি টাকা তুলে নেওয়ার চার বছর পর ঘোষণা না দিয়ে কোম্পানি বন্ধ করে দেন নুরানী ডায়িং কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালকরা।
২০১৯ সালে রিং সাইন টেক্সটাইল তোলে ১৫০ কোটি টাকা। পরের বছর কোম্পানি বন্ধ করে লাপাত্তা হয় মালিকপক্ষ। পর্ষদ পুনর্গঠন করে কোম্পানিটিকে উৎপাদনে ফেরানো গেলেও মুনাফার মুখ দেখেনি।
আয়ে ভাটা, প্রিমিয়ামের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন
২০১৩ সালে পুঁজিবাজারে আরগন ডেনিমের ১০ টাকার শেয়ারে ৩৪ টাকা প্রিমিয়ামে তোলা হয় ১৩২ কোটি টাকা। ইপিএস দেখানো হয় ৫ টাকা ৪৬ পয়সা। বস্ত্র খাতের রপ্তানি বাড়তে থাকলেও উল্টো দৌড়ে আরগন। ২০২১ সালে শেয়ার প্রতি ৭১ পয়সা, পরের বছর ৫২ পয়সা এবং ২০২৩ সালে আয় করে ৬৮ পয়সা।
২০১৩ সালে গোল্ডেন হারভেস্ট পুঁজিবাজারে আসার আগে ইপিএস দেখায় ৪ টাকা ৭২ পয়সা। কোম্পানিটি বাজার থেকে টাকা তোলে দুইবার।
আইপিওতে ১৫ টাকা প্রিমিয়ামে ২৫ টাকায় শেয়ার ছেড়ে তোলা হয় ৭৫ কোটি টাকা। ছয় বছর পর রাইট শেয়ার ছেড়ে তোলে আরও ৯০ কোটি।
দুই দফায় ১৬৫ কোটি টাকা তুললেও ব্যবসার অবস্থা খারাপ। ২০২৩ সালে শেয়ারপ্রতি ২ পয়সা মুনাফা দেখাতে পেরেছে তারা।
২০১৫ সালে ২৫ টাকা প্রিমিয়ামে শাশা ডেনিম তোলে ১৭৫ কোটি টাকা। ইপিএস দেখানো হয় ৩ টাকা ৭০ পয়সা। ২০২০ সাল থেকে আয়ে ভাটা। ২০২২ সালে শেয়ার প্রতি ৫ টাকা ৭৫ পয়সা লোকসান দেয় কোম্পানিটি।
২০১৪ সালে দ্য পেনিনসুলা চিটাগংয়ের শেয়ারে ২০ টাকা প্রিমিয়াম যোগ করে ১৬৫ কোটি টাকা তোলার অনুমোদন দেয় বিএসইসি। সে সময় ইপিএস দেখানো হয় ২ টাকা ৪৯ পয়সা। ২০২০ সালে ১৯ পয়সা, ২০২১ সালে ৪১ পয়সা, ২০২০ সালে ৫ পয়সা আয় দেখানোর পর ২০২৩ সালে লোকসান দিয়েছে ৩৪ পয়সা।
২০১৩ সালে ১৫ টাকা প্রিমিয়াম পেয়ে বেঙ্গল উইন্ডসর থার্মোপ্লাস্টিকস তোলে ৪০ কোটি টাকা। ইপিএস দেখানো হয় ৩ টাকা ৬২ পয়সা। গত তিন বছরের মধ্যে ২০২৩ সালে সর্বোচ্চ আয় দেখিয়েছে ৫১ পয়সা।
২০১১ সালে জাহিনটেক্স ১৫ টাকা প্রিমিয়াম নিয়ে দুই কোটি শেয়ার ছেড়ে তোলে ৫০ কোটি টাকা। ইপিএস দেখায় ১ টাকা ৮৩ পয়সা।
কোম্পানিটি গত পাঁচ বছর ধরে লোকসানে। ২০২৩ সালে শেয়ারপ্রতি লোকসান হয় ২ টাকা ৫৮ পয়সা। তার আগের দুই বছরে লোকসান ছিল ৩ টাকার বেশি।
‘ছোট ছোট’ কোম্পানি
২০১৫ সালে ২০ কোটি টাকা তোলা অলিম্পিক অ্যাকসেসোরিজ ইপিএস দেখায় ১ টাকা ৪৩ পয়সা। এখন টানা চার বছর লোকসানে তারা। ২০২৩ সালে শেয়ার প্রতি লোকসান দেখানো হয় ২ টাকা ৩৩ পয়সা।
২০১৩ সালে পুঁজিবাজারে আসার আগে বাংলাদেশ বিল্ডিং সিস্টেমস লিমিটেড ইপিএস দেখায় ২ দশমিক ৫৮ টাকা। ১৪ কোটি টাকা সংগ্রহ করে তারা ব্যবসা বাড়াতে পারেনি। গত তিন বছরের মধ্যে দুই বছরই লোকসান হয়েছে।
২০১৪ সালে ১৪ কোটি টাকা তোলা সুহৃদ ইন্ডাস্ট্রিজে কী হচ্ছে, তার কিছুই জানতে পারছেন না বিনিয়োগকারীরা।
পুঁজিবাজারে আসার আগে ১ টাকা ৯ পয়সা ইপিএস দেখানো কোম্পানিটি ২০১৫ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত লোকসান দেখায়।
২০১৮ সালে ৪১ পয়সা এবং পরের বছর ১ টাকা ৩৮ পয়সা ইপিএস দেখিয়ে শেয়ার প্রতি ১ টাকা লভ্যাংশ ঘোষণা করা হয়। শেয়ারদর ৪০ টাকার কাছাকাছি ওঠে। কিন্তু সেই লভ্যাংশ বিতরণ করা হয়নি। চার বছর ধরে আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ হচ্ছে না।
২০১৪ সালে পুঁজিবাজারে আসার আগে ব্রাদার্স পিপি ওভেনের পাঁচ বছরের ইপিএসের ভারিত গড় ছিল ৮৭ পয়সা। বাজার থেকে ২০ কোটি টাকা তোলা কোম্পানিটি গত চার বছর ধরে লোকসান দিচ্ছে।
২০১৫ সালে ১ কোটি ৮০ লাখ শেয়ার ছেড়ে ১৮ কোটি টাকা তোলা ন্যাশনাল ফিড মিলস আগের বছর ইপিএস দেখায় এক টাকা ৮৫ পয়সা। ২০১৮ সালে ৫৬ পয়সা আয় দেখানোর পর আর কখনও ২০ পয়সাও আয় করতে পারেনি।
২০১৩ সালে ১৪ কোটি টাকা তোলার আগে সেন্ট্রাল ফার্মা ইপিএস দেখায় ১ টাকা ২১ পয়সা। এরপর থেকে ক্রমাগত ডুবতে থাকা কোম্পানিটি ২০২০ সাল থেকে লোকসানে।
২০১৮ সালে পুঁজিবাজারে ২০ কোটি টাকা তোলা ইন্দোবাংলা ফার্মা আগের বছর ইপিএস দেখায় ২ টাকা ৬২ পয়সা। কমতে কমতে গত অর্থবছরে তা নেমেছে ৭ পয়সায়।
তালিকাভুক্তির আগে এত আয়!
২০১৪ সালে ১২ কোটি টাকা সংগ্রহ করা ফার কেমিকেলস তালিকাভুক্তির আগের বছর ইপিএস দেখায় ৫ টাকা ১ পয়সা। সেই কোম্পানি টানা তিন বছর ধরে লোকসানে।
২০১১ সালে ৩ টাকা ৪৭ পয়সা ইপিএস দেখিয়ে ১৬ কোটি টাকা তোলে দেশবন্ধু পলিমার। কিন্তু ২০১৮ সাল থেকে ছয় বছরে একবারই কোম্পানিটি শেয়ারপ্রতি ৫০ পয়সার বেশি আয় করতে পেরেছে।
২০১৩ সালে তালিকাভুক্তির আগের বছর গ্লোবাল হেভি কেমিকেলস ইপিএস দেখায় ৩ টাকা ৭১ পয়সা। ১০ বছর পর ২০২৩ সালে শেয়ার প্রতি তারা লোকসান দেখায় ৫ টাকা ৭৭ পয়সা। অথচ শক্তিশালী কোম্পানি হিসেবে বিএসইসি ১০ টাকার শেয়ার ২০ টাকায় বিক্রির অনুমোদন দিয়েছিল। তারা বাজার থেকে তোলে ২৪ কোটি টাকা।
২০১৪ সালে ৪০ কোটি টাকা উত্তোলনের আগের বছর খুলনা প্রিন্টিং অ্যান্ড পেপার মিলস ইপিএস দেখায় ২ টাকা ৮২ টাকা। ২০১৭ সাল থেকে টানা লোকসানে তারা। ২০২৩ সালের আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ হয়নি।
মূল্যায়ন নিয়ে প্রশ্ন, স্বীকার করে না বিএসইসি
এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম নিজেও এক সময় বিএসইসির চেয়ারম্যান ছিলেন। তার কাছে প্রশ্ন ছিল, কোম্পানিকে কোন বিবেচনায় শেয়ার ছেড়ে প্রিমিয়াম নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়।
এ প্রশ্নে তিনি বলেন, “কোম্পানির পারফরম্যান্স কী রকম সেটা একটা বিবেচ্য। আবার দেখতে হবে কোন সেক্টরের কোম্পানি, সেই খাতের ভবিষ্যত কী, কোম্পানির ব্যবস্থাপনায় কারা, তারা কত দিন ধরে ব্যবসায়, এসব বিবেচনায় প্রিমিয়াম দেওয়া হয়।”
৩৫০টি কোম্পানির মধ্যে একশর কাছাকাছি কোম্পানি যখন রুগ্ন হয়ে যায়, প্রিমিয়ামে শেয়ার বিক্রি করা কোম্পানি পুঁজিবাজারে এসেই ব্যবসা হারিয়ে ফেলে, তখন কী বলবেন?
এই প্রশ্নে মির্জ্জা আজিজ বলেন, “নিঃসন্দহে মূল্যায়ন সঠিক হয়নি।”
এখন বিনিয়োগকারীদের কী হবে?
মির্জ্জা আজিজ বলেন, “বিষয়টি খতিয়ে দেখে ভবিষ্যতে করপোরেট গভর্ন্যান্সটা সঠিক করতে হবে।”
এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে বিএসইসির মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক রেজাউল করিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কোম্পানি আইপিওতে আসার সময় আর্থিক বিবরণীর ভিত্তিতে আবেদন করে। যদি দেখা যায় সেগুলো আন্তর্জাতিক হিসাব মান অনুসরণ করেছে, তাহলেই অনুমোদন দেওয়া হয়।”
তাহলে পুঁজিবাজারে এত কোম্পানি রুগ্ন হয় কেন-এ প্রশ্নে তিনি বলেন, “অর্থনৈতিক কারণ থাকে, ব্যবস্থাপনার কারণেও কোম্পানি লোকসানে পড়ে। যখনই খারাপ হতে থাকে, তারা সেগুলোর প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তার ভিত্তিতেই বিনিয়োগকারীরা শেয়ার কেনাবেচা করে।
“এটা ঠিক যে অনেকে দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ করে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আবার অনেকে স্বল্প মেয়াদে লাভবানও হয়েছে।”
বাজারে আসার পর রুগ্ন হওয়া শুরু কেন, এ প্রশ্নে রেজাউল বলেন, “আপনি আজ সুস্থ আছেন বলে কালও সুস্থ থাকবেন, এটা তো বলা যায় না। তবে আমাদের তদারকি ও তত্ত্বাবধানের মাধ্যমে সেগুলোর অবস্থা উন্নত করার চেষ্টা আছে।
“বেশ কিছু বন্ধ ও লো পারফরর্মিং কোম্পানির বোর্ড পুনর্গঠন করা হয়েছে। এই উদ্যোগ কতটা কার্যকর হবে, তা আগামীতে বোঝা যাবে। এটা বলা যায়, কোম্পানিগুলোকে নজরদারিতে রেখেছে বিএসইসি।”